মিতু বলল, আজ থেকে তোমার নাম মিস্টার আগস্ট।

লোকটি হাসল। মিতু বলল, তোমার খুশী লাগছে না? নতুন নাম পেয়ে গেছ।

হা খুশী লাগছে। খুব খুশী। বৎসরে বারটা নাম ঘুরে ঘুরে আসবে। তার চেয়েও ভাল হত যদি এক দুই তিন চার এইভাবে নাম রাখা হত। যেমন যেদিন। একটা শিশুর জন্ম হল সেদিন তার নাম এক, পরের দিন তার নাম দুই, তার পরের দিন তিন। এইভাবেই চলতে থাকবে। প্রতিদিন নতুন নাম। এতে অনেক সুবিধা।

কি সুবিধা?

কেউ যখন তার নাম বলবে সঙ্গে সঙ্গে তুমি বুঝবে এই পৃথিবীতে সে কতদিন বাঁচল। এটা জানা থাকা খুব দরকার।

দরকার কেন?

দরকার এই জন্যে যে নাম শোনামাত্র তুমি বুঝবে এই পৃথিবীতে সর্বমোট। কতগুলি সূর্যাস্ত তুমি দেখেছে।

মিতু খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ব্যাপারটা তার ভাল লাগছে। সে নিজের নামটা বদলে ফেলবে কিনা ভাবছে। বদলে ফেললে হয়। কেউ আবার রাগ করবে না তো?

মিস্টার আগস্ট মিটি মিটি হাসছে। মিতু বলল, আপনি হাসছেন কেন?

তুমি তোমার নাম বদলে ফেলতে চাচ্ছ এই জন্যে হাসছি।

কে বলল আপনাকে নাম বদলাতে চাচ্ছি?

কে কি ভাবছে তা আমি অনুমান করতে পারি। তুমি তোমার জন্ম তারিখ বল, আমি ঠিক করে দেব তোমার নাম কি হবে।

আমার জন্ম ১১ মার্চ।

কোন সনে জন্ম সেটা বল।

মিতু বলল। লোকটা সঙ্গে সঙ্গেই বলল, তোমার নাম হল তিন হাজার ছয়শ চুয়ান্ন।

আগামীকাল আমার নাম হবে তিন হাজার ছয়শ পঞ্চান্ন।

হ্যাঁ।

মিতু নতুন নামের আনন্দ চোখে মুখে নিয়ে ঘর থেকে বেরুল। সবাইকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। বাসার সবাইকে তো জানাবেই, স্কুলের বন্ধুদেরও জানাতে হবে। আজ ছুটির দিন হয়ে মুশকিল হয়ে গেছে। ছুটির দিন না হলে সব বন্ধুদের এক সঙ্গে বলা যেত। এখন বলতে হবে টেলিফোনে। ভাগ্যিস তার একটা টেলিফোন বই আছে। সেই বই-এ সে সবার টেলিফোন নাম্বার লিখে রেখেছে। অবশ্যি যাদের সঙ্গে ঝগড়া হয় তাদের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার কেটে দেয়। ঝগড়া মিটমাট হলে আবার লেখে।

মিতু তার টেলিফোনের বই নিয়ে বেশ কিছু টেলিফোন করল হ্যালো শমি–আমি মিতু। কেমন আছিস ভাই?

ভাল।

আজ থেকে আমি আমার নাম বদলে ফেলেছি–এখন আমার নাম তিন হাজার ছয়শ চুয়ান্ন।

ধ্যাৎ

ধ্যাৎ না। সত্যি। আগামীকাল আমার বয়স হবে তিন হাজার ছয়শ পঞ্চান্ন। আমার যতদিন বয়স–সেটাই আমার নাম। এতে সুবিধা কি জানিস? এতে সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাবে এ জীবনে আমি কটা সূর্যাস্ত দেখেছি।

মিতু তুই পাগলের মত কথা বলছিস কেন? তোর কি জ্বর হয়েছে?

মিতু বলে তুই আমাকে আর ডাকবি না ভাই। আমার যা নাম তাই ডাকবি–তিন হাজার ছয়শ চুয়ান্ন। আচ্ছা ভাই রাখলাম।

মিতু সব মিলিয়ে চারটা টেলিফোন করল। পঞ্চমটা করতে যাচ্ছে, তখন মতিন সাহেব তাকে কাছে ডাকলেন। হাসিমুখে বললেন, হচ্ছে কি মিতু? মিতু লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না বাবা।

টেলিফোনে কি বলছিস? আমি খবরের কাগজ পড়তে পড়তে শুনলাম। যদিও অন্যের টেলিফোন কনভারসেশন শোনা খুবই অনুচিত। মনের ভুলে শুনে ফেলেছি। তুমি কি বলছ বন্ধুদের?

এখন থেকে আমার নতুন নাম বাবা। একেকটা দিন আসবে আমার নাম বদলে যাবে।

এই বুদ্ধি কার?

মিস্টার আগস্ট আমাকে বলেছেন।

মতিন সাহেবের মুখ একটু যেন গম্ভীর হল। মুখের গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে বললেন–আচ্ছা ঠিক আছে। এষাকে বল আমাকে চা বানিয়ে দিতে। মিতু চায়ের কথা বলতে গেল। মতিন সাহেব খবরের কাগজ হাতে লোকটার খোজে গেলেন। সে ঘরে নেই। কাঁঠাল গাছের নীচে বসে আছে। মতিন সাহেব মন্টুর ঘরে উঁকি দিলেন। সকাল এগারোটা বাজে। মন্টুর ঘুম ভেঙ্গেছে। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাঁত ব্রাশ করছে। কেউ বিছানায় শুয়ে ব্রাশ করতে পারে তা তার ধারণার বাইরে ছিল। মন্টু দুলাভাইকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

দুলাভাই কিছু বলবেন?

হ্যাঁ। তুমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাঁত মাজ এটা জানতাম না।

এটা নতুন শুরু করেছি দুলা ভাই। রাতে শোবার আগে টুথপেস্ট লাগিয়ে মাথার কাছে রেখে দেই। দাঁত-টাত মেজে একেবারে ফ্রেশ হয়ে বিছানা থেকে। নামি।

ভাল।

কি বলতে এসেছেন দুলাভাই??

তুমি ঐ লোকটাকে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসতে পারবে? কোন খোঁজ তো পাওয়া যাচ্ছে না–আর কতদিন রাখব। সে যে নিজ থেকে চলে যাবে তারও লক্ষণ দেখছি না।

আমি বরং এক কাজ করি। লোকটাকে কড়া করে বলি, গেট আউট। মামদোবাজি শুরু করেছ? পরের বাড়িতে খাচ্ছ-দাচ্ছ ঘুমুচ্ছ। স্টপ ইট, বিদায় হও।

এসব বলার কোন দরকার নেই। লোকটাকে যেখান থেকে তুলে এনেছিলাম। সেখানে রেখে এসো। গাড়ি নিয়ে যাও। আরেকটা কথা–লোকটাকে না জানানো ভাল যে, তুমি তাকে রেখে আসতে যাচ্ছ।

জানলে অসুবিধা কি?

লোকটার আজ যে এই অবস্থা তার জন্যে আমি নিজেকে দায়ী মনে করছি। আমার মধ্যে অপরাধবোধ আছে।

আপনি যা বলবেন তাই করব দুলাভাই। বিড়ালের বাচ্চা যেমন ছেড়ে দিয়ে আসে–ঠিক তেমনি ছেড়ে দিয়ে আসব। ব্যাটা আবার গন্ধ শুকে চলে না আসে।

মতিন সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, যা করবে চুপচাপ করবে। বাসার কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই। বিশেষ করে মিতু যেন কিছু না জানে।

কেউ কিছু জানবে না দুলাভাই। আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। রাতের অন্ধকারে মাল পাচার করে দেব।

 

এষা দোতলার বারান্দা থেকে দেখল লোকটা কাঁঠাল গাছের নীচে মোটা একটা বই নিয়ে বসে আছে। কি বই এত মন দিয়ে পড়ছে? একবার ভাবল নীচে নেমে জিজ্ঞেস করবে, পর মুহূর্তেই মনে হল–কি দরকার। এষা সাবেরের ঘরে ঢুকল। তিনদিন ধরে সে জ্বরে ভুগছে। লোকটার সঙ্গে সে ঘন্টাখানিক বৃষ্টিতে ভিজেছিল। লোকটার কিছু হয়নি। তার ঠাণ্ডা লেগে গেল। সেখান থেকে হল টনসিলাইটিস। এখন বুকে ব্যথা করছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এষা বলল, শরীর কেমন দাদা? সাবের বিরস মুখে বলল, সুবিধার মনে হচ্ছে না। গায়ে টেম্পারেচার আছে। ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে নিউমোনিয়ায় টার্ন নেবে।

ডাক্তার ডাকাও। ডাক্তার ডাকিয়ে চিকিৎসা করাও।

ডাক্তার কি ডাকব। আমি নিজেই ডাক্তার না?

বেশ তুমি নিজেই প্রেসক্রিপশন লিখে অষুধ আনাও। অষুধ এনে খাও।

খাব। একটু টাইম নিচ্ছি। দেখছি।

কি দেখছ?

অসুখটা কোন দিকে টার্ন নিচ্ছে তাই দেখছি। মিস্টার আগস্ট আমাকে বলেছেন, কোন অসুখ সম্পর্কে পুরোপুরি জানার একটাই উপায়–অসুখটা নিজের হওয়া। এখন চট করে অষুধ খেয়ে রোগ সারিয়ে ফেললে আমি জানব। কি?

মিস্টার আগস্ট এখন তোমাকে ডাক্তারী শেখাচ্ছেন?

তা না, শিখতে সাহায্য করছেন। সাহায্যটা আমার খুব কাজে আসছে।

সাহায্য করার এই তো নমুনা–সবগুলি অসুখ নিজের হতে হবে।

তা ঠিক।

ক্যান্সার সম্পর্কে জানার জন্যে তাহলে তো ক্যান্সার হওয়া দরকার।

অবশ্যই দরকার।

তোমার শিক্ষাগুরু মিস্টার আগস্ট কি বিনা পয়সায় তোমাকে শিখাচ্ছেন না। যৎকিঞ্চিৎ ফি নিচ্ছেন?

ফি-টি কিছু না। ইন-রিটার্ন আমি উনাকে ইংরেজী শেখাচ্ছি। তাঁর স্মৃতিশক্তি খুব ভাল। দ্রুত শিখে ফেলেছেন। এখন উনাকে বলেছি শব্দভাণ্ডার বাড়াতে। ডিকশনারী মুখস্থ করতে বলেছি।

ডিকশনারী মুখস্থ করতে বলেছ?

হ্যাঁ। আমার যেমন স্মৃতিশক্তি বলে কিছু নেই উনার আবার উল্টো ব্যাপার। অসম্ভব ভাল স্মৃতিশক্তি। এর কারণও খুঁজে বের করেছি।

কি কারণ?

কারণ হল উনার আগের কোন স্মৃতি নেই। ব্রেইনের মেমোরী সেল সব খালি। সেই খালি জায়গাগুলিতে উনি ইনফরমেশন ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছেন।

এষা উঠে দাঁড়াল। সাবের বলল, তুই একটা কাজ করবি এষা, উনাকে এখানে পাঠাবি?

এষা অবাক হয়ে বলল, এখানে? বাইরের একজন মানুষকে তুমি দোতলার শোবার ঘরে নিয়ে আসবে?

উনি তো আসেন প্রায়ই।

এষা বিস্মিত হয়ে বলল, প্রায়ই আসেন মানে?

গভীর রাতে আসেন। তোরা সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকিস তখন আসেন। গল্প-গুজব করি। কাল রাতে তিনটার দিকে এসেছিলেন।

দাদা শোন, আর কখনো তুমি তাঁকে এখানে আসতে বলবে না। কখনো না।

তুই রাগ করছিস কেন? চমৎকার একজন মানুষ …

চমৎকার মানুষ হোক আর না হোক। তুমি তাকে আসতে বলবে না।

আমি আসতে বলি না তো। উনি নিজে নিজেই চলে আসেন।

নিজে নিজেই চলে আসেন? কি বলছ তুমি এসব?

আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুই নিজেই উনাকে জিজ্ঞেস করে আয়।

এষা নীচে নেমে গেল। মনে মনে ঠিক করে রাখল কঠিন কিছু কথা বলবে। বাড়ি থেকে চলে যেতেও বলবে। মনে হচ্ছে এই লোকটা সমস্যা সৃষ্টি করবে। হয়তো ইতিমধ্যে করেও ফেলেছে। মিতু বলছে তার নাম, তিন হাজার ছয়শ চুয়ান্ন। এই নামে না ডাকলে সে কথা বলছে না। এসবের কোন মানে হয়?

এষাকে দেখে লোকটা উঠে দাঁড়াল। তার হাতে সত্যি সত্যি একটা ডিকশনারী–সংসদ, ইংলিশ টু বেঙ্গলী অভিধান। লোকটা বলল, কেমন আছেন?

এষা কঠিন মুখে বলল, ভাল।

আপনি মনে হচ্ছে আমার উপর রাগ করেছেন।

রাগের ব্যাপার না। আপনার সঙ্গে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

রাগ নিয়ে কথা বললে কথাগুলি গুছিয়ে বলতে পারবেন না। রাগ দূর করে কথাগুলি বলুন। কথা বলা শেষ হবার পর আবার রাগ করুন।

তাকি সম্ভব?

অবশ্য সম্ভব। আচ্ছা আমি বরং আপনার রাগ কমানোর ব্যাপারে সাহায্য করি। আমি এমন কিছু বলি যাতে আপনার রাগ কমে যায়।

বলুন।

আমি এই ডিকশনারীটা মুখস্থ করে ফেলেছি।

এষা বিরক্ত গলায় বলল, আপনি ডিকশনারী মুখস্থ করেছেন খুবই ভাল কথা। এতে আমার রাগ কমবে কেন?

ডিকশনারী মুখস্থ করেছি আপনার জন্য।

আমার জন্য মানে?

আমি ইংরেজী জানি না শুনে আপনার মন খারাপ হয়েছিল। তখনি আমি ঠিক করলাম–ইংরেজী শিখব। আপনাকে খুশী করব। আমি আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আপনি খুশী হয়েছেন। এখন বলুন কি বলতে চান। এখানে। বসুন, তারপর বলুন।

আপনি মিতুর নাম বদলে দিয়েছেন?

আমি বদলাইনি। সে নিজের আগ্রহেই বদলেছে।

আপনার ধারণা সংখ্যা দিয়ে নামের এই আইডিয়া একটা ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া?

হ্যাঁ।

সমস্যাগুলি ভেবে দেখেছেন? সবার হবে এক রকম নাম …।

এটাই কি ভাল না? সব মানুষ তো আসলে এক। আমরা নানানভাবে একজন মানুষকে অন্যের থেকে আলাদা করি। তার ভিন্ন ভিন্ন নাম দেই। সংখ্যাবাচক নাম হলে আমরা বুঝব মানুষ আসলে একই রকম। শুধু সংখ্যার বেশ কম।

এষা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ কোন যুক্তি তার মনে এল না। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, নাম মনে রাখাও একটা সমস্যা হবে। ধরুন, মিতুর সঙ্গে দশদিন আপনার দেখা হল না। তার নাম এই দশদিনে পাল্টে গিয়ে হল তিন হাজার ছয়শ চৌষট্টি। আপনার মনে থাকবে?

থাকা উচিত। যে মনে রাখতে পারবে না বুঝতে হবে তার মনে রাখার প্রয়োজন নেই।

আপনি খুবই অদ্ভুত কথা বলছেন। এইসব কথাবার্তার একটিই উদ্দেশ্য। আপনি আমাদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছেন। ঠিক করে বলুন তো আপনি কে?

আমি মিস্টার আগস্ট।

প্লীজ দয়া করে বলুন আপনি কে?

লোকটা মুখ টিপে হাসতে লাগল।

এষা শান্ত গলায় বলল, গভীর রাতে আপনি দাদার ঘরে যান। কেন যান?

ও আমাকে ডাকে–তাই যাই।

যে আপনাকে ডাকবে আপনি তার কাছেই যাবেন?

হ্যাঁ?

আপনি কে বলুন তো? সত্যি করে বলুন তো আপনি কে?

আমি জানি না। বিশ্বাস করুন আমি জানি না।

আপনি নিশ্চয়ই দাবী করেন না যে আপনি একজন দেবদূত। আকাশ থেকে পড়েছেন।

কি যে বলেন। দেবদূত হতে যাব কেন?

এষা গলার স্বর নামিয়ে বলল, সায়েন্স ফিকশানের কোন ক্যারেক্টার না তো?

আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না।

সায়েন্স ফিকশানে এরকম প্রায়ই পাওয়া যায়–ভবিষ্যতের একজন মানুষ টাইম মেশিনে করে অতীতে চলে এসেছেন–আপনি তেমন কেউ না তো? ম্যান ফ্রম দ্যা ফিউচার?

না–তা না। তবে …।

তবে কি?

হলে মন্দ হত না।

লোকটি মুখ টিপে হাসল। সে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। তার চোখ কালো। তবু কালো চোখেও কোথায় যেন নীলচে ভাব আছে।

এষার কেন জানি ভয় ভয় করতে লাগল। যদিও সে জানে ভয়ের কোনই কারণ নেই। কাঁঠাল গাছের নীচে বসে থাকা লোকটি আধা পাগল ধরনের মানুষ। এই ধরনের মানুষ নিজস্ব ভঙ্গিতে কিছু কথাবার্তা বলে। যেসব কথাবার্তা সাধারণ মানুষের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়।

এষা।

জ্বি।

তুমি কি একটু পরীক্ষা করে দেখবে আমি ডিকশনারীটা পুরোপুরি মুখস্থ করতে পেরেছি কিনা।

আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?

আচ্ছা আর বলব না। আপনি কি দয়া করে দুএকটা কঠিন ইংরেজী শব্দ জিজ্ঞেস করবেন–আমি দেখতে চাই ডিকশনারী মুখস্থ করতে পারলাম কি না।

এষা কিছু না বলে উঠে চলে গেল। লোকটা আবার ডিকশনারী খুলে বসল। তার গায়ে চৈত্র মাসের কড়া রোদ এসে পড়েছে। সেদিকে তার জুক্ষেপও নেই। ঘণ্টাখানিক এইভাবেই পার হল। তখন মন্টুকে শিস দিয়ে আসতে দেখা গেল। সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, ব্রাদার কি করছেন?

কিছু করছি না।

রোদে তো ভাজা ভাজা হয়ে গেলেন। চলুন ঘুরে আসি।

কোথায়?

আরে ব্রাদার চলুন না। গাড়ি করে যাব। গাড়ি করে ফিরে আসব। গায়ে হাওয়া লাগবে।

চলুন।

আপনার সঙ্গে আমার এখনো পরিচয় হয়নি। আমার সমস্যা কি জানেন? আমি আগ বাড়িয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে এলে–খুবই ভাল কথা। কথা বলব। সেধে চা খাওয়াব। সিগারেট অফার করব। কেউ নিজের থেকে আমার কাছে না এলে আমি ভুলেও কিছু বলব না।

গাড়িতে উঠতে উঠতে মিস্টার আগস্ট বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

মন্টু দরাজ গলায় বলল, চলুন না ভাই–শালবন দেখে আসি। চৈত্র মাসে শালবনের একটা আলাদা বিউটি আছে।

রাস্তা ফাঁকা, গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। লোকটি পেছনের সীটে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। মন্টু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। একটা বিড়াল দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসা এক কথা আর একটা জলজ্যান্ত মানুষ ছেড়ে দিয়ে আসা ভিন্ন কথা। কেমন যেন খুঁত খুঁত করছে। মন্টু উঁচু গলায় বলল, ব্রাদারের কি ধূমপানের অভ্যাস আছে?

জি না।

বেঁচে গেছেন। অসম্ভব পাজি নেশা। টাকা নষ্ট, স্বাস্থ্য নষ্ট। আমার দেড় প্যাকেটের মত লাগে। আগে দু প্যাকেট লাগতো। কমিয়ে দেড় করেছি।

লোকটি জবাব দিল না। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। মন্টু একের পর এক সিগারেট টেনে যেতে লাগল। সে বুঝতে পারেনি তার এতটা অস্বস্তি লাগবে।

গাড়ি এসে মৌচাকে শালবনের কাছে থামল। মন্টু ক্ষীণস্বরে বলল, ব্রাদার নামুন।

লোকটা নামল। হাসিমুখেই নামল।

ব্রাদার আপনার হাতে এটা কি বই?

ডিকশনারী।

ডিকশনারী নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন। ব্যাপার কি?

ডিকশনারীটা মুখস্থ করে ফেলেছি চৰ্চার ব্যাপার তো, চর্চা না থাকলে ভুলে যাব। এই জন্যে সঙ্গে সঙ্গে রাখি। সময় পেলেই পাতা উল্টাই।

সত্যি মুখস্থ করে ফেলেছেন?

হ্যাঁ।

বলেন কি ব্রাদার, আপনি তো মহাকাবিল লোক। দেখি ডিকশনারীটা দিন তো আমার হাতে।

লোকটা ডিকশনারী মন্টুর হাতে তুলে দিল। মন্টু পাতা উল্টে বলল, বলুন তো Meed মানে কি?

মীড শব্দটার মানে হল পারিশ্রমিক।

গুড, হয়েছে। এখন বলুন ম্যালানিন মানে কি?

ম্যালানিন হচ্ছে কৃষ্ণকায় জাতির চুলের ও ত্বকের কৃষ্ণবর্ণ।

ভেরী গুড। এবার বলুন শেরাটন মানে কি?

শেরাটন হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর আসবাবপত্রের অনাড়ম্বর নির্মাণশৈলী।

হয়েছে। আমি তো জানতাম শেরাটন হোটেলের নাম। ব্রাদার আপনি তো কাবিল আদমী।

কাবিল আদমী ব্যাপারটা কি?

কাবিল আদমী হল গ্রেটম্যান। আপনার বয়স অল্প। আরেকটু বেশী বয়স হলে আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলতাম। অনেস্ট। আপনি তো ব্রাদার সুপারম্যান। আসুন এই গাছটার নীচে বসি। ব্রাদারলি কিছু কথাবার্তা বলি।

দুজনে গাছের নীচে বসল। মন্টু বলল, সঙ্গে চা থাকলে ভাল হত। গাছের নীচে বসে চা খেতাম। গ্রেট মিসটেক হয়ে গেছে।

লোকটা বলল, আপনি কি আমাকে এখানে রেখে যেতে এসেছেন?

আরে না। কি যে বলেন। আপনাকে খামাখা এখানে রেখে যাব কেন? আপনি বিড়াল হলেও একটা কথা ছিল। আমি আবার বিড়াল ফেলে দিয়ে আসার ব্যাপারে এক্সপার্ট। বিড়াল কিভাবে ফেলে দিয়ে আসতে হয় জানেন?

না।

একটা বস্তায় ভরতে হয়। বস্তার ভিতর নিতে হয় কপূর। যাতে কপূরের গন্ধে অন্য সব গন্ধ ঢাকা পড়ে যায়। অনেক দূরে নিয়ে বস্তার মুখ খুলতে হয়। বস্তার মুখ খুলবার আগে বস্তাটা ঝ ঝ করে ঘুরাতে হয় যাতে বিড়ালের দিকভ্রম হয়।

অনেক কায়দাকানুন দেখি।

হ্যাঁ অনেক। তারপরেও বিড়াল গন্ধ শুকে কে বাসায় চলে আসে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করে ডাকে। মনটা খুব খারাপ হয় ভাইসাব। আহা! বেচারা কতদূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছে। মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। আবার বস্তায় ভরে ফেলে দিয়ে আসতে হয় আরো দূরে। আবারো চলে আসে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করে।

লোকটি নীচু গলায় বলল, বিড়াল মিউ মিউ করে যে কথাগুলি বলে তা যদি মানুষ বুঝতো তাহলে তাকে কোনদিন ফেলে দিয়ে আসতো না।

বিড়াল কি বলে?

বিড়াল কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি আমাকে অনেক দূরে ফেলে দিয়ে এসেছিলে। আশ্রয় এবং খাদ্যের সন্ধানে আমি অন্য কোথাও যেতে পারতাম। তা যাইনি। তোমার কাছেই ফিরে এসেছি। অনেক কষ্টে ফিরেছি। কেন জান? তোমার প্রতি ভালবাসার জন্যে। এই ভালবাসা পশুর ভালবাসা হলেও ভালবাসা। এর অমর্যাদা করো না। তুমি আমাকে গ্রহণ কর।

আপনাকে এসব কে বলেছে?

কেউ বলেনি। আমি অনুমান করেছি।

ভাই এই দেখেন আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি আবার হাইলি ইমোশনাল লোক। অল্পতেই আমার চোখে পানি এসে যায়। টিভির বাংলা সিনেমা যতবার দেখি ততবার কাঁদি। সবাই হাসাহাসি করে। সিনেমা দেখা ছেড়ে দিলাম এই কারণে।

মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা।

কারেক্ট কথা বলেছেন ভাই। এর চেয়ে গাছ হয়ে জন্মানো ভাল ছিল। মাঝে মাঝে গাছ হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। হাসবেন না ভাই সত্যি বলছি।

গাছ হওয়া তো খুব সহজ।

খুব সহজ? কি বলছেন আপনি?

হ্যাঁ খুব সহজ। গভীর বনের মাঝামাঝি একটা ফাঁকা জায়গায় দুহাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গায়ে কোন কাপড় থাকবে না। মাথায় রোদ পড়বে, বৃষ্টি পড়বে, রাতে চাঁদের আলো পড়বে। আস্তে আস্তে শরীরটা গাছের মত হয়ে যেতে থাকবে। প্রথম দিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা হবে। আস্তে আস্তে কমে যাবে। রোদে পুড়ে গায়ের চামড়া শক্ত হতে থাকবে। পায়ের তলা দিয়ে শিকড় বেরুবে।

সত্যি বলছেন নাকি ভাই?

হ্যাঁ সত্যি।

কতদিন লাগে?

কারো জন্যে খুব অল্পদিন লাগে। আবার কারো জন্যে দীর্ঘ সময় লাগে।

আমার কতদিন লাগবে বলে মনে হয়?

বুঝতে পারছি না। আপনার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করছে।

ট্রাই করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।

দেখুন না।

পুরোপুরি নগ্ন না হয়ে যদি একটা আণ্ডার ওয়্যার থাকে তাতে অসুবিধা হবে?

না। তবে পুরোপুরি নগ্ন হতেই অসুবিধা কি? কেউ তো দেখছে না।

সেটাও সত্যি। আচ্ছা ভাই আপনি অনেস্টলি বলুন তো–আমি কি দেখব চেষ্টা করে?

দেখুন। অন্তত একদিন এবং একরাত দেখুন। যদি দেখছেন পারছেন না, বাসায় চলে আসবেন।

মন্টুর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। সে নিজের ভেতর অন্য এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। সে গাঢ় স্বরে বলল, ব্রাদার একটা কথা।

বলুন।

আপনি এক কাজ করুন। গাড়ি নিয়ে চলে যান। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমি থেকে গেছি। কি জন্যে সেটা বলবেন না। ওরা হাসাহাসি করতে পারে।

জি আচ্ছা বলব না।

লোকটা বাসায় ফিরল বিকেল পাঁচটায়।

সে সরাসরি বাসায় আসেনি। গাড়ি নিয়ে সারা শহর ঘুরেছে। ড্রাইভার বিরক্ত হলেও কিছু বলে নি।

মতিন সাহেব বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন–তিনি লোকটাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বিস্মিত হলেন। লোকটি বলল, ফিরতে খানিকটা দেরী করলাম। গাড়ি নিয়ে খুব ঘুরেছি। আশাকরি কিছু মনে করবেন না।

মন্টু? মন্টু কোথায়?

উনি মৌচাকে থেকে গেলেন। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।

মতিন সাহেব কি বলবেন ভেবে পেলেন না। লোকটি গুন গুন করতে করতে নিজের ঘরের দিকে এগুচ্ছে–

সকাতরে ঐ কাদিছে সকলে শোন শোন পিতা
কহ কানে কানে শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।

সুরমাকে নিয়ে আজ চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। মতিন সাহেব কোন উৎসাহ বোধ করছেন না। তার ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। তার মন বলছে লোকটিকে তাড়িয়ে দিতে হবে। অতি দ্রুত তাড়িয়ে দিতে হবে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ