শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। অমর বাবু লোকালয় প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকেন। রূপেশ্বরের পাশের গ্রাম হলদিয়ায় ঘন বন আছে। এখন ঐ বনেই তাঁর আস্তানা। তাঁর মেয়ে অতসী প্রায়ই তাঁকে খুঁজতে আসে। পায় না। মেয়েটা বনে বনে ঘুরে এবং কাঁদে। তিনি চার-পাঁচদিন পর পর একবার বের হয়ে আসেন। তাঁকে দেখে আগের অমর বাবু বলে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন মানুষ না-প্ৰেত বিশেষ। মাথাভর্তি বিরাট চুল, বড় বড় দাড়ি। হাতের নখগুলি বড় হতে হতে পাখির ঠোটের মতো বেঁকে গেছে। স্বভাব-চরিত্র হয়েছে ভয়ংকর। মানুষ দেখলে কামড়াতে আসেন। ইট-পাথর ছুড়েন। একবার স্থানীয় পোস্ট মাস্টারকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিলেন। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অতসীর বিয়ে হয়ে গেছে, সেও এখন আর বাবার খোঁজে আসে না।

 

দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। এগারোটার মতো বাজে। হেড স্যার খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন, হঠাৎ শুনলেন উঠান থেকে অমর বাবু ডাকছেন—স্যার, স্যার-স্যার জেগে আছেন?

কে?

স্যার আমি অমর। একটু বাইরে আসবেন?

হেড স্যার অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, খবরদার, তুমি বেরুতে পারবে না। পাগল মানুষকি না কি করে বসে। ঘুমাও।

অমর বাবু আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন স্যার খুব দরকার। খুব বেশি দরকার।

হেড স্যার ভয়ে ভয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনের আমগাছের সমান উচ্চতায় অমর বাবু ভাসছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। একটা মানুষ অবলীলায় শূন্যে ভাসছে। তার জন্যে পাখিদের মতো তাঁকে ডানা ঝাল্টাতে হচ্ছে না।

স্যার দেখুন আমি ভাসছি।

হেড স্যার জবাব দিতে পারছেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মতো সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন—অমর বাবু শূন্যে ভাসছেন। এই তো ভাসতে ভাসতে খানিকটা এগিয়ে এলেন। সাঁতার কাটার মতো অবস্থায় মানুষটা শুয়ে আছে। কী আশ্চর্য।

স্যার দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আজ হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। বন থেকে বের হয়ে রূপেশ্বরের দিকে। আসছি হঠাৎ শরীরটা হালকা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে দশ-বারো ফুট উঠে গেলাম। প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখিয়ে আসি। ভাসতে ভাসতে আসলাম।

আর কেউ দেখেনি?

না। কয়েকটা কুকুর দেখেছে। ওরা ভয় পেয়ে খুব চিৎকার করছিল। এরকম দেখে তো অভ্যাস নেই। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে স্যার?

হ্যাঁ, হচ্ছে। আমি ঠিক করেছিভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাব।

ও আচ্ছা।

আমার মাথাটা বোধ হয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল সারাক্ষণ ব্যথা করত। এখন ব্যথাও নেই। আগে কাউকে চিনতে পারতাম না। এখন পারছি।

শুনে ভালো লাগছে অমর বাবু।

অন্য একটা কারণেও মনে খুব শান্তি পাচ্ছি। কারণটা বলি—মহাশূন্যে ভাসার রহস্যটাও ধরতে পেরেছি।

হেড মাস্টার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রহস্যটা কী?

রহস্যটা খুব সাধারণ। এতদিন কেন ধরতে পারিনি কে জানে। তবে স্যার আপনাকে রহস্যটা বলব না। বললে আপনি শিখে যাবেন। তখন দেখা যাবে সবাই শূন্যে ভাসছে। এটা ঠিক না। প্রকৃতি তা চায় না। স্যার যাই?

অমর বাবু উপরে উঠতে লাগলেন। অনেক অনেক উঁচুতে। এক সময় তাঁকে কালো বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল।

হেড স্যারের স্ত্রী হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে ভীত গলায় বললেন, কি ব্যাপার? পাগলটা কোথায়?

চলে গেছে।

তুমি বাইরে কেন? ভেতরে এসে ঘুমাও।

তিনি ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন।

অমর বাবুকে এর পর আর কেউ এই অঞ্চলে দেখখনি। হেড স্যার সেই রাত্রির কথা কাউকেই বলেননি। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই পাগল ভাববে। আর একবার পাগল ভাবতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পাগল হতেই হয়—এটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ