মুনির গত তিন দিন ধরে অফিসে আসছে না। আজ এক তারিখ। বেতনের ডেট। যারা অসুস্থ, তারাও এই দিনে উপস্থিত থাকে—বেতন নিয়ে চলে যায়। মুনির আজও এল না।

নিজাম সাহেব সত্যি-সত্যি চিন্তিত বোধ করলেন। আজ অফিসে আসবার পথে বিনু বলেছে, বাবা, ওঁকে নিয়ে আসবে? মুনির সাহেবকে।

তিনি হাঁ-সূচক মাথা নেড়েছেন। বাসায় মুনিরকে আনার তাঁর কোনো ইচ্ছে নেই, কিন্তু খোঁজ নিশ্চয়ই নেয়া যেতে পারে এবং নেয়া উচিতও। ছেলেটিকে তিনি সত্যি-সত্যি পছন্দ করেন।

অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে, তিনি সন্ধ্যার আগে আগে মুনিরের ঘরের দরজায় উঁকি দিলেন।

তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। একটা মরা মানুষ যেন বিছানায় পড়ে আছে। বড়বড় করে শ্বাস নিচ্ছে।

তোমার কী হয়েছে?

শরীরটা খুব খারাপ। রাতে-দিনে কখনো ঘুমাতে পারি না। ক্রমাগত নানান জায়গায় যাই!

তোমার কথা বুঝলাম না। নানান জায়গায় যাও মানে? কোথায় যাও?

না, যাই না কোথাও। শুয়ে থাকি।

নিজাম সাহেব গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। অনেক জ্বর।

ডাক্তার দেখিয়েছ?

জ্বি না। ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।

কী করে বুঝলে ডাক্তার কিছু করতে পারবে না?

আমি জানি।

পাগলের মতো কথা বলবে না। তুমি সবজান্তা নাকি?

জ্বি, আমি সব কিছুই জানি।

নিজাম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কী অদ্ভুত কথাবার্তা! সত্যি সত্যি কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে! গায়ে আধময়লা একটা কাঁথা। ঘরে আলো নেই। অল্প যা আলো আসছে, তাতে মুনিরের মুখ অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে লাগছে। কিন্তু চোখ দুটি উজ্জ্বল চকচক করছে।

বিনু কেমন আছে?

ভালো আছে।

ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। নিজাম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই ছেলে এসব কী বলছে। বিনুকে তার দেখতে ইচ্ছে করবে কেন?

ও আমার সঙ্গে শুধু কষ্টই করেছে। বেশির ভাগ সময়ই ওকে আমি কষ্ট দিয়েছি। এতে আমার মন-খারাপ লাগে। আমি শুধু কাঁদি। ওকে আপনি বলবেন।

তুমি এসব কী বলছ?

জ্বি?

এসব কী কথাবার্তা তুমি বলছ?

আমার ভুল হয়েছে। আর বলব না।

তুমি এক দিন মাত্র গিয়েছ আমার বাসায়। বিনুর সঙ্গে তোমার কোনো পরিচয় থাকার কথা নয়।

জ্বি-না। আমার সব কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেছে। জট পাকিয়ে গেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।

না না, ঠিক আছে! ডাক্তার দেখানো দরকার। অবহেলা করা ঠিক হবে না। চল আমার সঙ্গে।

কোথায়?

তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

জ্বি আচ্ছা। বিনুকে আপনি কি দয়া করে একটা কথা বলতে পারবেন?

কী কথা?

বলবেন যে, তার ধারণা ঠিক নয়। আমি তার ওপর কোনো অবিচার করি নি।

আমি বলব। তুমি ঘুমাবার চেষ্টা কর।

জ্বি আচ্ছা।

মুনির সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর গাঢ় ঘুম। নিজাম সাহেব দীর্ঘ সময় তার পাশে রইলেন। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে এলেন। তারা এক জন ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার বলেছে।–প্রেসার বেশি হই। কমপ্লিট রেস্ট নিতে হবে। নিজাম সাহেব এক জন ডাক্তার নিয়ে এলেন। সেই ডাক্তার অনেক ডাকাডাকি করেও মুনিরের ঘুম ভাঙাতে পারলেন না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করলে জ্বি বলে সাড়া দেয়, তারপর আর কোনো উত্তর করে না। ডাক্তার সাহেব বললেন, ইনি কি আপনার আত্মীয়?

জ্বি না। তবে আত্মীয়ের মতোই। ছেলেটিকে খুব স্নেহ করি। আমার অফিসেই কাজ করে।

ড্রাগস খায় কি না জানেন?

আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।

চোখের মণি খুব ছোট। আলো ফেললেও তেমন রেসপন্স করছে না। ড্রাগ এডিক্টদের এরকম হয়। ড্রাগস নেয় কি না আপনি জানেন না?

জ্বি-না।

মনে হচ্ছে নেয়। ড্রাগসটা অসম্ভব বেড়ে গেছে। এটা খুব অল্প দিনেই বিরাট সামাজিক সমস্যা হিসেবে আসবে। আপনি বরং একে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিন। দেরি করবেন না। হাসপাতালে চেনা-জানা কেউ আছে?

জ্বি-না।

হাসপাতালে ভর্তি করাটাও তো তাহলে এক সমস্যা হবে।

নিজাম সাহেব অসাধ্য সাধন করলেন। রাত নটার মধ্যে মুনিরকে হাসপাতালে তুর্তি করিয়ে ফেললেন। এক জন অল্পবয়স্ক ডাক্তারের হাত ধরে সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেললেন।

একটু দেখবেন ভাই। ছেলেটার কেউ নেই।

দেখব, নিশ্চয়ই দেখব।

খুবই দরিদ্র ছেলে।

ধনীর যে-চিকিৎসা হবে, দরিদ্রেরও সেই একই চিকিৎসা হবে।

ভাই, তা তো হয় না।

হয়। আপনারা জানেন না। আমরা ইন্টানি ডাক্তার হাসপাতাল আমরাই চালাই। ধনী-দরিদ্র নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। যখন বয়স্ক হব, প্রফেসর-ট্রফেসর হব, তখন হয়তো ঘামাব! এখনো আদর্শ বলে একটা ব্যাপার সামনে আছে।

নিজাম সাহেব ডাক্তার ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন।

বাড়ি ফিরতে-ফিরতে তাঁর এগারটা বেজে গেল। উদ্বিগ্ন মুখে বিনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তার বাবা কখনো এত দেরি করেন না! আজ কোন করছেন? অ্যাকসিডেন্ট হয়। নি তো? বারবার বিনুর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। বাবাকে দেখে সে সত্যি-সত্যি কেঁদে ফেলল, কোথায় ছিলে তুমি?

মুনিরের খোঁজে গিয়েছিলাম।

আমি এদিকে ভয়ে অস্থির। ওঁকে পেয়েছিলে?

নিজাম সাহেব ইতস্তত করে বললেন, না।

বিনু দীর্ঘ সময় বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল, মিথ্যা কথা বলছ কেন বাবা?

নিজাম সাহেব মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

বাবা, উনি কি অসুস্থ?

হ্যাঁ।

কোথায় আছেন?

হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছি।

কী অসুখ?

বুঝতে পারছি না। কী সব আবোল-তাবোল কথা বলছে।

আমার এখানে যখন এসেছিলেন, তখনো আবোল-তাবোল কথা বলেছিলেন। আমি খুব রাগ করেছিলাম। i

নিজাম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এখানে এসেছিল নাকি?

হ্যাঁ।

কই, তুই তো আমাকে বলিস নি?

উনি যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন, এটাও তো তুমি আমাকে বল নি।

নিজাম সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কী বলবেন, বুঝতে পারলেন না।

বাবা।

কি?

তুমি আমাকে একবার ওঁর কাছে নিয়ে যাবে?

নিজাম সাহেব চুপ করে রইলেন। বিনু বলল, আমি তাঁকে খুব কড়া-কড়া কথা বলেছি। আমার খারাপ লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে এস, ভাত দিচ্ছি।

নিজাম সাহেব ক্ষুধার্ত ছিলেন। কিন্তু কোনো খাবারই মুখে রুচল না। বারবার মনে হতে লাগল, বিনুর বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না তো? সে শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসবে না তো? গায়ে-হলুদের আর মাত্র পাঁচ দিন আছে। আত্মীয়স্বজনরা আসতে শুরু করবে। একটা কেলেঙ্কারি হবে না তো?

সারা রাত বিনু এক ফোঁটা ঘুমুতে পারল না। বারান্দায় মোড়া পেতে বসে রইল। তার কাছে সব কিছুই কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে একটা জটিল রহস্যের আবর্তে সে পড়ে গেছে, এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। বারান্দা অন্ধকার। অনেক দূরে একটা স্ট্রীটল্যাম্প জ্বলছে। তার আলো যেন চারপাশের অন্ধকারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ