স্থান : ফুলবাড়িয়া বাস টাৰ্মিনালের নর্দমার ডান পাশ।

সময় : সন্ধ্যা হবে-হবে করছে।

মাস : আষাঢ়ের শেষ কিংবা শ্রাবণের শুরু।

তারিখ : জানা নেই।

আমি হিমু, তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। কবিরা আকাশের মেঘ দেখে আপ্লুত হন। তবে তারা বাস টার্মিনালের নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেন না।

নর্দমার বিকট গন্ধ নাকে লাগছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি বলে মনে হচ্ছে, গন্ধটা আকাশ থেকে আসছে।

আকাশ মেঘে মেঘে অন্ধকার। মেঘের ভাব দেখে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরে ঝাপিয়ে পড়ার ব্যাপারে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তবে ঠিক কখন ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ব্যাপারে হিসাবনিকাশ করছে। বুঝতে চেষ্টা করছে সে কখন নামলে শহরের মানুষ সবচেয়ে বেশ ঝামেলায় পড়বে। মেঘেদের মন-মেজাজ আছে। তারা রহস্য করতে পছন্দ করে।

ভাইজান, কী দেখেন?

কেউ-একজন? আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মোটামুটি বিস্মিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছে। আমি আকাশ থেকে দৃষ্টি ফেরালাম না।

ভাইজান কিন্তু অখনো আমার প্রশ্নের জবাব দেন নাই। আসমানের দিকে চাইয়া কী দেখেন?

আমি আকাশ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আমার সামনে যে-মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকালাম।

আমার সামনে ছোটখাটো একজন মানুষ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবার কথা। গরমের সময়ও তার গায়ে ফ্লানেলের ফুলশার্ট। জিনসের প্যান্ট। প্যান্টের পা অনেকখানি গোটানো। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। জিনসের প্যান্টের সঙ্গে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের কম্বিনেশন গ্রহণযোগ্য। বৃষ্টিবাদলায় স্পঞ্জের স্যান্ডেল খুব কাজে দেয়। যেটা গ্রহণযোগ্য না সেটা হলো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা দুটা দু রঙের। একটা সবুজ, একটা লাল।

একসময় স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা আলাদা। কিনতে পাওয়া যেত। ফিতা ছিড়ে গেলে বাজার থেকে নতুন ফিতা কিনে লাগানো হতো। এখন এই কাজ কেউ করে না। ফিতা ছিড়ে গেলে স্যান্ডেল ফেলে দিয়ে নতুন স্যান্ডেল কেনে। ওয়ানটাইম ইউজ। আমরা দ্রুত ওয়ানটাইমের দিকে এগুচ্ছি। এই অভ্যাস কি আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে পেয়েছি? প্রকৃতিও এরকমই করে। একটা মেঘ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়। আবার নতুন মেঘ তৈরি করে।

লোকটার গালে খোচা-খোচা পাকা দাড়ি। জর্দা দিয়ে পান খাওয়া অভ্যাস আছে। মুখ থেকে ভুরিভুর করে জর্দার গন্ধ আসছে। অভাবী মানুষদের মতো গাল ভাঙা, চোখ চকচক করছে। অভাবী মানুষদের চোখ কেন জানি পশুদের চোখের মতো চকচক করে।

ভাইজান, আমার নাম মতি। মতি মিয়া।

লোকটা এখন হ্যান্ডশেকের জন্যে হাত বাড়াল। এরকম রুগণ হাত আমি আগে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আলাদা আলাদাভাবে মৃত্যু হবার ব্যবস্থা থাকলে বলতে পারতাম, মতি নামের লোকটার ডান হাতের মৃত্যু হয়েছে।

আমার নাম তো বলেছি, মতি মিয়া। এখন আপনার নাম কী, জানতে পারি?

আমি বললাম, জানতে পারেন। আমার নাম হি।

মতি মিয়া অবাক হয়ে বলল, হি? হুদামুদা হি?

ঠিকই ধরেছেন। হুদামুদা হি। হিমু থেকে সংক্ষেপ করে হি। ভালো নাম ছিল হিমালয়। হিমালয় থেকে হিমু। হিমু থেকে হি। এরপর হবে ি। সংক্ষেপ করেই যাব।

সংক্ষেপ করবেন কীজন্যে?

বাংলাদেশ বিমানের বিজ্ঞাপন দেখেন না? পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। আমাদের নামও ছোট হয়ে আসছে। আপনার নাম তো মতি? সংক্ষেপ করে ফেলুন। এখন থেকে আপনার নাম ম।

ম?

জি ম। হুদামুদা ম।

মতি মিয়ার মুখের চামড়া শক্ত হয়ে গিয়েছে। ভুরু গেছে। কুচকে। মনে হচ্ছে সে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে। চেষ্টা পুরাপুরি সফল হলো না। রাগ থেকেই গেল। সে চাপা–গলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার সাথে বাইচলামি করেন? এখন আমি আপনেরে যে-কথাটা বলব সেটা শুনলে বাইচলামি বন হইয়া যাইব। পাতলা পায়খানাও ছুটতে পারে।

আমিও মতি মিয়ার মতো গলা নিচু করে বললাম, কথাটা কী?

আপনের ডাক পড়ছে।

কে ডাকছে?

আঙুল-কাটা জগলু ভাই ডাকছে। আমি আপনেরে উনার কাছে নিয়া যাব। দৌড় দেওনের চিন্তা মাথা থাইক্যা দূর করেন। চাইরদিকে আমরার লোক আছে। আমার পিছে পিছে হাঁটেন। ডাইনে-বামে চাউখ দিবেন না।

চউখ বন্ধ করে ফেলি, হাত ধরে ধরে নিয়ে যান। বাইচলামি অনেক করছেন। আর না। আঙুল-কাটা জগলু ভাইরে চিনছেন তো? নাকি চিনেন নাই। পরিচয় দিব? পরিচয়ের প্রয়োজন আছে?

আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম। জগলু ভাইয়ের পরিচয় লাগে না। উনি অতি পরিচিত ব্যক্তি। পত্রিকার ভাষায় শীর্ষ সন্ত্রাসী। বাংলাদেশ সরকার তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। সন্ত্রাসী হলেও উনি শিক্ষিত। ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি-পাওয়া মানুষ। তাঁর পড়াশোনার বিষয় ইংরেজি সাহিত্য। আঙুল-কাটা জগলু ভাইজান থাকেন কোথায়? কথা না বইল্যা চুপেচাপে হাঁটেন। নো টিক। আমি বললাম, বেশি দূর হলে একটা রিকশা নিয়ে নেই। যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।

মতি মিয়া কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টি যে-কোনো মানুষকে ভড়কে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। দৃষ্টির কারণে এখন মতি মিয়ার চেহারাই পালটে গেছে। সরল বোকা-বোকা চেহারার বাইরেও যে তার অন্য একটা চেহারা আছে, এটা দেখে ভালো লাগছে। মতি মিয়া হাঁটছেও দ্রুত। লম্বা লম্বা পা ফেলছে। মানুষ ছোট-খাট হলেও তার পা বেশ লম্বা।

 

ইজিচেয়ারে যিনি শুয়ে আছেন তিনিই কি আঙুল-কাটা জগলু ভাইজান? প্রথমেই চোখ গেল আঙুলের দিকে। আঙুল ঠিক আছে। শুধু ঠিক না, বেশ ভালোরকম ঠিক। লম্বা লম্বা সুন্দর আঙুল। হাতের সঙ্গে মানানসই। পামিস্টরা এই ধরনের হাতকে বলেন কনিকেল হ্যান্ড। কৌণিক হস্ত। এধরনের হাতের মানুষেরা শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী হয়। তারা হয় কোমল অন্তঃকরণবিশিষ্ট ভাবুক মানুষ।

উনার বাঁ হাতের মধ্যমায় সবুজ পাথরের আংটি। গায়ে কাজ-করা পাঞ্জাবি। পরনে সবুজ রঙের এক কালারের লুঙ্গি। তার টাইপের লোকজন লুঙ্গি পরে আয়েশি ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে ভাবতে কেমন যেন লাগে। এদের তো টেনশনে অস্থির হয়ে থাকার কথা। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি টাইপ ব্যাপার। পালাতে হবে কিংবা এক্ষুনি অ্যাকশনে যেতে হবে।

মতি ধাক্কা দিয়ে আমাকে কয়েক হাত এগিয়ে দিয়ে চাপাগলায় বলল, ওস্তাদ মাল আনছি।

জগলু ভাই চোখ তুলে একবার আমাকে দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মানুষটার চোখ সুন্দর, চেহারা সুন্দর। মাথাভরতি চুল। প্যাকেজ নাটকে নায়কের বড় ভাই চরিত্র দেওয়া যায় ধরনের চেহরা। যে বড় ভাই হয় ব্যাংকে কাজ করেন। কিংবা কলেজের প্রফেসর। দুই মেয়ে এবং স্ত্রী নিয়ে সংসার। একটা বড় খাটে স্বামী-স্ত্রী ঘুমান, বাচ্চা দুটো তাদের মাঝখানে থাকে। আমি জগলু ভাইয়ের বয়স আঁচ করার চেষ্টা করছি। কত হতে পারে? চল্লিশ?

মতি মিয়া বলল, নাম জিজ্ঞাস করলাম। বলতেছে নাম হি। বাইচলামি করে।

জগলু ভাই একপলকের জন্যে চোখ মেলেই বন্ধ করে ফেললেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোকে নাম জিজ্ঞাস করতে বলি নাই। ধরে আনতে বলেছি। তুই সামনে থেকে যা।

মতি মিয়া সামান্য ধমকেই ভয়ে কঁকড়ে গেল। দ্রুত ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেল। উফ বলে চাপা আওয়াজ করল। জগলু ভাই চোখ খুললেন না। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। ঠোঁটে সিগারেট দিলেন। দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় দেয়াশলাই জুলানো বেশ কঠিন কাজ। দুই হাতে ভালো সিনক্রোনাইজেশনের প্রয়োজন হয়। শুধুমাত্র অন্ধরাই এই কাজটা পারে।

জগলু ভাই আমার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। ইশরার অর্থ বসো কিংবা বসুন। মুখের কথায় আপনি-তুমি হয়। ইশারায় হয় না। আমি জগলু ভাইয়ের সামনে রাখা কাঠের চেয়ারে বসলাম। চেয়ারে বসা ঠিক হচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না। জগলু ভাই হয়তো আমাকে মেঝেতে বসতে বলেছেন। এখন এই ঘরে শুধু আমি এবং জগলু ভাই।

মাঝারি ধরনের ঘর। আসবাবপত্র বলতে কয়েকটা কাঠের চেয়ার। একটা নিচু টেবিল। পুরনো আমলের হাতলওয়ালা ইজিচেয়ার। ঘরটার মধ্যে মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত ভাব আছে, তবে বেশ বড় ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভি আছে। টিভির সঙ্গে ডিভিডি প্লেয়ার লাগানো। জগলু ভাই সম্ভবত টিভি দেখতে পছন্দ করেন। এমন হতে পারে, কোনো-একটা বিশেষ সিরিয়াল তিনি খুব মন দিয়ে দেখেন। একটাও মিস করেন না।

তার একটা ইন্টারভিউ নিতে পারলে ভালো হতো। শীর্ষ সন্ত্রাসী আঙুল-কাটা জগলু ভাই বিষয়ে মানুষজন জানতে পারত।

প্রশ্ন : জনাব আপনার প্রিয় টিভি প্রোগ্রাম কোনটি?

উত্তর : কৌন বনেগা ক্রোড়পতি।

প্রশ্ন : আপনার প্রিয় রঙ?

উত্তর : সবুজ।

প্রশ্ন : আপনার প্রিয় লেখক?

উত্তর : শেক্সপিয়ার।

জগলু ভাই চোখ মেলেছেন। আধশোয়া অবস্থা থেকে তিনি এখন বসা অবস্থানে এসেছেন। আগের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, এখন তিনি দ্বিতীয় সিগারেট ধরাচ্ছেন। চোখ খোলা অবস্থায় দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এই কাজটা তিনি মনে হয় চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ভালো পারেন।

তিনি বললেন (আমার দিকে না তাকিয়ে), তোমার নাম হি?

আমি বললাম, সংক্ষেপে হি। হিমু থেকে হি।

সংক্ষেপ কে করেছে?

আমিই করেছি।

কেন?

এখন সংক্ষেপের জমানা। সবকিছু সংক্ষেপ হয়ে যাচ্ছে। এইজন্যে নামটাও সংক্ষেপ করলাম।

সবকিছু সংক্ষেপ হয়ে যাচ্ছে মানে কী? কী সংক্ষেপ হচ্ছে?

মানুষের জীবন। যে-ছেলের বাঁচার কথা আশি বছর সে বিশ বছর বয়সে বোমা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেল।

তোমার ঝোলার ভেতর কী?

তেমন কিছু না।

ঝোলা উপুড় করে মেঝেতে ধরো। দেখি কী আছে।

জগলু ভাই বেশ আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে এসেছেন। তিনি মনে হয় ভাবছেন, ইন্টারেস্টিং কিছু বের হবে। ইন্টারেস্টিং কিছু বের হবার কথা না। ঝোলাতে কী আছে আমি নিজেও অবিশ্যি ভুলে গেছি। আমি নিজেও আগ্ৰহ নিয়ে তাকিয়ে আছি।

আমি ঝোলা উপুড় করলাম। দুটা বলপয়েন্ট বের হলো। একটা খাতা বের হলো। আর বের হলো গ্রাকোজ বিস্কিটের প্যাকেট। প্যাকেট খোলা। আমি কয়েকটা খেয়েছি, বাকি সব প্যাকেটে আছে। জগনু খুব সাবধানে বিস্কিটের প্যাকেট হাতে নিলেন। একটা একটা করে বিস্কিট বের করছেন, শুঁকে দেখছেন মেঝেতে ফেলছেন। প্রতিটি বিস্কিট দেখা শেষ হবার পর খাতাটা হাতে নিলেন। সেটিও শুঁকে দেখে রেখে দিলেন। উনার বোধহয় কুকুর–স্বভাব। সব জিনিস শুঁকে দেখতে হয়।

তুমি পুলিশের ইনফরমার?

জি না।

পুলিশের ইনফরমার না হলে আমার পিছনে পিছনে ঘুরছ কেন? গত এক সপ্তাহে আমি পাঁচবার তোমাকে আমার আশপাশে দেখেছি। তোমাকে লোকেট করা সহজ। হলুদ পাঞ্জাবি দেখেই তোমাকে আমি চিনি।

আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, জগলু ভাই, আমি পুলিশের ইনফরমার হলে প্রতিদিন হলুদ পাঞ্জাবি পরে আপনাকে খুঁজতাম না। একেক দিন একেক পোশাক পারতাম।

তুমি কি মজিদের লোক?

কোন মজিদ বলুন তো! এক মজিদকে চিনি, ঠেলাওয়ালা। ঠেলা চালায়।

আর কোনো মজিদকে চেন না?

জি না।

বোমা মজিদের নাম শুনেছ?

জি না। উনি নিশ্চয়ই আপনার মতো বিখ্যাত না। আপনার মতো বিখ্যাত হলে নাম শুনতাম।

তুমি পুলিশের ইনফরমারও না, আবার মজিদের লোকও না?

জি না।

জগলু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। একজন অতি ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল; তার চোখের দৃষ্টি কঠিন হবার কথা। দৃষ্টি সেরকম না। চোখের দৃষ্টিতে প্রশ্ৰয়-প্রশ্রয় ভাব আছে।

তার চোখের দৃষ্টির ওপর ভরসা করেই বললাম, জনাব, আপনাকে একটা প্রশ্ন কি করব? ব্যক্তিগত কৌতুহল।

কী প্রশ্ন?

আপনার আঙুল তো ঠিক আছে। আপনার নাম আঙুল-কাটা জগলু কেন?

আমি অন্যের আঙুল কাটি।

সব আঙুল কেটে দেন, না একটা-দুটা কাটেন?

তিনি আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঠাণ্ডা গলায় ডাকলেন, মতি!

মতি মিয়া ঝড়ের বেগে ছুটে এল। ঘরে ঢুকতে গিয়ে আবার দরজার সঙ্গে কিলিসান। এই ব্যাচারার মনে হয় ধাক্কা রাশি। জগলু ভাই বললেন, চৌবাচ্চায় পানি আছে?

মতি বলল, অল্প আছে।

চৌবাচ্চা পানি দিয়ে ভরতি কর। একে নিয়ে যা, এক মিনিট করে মাথা পানিতে ড়ুবায়ে রাখবি। তারপর জিজ্ঞেস করবি সে কার লোক, কী সমাচার। তখন মুখে বুলি ফুটবে। আমার ধারণা মজিদের লোক।

জলচিকিৎসাতে যদি কাজ না হয় সকালে বাঁ হাতের কানি আঙুলটা কেটে দিস।

আমি বললাম, জগলু ভাই, এক মিনিট করে চুবায়ে রাখলে জলচিকিৎসায় কাজ হবে না। আমি ড়ুব দিয়ে দেড় মিনিট থাকতে পারি।

আমার রসিকতা করার চেষ্টায় জগলু ভাই বিভ্রান্ত হলেন না। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করলেন। ভাবটা এরকম যেন আমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ।

মতি মিয়া আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মুখভরতি হাসি। মনে হয় পানিতে মাথা চোবানো এবং আঙুল কাটা এই দুটি কাজেই সে আনন্দ পায়। বর্তমান সময়ে মানুষের প্রধান সমস্যা কাজ করে আনন্দ না-পাওয়া। মতি মিয়া পাচ্ছে। তার জব স্যাটিসফেকশন আছে। এটা খারাপ কী?

 

আমি এখন আছি চৌবাচ্চাঘরে। মোগল আমল হলে বলতে পারতাম হাম্মামখানা। জানালাবিহীন ঘর। একটাই দরজা। ঘরের এক কোণে চৌবাচ্চা। ট্যাপ খোলা হয়েছে। চৌবাচ্চায় পানি দেওয়া হচ্ছে। আমার সঙ্গে এক প্রৌঢ়ও আছেন। তার হাত বাধা। প্রথম যখন ধাক্কা দিয়ে আমাকে এই ঘরে ঢোকানো হয়, তখন অন্ধকারের কারণে প্রৌঢ়ের মুখ দেখতে পাইনি। এখন চোখে অন্ধকার সয়ে এসেছে। প্রৌঢ়কে দেখতে পাচ্ছি।

দীর্ঘদিন ব্যালান্সড্‌ ডায়েট খাওয়া চেহারা। চব্বিশ ঘণ্টা এসি রুমে থাকলে চামড়ায় তেলতোলা যে ভাব আসে, তা এসেছে। পরনে ফতুয়া ধরনের পোশাক। জিনিসটিতে জটিল সুচের কাজ করা হয়েছে, অর্থাৎ দামি পোশাক। তবে ভদ্রলোক চুপসে গেছেন। তাঁর দামি ফুতুয়া ঘামে ভেজা। তিনি ক্রমাগত নড়াচড়া করছেন। ঘরে আমরা দুইজন। দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ। দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু আলো আসছে। আলোর একটা রেখা প্রৌঢ়ের মাথার ঠিক মাঝখানে পড়েছে। নাক এবং ঠোঁটের মাঝখান আলো হয়ে আছে। বাকিটা অন্ধকার। ফেলিনি কিংবা বাৰ্গম্যানের মতো পরিচালক থাকলে এই লাইটিং দেখে মজা পেতেন।

তালাবন্ধ দরকার বাইরে লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে বোঝা যাচ্ছে। একবার ঘড়ঘড় শব্দ হলো। মনে হচ্ছে কেউ ভারী কিছু টেনে আনছে। ঘড়ঘড় শব্দে প্রৌঢ় ভদ্রলোক এমনভাবে কেঁপে উঠলেন যেন ট্যাঙ্ক আসছে। এক্ষুনি তার দিকে কামান তাক করে গুলি করা হবে। তিনি রাজহাঁস টাইপ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, কী ব্যাপার? শব্দ কিসের? প্রশ্নটা তিনি আমার দিকে তাকিয়ে করলেন।

আমি বললাম, মনে হয় ট্যাঙ্ক। ছোট ছোট রাশিয়ান ট্যাঙ্ক যখন চলে এরকম শব্দ হয়। ব্যালাড অব এ সোলাজার ছবিতে এরকম শব্দ শুনেছি।

ভদ্রলোক মোটামুটি কঠিন গলায় বললেন, তুমি কে?

প্রথম আলাপেই সরাসরি তুমি। বোঝা যাচ্ছে, এই লোক তুমি বলেই অভ্যস্ত। শিক্ষকরা যেমন যাকে দেখে তাকেই ছাত্ৰ মনে করে, এই লোকও যাকে দেখে তাকেই মনে হয় কর্মচারী মনে করে। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বিনীত গলায় বললাম, স্যার আমার নাম জানতে চাচ্ছেন? আমার নাম হিমু। ইদানীং সংক্ষেপ করে বলছি হি।

তোমাকে এরা ধরেছে কীজন্যে?

আঙুল কাটার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছে স্যার। ওস্তাদ জগলু ভাই মানুষের আঙুল কাটতে পছন্দ করেন শুনেছেন বোধহয়। আপনার আঙুল যেমন কাটবে। আমারটাও কাটবে। জগলু ভাইয়ের কাছে গরিব-ধনী সমান। স্যার, আপনার পরিচয়টা কি জানতে পারি? আপনার কিসের ব্যবসা?

আমি মনসুর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। আমার নাম মনসুর খান।

শুনে ভালো লাগল স্যার। আমার হাত বাধা। হাত খোলা থাকলে আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতাম। আপনাদের মতো লোকদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। আপনাকে ধরেছে কীজন্যে?

টাকা চায়। বিশ লাখ টাকা চায়।

দিয়ে দেন। বিশ লাখ টাকা তো আপনার হাতের ময়লা। আপনার একটা আঙুলের দাম নিশ্চয়ই বিশ লাখের বেশি।

টাকা দিয়ে দিতে বলেছি। সম্ভবত এর মধ্যে দিয়েও দিয়েছে।

তা হলে তো স্যার আপনি রিলিজ নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

আই হোপ সো। এরা চৌবাচ্চায় পানি দিচ্ছে কেন?

আমার জন্যে জলচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। জগলু ভাই অর্ডার দিয়েছেন চৌবাচ্চা ভরতি হলে এক মিনিট করে যেন আমার মাথা চৌবাচ্চায় ড়ুবানো হয়। পেট থেকে কথা বের করার পদ্ধতি।

বলে কী! তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে না। তুমি ভয় পাচ্ছি।

আমি বললাম, ভয় পেলে যদি কোনো লাভ হতো তা হলে ভয় পেতাম। লাভ যখন হবে না, শুধু শুধু ভয় পাওয়ার দরকার কী? স্যার, আপনি পানিতে ড়ুব দিয়ে কতক্ষণ থাকতে পারেন?

কেন?

কিছুই তো বলা যায় না, ধরেন আমাকে বাদ দিয়ে আপনাকে পানিতে চুবানো শুরু করল।

আমি তো তোমাকে বলেছি তারা যা চেয়েছে সেটা দিতে বলেছি। আমি এখন রিলিজ নিয়ে চলে যাব। আমি আর দেশেই থাকিব না। কানাডায় ইমিগ্রেশন নেওয়া আছে, মেয়েকে নিয়ে চলে যাব। কানাডা।

আপনার মেয়ের নাম কী?

স্যার, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?

তুমি ফালতু কথা বলছি কেন?

ঠিক আছে স্যার, আর কথা বলব না, একটা ছোট্ট উপদেশ দেই? বিপদে উপদেশ কাজে লাগতে পারে।

ফাজিল! চুপ, উপদেশ দিতে হবে না।

গালাগালি করছেন কেন স্যার? আমার উপদেশটা শুনে রাখুন— পানিতে যখন মাথাটা চুবাবে নিশ্বাস নিবেন না, হাঁ করবেন না, নড়াচড়া করবেন না। ভয়ে যদি নিশ্বাস নিয়ে ফেললেন, বিরাট বিপদ হবে। নাক দিয়ে পানি ঢুকলে সমস্যা। পানি ঢুকে যাবে ফুসফুসে। জীবন-সংশয় হবে। দেড়-দুই মিনিট নিশ্বাস বন্ধ করে থাকা খুবই কষ্টকর, তবে অসম্ভব না। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তিন মিনিট পানিতে ড়ুব দেবার কথা আছে।

ভদ্রলোক ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, চুপ বললাম, চুপ।।

আমি মধুর ভঙ্গিতে বললাম, চেষ্টা করবেন। শান্ত থাকতে। শান্ত থাকলে শরীরের অক্সিজেনের প্রয়োজন কিছুটা কমে।

তুই শান্ত থাক। তুই অক্সিজেনের পরিমাণ কমা।

তুইতোকারি করছেন কেন স্যার? আমরা দুইজন একই পথের পথিক। জলচিকিৎসার রোগী। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা…

চুপ।

ভদ্রলোক হয়তো আরো হইচই করতেন। সুযোগ পেলেন না, দরজা খুলে গেল। মতি মিয়া ঢুকল। চৌবাচ্চার পানি পরীক্ষা করল। চৌবাচ্চা এখনো ভরতি হয়নি। আমি প্রৌঢ়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, চৌবাচ্চাটা ৬রতি হতে এতক্ষণ লাগছে কেন বুঝলাম না। মনে হয় কোনো ফুটো আছে। স্যার, আপনি কি চৌবাচ্চার অঙ্ক জানেন-একটা নল দিয়ে পানি ঢুকে আরেকটা দিয়ে চলে যায়?

প্রৌঢ় আগের মতো গলাতেই ধমক দিলেন, চুপ!

আমি চুপ করলাম। মতি মিয়া এখন প্রৌঢ়ের দড়ির বাঁধন খুলছে। খুলতে খুলতেই বলল, আপনার জন্যে সুসংবাদ। এখন চলে যাবেন। ওস্তাদ আপনাকে ছেড়ে দিতে বলেছে। চাউখ বান্দা অবস্থায় মাইক্রোবাসে তুলব। দূরে নিয়ে ছেড়ে দিব। রিকশা নিয়ে চলে যাবেন।

প্রৌঢ় বললেন, থ্যাঙ্ক য়ু।

মতি মিয়া বলল, আপনার তকলিফ হয়েছে, কিছু মনে নিবেন না।

কোনো অসুবিধা নেই, ঠিক আছে।

আপনার ভাগ্য ভালো, আপনে অল্পের ওপর পার পাইছেন।

প্রৌঢ় আমার দিকে শেষ তাকানো তাকিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। একে অবিশ্যি তাকানো বলা যাবে না। তিনি তীরনিক্ষেপের মতো দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন বলা চলে।

 

আকাশে মেঘ ডাকছে। যে-মেঘের নামার কথা ছিল সেই মেঘ তা হলে এখনো নামেনি। বৃষ্টি নামার আগের মেঘের ডাকের সঙ্গে বৃষ্টি নামার পরের মেঘের ডাকের সামান্য পার্থক্য আছে। রূপা নামের এক তরুণী আমাকে ৷ ই পার্থক্য শিখিয়েছিল। আমি শিখিয়েছি আমার খালাতো ভাই বাদলকে। মেV|বিদ্যা পুরোপুরি নষ্ট হতে দেওয়া ঠিক না। বাদল এই বিদ্যার চর্চা করছে কি না জানি না। অনেক দিন তার সাথে দেখা হয় না। ইদানীং সে কিছু ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কী-একটা গান তার মাথায় ঢুকে (গছে। সে যেখানে যায়, যা-ই করে তার মাথায় একটা গানের লাইন লাজে। বড়ই অদ্ভুত গানের কথা। প্রথম লাইনটা হচ্ছে, নে দি লদ বা রয়াওহালা গপা। সমস্যা হচ্ছে এই গান নাকি সে আগে কখনো শোনেনি। যে গান সে কোনোদিন শোনেনি সেই গান কী করে তার মাথায় ঢুকল কে জানে!, তার মাথা থেকে কি গান দূর হয়েছে? একটা টেলিফোন হাতের কাছে থাকলে বাদলকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম। থানাওয়ালাদের হাতে যখন ধরা খেয়েছি তখন তারা মাঝেমধ্যে টেলিফোন করতে চাইলে দিত। বেশির ভাগ সময়ই অবিশ্যি দেখা যেত তাদের টেলিফোন কাজ করে না। ডায়ালটোন আসে না, আর যদিও আসে শোশো আওয়াজ হয়। বাংলাদেশে বেশির ভাগ সময় দুই জায়গার টেলিফোন নষ্ট থাকে—পুলিশের টেলিফোন এবং হাসপাতালের টেলিফোন। এদেরকে কি জিজ্ঞেস করে দেখব। একটা টেলিফোন করতে দিবে কি-না।

বন্ধ দরজা ধড়াম করে খুলে গেল। চার-পাঁচজনের একটা দল প্রবেশ করল। দলের পুরোভাগে জগলু ভাই আছেন। এবং আমাদের প্রৌঢ়—মনসুর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মনসুর খাঁ সাহেবও আছেন। তার মুখ ঝুলে পড়েছে। এবং তিনি হাঁপানি রোগীদের মতো টেনে টেনে শ্বাস নিচেছন।

ঘটনা আঁচ করতে পারছি। বিশ লক্ষ টাকা জায়গামতো পৌঁছেনি। মনসুর সাহেবের মেয়ে হয়তো পুলিশে খবর দিয়েছে। সাদা পোশাকের পুলিশ একটা বেড়াছেড়া বাধিয়েছে। কিংবা টাকার বদলে সুটকেসভরতি পুরনো খবরের কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছে। তার বাবা যে কত বড় বিপদে আছে সে বোধহয় আঁচ করতে পারছে না।

জগলু ভাইয়ের হাতে সিগারেট। তিনি ঘনঘন সিগারেট টানছেন। যতবারই টানছেন ততবারই আড়াচোখে তার রিস্টওয়াচের দিকে তাকাচ্ছেন। এই প্রথম তার মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ করলাম। উত্তেজনায় তার নাক ঘামছে। সমুদ্রবিদ্যা বইয়ে আছে, মানসিক উত্তেজনাকালে যে-পুরুষের নাক ঘামে সে স্ত্রী-সোহাগী হয়। জগলু ভাই কি স্ত্রী-সোহাগী?

জগলু ভাই বললেন, বুড়ার মাথা পানিতে চুবাও। তার আগে বদমাইশের মেয়েটাকে মোবাইল টেলিফোনে ধরো। বুড়ার মাথা পানি থেকে তোলার পর টেলিফোনটা বুড়ার হাতে দাও। বুড়া মেয়ের সঙ্গে কথা বলুক। ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। আমার সঙ্গে টালটুবাজি?

টেলিফোনে মেয়েকে ধরতে ঝামেলা হলো। নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। যখন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তখন মেয়ের টেলিফোন থাকে বিজি। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। জগনু ভাইয়ের রাগ ক্রমেই বাড়ছে। চৌবাচ্চা পূৰ্ণ। এক্ষুনি হয়তো পানি উপচে পড়বে।

জগলু ভাই বললেন, কী, লাইন পাওয়া গেছে?

মতি মিয়ার হাতে টেলিফোন। সে ভীত গলায় বলল, জি না।

একটা কানেকশন ঠিকমতো করতে পারো না? নাম্বার জানো? বোতাম ঠিকমতো টিপছ? টিলিফোন হারুনের কাছ দাও। তুমি জীবনে কোনোএকটা কাজ ঠিকমতো করতে পেরেছ বলে আমার মনে পড়ে না।

হারুনের পারফরমেন্স মতি মিয়ার চেয়েও খারাপ। সে বোতাম টেপার আগেই মোবাইল সেট হাত থেকে ফেলে দিল। সেট সে মেঝে থেকে অতি দ্রুত তুলল। ঝড়ের গতিতে বোতাম টিপল। ছয়-সাত বার হ্যালো, হ্যালো বলল, লাভ কিছু হলো না।

জগলু ভাই বললেন, কী হলো? এখনো লাইনে পাচ্ছ না?

হারুন কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, টেলিফোন অফ করে রেখেছে। রিং হয় ধরে না।

জগলু ভাই। থমথমে গলায় বললেন, বেকুবের মতো কথা বলবে না। যে-মেয়ের বাপের এই অবস্থা, আমাদের সঙ্গে যেখানে তার যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা টেলিফোন, সেখানে সে টেলিফোন অফ করে রাখবে? আমি কোনো বেকুব পছন্দ করি না, আর আমাকে চলতে হয় বেকুব নিয়ে। এখন চৌবাচ্চা কানায় কানায় পূর্ণ। টেলিফোনে মেয়েটিকে ধরা যাচ্ছে না বলে চৌবাচ্চা কাজে লাগছে না। বাংলা ছবির কোনো দৃশ্য হলে এই অবস্থায় ব্যাকগ্রাউন্ডে সুপার টেনশন মিউজিক বাজত। মিউজিকের মধ্যে আফ্রিকান ড্রামের শব্দ-ড্রিম ড্রিম ড্রিম। এই ড্রিম ড্রিামের সঙ্গে হার্ট বিটের শব্দ মিশিয়ে মিশ্র মিউজিক।

আমি বললাম, জগলু ভাই, আমি কি ট্রাই করে দেখব? টেলিফোনে কানেকশন পাওয়ার লাক আমার খুব ভালো। সবসময় এক চান্সে লাইন পাই।

দলনেতা এবং দলের সদস্যরা সবাই একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। গুগলু ভাইয়ের চোখ চকচক করছে। তার সিগারেট নিভে গেছে। তিনি নেভা সিগারেটই টানছেন।

মতি বলল, ওস্তাদ, এইটারে আগে পানিত চুবাই। এই কুত্তা বড় দিগদারি করতেছে।

জগলু ভাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে গিয়েও নাড়লেন না। শেষমূহুর্তে মত বদলে বললেন, এর হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে এর হাতে টেলিফোন দে।

আমি বললাম, নাম্বারটা দিন।

টেলিফোন হাতে নিয়ে যে ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে—হারুন ভাইজান—সে বলল, রিডায়ালে টিপলেই হবে।

আমি বললাম, রিডায়ালে টিপলে হবে না হারুন ভাই। একেকজনের একেক সিস্টেম। আমি রিডায়ালের লোক না। আমি ডাইরেক্ট ডায়ালের লোক। নাম্বারটা বলুন।

হারুন ভাইজান নাম্বার বললেন। আমি বোতাম টিপলাম। সেট কানে লাগানোর আগে মনসুর খাঁ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, মেয়েটার নাম কী? খাঁ সাহেবের মুখ আরো ঝুলে গেছে। তিনি এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন প্রশ্ন শুনতে পাননি।

স্যার, আপনার মেয়েটার নাম বলুন।

মিতু।

মিস না মিসেস?

মিস না মিসেস দিয়ে কোনো দরকার আছে?

অবশ্যই দরকার আছে। হ্যালো মিস মিতু বলব না। হ্যালো মিসেস মিতু বলব জানাতে হবে না?

ওর বিয়ে হয়নি।

বয়স কত?

বয়স দিয়ে কী হবে?

কোন বয়সের মেয়ে সেটা হিসাব করে কথা বলতে হবে না?

উনিশ।

জগলু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার কথা বলার কিছু নাই। তুমি লাইন ধরে দাও। প্রথমবারে যদি না পাও আমি স্ট্রেইট তোমাকে পানিতে চুবাব। তোমার রস বেশি হয়েছে। রস বের করে রস দিয়ে গুড় বানায়ে দিব। আসার পর থেকে ফাজলামি করেই যাচ্ছি। আমি দেখতে চাই তুমি কতক্ষণ ফাজলামি করতে পার।

প্রথম চেষ্টাতেই লাইন পাওয়া গেল। অতি মিষ্টি গলায় একটি মেয়ে বলল, হ্যালো।

আমি বললাম, মিতু, ভালো আছ?

আপনি কে?

আমাকে তুমি চিনতে পারবে না। আমার নাম হিমু। সংক্ষেপ হি।

কী চান আপনি?

ধমক দিয়ে কথা বোলো না মিতু। আমি জগলু ভাইয়ের আপনা লোক। জগলু ভাই আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তোমার কথা উনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। জগলু ভাইকে চিনতে পারছ তো? আঙুল-কাটা জগলু। কঠিন বস্তু। কচাকচ আঙ্গুল কাটনেওয়ালা।

মিতুর আর কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে নিজেকে সামলানোর জন্যে সময় নিচ্ছে। আমি হাত দিয়ে রিসিভার চাপা দিয়ে জগলু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওস্তাদ, আপনি কথা বলবেন? নাকি প্ৰাথমিক আলাপ আমিই করব?

জগলু ভাইও কিছু বলছেন না। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার চোখে। মনে হচ্ছে তিনি পলক ফেলছেন না। কাজেই আমি আবারও টেলিফোন কানে নিলাম।

হ্যালো মিতু। তোমরা কাজটা ঠিক করনি। বিশ লাখ টাকা তোমাদের কাছে এমন কোনো টাকা না। সেই টাকা নিয়ে তোমরা ভাওতাবাজি করলে। ওস্তাদ খুব রাগ হয়েছেন। এখন আমরা তোমার বাবাকে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট দেব। আয়োজন সম্পন্ন, এখন উনার মাথা পানিতে চুবানো হবে। পরপর তিনটা দেড় মিনিটের সেশন হবে।

বাবা কি আপনার আশপাশে আছে?

অবশ্যই আছেন। জলচিকিৎসার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

বাবাকে দিন।

এখন তো উনাকে দেয়া যাবে না। প্রথম ডোজ ওষুধ পড়ার পর দেয়া হবে।

প্রথম ডোজ ওষুধ মানে? প্রথম ডোজ ওষুধ মানে প্রথমবার পানিতে চুবানো। জলচিকিৎসার পর আমরা কী করব শোনো, শল্যচিকিৎসা। উনার একটা আঙুল কেটে কুরিয়ার সার্ভিসে তোমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে শেষ সুযোগ এখনো আছে। টাকাভিরতি সুটকেস হাতের কাছে রাখো। প্রথমবার আমাদের সঙ্গে টালিটুবাজি করেছ বলেই এই দফায় টাকার পরিমাণ কিছু বেড়েছে। এখন হয়েছে পঁচিশ লাখ। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে টাকা নিতে আসছি। দারোয়ানকে আমার কথা বলে রাখো। বলামাত্রই যেন গেট খুলে দেয়। ভালো কথা, তোমাদের বাড়িতে কুকুর নেই তো? কুকুর থাকলে আমি যাব না। অন্য লোক যাবে। আমি কুকুর ভয় পাই।

আপনি বাবাকে টেলিফোন দিন।

একটু দাড়াও, ওস্তাদ জগলু ভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখি তিনি পারমিশন দেন। কি না। লিডারের পারমিশন ছাড়া টেলিফোন দিতে পারব। উনি আমাদের লিডার।

জগলু ভাই চোখের ইশারায় অনুমতি দিলেন। আমি টেলিফোন মনসুর সাহেবের কানো ধরলাম। তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলেন। ওপাশ থেকে মেয়ের কথা শোনা যাচ্ছে, কে, বাবা? বাবা? হ্যালো। প্লিজ কুল ডাউন। তোমাকে রিলিজ করার জন্যে যা করার করব। কুল ডাউন বাবা। কুল ডাউন।

 

আমরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছি। চৌবাচ্চা সামনে রেখে দুজন বসে আছি। আমার দৃষ্টি চৌবাচ্চার দিকে। মনসুর সাহেব তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ, তবে দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই অন্ধকারে আছি বলে চোখ সয়ে আছে। আমি মনসুর সাহেবের মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমেরিকার এক বিখ্যাত প্রেসিডেন্টের চেহারার সঙ্গে তাঁর চেহারার সুসাদৃশ্য আছে। প্রেসিডেন্টের নাম আব্রাহাম লিংকন ৷

মনসুর সাহেবের মনে হয়। হাঁপানি নামক ব্যাধি ভালোভাবেই ধরেছে। নিশ্বাসই নিতে পারছেন না। অবস্থা যা তাকে পানিতে চোবানোর আগেই তিনি মারা যাবেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, হাঁপানির জন্যে আপনি কি কখনো লোকজ কোনো চিকিৎসা করিয়েছেন?

কী চিকিৎসা?

লোকজ চিকিৎসা। শিয়ালের মাংস খেলে হাঁপানি সারে বলে শুনেছি। খেয়েছেন শিয়ালের মাংস?

মনসুর সাহেব বললেন, আমি চরম দুঃসময়ের মধ্যে যাচ্ছি, এর মধ্যে তুমি এরকম ঠাট্টা-ফাজলামি কথা বলতে পারছ?

যদি উদ্ধার পেয়ে যান তা হলে তো আর আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হবে না। তখন মনে করে শিয়ালের মাংস খাবেন। মাটন বিরিয়ানি স্টাইলে বাবুর্চিকে রাধাতে বলবেন। আসলে জিনিসটা হবে ফক্স বিরিয়ানি। শিয়ালের গন্ধ মারার জন্যে বেশি করে এলাচি দিতে বলবেন।

তুমি কি দয়া করে চুপ করবে? হাঁপানির আরো একটা ভালো লোকজ চিকিৎসা আছে। এই চিকিৎসায় কোনোকিছু খেতে হবে না। চিকিৎসাটা বলব?

মনসুর সাহেব কঠিন চোখে তাকাচ্ছেন। আমি তাঁর দৃষ্টি অগ্রাহ্য করলাম।

এই চিকিৎসা যে আপনাকে করতেই হবে তা তো না। জানা থাকিল। আপনি কী করবেন শুনুন, একটা জীবন্ত ছোট সাইজের তেলাপোকা ধরবেন। হ্যা করে মুখের ভেতর রাখবেন। ঠোট বন্ধ করে দেবেন। তোলাপোকা মুখের ভেতর ফড়িফড় করতে থাকবে। মীরবে না। কারণ, তার অক্সিজেনের অভাব হবে না। প্রতিদিন এই চিকিৎসা যদি একবার করে চালিয়ে যান, আপনি হবেন সম্পূর্ণ রোগমুক্ত।

মনসুর সাহেব আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চৌবাচ্চার দিকে তাকালেন। চৌবাচ্চা থেকে পানি উপচে পড়ছে। ঝরনার মতো সুন্দর শব্দ হচ্ছে। মনসুর সাহেব চৌবাচ্চার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম হি?

আমি বললাম, সংক্ষিপ্ত নাম হি। অনেকেই ডাকে হিমু। শুধু আমার বাবা আমাকে ডাকতেন হিমালয়।

হিমু শোনো। আমি তোমার কথাবার্তা, কর্মকাণ্ড কিছুই মিলাতে পারছি না। আমি জানতে চাচ্ছি। তোমার কী ধারণা, এরা কি আমাকে মেরে

ফেলবে?

আমি বললাম, এরা যদি বুদ্ধিমান হয় তা হলে মেরে ফেলবে। আর যদি বোকা হয় বাড়িতে ফেরত পাঠাবে।

জগলু বোকা না বুদ্ধিমান?

বুদ্ধিমান।

তা হলে সে আমাকে মেরে ফেলবে?

মেরে ফেলা উচিত, তবে বিরাট বুদ্ধিমানরা মাঝে মাঝে বোকামি করে। সেই বোকামিতে আপনি ছাড়া পেতে পারেন।

আর তোমাকে কী করবে?

আমাকে আপনার মেয়ের কাছে পাঠাবে সুটকেসভরতি টাকা নিয়ে আসতে।

তুমি এমনভাবে কথা বলছি যে, কী ঘটবে না-ঘটবে সবই তুমি জানো।

আমি হাসলাম। বিশেষ ধরনের হাসি— যে-হাসির নানান অর্থ করা যায়।

হিমু!

জি?

তোমার সঙ্গে কি ঘড়ি আছে, কয়টা বাজে বলতে পারে? আমি বললাম, আমার সঙ্গে ঘড়ি নাই, তবে কয়টা বাজে বলতে পারি। আটটা পঁচিশ।

তালা খোলার শব্দ হচ্ছে। জাগলু ভাই সঙ্গে এমন একজনকে নিয়ে ঢুকেছেন যাকে দেখামাত্র হার্টবিট বেড়ে একশো-একশো দশের মতো হওয়ার কথা। গামা পালোয়ান ধরনের কেউ না। সাধারণ স্বাস্থ্যের লম্বা একজন মানুষ। গায়ের রং ফরসা। ছোট ছোট চোখ। মাথার চুল সম্ভবত পাকা, মেন্দির রং দিয়ে লাল করা হয়েছে। মানুষটার চেহারার সবকিছুই স্বাভাবিক, কিন্তু সব স্বাভাবিকতার বাইরে এমন ভয়ঙ্কর কিছু আছে যা সরাসরি বুকে ধাক্কা দেয়।

জগলু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েটার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে বলেছে আর সমস্যা হবে না। কাউকে পাঠালে টাকা দিয়ে দিবে। আমরা ঠিক করেছি। তুমি গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। আমার নিজের লোক কেউ যাবে না।

আমি বললাম, স্যার, আমি একা যাব?

হ্যাঁ একাই যাবে। দূর থেকে আমার লোকজন তোমাকে ফলো করবে। টালটুবাজি করার সুযোগ নেই।

মিতুর সঙ্গে একটু কথা বলে নেই। টেলিফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিন।

তার সঙ্গে তোমার কথা বলার কিছু নেই।

অবশ্যই আছে। আমার কিছু জিনিস জানতে হবে। আমি তাদের বাড়িতে ঢুকলাম আর ধরা খেয়ে গেলাম। এটা কি ঠিক হবে? তা ছাড়া এই বুড়া মিয়ার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনসুর সাহেবের কথা বলছি।

তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?

তাকে আমরা কখন খুন করব? আমি রওনা হবার আগেই, না। টাকা নিয়ে ফিরে আসার পর?

এত চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তোমার কাজ টাকাটা নিয়ে আসা।

জগলু ভাই, আমি ওই মেয়ের সঙ্গে কথা না বলে রওনাই হব না। আমি তিনি কথার মানুষ।

তিনি কথার মানুষ মানে?

আমি প্রতিটি কথা তিনবার করে বলি। দানে দানে তিন দান। তিন নম্বর কথা যেটা বলি সেটা ফাইনাল।

জগলু ভাই তার হাতের মোবাইল এগিয়ে দিলেন। মিতুকে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল। আমি বললাম, কেমন আছ মিতু?

মিতু বলল, আপনি কে?

আমার নাম হিমু, আমি জগলু ভাইয়ের আপনা লোক। তোমার সঙ্গে আগেও কথা হয়েছে। আমি টাকার সুটকেস নেবার জন্যে আসছি। টাকা রেডি তো?

হ্যাঁ রেডি।

গেটে বলে রাখবে। রিকশা করে দুজন লোক আসবে। রিকশা থামামাত্ৰ যেন গেট খুলে দেয়।

বলে রাখা হবে।

কফির পানি গরম করে রাখবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসব তো! গরম এক কাপ কফি কাজে দেবে।

কফির ব্যবস্থা থাকবে।

স্ন্যাকস জাতীয় কিছু রাখতে পারবে? ভাজাভুজি ধরনের কিছু?

থাকবে।

কুকুর দূর করেছ? আমি আগেই বলেছি যে-বাড়িতে কুকুর আছে সেবাড়িতে আমি যাই না।

কুকুর বেঁধে রাখা হয়েছে।

আমি বাঁধাবাঁধির মধ্যে নাই। অন্য বাড়িতে কুকুর পাঠিয়ে দিতে হবে।

আমার বাবা কোথায়? বাবাকে কখন ফেরত পাব?

উনাকে সঙ্গে নিয়ে আসব।

উনাকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন?

অবশ্যই। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল অবস্থা। মাল ডেলিভারি দিয়ে টাকা নিয়ে চলে আসব। জগলু ভাইয়ের এইটাই সিস্টেম।

আমার কথা শেষ হবার আগেই জগলু ভাই খপ করে হাত থেকে টেলিফোন নিয়ে নিলেন। তাঁর মুখ সেগুন কাঠের মতো শক্ত। চোখ এখন মারবেলের মতো। তিনি সৰ্প স্টাইলে হিসহিস করে বললেন, মাল ডেলিভারি নিয়ে যাবে মানে? কী মাল?

মনসুর সাহেবকে নিয়ে যাব। তাকে তো এখন আমাদের দরকার নাই।

তাকে দরকার নাই এই গুরুত্বপূর্ণ খবর তোমাকে কে দিয়েছে?

আপনি চান আমি একা যাই?

অবশ্যই। আগে টাকা আসুক, তারপর বুড়োর ব্যাপারে কী করা যায় আমরা বিবেচনা করব।

আমি এর মধ্যে নাই।

কী বলতে চাও তুমি?

জগলু ভাই, আমি যেটা বলতে চাই পরিষ্কার করে বলব। মন দিয়ে শুনুন। আপনাদের দরকার টাকা। বুড়ো লোকটাকে আপনাদের দরকার নাই। টাকা আমি এনে দেব। তবে বুড়োকে ফেরত দিতে হবে। রাজি থাকলে বলুন। রাজি না থাকলে আমাকে পানিতে চুবান।

জগলু ভাই তার মারবেলের চোখে ইশারা করলেন। নিমেষের মধ্যে এরা আমাকে ঘাড় পর্যন্ত পানিতে চুবিয়ে ধরল।

শৈশবে এই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। আমার জ্ঞানী বাবা আমাকে এ ধরনের জলচিকিৎসা বেশ কয়েকবার করিয়েছেন। নিশ্বাস নিতে না পারার কষ্টটা অনুভব করার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি যা করতেন তা হলো, মাথা পানিতে চুবিয়ে উচু গলায় কথা বলতেন। পানির নিচে সেই কথা অন্যরকমভাবে কানে আসত। তার কথাগুলো ছিল :

হে পুত্র। তুমি কঠিন অবস্থায় আছি। অক্সিজেন নামক অতি ক্ষুদ্র কিছু অণুর জন্যে তোমার সমস্ত শরীর এখন ঝন ঝন করছে। মানুষের মস্তিষ্ক অক্সিজেন সবচেয়ে বেশি বেশি ব্যবহার করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার মস্তিষ্কের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবে। তখন মস্তিষ্ক স্বরূপে আবির্ভূত হবে। মস্তিষ্ক তোমাকে অদ্ভুত সব অনুভূতি দেখাবে, দৃশ্য দেখাবে। ভয় পেও না।

এখানে আমি বাবার কথা শুনতে পাচ্ছি না, তবে অন্যদের কথা শুনতে পাচ্ছি। মনসুর সাহেবের কান্না শুনতে পাচ্ছি। মতি নামের লোকটার কথা শুনতে পাচ্ছি। সে বিড়বিড় করে বলছে, ওস্তাদ, মনে হয় শেষ হয়ে গেছে। তুলব?

ব্যাঞ্জো টাইপ একটা বাজনা কানে আসছে। এটা মনে হচ্ছে শব্দের হ্যালুসিনেশন। এখানে নিশ্চয়উ কেউ ব্যাঞ্জো বাজাচ্ছে না। মস্তিষ্কের অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। সে হ্যালুসিনেশন দেখাতে শুরু করেছে। না হলে এই অবস্থায় ব্যাঞ্জোর বাজনা কানে আসত না। আমি হাত-পা নাড়ছি না। শরীর দোলাচ্ছি না। পরিশ্রম করা মানেই বাড়তি অক্সিজেন খরচ করা। এ-কাজ এখন করাই যাবে না। আমাদের ফুসফুস ভরতি এখন কার্বন ডাইঅক্সাইড। এমন কোনো সিস্টেম যদি বের করা যেত যাতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ভেঙে জীবনদায়িনী অক্সিজেন পেতাম।

CO2->C+O2

কোনো-একটা বিশেষ ক্যাটালিস্ট কার্বন ডাইঅক্সাইডকে ভেঙে দেবে।

জগলু ভাইয়ের গলা শোনা গেল, এই একে পানি থেকে তুলে দ্যাখ, এখনো আছে না গেছে।

আমাকে পানি থেকে তোলা হলো। বিরাট বড় হাঁ করে একগাদা অক্সিজেন আমি মুখে নিলাম না। সামান্য একটু নিলাম। হঠাৎ করে একগাদা অক্সিজেন নিলে আমাকে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে যেতে হবে।

আমি তাকিয়ে আছি হাসিহাসি মুখে। এই অংশটা অভিনয়। দুই মিনিট অক্সিজেন ছাড়া যে থাকে তার মুখ হাসিহাসি হওয়া কঠিন ব্যাপার। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে বিস্ময় আছে, খানিকটা ভয়ও আছে। ভয়টা কীজন্যে আছে বুঝতে পারছি না।

আমি বললাম, আপনার সিদ্ধান্ত কী নিলেন তাড়াতাড়ি জানান। আমার হাতে এত সময় নাই। আমাকে পানিতে ড়ুবিয়ে মারতে চাইলে মারবেন। কোনো অসুবিধা নাই।

জগলু ভাই বললেন, কোনো অসুবিধা নাই?

না, অসুবিধা নাই। আমরা সবাই মরব। আমি পানিতে ড়ুবে মরব, জগলু ভাই অন্যভাবে মরবে। তাকে কেউ হয়তো জ্বলন্ত ইটের ভাটায় ছেড়ে দিবে। ঠাণ্ডা মৃত্যু, গরম মৃত্যু। জিনিস একই। জগলু ভাই, আমাকে একটা সিগারেট দিতে বলেন না! লিকার চা আর একটা বেনসন সিগারেট।

জগলু ভাই বললেন, চা-সিগারেট খাবে?

আমি বললাম, কফি খেতে পারলে ভাল হত। কফির ব্যবস্থাতো নিশ্চয়ই নেই।

সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। সবার চোখেই বিস্ময়। শুধু লাল চুলের পিশাচ টাইপ মানুষটার চোখ বিস্ময়মুক্ত। আমি আবার বললাম, চা-সিগারেটেই কি হবে?

জগলু ভাই মতিকে চা-সিগারেট দিতে বললেন। সিদ্ধান্ত হলো মনসুর সাহেবকে নিয়েই আমি যাব। আমার দায়িত্ব টাকার সুটকেস জগলু ভাইয়ের হাতে ফেরত দেওয়া।

জগলু ভাই আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কঠিন গলায় বললেন, আমি আঙুল-কাটা জগলু, আমার সঙ্গে কোনো উনিশ-বিশ করলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না।

আমি বললাম, আমি হইলদা হিমু! আমার সঙ্গে কোনো উনিশ-বিশ করলে আমিও কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না।

জগলু ভাই শীতল গলায় বললেন, তার মানে?

আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। জগলু ভাই সেই হাসি কীভাবে নিলেন বুঝতে পারছি না। খুব ভালোভাবে নেবার কথা না।

 

যে-মেঘ এতক্ষণ শহরের ওপর ঝুলে ছিল, শহরের মানুষদের ভেজাবে কি ভেজাবে না-এ–বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না, সেই মেঘ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইংরেজিতে এই বৃষ্টিকেই বোধহয় বলে—Cats and dogs. রিকশার হুড তুলে দেওয়া হয়েছে। পায়ের ওপর ব্ৰাউন কালারের প্লাস্টিক। কোনোই লাভ হচ্ছে না। আমি এবং মনসুর সাহেব ঘেষা ঘোষি করে বসেছি। ভদ্রলোকের গায়ের কাপুনি টের পাচ্ছি। শীতে কাপছেন বলেই মনে হচ্ছে। কিংবা তার জ্বর এসে গেছে। জুর চলে আসা বিচিত্র না। তিনি এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন। তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং আমি রিকশা করে তার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছি, এই সত্যটা মনে হয় এখনো গ্ৰহণ করতে পারেননি। তিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। সারাক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। একটু পরপরই রিকশার পেছনের পরদা উঠিয়ে পেছনটা দেখতে চেষ্টা করছেন।

আমার হাতে একটা মোবাইল টেলিফোন। জগল্প ভাই দিয়ে দিয়েছেন যাতে সারাক্ষণ তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি। নতুন একটা সিমকার্ড মোবাইলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হলে এই সিমকার্ড ফেলে আরেকটা ঢোকানো হবে। কোন নাম্বার থেকে টেলিফোন করা হয়েছে। কেউ ধরতে পারবে না।

মনসুর সাহেব গলা নামিয়ে বললেন, রিকশাওয়ালা কি ওদের লোক?

আমি বললাম, না।

কীভাবে বুঝলে যে ওদের লোক না?

রিকশা ওরা এনে দেয়নি। আমি ঠিক করেছি।

ওরা কি আমাদের ফলো করছে?

না।

কীভাবে বুঝলে ওরা আমাদের ফলো করছে না?

জগলু ভাই পুরো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এই ধরনের মানুষ সবকিছু নিয়ে জুয়া ধরতে পছন্দ করেন। আমার ব্যাপারটাও তার কাছে একটা জুয়ার মতো। জিতলে জিতবেন, হারলে হারবেন—এরকম ভাব।

হিমু!

জি?

তুমি সাধারণ মানুষের পর্যায়ের না।

আমরা কেউই সাধারণের পর্যায়ে না। সবাই সাধারণের ওপরে।

তুমি বিবাহ করেছ?

না।

চাকরি করো?

না।

মাসে দশ হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরির ব্যবস্থা আমি তোমার জন্য করব?

আমি কাজকর্ম তো কিছু জানি না।

কাজকর্ম কিছুই জানতে হবে না। মাসের এক তারিখে তুমি হেড অফিসে চলে যাবে। সেখানে ক্যাশিয়ার ইয়াকুবউল্লাহর সঙ্গে দেখা করবে। সে নগদ দশ হাজার টাকা দেবে। ঠিক আছে?

অবশ্যই ঠিক আছে।

তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ। মাসে দশ হাজার সেখানে কোনো ব্যাপারই না। আজীবন এই এলাউন্স পাবে।

ধরুন কোনো কারণে এক তারিখ উপস্থিত হতে পারলাম না। তিন বাঁ চার তারিখে উপস্থিত হলাম, তখন কি টাকাটা পাওয়া যাবে?

তুমি আমার কথাটা গুরুত্বের সঙ্গে নাও নাই বলে রসিকতা করার চেষ্টা করছ। রসিকতা করবে না। মাসের এক তারিখে ঠিকই তুমি টাকা পাবে। নাকি তুমি টাকা নেবে না?

কেন নেব না? আমি তো মহাপুরুষ না। মহাপুরুষদের টাকার দরকার থাকে না। আমি হামপুরুষ। আমার টাকার দরকার আছে।

হামপুরুষটা কী?

হাম হচ্ছে মহার উলটা।

তোমার সঙ্গে সিরিয়াস ধরনের কোনো কথাবার্তা বলা একেবারেই অর্থহীন। তার পরেও কিছু জরুরি কথা বলছি শোনো। মন দিয়ে শোনো।

একটু উঁচু গলায় কথা বলতে হবে। বৃষ্টি পড়ছে তো। আপনার ফিসফিসানি কথা পরিস্কার শোনা যাচ্ছে না।

মনসুর সাহেব তার পরেও গলা উচু করলেন না। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, তোমাকে আমি প্রটেকশন দেব। বুঝলে ব্যাপারটা? বাড়িতে পৌছার পরপর পুলিশ আমার বাড়ি ঘিরে রাখবে। জগন্নুর ওই আস্তানা রেইড করার ব্যবস্থা করব। কত ধানে কত চাল সে তখন বুঝবে।

আমি বললাম, তার মানে কি এই যে সুটকেসভরতি টাকার ব্যাগ নিয়ে আমি ফেরত যাব না?

অসম্ভব। সুটকেসের একটা টাকাও ঘর থেকে বের হবে না।

আমি যে কথা দিয়ে এসেছি। তারা অপেক্ষা করবে।

তুমি কাকে কথা দিয়েছ? ক্রিমিনালকে কথা দিয়েছ? ক্রিমিনালকে দেয়া কথা তোমাকে রক্ষা করতে হবে? গর্তে পড়ে রিকশা বড় ধরনের একটা হোচট খেয়ে থেমে গেল। আর তখনই আমার মোবাইল বেজে উঠল। জগনু ভাই টেলিফোন করেছেন।

কে, হিমু?

ইয়েস জগলু ভাই।

অবস্থা কী?

অবস্থা ঠিক আছে, আমরা এখনো গুলশান এলাকায় ঢুকি নাই। আরো দশ-পনেরো মিনিট লাগবে।

বুড়া আছে ঠিকমতো?

জি, উনি ঠিকমতোই আছেন।

কিছু বলছে?

আমার সঙ্গে পরামর্শ করার চেষ্টা করছেন।

কী পরামর্শ?

উনি বলছেন বাড়িতে একবার ঢোকার পর ডিল অফ। তখন পুলিশ চলে আসবে। আপনার আস্তানায়ও পুলিশ চলে যাবে। পুলিশ রেইডের ব্যবস্থা করা হবে।

বুড়া এই কথা বলছে?

জি, জগলু ভাই। তবে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না, আমি টাকা নিয়েই ফিরব।

আমারও সেইরকমই ধারণা।

আমি মনসুর সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন। তার হাত-পা শক্ত। গায়ের কাপুনি এখন আর নেই। আমি বললাম, স্যার, আপনি কি মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন?

না।

বাড়িতে ফিরছেন। আগেভাগে জানলে উনি খুশি হতেন।

মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। একবার বিদ্যুৎ চমকাল। বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম তার চোেখ-মুখ শক্ত। দাঁত দিয়ে তিনি নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন। সমুদ্রবিদ্যার বইয়ে আছে, যে-লোক দাত দিয়ে ঘনঘন ঠোঁট কামড়ায় সে বরাহ প্ৰজাতির মানুষ। সুযোগ পাইলেই সে অন্যের অনিষ্ট করিবার চেষ্টায় থাকে।

আমার তেমন কোনো অনিষ্ট হলো না। টাকাভিরতি সুটকেস নিয়ে আমি সহজভাবেই গেট থেকে বের হয়ে এলাম। মনসুর সাহেবের মেয়েটাকে দেখলাম সুচিত্ৰা-উত্তমের যুগের নায়িকাদের মতো বিরহী-বিরহী চেহারা। গলার স্বর অসম্ভব মিষ্টি। দুই মিনিট তার কথা শুনলে যে-কোনো পুরুষের উচিত ধপাস করে তার প্রেমে পড়ে যাওয়া। তার গলার অস্বাভাবিক মিষ্টির ব্যাপারটা মনে হয় মেয়েটা জানে। কারণ, সে বড়ই স্বল্পভাষী।

আমি বললাম, মিস, টাকা গোনা আছে? না আমি আরেকবার গুনাব? যদি কম থাকে তা হলে দেখা যাবে জগলু ভাই আমার আঙুল অফ করে দিলেন। দশ আঙুল নিয়ে গেলাম, নয়। আঙুল নিয়ে ফিরলাম।

টাকা হিসাবমতো আছে।

মিস, আপনার শরীর ভালো তো? দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে জুর। চোখও সামান্য লাল হয়ে আছে।

আপনার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিষয়ক কথা আমি বলতে চাচ্ছি না।

একটা শুকনা টাওয়েল কি দিতে পারেন? মাথা ভিজে গেছে। চুল শুকাব। পরে একদিন এসে ফেরত দিয়ে যাব।

আপনি যেভাবে এসেছেন সেইভাবে ফেরত যাবেন। এবং এক্ষুনি বিদায় হবেন।

এক কাপ কফি খেয়ে কি যেতে পারি?

না। প্লিজ, লিভ দিস হাউজ।

আপনি কিন্তু বলেছিলেন গরম কফি খাওয়াবেন, স্ন্যাকস খাওয়াবেন।

দয়া করে বিদায় হোন।

রিকশায় উঠেই জগলু ভাইকে টেলিফোন করলাম, ওস্তাদ মাল ডেলিভারি পেয়ে গেছি, এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসব।

জগলু ভাই বললেন, আপাতত তোমার কাছে রাখো, পরে ব্যবস্থা করব।

আমার কাছে কোথায় রাখব? আমার নিজেরই থাকার জায়গা নাই।

একটা ব্যবস্থা করো। এই মুহুর্তে আমাকে এটা নিয়ে যন্ত্রণা করবে না। বিরাট ঝামেলায় পড়ে গেছি।

জগলু ভাই কট করে টেলিফোন লাইন কেটে দিলেন। তিনি যে বিশেষ ধরনের বড় কোনো ঝামেলায় পড়েছেন তা তাঁর গলার স্বরেই বোঝা যাচ্ছে। গলা শেষের দিকে কেঁপে যাচ্ছে।

রিকশাওয়ালা বৃষ্টিতে রিকশা টানছে। সে বেছে বেছে বড় বড় খানাখন্দে রিকশা টেনে নিয়ে প্রায় হুমড়ি খাওয়ার মতো করে পড়ছে। কাজটা করে সে আনন্দ পাচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে। একেকবার পড়ছে। আর দাঁত বের করে বলছে, এইটা দেখি পুশকুনি!

আমি আপাতত বাদলের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আজ রাতটা বাদলের সঙ্গে থাকাই ভালো।

কলিংবেলের প্রথম শব্দেই দরজা খুলে গেল। খোলা দরজায় ক্লিপিং গাউন পরা খালুসাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ঠোঁটে পাইপ।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ