৬ষ্ঠ। না আর দূর নেই, আমরা এসে পড়েছি। হাঁ স্বর্গীয় বনমালীবাবুর সম্পত্তির সমস্ত ভার তাঁর বাল্যবন্ধু রাসবিহারীবাবুর পরেই। শুধু এখন নয়, বরাবরই এই ব্যবস্থা। বনমালীবাবু সেই যে দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন আর ত কখনো ফিরে যাননি।

৭ম। তাঁর কন্যার সঙ্গে রাসবিহারীবাবুর পুত্রের বিবাহ কি স্থির হয়ে গেছে?

৬ষ্ঠ। স্থির বৈ কি। সম্বন্ধ কন্যার পিতা নিজেই করে যান, হঠাৎ মৃত্যু না হলে বিবাহ তিনিই দিয়ে যেতেন।

৭ম। এ বিবাহ কি গ্রামেই হবে?

৬ষ্ঠ। এই কথাই তো রাসবিহারীবাবু সেদিন নিজেই বললেন। শুধু তাই নয়, বিয়ের পর ছেলে-বৌ দেশেই বাস করবে, শহরের নানা প্রলোভনের মধ্যে তাদের পাঠাবেন না এই তাঁর সঙ্কল্প। অন্ততঃ, যতদিন বেঁচে আছেন। বিশেষতঃ, এত বড় সম্পত্তি দূর থেকে দেখাশোনা যায় না, নষ্ট হবার ভয় থাকে। নিজের জীবিতকালেই সমস্ত কাজকর্ম ছেলেকে শিখিয়ে দিয়ে যাবেন।

৭ম। অতিশয় সৎ বিবেচনা। বিবাহ হবে কবে।?

৬ষ্ঠ। ইচ্ছা যত শীঘ্র সম্ভব। মন্দির-প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কথাবার্তা বোধ করি আপনাদের সম্মুখেই পাকা হয়ে যাবে। এ বড় সুখের বিবাহ অবিনাশবাবু। বর-বধূর পরে ভগবান তাঁর শুভহস্ত প্রসারিত করুন আমরা এই প্রার্থনা করি। চলুন, এই বাগানটার শেষেই বনমালীবাবুর বাড়ি।

৭ম। আপনি কি পূর্বে এখানে এসেছিলেন?

৬ষ্ঠ। (সহাস্যে) বহুবার। রাসবিহারীবাবু আমার অনেককালের বন্ধু। তিনি পত্রে জানিয়েছেন, নূতন মন্দির-গৃহটি আছে নদীর ওপারে—একটু দূরে। আমাদের থাকার জায়গাও সেইখানেই নির্দিষ্ট হয়েছে, কিন্তু বিজয়ার ইচ্ছে আজ সকালেই একটি ছোট অনুষ্ঠান তাঁর গৃহেই সম্পন্ন হয় এবং পরে সে-বাড়িতে যাই।

৭ম। উওম প্রস্তাব। চলুন, আমাদের হয়ত বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে।

[প্রস্থান

তৃতীয় দৃশ্য

বিজয়ার বাড়ির নীচে হলঘর

[বেলা পূর্বাহ্ন। বিজয়ার অট্টালিকার নীচের বড় ঘরটি ফুল-লতা-পাতা দিয়া কিছু কিছু সাজানো হইয়াছে, মাঝখানে দাঁড়াইয়া রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী এই-সকল পরীক্ষা করিতেছিলেন, এমন সময়ে সদ্যসমাগত অতিথিগণ একে একে প্রবেশ করিলেন]

রাসবিহারী। (বদ্ধাঞ্জলিপূর্বক) স্বাগতম্‌! স্বাগতম্‌! আজ শুধু এই গৃহ নয়, আজ আমাদের সমস্ত গ্রামখানি আপনাদের চরণধূলিতে চরিতার্থ হলো। আজ আমি ধন্য। আপনার আসন গ্রহণ করুন।

১ম। আমরাও তেমনি ধন্য হয়েছি রাসবিহারীবাবু, এমন পুণ্যকর্মে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিতে পারা জীবনের সৌভাগ্য।

রাস। পথে কোন ক্লেশ হয়নি ত?

সকলে। না না, কিছুমাএ না। কোন ক্লেশ হয়নি।

রাস। হবার কথাও নয় যে। এ যে তাঁর সেবা তাঁর কর্ম নিয়েই আপনাদের আগমন,—মানবজাতির পরম কল্যাণের জন্যই ত সকলে সমবেত হয়েছি।

১ম ব্যক্তি। ওঁ স্বস্তি! ওঁ স্বস্তি! ওঁ স্বস্তি!

রাস। স্বর্গগত বনমালীর কন্যা বিজয়া এবং তাঁর ভাবী জামাতা বিলাসবিহারী—এ মঙ্গল অনুষ্ঠান তাঁদেরই। আমি কেউ নয়—কিছুই নয়। শুধু চোখে দেখে পুণ্য সঞ্চয় করে যাব এই আমার একমাত্র বাসনা। বাবা বিলাস, মা বিজয়া বুঝি এখনও খবর পাননি। কালীপদকে ডেকে বলে দাও পূজনীয় অতিথিরা পৌঁচেছেন।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়