চিরকাল ঘৃণা করব—তবু আসব, তবু বসব, তবু কথা কব—না হলে যে উপায় নেই। তা কি তোমরা কেউ বুঝবে? হাঃ—হাঃ—লোকে পাপ কাজ আঁধারে করে, আর আমি এখানে মাতাল হই—এমন উপযুক্ত স্থান জগতে কি আর আছে! আর তোমরা—

দেবদাস দৃষ্টি সংযত করিয়া কিছুক্ষণ তাহার বিষণ্ণ মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আহা! সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান, অত্যাচার, উপদ্রব—স্ত্রীলোকে যে কত সইতে পারে—তোমরাই তার দৃষ্টান্ত!

তাহার পর চিত হইয়া শুইয়া পড়িয়া, চুপি চুপি কহিতে লাগিল—চন্দ্রমুখী বলে, সে আমাকে ভালবাসে—আমি তা চাইনে—চাইনে—চাইনে—লোকে থিয়েটার করে, মুখে চুনকালি মাখে—চোর হয়—ভিক্ষা করে—রাজা হয়—রানী হয়—ভালবাসে—কত ভালবাসার কথা বলে—কত কাঁদে—ঠিক যেন সব সত্য! চন্দ্রমুখী আমার থিয়েটার করে, আমি দেখি। কিন্তু তাকে যে মনে পড়ে—একদণ্ডে কি যেন সব হয়ে গেল। কোথায় সে চলে গেল—আর কোন্‌ পথে আমি চলে গেলাম। এখন একটা সমস্ত জীবনব্যাপী মস্ত অভিনয় আরম্ভ হয়েচে। একটা ঘোর মাতাল—আর এই একটা—হোক, তাই হোক—মন্দ কি! আশা নেই, ভরসা নেই—সুখও নেই, সাধও নেই—বাঃ! বহুৎ আচ্ছা—

তাহার পর দেবদাস পাশ ফিরিয়া বিড়বিড় করিয়া কি বলিতে লাগিল।

চন্দ্রমুখী তাহা বুঝিতে পারিল না। অল্পক্ষণেই দেবদাস ঘুমাইয়া পড়িল। চন্দ্রমুখী তখন কাছে আসিয়া বসিল। অঞ্চল ভিজাইয়া মুখ মুছাইয়া দিয়া, সিক্ত বালিশ বদলাইয়া দিল। একটা পাখা লইয়া কিছুক্ষণ বাতাস করিয়া, বহুক্ষণ অধোবদনে বসিয়া রহিল। রাত্রি তখন প্রায় একটা। দীপ নিভাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া অন্য কক্ষে চলিয়া গেল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়