০১. কথোপকথন

মানব সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ক্রটি তাদের অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রবণতা। তারা ৬০.৩৭ ভাগ কথাই কারণ ছাড়া বলে।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা, পৃষ্ঠা ২০০৫

সময় সন্ধ্যা ছটা। তারিখ ৯ নভেম্বর সন ৪০০৯।

ভবিষ্যতের পৃথিবী। কথা হচ্ছে কম্পিউটার কেন্দ্রের সঙ্গে নিনিতার ভবিষ্যতের পৃথিবীতে মানুষের কোনো নাম নেই। সবই পিন নাম্বার। গল্প বর্ণনা সুবিধার জন্যে নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।

নিনিতা : হ্যালো। আমার পিন নাম্বার ০০২৮৩৮৪১/০৩৭/২৩৮১।

কম্পিউটার : নিনিতা, কেমন আছেন?

নিনিতা : ভালো।

কম্পিউটার : শুভ সন্ধ্যা।

নিনিতা : শুভ সন্ধ্যা।

কম্পিউটার : আমার প্রতি আপনার আদেশ বলুন।

নিনিতা : আমার স্বামীকে আমি জন্মদিনে একটা উপহার দিতে চাই। কী উপহার দেব বুঝতে পারছি না।

কম্পিউটার : আমাকে দুসেকেন্ড সময় দিলে আমি আপনার স্বামীর প্রোফাইল দেখে নিতে পারি।

নিনিতা : তার পিন নাম্বার কি দেব?

কম্পিউটার; প্রয়োজন নেই। আপনার পিন নাম্বার থেকেই তারটা পাব।

নিনিতা : তা অবশ্য পাওয়া যাবে।

কম্পিউটার : তিনি গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। একা থাকতে পছন্দ করেন। কম্পিউটার গেম The Orion Day তার অতি পছন্দের খেলা। এই খেলার পেছনে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন। নিনিতা, আপনি তাকে The Orion Day খেলার নতুন versionটা দিতে পারেন। পঞ্চাশ ইউনিট খরচ পড়বে। লাইসেন্স ফি দশ ইউনিট।

নিনিতাঃ একটি খেলার যন্ত্রণাতেই আমি অস্থির। দ্বিতীয় খেলা আমি কিনব না।

কম্পিউটার : এইমাত্র আপনার স্বামীর DNA প্রোফাইল আমাদের হাতে এসেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি সুখাদ্য পছন্দ করেন। নতুন একটা ফুড প্রসেসর বাজারে এসেছে। এটা প্রাচীন। পৃথিবীর খাদ্য প্রস্তুতে বিশেষ পারদর্শী। দাম এক হাজার ইউনিট। একটু বেশি। কিন্তু ফুড প্রসেসরটি অসাধারণ।

নিনিতা : আমার যে ফুড প্রসেসর আছে সেটা যথেষ্ট।

কম্পিউটার : আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে আরো কিছু সময় দিন। এই ফাঁকে আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন। তাতে অবশ্য সারপ্রাইজ এলিমেন্ট নষ্ট হবে।

নিনিতা : আমি এই বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না।

কম্পিউটার : আপনার অনুমতি পেলে আমরা কথা বলতে পারি। এমনভাবে কথা বলব যেন তিনি বুঝতে না পারেন এর পেছনে আপনার কোনো ভূমিকা আছে।

নিনিতা :  সেটা কীভাবে বলবেন?

কম্পিউটার : আমরা বলব—কার কী ধরনের উপহার পছন্দ এটা নিয়ে একটি গবেষণা হচ্ছে। আপনি সেই গবেষণার একটি অংশ। আপনি আপনার পছন্দের উপহারের তালিকা বলুন।

 নিনিতা : বুদ্ধি খারাপ না।

কম্পিউটার : ধন্যবাদ। আমরা যথাসময়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

.

এল সি স্ক্রিনের পর্দা নীলাভ হয়ে গেল। নিনিতা ফুড প্রোর দিকে এগিয়ে গেল। রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। নিনিতা ফুড প্রোর বোতাম টিপতেই মিষ্টি গলার স্বর শোনা গেল।

ম্যাডাম, আজ রাতে কি নতুন কিছু তৈরি করব?

 নতুন মানে কী?

Martian সালাদ। এই সালাদ মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীদের অত্যন্ত প্রিয়। এক ধরনের হার্ব ব্যবহার করা হয়, যা শুধু মঙ্গল গ্রহেই জন্মে। আমি অবশ্য Original হার্ব ব্যবহার করব না, সিনথেটিক হার্ব ব্যবহার করব।

সালাদের সঙ্গে আর কী থাকবে?

মেইন ডিশে ভেড়ার মাংসের সঙ্গে স্টিকি রাইসের একটা প্রিপারেশন কি দেব? সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর সাতভাগ মানুষের কাছে এই খাবারটি প্রিয়।

এই খাবারটা দাও। সঙ্গে আরেকটা আইটেম থাকুক।

কী আইটেম দেব?

তোমার ইচ্ছামতো দাও। সারপ্রাইজ আইটেম।

ডেজার্টে কি আইসক্রিম দেব?

না। আইসক্রিম আমাদের দুজনেরই খুব অপছন্দের, তুমি এটা জানো।

জানার পরেও আমি আইসক্রিম দিতে চাচ্ছি, কারণ আজ রাতের মেন্যুর সঙ্গে সবচেয়ে ভালো যাবে আইসক্রিম।

আমি লক্ষ করেছি, তুমি সবসময় তোমার সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দাও। আমি স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারি না।

ম্যাডাম, এর প্রধান কারণ, আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জন্মদিনে কী উপহার দেবেন এই সিদ্ধান্ত পর্যন্ত আপনি নিতে পারছেন না। আপনাকে মূল কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে।

তুমি কীভাবে জানলে?

 ম্যাডাম, কেন জানব না? আমি মূল কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত।

সরি, ভুলে গিয়েছিলাম।

জন্মদিনের উপহার বিষয়ে আমি কি কোনো উপদেশ দিতে পারি?

না। তোমার কাজ রান্না করা। উপদেশ দেয়া না।

জন্মদিনে বিশেষ কী খাবার রান্না হবে এই বিষয়ে কি কিছু ভেবেছেন?

না।

আমি কি ভাবব?

না। তোমাকেও ভাবতে হবে না। যথাসময়ে আমি সিদ্ধান্ত নেব।

ম্যাডাম, রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে।

গুড।

আপনি স্যারকে ডেকে নিয়ে আসুন। যদিও স্যার এখন খুব আগ্রহ নিয়ে নিউজ চ্যানেল দেখছেন। চট করে তাকে খাবার টেবিলে আনা যাবে না। আমি ইচ্ছা করলে নিউজ চ্যানেল আমার স্ক্রিনে নিয়ে আসতে পারি। স্যার খেতে খেতে নিউজ দেখতে পারবেন। তবে নতুন বিধিমালায় তা সম্ভব না। খাবার খেতে হবে উত্তেজনাবিহীন পরিবেশে। সেখানে হালকা মিউজিক চলতে পারে। আর কিছু না।

তুমি কথা বেশি বলে।

ম্যাডাম, আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে বেশি কথা বলার জন্যে। আপনারা দুজন মাত্র মানুষ। দুজন দুজনের কথাই শুধু শোনেন। এতে বিরক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়। টেনশন তৈরি হয়। দুজনার মাঝখানে আমার কথা ফিলারের মতো আসে। এতে টেনশন কমে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে,..

প্লিজ স্টপ।

ফুড প্রো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলার মতো শব্দ করল। নিনিতা তার স্বামীর ঘরের দিকে রওনা হলো। নিনিতার স্বামীর একটি নাম দেয়া যাক। ধরা যাক তার নাম কুন। পিন নাম্বার ব্যবহার করে গল্প চলিয়ে নেয়া কঠিন। যদিও ভবিষ্যতের পৃথিবীর কাছে মানুষের পরিচয় হিসেবে PIN নাম্বারের বিকল্প নেই। পিন নাম্বারে একজন মানুষের সকল তথ্য থাকে। নিনিতার পিন নাম্বার দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক। নিনিতার পিন নাম্বার

০০২৮৩৮৪১/০৩৭/২৩৮১

প্রথম ডিজিট o বলছে সে একজন মেয়ে। পুরুষ হলে প্রথম ডিজিট হতো ১। পরের পাঁচটি ডিজিট বলছে তার DNA code. যা হলো ০২৮৩৮। তারপরের ডিজিট তার বয়স বলছে। নিনিতার বয়স ৪১। এই সংখ্যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলাবে। অবলিকের পরে আছে ০৩৭, এর মধ্যেই নিনিতার পেশা এবং মেডিকেল প্রোফাইল বলা হচ্ছে। সর্বশেষ চারটি ডিজিট হচ্ছে ২৩৮১, এটি সরকার থেকে দেয়া সংখ্যা যার অর্থ শুধু সরকার (সরকার অর্থ হলো মূল কম্পিউটার সিডিসি) জানবে। তবে সর্বশেষ ডিজিটটির অর্থ পরিষ্কার। সর্বশেষ ডিজিট ১-এর অর্থ এই তরুণীকে সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স দেয়া হয় নি। যেসব তরুণীর সর্বশেষ ডিজিট ২, তারা সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স পেয়েছে। পৃথিবীর মাত্র ০.০০৩ ভাগ তরুণী এই লাইসেন্স পায়। কারা লাইসেন্স পাবে তা ঠিক করা হয় লটারির মাধ্যমে। এই লটারি প্রতি চার বছর পর একবার করা হয়। লটারির দিন পৃথিবীতে ছুটি থাকে। কারণ ঐ দিনটি মহাউৎসবের একটি দিন।

কুনের কাছে ফিরে আসি। সে গ্যালাক্সি নিউজ দেখছে। গ্যালাক্সিতে বিশেষ বিশেষ ঘটনার ফুটেজ দেখানো হচ্ছে। তাৎক্ষণিক নিউজ না। গ্যালাক্সির যে অংশ এক লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে, পৃথিবীতে তার আলো আসতে এক লক্ষ বছর লাগবে। তাদের ভিডিও ফুটেজ হবে এক লক্ষ বছরের পুরনো।

ওরিয়ন নক্ষত্রের একটি গ্রহকে দেখানো হচ্ছে। তাদের বুদ্ধিমান প্রাণীদের নিয়ে প্রতিবেদন। নিনিতা এসে কুনের রিভলভিং চেয়ারে হাত রাখল। কুন টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, এই গ্রহের প্রাণীগুলি দেখ। Humanoid, অবিকল মানুষের মতো, শুধু চারটা করে হাত। কী সুন্দর দেখতে, তাই না?

নিনিতা বলল, দেখতে কুৎসিত মাকড়শার মতো লাগছে।

কুন বলল, মোটেই মাকড়শার মতো লাগছে না। দেখ কী গ্রেসফুল। ইভোলিউশনে ওরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে। চারটা হাত ওদেরকে এগিয়ে দিয়েছে।

নিনিতা বলল, খেতে আস।

 কুন বলল, অজি রাতের মেনু কী?

জানি না। হাবিজাবি কী সব যেন বানিয়েছে। তোমার কি বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?

হুঁ। করছে।

কী খেতে ইচ্ছা করছে বলো, আমি ফুড প্রো-কে বলে ব্যবস্থা করি।

ও ব্যবস্থা করতে পারবে না। শুধু তুমি পারবে।

নিনিতা অবাক হয়ে বলল, আমি কীভাবে পারব?

কুন বলল, তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। অমির চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। খাবার হিসেবে চুমু অসাধারণ।

নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, মাঝে মাঝে আমাকে খুশি করার জন্যে তুমি কিছু কাণ্ডকারখানা কর। আমি খুশি হই না। বিরক্ত হই। এসো, খেতে আসি।

ফুড প্রো টেবিল সাজিয়েছে। দুটি প্লেটে ন্যাপকিন কাটা চামচ। প্লেটের পাশে ষাট মিলিলিটার করে ক্যাম্পিয়ান রেড ওয়াইন। আলাদা সালাদের বাটি। মেইন কোর্স, ডেজার্ট ক্যান্ডেল লাইটের ব্যবস্থা আছে। মোমবাতি জ্বলছে। খাবার শেষ হওয়া মাত্র সব চলে যাবে ফুড প্রোর ওয়েস্ট ডিসপোজালে। সবই অ্যাটমিক স্পশারে নষ্ট করে ফেলা হবে। আবার নতুন করে তৈরি হবে।

সালাদ মুখে দিয়ে কুন বলল, অসাধারণ।

নিনিতা বলল, অসাধারণ বললে কেন? তিতকুটে একটা জিনিস। আঠালো। নাকে ঝাঁঝ লাগছে।

কুন বলল, মজা তো এখানেই। তুমি না খেলে তোমার সালাদের বাটিটা এগিয়ে দাও।

নিনিতা সালাদের বাটি ঠেলে দিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল, ফুড প্রো তোমার পছন্দের দিকে খেয়াল রেখে খাবার তৈরি করে। আমার পছন্দ সে হিসেবে ধরে না।

ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম, কথাটা ঠিক না। আপনার মেজাজ কোনো কারণে খারাপ বলে আপনি খেয়ে আনন্দ পাচ্ছেন না।

নিনিতা বলল, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে তুমি কথা বলছ কেন?

সরি। আপনাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কথা বলব না। আপনাদের ডিনার আনন্দময় হোক।

খাওয়া শেষ হবার পরেও কোনো কথা বলবে না।

সফট কোনো মিউজিক কি দেব ম্যাডাম?

নিনিতা জবাব দিল না। হালকা বাজনা শুরু হলো। মোমবাতির শিখা বাজনার সঙ্গে যুক্ত। শিখা তালে তালে কাঁপছে। মাঝে মাঝে বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে। এদিক ওদিক দুলছে। অপূর্ব আলোক নৃত্য।

কুন বলল, কম্পিউটার সেন্টার থেকে আমাকে টেলিফোন করেছিল। জানতে চাচ্ছিল আমার পছন্দের উপহার কী? তারা কী একটা গবেষণা না-কি করছে।

তুমি পছন্দের উপহারের তালিকায় কী কী নাম দিয়েছ?

আমার একটাই পছন্দ। তার নাম দিয়েছি। ক্র্যাব ন্যাধুলার পঞ্চম গ্রহের পশু রিরি।

পাগল না-কি? একটা রিরির দাম কত তুমি জানো?

জানি। দুই মিলিয়ন ক্রেডিট। ওরা আমার কাছ থেকে পছন্দের তালিকা চেয়েছে। দামের কথা জিজ্ঞেস করে নি। তোমার পছন্দ কী বলো তো?

নিনিতা বলল, আমার আর যাই পছন্দ হোক রিরি পছন্দ না।

ফুড প্রো অবাক গলায় বলল, ম্যাডাম, রিরি কেন পছন্দ করবেন না? রিরি একমাত্র পশু যে সব পশুর ভাষা বুঝে সেই ভাষায় কথা বলতে পারে।

নিনিতা বলল, আমার ভাষাবিদ পণ্ডিতের কোনো প্রয়োজন নেই। তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের কথার মধ্যে নাক গলাচ্ছ কেন?

ফুড প্রো বলল, হঠাৎ রিরির প্রসঙ্গ উঠল তো। নিজেকে সামলাতে পারলাম। পেট (Pet) রাখার অনুমতি আমাকে দেয়া হলে আমি একটা রিরি পুষতাম। তাকে নানান ধরনের খাবার বানিয়ে খাওয়াতাম।

অনেক কথা বলে ফেলেছ। আর না।

আপনাদের খাবার কি শেষ? টেবিল সরিয়ে ফেলব।

 হ্যাঁ।

নিনিতা এবং কুন সরে দাঁড়াল। খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর খাবার ঘর গোছানোর দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে! এই দৃশ্য অসংখ্যবার দেখা, তারপরেও মনে হয় প্রথমবার দেখা হচ্ছে।

ফুড প্রোর ময়লা নিষ্কাশন প্যানেল খুলে গেল। সেখান থেকে দু’টা হাত বের হয়ে টেবিলের ওপর থেকে থালাবাসন, মোমবাতি, অবশিষ্ট খাবার টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। খটখট শব্দ হচ্ছে। চেয়ার এবং টেবিল ভাজ হচ্ছে। এখন চেয়ার টেবিল ঢুকে যাচ্ছে সার্ভারের ভেতর। ভ্যাক কাজ করতে শুরু করছে। ভ্যাক চেয়ার-টেবিলের নিচের জায়গাটা নিমিষে ঝকঝকে করে ফেলবে। তারপর সেখানেই পাতা হবে ঘুমানোর আরামদায়ক বিছানা। লোবিড় সুপার পাউডার ভর্তি তোষক, চাদর এবং বালিশ চলে আসবে। যে বিছানায় শোবে তার শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে লোবিড সুপার পাউডার তার তাপমাত্রা বদলাতে থাকবে।

নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঘুমাবে কখন?

বুঝতে পারছি না। ঘুম পাচ্ছে না। পে চ্যানেলে কিছু দেখবে?

অযথা ক্রেডিট নষ্ট করে লাভ আছে?

কুন বলল, ঘরের ভেতর কেন জানি দমবন্ধ হয়ে আসছে।

নিনিতা বলল, রাস্তায় হাঁটতে যাবে?

কুন বলল, রাস্তায় বের হলেও তো একশ ক্রেডিট করে লাগবে।

ফুড প্রো বলল, আজ রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে বের হলে ক্রেডিট খরচ করতে হবে না।

নিনিতা বলল, না কেন?

আপনাদের দুজনের কারোরই মনে নেই–আজ সেই বিশেষ রাত। আজ রাত বারোটায় ভাগ্যবান তরুণীদের তালিকা ঘোষণা করা হবে। যারা সন্তান নিতে পারার লাইসেন্স পাবেন।

নিনিতা শুকনো গলায় বলল, ও আচ্ছা।

এই বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। কারণ তার বয়স একচল্লিশ। সন্তান নেবার লাইসেন্স চল্লিশের পরের কোনো মহিলাকেই দেয়া হয় না।

নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, চল বের হই। বিনা ক্রেডিটে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।

কুন বলল, এখন কেন জানি বের হতে ইচ্ছা করছে না।

ফুড প্রো বলল, সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না স্যার। আজ বাইরের আবহাওয়া অত্যন্ত আরামদায়ক। তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাস। বইছে। চেরীগাছে ফুল ফুটেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কনসার্ট হচ্ছে।

নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, এই খবরগুলি আগে কেন বলো নি?

বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন বলে বলি নি। তাছাড়া আপনারা দুজনের কেউই বাইরে যাবার বিষয়ে কখনো আগ্রহী না।

নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, যাবে?

কুন হতাশ গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।

ফুড প্রো বলল, ফিফথ রোডের মোড়ে মহান শিল্পী আহান গান করবেন। তাঁর বিখ্যাত চন্দ্রগীতি। এই সুযোগ হারানো ঠিক হবে না।

নিনিতা বলল, চন্দ্রগীতি আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হয়।

কুন বলল, ফালতু মনে হলেও চন্দ্রগীতি শোনার সময় তুমি কেঁদে বুক ভাসাও। চল যাওয়া যাক।

.

ফিফথ রোড লোকে লোকারণ্য। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ফিসফিস করেও কেউ কিছু বলছে না। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে চেরীগাছের পাতা নড়ছে। সেই শব্দ দূরাগত সঙ্গীতের মতো কানে বাজছে।

মহান শিল্পী আহানের জন্যে ছোট্ট একটা স্টেজ করা হয়েছে। চন্দ্ৰবৃক্ষের গোল চত্ত্বরের মাঝখানে রিটো-পলিমারের তৈরি স্টেজ। মনে হয় পাথরের বেদি। যেখান থেকে নরম আলো বের হচ্ছে। স্টেজের নাম আহান বেদি। এই বেদিতে তিনি ছাড়া কেউ গান করেন না। শহরে চন্দ্ৰবৃক্ষের তিনটি গাছ শুধু এখানেই আছে। যদিও বলা হয় চন্দ্ৰবৃক্ষ, কিন্তু এই বৃক্ষ বৃহস্পতির চাঁদ টিটান থেকে আনা। বৃক্ষের ফসিল থেকে জেনেটিক পদ্ধতিতে নতুন জীবন দান করে। পাতাশূন্য এই বৃক্ষ একসময় তার ডালপালা ছড়িয়ে দেয়, যার রঙ গাঢ় নীল। আহান দলবল নিয়ে গান করেন না। একা গান করেন। ছোট্ট স্টেজ তার জন্যে যথেষ্ট। গানের মাঝে মাঝে তিনি শিস দেন। বলা হয়ে থাকে, আহানের শিসের সুরের জন্ম এই পৃথিবীতে না। অন্য কোনো সুরলোকে, যার সন্ধান মানুষ এখনো। পায় নি।

নিনিতা স্বামীকে নিয়ে এগুচ্ছে। কুন বলল, আর কাছে যাবার দরকার কী? এখান থেকে উনাকে পরিষ্কার দেখা যাবে।

নিনিতা ফিসফিস করে বলল, এত শব্দ করে কথা বলছ কেন?

সরি।

তারা বড় একটা চেরীগাছের নিচে দাঁড়াল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহান শিল্পী আহান স্টেজে ঢুকলেন। স্টেজের মাঝখানে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সম্মান প্রদর্শন করলেন।

বেদির আলো এসে পড়েছে তার চোখেমুখে। কী সুন্দরই না লাগছে দেখতে। বালক বালক চেহারার একজন মানুষ। বড় বড় চোখ। সেই চোখের দৃষ্টিতে গভীর দুঃখবোধ। যেন তিনি কিছুক্ষণ আগেই তার অতি প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। যার সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হবে না।

আহান নতজানু হবার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা সবাই নতজানু হয়েছিল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দর্শকরাও উঠে দাঁড়াল। কুন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জানো অনেকের ধারণা আহান এই গ্রহের মানুষ না? অন্য গ্রহের।

নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, অতি বিখ্যাতদের নিয়ে নানান গল্প প্রচলিত থাকে।

কুন বলল, তাও ঠিক।

আহান কথা বলা শুরু করেছেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট এবং সুরেলা। নিনিতার মনে হলো এই মানুষটা গান না করে শুধু যদি কথা বলেন, তাও মানুষ ঘণ্টার পর ঘন্টা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনবে।

আজ রাত অতি আনন্দের রাত। কিছু মা সন্তান ধারণের লাইসেন্স পাবেন। আহা, তাদের হৃদয়ে আজ কত না আনন্দ। আমি এক অতি অভাজন আহান। তাদের আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছে। আমার চোখও তাদের আনন্দে সিক্ত।

আহান চোখ মুছলেন। দর্শকদের বেশিরভাগ চোখ মুছল। আহানের কথা শুনে তাদের চোখও ভিজে উঠেছে।

আহান বললেন, আজকের চন্দ্রগীতি ভাগ্যবতী মায়েদের উদ্দেশে নিবেদিত।

সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু হলো—

(চন্দ্রগীতি)

হে চন্দ্র! আজ রাতে তোমাকে বিদায়।
আলো নেই অন্ধকার।
 চন্দ্ৰবৃক্ষে হাহাকার।
অশ্রুর কারাগার।
আমরা কাঁদিতেছি গভীর মায়ায়
হে চন্দ্র! আজ রাতে তোমাকে বিদায়।

গানের প্রথম অন্তরা শেষ হয়েছে, আহান শিস দিতে সুর করেছেন। সুরের ওঠানামায় সবার মনে হচ্ছে, গভীর বিষাদের সমুদ্রে সবাই ভাসছে। বিষাদ আরো তীব্র হবে। একসময় সবাই ডুবে যাবে বিষাদ সমুদ্রে।

নিনিতা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কুন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছে। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।

রাত বারোটা পার করে নিনিতা ঘরে ফিরল। ঘরে কফির গন্ধ। ফুড প্রো আগেভাগেই কফি বানিয়ে রেখেছে। ফুড প্রো আগেভাগে কিছু কাজ করে, যা নিনিতার পছন্দ না। অথচ তার কফি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। নিনিতা বলল, কফি নষ্ট করে দাও। কফি খাবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।

ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম, শ্যাম্পেনের একটা বোতল কি খুলব?

নিনিতা বলল, শুধু শুধু শ্যাম্পেনের বোতল কেন খুলবে?

ফুড প্রো বলল, ন্যাশনাল ইনফরমেশন সার্ভিস জানিয়েছে আপনি সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স পেয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। টেলিভিশন চালু করুন। সুরের মহান জাদুকর আহান প্রতিটি লাইসেন্স পাওয়া মাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। নতুন সব কে তিনি চন্দ্রমাতা সম্বোধন করছেন।

নিনিতা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সবকিছু দুলছে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে। শরীর ঘামছে। নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, টিভি চালু করছ না কেন?

কুন ছুটে গিয়ে টিভি চালু করল। পর্দায় আহানের আনন্দময় মুখ। তিনি বললেন, চন্দ্রমাতা, তোমাকে অভিনন্দন। তোমার কোল আলো করে যে চন্দ্ৰশিশু আসছে তাকেও অভিনন্দন।

কুন ফুড প্রোর দিকে তাকিয়ে বলল, এই গাধা! শ্যাম্পেনের বোতল খুলছ না কেন?

ফুড প্রো শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে খুলতে বলল, গাধা নামক প্রাণী পৃথিবী থেকে কত আগে extinct হয়ে গেছে, অথচ তাকে জড়িয়ে গালিটা রয়ে গেছে। এটা অবশ্যই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।

নিনিতা বলল, আমাকে শুইয়ে দাও। আমি এই আনন্দ নিতে পারছি না।

ফুড প্রো বলল, শুয়ে শুয়ে শ্যাম্পেন কীভাবে খাবেন ম্যাডাম?

নিনিতা বলল, সেটা আমার বিষয়। গাধার গাধা!

টিভি পর্দায় টুনটুন ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে। এর মানে সরকারি জরুরি নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। নিনিতা তাকালো।

হবু মা’দের প্রতি নির্দেশমালা

একের পর এক নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। নির্দেশগুলির দিকে তাকিয়ে থাকাও আনন্দের ব্যাপার। নিনিতার চোখে একটু পরপর পানি এসে যাচ্ছে। সে নির্দেশ ঠিকমতো পড়তে পারছে না।

চন্দ্রমাতাদের প্রতি নির্দেশ
ক) নিজের পছন্দের সব খাবার এখন থেকে বন্ধ। আপনাকে যে খাবার খেতে দেয়া হবে তাই খাবেন।
খ) নিউজ চ্যানেলে ভিন গ্রহের প্রাণীদের নিয়ে অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ। প্রাণীদের অবয়ব এবং আচার-ব্যবহার চন্দ্রমাতাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে।
গ) পৃথিবীতে উৎপন্ন হয় না এমন সব খাদ্য যেমন Martian salad খাওয়া নিষিদ্ধ।
ঘ) ভূগর্ভের দ্বিতীয় স্তরে চলে যেতে হবে। মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এই ব্যবস্থা।

নিনিতা চন্দ্রমাতাদের প্রতি নির্দেশ পড়ছে না। সে বিছানায় বসে আছে। দুই হাতে তার মুখ ঢাকা। সে কেঁদেই যাচ্ছে। ফুড প্রো বলল, আপনার আনন্দ দেখে এত ভালো লাগছে! রোবটদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকলে আমি একটা সন্তান নিতাম। তাঁর নাম দিতাম সুশীন। সুশান নামটা কেমন?

চুপ কর।

না, আমি চুপ করব না। আপনি যেমন আনন্দ করছেন আমিও আনন্দ করছি। আজ আমি মানুষদের মতো বেশি কথা বলব। আপনি কান্না না থামানো পর্যন্ত বকবক করতেই থাকব।

নিনিতা বলল, কুন কোথায়? সে কী করছে?

ফুড প্রো বলল, হা করে পর্দায় চন্দ্রমাতাদের নির্দেশ পড়ছে। আপনার এখন উচিত স্বামীর কাছে যাওয়া। তার কোমর জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নাচানাচি করা। আমি নাচের একটা প্রাচীন মিউজিক দিচ্ছি। এই মিউজিক প্রাচীন পৃথিবীর একজন মহান সুরকার কম্পোজ করেছিলেন। তার নাম মোৎসার্ট। দেব?

না। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।

 মানব সম্প্রদায়ের স্বভাবের মধ্যে একা থাকার বিষয়টি নেই। সে একা থাকতে পছন্দ করে না। যখন সে বাধ্য হয়ে একা থাকে, তখনো তার কল্পনায় থাকে অনেক মানুষ।

বেশি জ্ঞানী হয়ো না। চুপ করে থাক।

আমি তো আগেই বলেছি, আজ আমি চুপ করে থাকব না। আপনার আনন্দে আমার অংশ আছে। এখন আমি মোসার্টের অতি বিখ্যাত অপেরা সঙ্গীত দিচ্ছি।

মোৎসার্ট বাজতে শুরু করেছে। নিনিতা বিছানা ছেড়ে নামল। কুনের পেছনে এসে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, এসো কিছুক্ষণ নাচি।

কুন বলল, চন্দ্রমাতাকে চুমু খাওয়া হয় নি।

নিনিতা হাসছে। কিন্তু তার চোখভর্তি পানি। এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকাতে বলা আছে—মানব সম্প্রদায় নানান বিপরীতমুখী স্বভাবের মিশ্রণ। তারা দুঃখে অশ্রু বর্ষণ করে। আনন্দেও অশ্রু বর্ষণ করে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ