রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী আমর ইবনে উমাইয়া (রা) কর্তৃক নিহত বনু আমেরের লোক দুটোর জন্য রক্তপণ আদায় করার ব্যাপারে সাহায্য চাইতে বনু নাযীরের কাছে গেলেন। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। বনু নাযীর ও বনু আমেরের মধ্যেও অনরূপ চুক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বনু নাযীরের কাছে গেলেন তখন তারা তাঁকে স্বাগত জানালো এবং রক্তপণের ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে সম্মত হলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাদের মাথায় চাপলো এক কুটিল ষড়যন্ত্র। তারা গোপনে সলাপরামর্শ করতে লাগলো কিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা যায়। তারা মনে করলো, এমন মোক্ষম সুযোগ আর কখনো পাওয়া যাবে না। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা প্রাচীরের পার্শ্বে বসে ছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবু বাক্র, উমার ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম। বনু নাযীরের লোকেরা পরস্পর সলাপরামর্শ করলো। তারা বললো, “কে আছ যে পাশের ঘরের ছাদে উঠে বড় একটা পাথর মুহাম্মাদের ওপর গড়িয়ে দিতে পারবে এবং তার কবল থেকে আমাদেরকে রেহাই দেবে?” বনু নাযীরের এক ব্যক্তি আমর ইবনে জাহাশ ইবনে কা’ব এ কাজের জন্য ছাদের ওপর আরোহণ করলো।

ঠিক এই মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে উঠলেন এবং মদীনায় ফিরে গেলেন। তাঁর সঙ্গী সাহাবীগণ তখনো টের পাননি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় গিয়েছেন। তাঁরা অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলেন তিনি ফিরছেন না, তখন তাঁরা তাঁর খোঁজে বেরুলেন। পথে এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে মদীনা থেকে আসছে। তাঁরা তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্ধান চাইলেন। সে বললো, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি মদীনায় প্রবেশ করতে দেখেছি।” সাহাবীগণ তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বনু নাবীরের ওপর আক্রমণ করা জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর মুসলমানদেরকে নিয়ে তিনি বনু নাযীরের ওপর আক্রমণ চালালেন। তারা তাদের দুর্গসমূহে আশ্রয় নিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে খেজুরের গাছসমূহ কেটে ফেলতে ও তা জ্বলিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। তা দেখে বনু নাযীরের লোকেরা দূর থেকে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদ, তুমি তো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করতে এবং যে তা করতো তার নিন্দা করতে এখন কেন তুমি খেজুর গাছ কাটছো এবং জ্বালিয়ে দিচ্ছো?”

এই সময় বুন আওফ ইবনে খাযরাজ গোত্রের কতিপয় ব্যক্তি যথা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই সুলুল, তার আমানত রক্ষক মালিক ইবনে আবু কাওফাল সুওয়াইদ ও দায়িম বুন নাযীরকে এই মর্মে বার্তা পাঠালো যে, “তোমারা ভয় পেয়ো না বা আত্মসমর্পণ করো না। আমরা কিছুতেই তোমাদেরকে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হতে দেব না। তারা যদি তোমারেদ সাথে যুদ্ধ করে তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে যাবো।” বনু নাযীর তাদের সাহায্যের অপেক্ষায় থেকে আত্মসমর্পন বা মুকাবিলা কোনটাই করলো না। আর শেষ পর্যন্ত কোন সাহায্যও এলো না। আল্লাহ তাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে দিলেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করলো, “রক্তপাত করবেন না। বরং আমাদেরকে বহিষ্কার করুন, আমরা আমাদের সব অস্ত্রশস্ত্র রেখে যাবো। অস্তাবর সম্পত্তির যতটুকু প্রত্যেকের উট বহন করে নিয়ে যেতে পারে, ততটুকু নিয়ে যাওয়অর অনুমতি দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের অনুরোধ রক্ষা করলেন। বুন নাযীরের প্রস্তাব অনুসারেই কাজ করা হলো। তারা উটের পিঠে বহনোপযোগী অস্থাবর সম্পদ নিয়ে গেল। এই সময় কেউ কেউ তার ঘরের দরজার ওপরের অংশ ভেঙ্গে উটের পিঠে করে নিয়ে যেতে লাগলো। কতক লোক খাইবারে এবং কতক সিরিয়ায় বলে গেল। যারা খাইবার গিয়েছিলো তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিল সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, কিনানা ইবনে রাবী ইবনে আবুল হুকাইক ও হুয়াই ইবনে আখতাব। খাইবারের অধিবাসীরা তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করলো।

আবু বাকরের পুত্র আবদুল্লহ বলেন, “আবু বাক্র (রা) জানিয়েছিলেন যে, বুন নাযীর তারেদ স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে গিয়েছিলো। সেইসাথে তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলোও নিয়ে গিয়েছিলো। দাসীরা তাদের পেছনে থেকে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের মধ্যে উরওয়া ইবনে ওরারদ ’আবাসীর স্ত্রী উম্মে ’আমরও ছিল। সালমা নাম্মী ও মহিলাকে তারা তার স্বামীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছিল।[ ৬৫. এই মহিলার প্রথমে বিয়ে হয় মুযইনা গোত্রে। উরওয়া ইবনে ওয়ারদ একবার তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে লুঠতরাজ করে। সেই সময় এ মহিলাকে সে ধরে নিয়ে যায়। উরওয়া বনু নাযীরের কাছে প্রায়ই আসা যাওয়া করতো এবং তাদের কাছ থেকে ধার কর্জ নিত। আবার কখনো বা নিজের লুঠ করা দ্রব্যাদি বিক্রি করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু সে তাকে বিক্রি করতে অস্বীকার করে। তখন তারা উরওয়াকে মদ খওয়ায় এবং কৌশলে তাকে তার কাছ থেকে কিনে নেয়। এই ক্রয় বিক্রয়ে তারা প্রয়োজনীয় সাক্ষীও সংগ্রহ করে। উরওয়া পরবর্তী সময় আক্ষেপ করে এ সম্পর্কে এরূপ কবিতা আবৃত্তি করতো, “আল্লাহর দুশমনরা আমাকে মদ খাইয়ে মিথ্যাচার ও চক্রান্তের মাধ্যমে কাবু করে নিয়েছিল। হায় অদৃষ্ট! কিভাবে আমি এমন প্রস্তাবে রাজী হলাম, যা আমার বিবেক অপছন্দ করে।” ] তারা এত ধুমধাম ও গর্বের সাথে যাচ্ছিলো যে, সে যুগে আর কোন গোত্রকে ও রকম ধুমধাম করতে দেখা যায়নি।”

তারা অবশিষ্ট সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য রেখে গিয়েছিলো। এই সমস্ত সম্পত্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিলো। সেটা তিনি যেভাবে খুশী কাজে লাগাতে পারতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সম্পত্তি শুধুমাত্র প্রথম হিজরাতকারী সাহাবাদের মধ্যে বণ্টন করেন। আনসারদের সাহল ইবনে হুনাইক ও আবু দুজানা সিমাক ইবনে খারাশা তাদের দারিদ্রের কথা জানালে তাদেরকেও কিছু দান করেন। বনু নাযীরের প্রসঙ্গে সমগ্র সূরা আল হাশর নযিল হয়। আল্লাহ বনু নাযীরের ওপর যে ভয়াবহ প্রতিশোধ গ্রহণ করেন এবং তাঁর রাসূলকে দিয়ে তাদের ওপর সৈন্য অভিযান পরিচারনা করিয়ে তাদে বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করান, এই সূরায় তার বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি আহলে কিতাব কাফিরদেরকে (মুসলিম মুজাহিদদের) প্রথম হানাতেই তাদের ঘরবাড়ী থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তোমরা ধারণা করতে পারনি যে, তারা বেরিয়ে যাবে। আর তারা মনে করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ওপর এমনভাবে চড়াও হলেন যে, তারা তা কল্পনাও করতে পারেনি। আল্লাহ তাদের মনের মধ্যে ভীতি সঞ্চর করে দিলেন। (ফলে) তারা তাদের ঘরবাড়ী নিজেদের হাতেও ভেঙ্গেছে আবার মুমিনদের হাত দিয়েও বঙ্গিয়েছে। কেননা তারা নিজেরাই তাদের ঘরের দরজায় উপরের অংশ ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।)

অতএব, হে বুদ্ধিমান লোকেরা, শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ যদি তাদের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত না দিয়ে থাকতেন (যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি প্রতিশোধই বটে) তাহলে দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি দিতেন (তরবারী দ্বারা), অধিকন্তু তাদের জন্য পরকালে রয়েছে দোজখের শাস্তি (বহিষ্কার ছাড়াও)। তোমরা যেসব সতেজ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছো অথবা শিকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছো উভয় কাজই আল্লাহর অনুমোদিত এবং তা শুধু নাফরমানদের অপদস্ত করার জন্যই। আর তাদের (বনু নাযীরের) যা কিছু সম্পদ আল্লাহ তাঁর রাসুলের দখলে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা তোমাদের উট ও ঘোড়া দৌড়িয়ে অর্জন করা জিনিস নয়, বরং আল্লাহ তাঁর রাসূলগণকে যার ওপর ইচ্ছা পরাক্রান্ত করে দেন। আর আল্লাহ তাঁর রাসূলের নিকট জনপদের লোকদের থেকে যে সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছেন ( অর্থাৎ উট, ঘোড়া চালিয়ে যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দখলে এসেছে। তা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের জন্য, আত্মীয় স্বজনের জন্য, ইয়াতীম মিসকীন ও পথিকের জন্য, যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। আর রাসূল তোমাদের কে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিবৃত্ত করেছেন তা থেকে নিবৃত্ত হও।”

এখানে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিতরণের বিধান বর্ণনা করেছেন।

এরপর আল্লাহ বলেন,

“তুমি কি মুনাফিকদের অবস্থা দেখনি, তারা তাদের কুফরীতে লিপ্ত আহলে কিতাব ভাইদেরকে (অর্থাৎ বনু নাযীরকে) বলেঃ তোমাদেরকে যদি বহিষ্কার করা হয় তাহলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাবো। আর তোমাদের স্বার্থের ব্যাপারে অন্য কারো কথা কখনো শুনবো না, আর যদি তোমাদের ওপর যুদ্ধ চপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবে। আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা মিথ্যাবাদী। তারা যদি বহিষ্কৃত হয় তবে ঐ মুনাফিকরা কখনো তাদের সাথে বেরিয়ে যাবে না, তাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে কখনো সাহায্য করবে না, আর যদি সাহায্য করেও, তবে তারা (শেষ পর্যন্ত ময়দানে টিকবে না বরং মাঝখানেই) রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে। অতঃপর তাদের কাছে আর কোথাও থেকে কোন সাহায্য আসবে না। আসলো তাদের মনে তোমাদের ভয় আল্লাহর ভয়ের চেয়েও বেশী। কেননা তারা একটা নির্বোধের দল। তারা কখনো তোমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে পারবে না, যদি বা লড়ে তবে সুরক্ষিত জনপদে অথবা দেয়ালের অপর পাশ থেকে ছাড়া নয়। তাদের ভেতরে পারস্পরিক মতবিরোধ খুবই প্রকট। তোমরা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ মনে করলেও আসলে তাদের মন বিভেদ-ক্লিষ্ট। কেননা তারা বিবেক বুদ্ধিহীন গোষ্ঠী। তারা সেই জনগোষ্ঠীর মতই যারা, যারা অল্পদিন আগেই কৃতমর্তের ফল ভোগ করেছে। তাছাড়া তাদের জন্য আরো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (অর্থাৎ বনু কুইনুকার মত) তারা শয়তানের মতই, যে শয়তান মানুষকে বলে: কুফরী কর। আর যখনই সে কুফরী করে, অমনি বলে: ‘আমি তোমার ধার ধারি না। আমি তো বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। ’তাদের উভয়্রেই শাস্তি হলো, তারা চিরকার আগুনে পুড়বে। আর ওটাই হলো যালিমদের কর্মফল।”

<

Super User