বিনু বলল, বাবা, তুমি ঐ ভদ্রলোককে আর তো আনলে না।

নিজাম সাহেব বললেন, মুনিরের কথা বলছিস?

হ্যাঁ। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় না?

হবে না কেন? রোজই তো হচ্ছে।

আজ একবার তাঁকে নিয়ে আসতে পারবে?

কেন?

একটা দরকার আছে বাবা।

কি দরকার?

আছে একটা দরকার। তুমি অবশ্যি আজ তাঁকে সঙ্গে করে আনবে।

রাতে খেতে বলব?

হুঁ, বলতে পার।

বিনুর ভাবভঙ্গি নিজাম সাহেব ঠিক বুঝতে পারলেন না। ক দিন আগেই সে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করেছে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে—আগে বিনু তাঁর ঘরে এল। মশারি গুঁজে দিল। বাতাস যাতে ঢুকতে পারে সে জন্যে জানালার পর্দা উঠিয়ে দিল। নিজাম সাহেব বললেন, কিছু বলবি?

না বাবা, কিছু বলব না।

তোকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাস।

না, চাই না। তুমি যদি কিছু বলতে চাও, বল। আমি শুনব।

আমি আবার কী বলব? ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে।

তাহলে ঘুমাও। বাতি নিভিয়ে দিই?

দে।

বিনু বাতি নিভিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই সে মৃদু স্বরে বলল, আমার যে বিয়ে তুমি ঠিক করেছ, ওতে আমার মত নেই। বিয়ে ভেঙে দাও!

কি বললি?

বিনু উত্তর দেবার জন্যে দাঁড়াল না, ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে এল। নিজাম সাহেব পেছনে-পেছনে উঠে এলেন। বিনু ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। তিনি বেশ ক বার ডাকলেন। বিনু সাড়া দিল না।

ভোরবেলায় তিনি বিনুকে খুব স্বাভাবিক দেখলেন। যেন কিছুই হয় নি। আগের মতো হাসিখুশি। তাঁর বুক থেকে পাথর নেমে গেল। তাঁর মনে হল বিনুযা করেছে, তা সাময়িক অস্থিরতার কারণে। অস্থিরতা কেটে গেছে।

বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বরপক্ষীয় লোকজন বিয়ের কার্ড ছাপাতে দিয়েছে। এ সময় নতুন কোনো ঝামেলা সৃষ্টি না-হলেই ভালো। বিনু তেমন ময়ে নয়। অবুঝের মতো কিছু করবে বলে মনে হয় না। তবু নিজাম সাহেবের ভয় না। চমৎকার ছেলে পাওয়া গেছে। ডাক্তার স্বভাব-চরিত্র ভালো।–নাম-ভদ্র ছেলে। এই বিয়ে ভেঙে গেলে এ-রকম আরেকটি ছেলে পাওয়া মুশকিল হবে।

সন্ধ্যাবেল নিজাম সাহেব এক-একা ফিরলেন। বিনু কিছু বলল না। নিজাম সাহেব জামা খুলতে-খুলতে নিজ থেকেই বললেন, মুনির আজ আসেনিরে মা! দেখি, আগামীকাল যদি আসে, নিয়ে আসব।

বিনুচুপ করে রইল। রাতে খেতে বসে নিজাম সাহেব দেখলেন, অনেক আয়োজন। তিনি শুধু মাছ কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে মুরগিও আছে।

মুরগি কোথায় পেলি রে?

আকবরের মাকে দিয়ে আনিয়েছি।

ও এসেছে নাকি?

হুঁ।

যাক, ভালো হয়েছে, এখন আর এক-একা থাকতে হবে না।

হ্যাঁ, ভালোই হয়েছে।

অবশ্যি কয়েকটা দিন। তোর খালারাও তো চলে আসবে। বিয়েশাদির ব্যাপার, ওদেরই তো এখন দায়িত্ব।

কথাটা বলে নিজাম সাহেব আড়চোখে তাকালেন। মেয়ের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলেন। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল না।

তুইও বসে যা। একসঙ্গে খাই।

আমার খিদে নেই বাবা, তুমি খাও।

খিদে নেই কেন? শরীর খারাপ নাকি?

না, শরীর ঠিকই আছে।

রাতে বিনু বাবার মশারি খাটাতে এসে শান্ত গলায় বলল, কাল যদি ঐ ভদ্রলোক আসেন, তাহলে তাকে মনে করে নিয়ে এসো।

নিজাম সাহেব বিস্ময় গোপন করে বললেন,  কোনো দরকার আছে?

না, এম্নি।

আচ্ছা, বলব। পরদিনও মুনির অফিসে এল না। নিজাম সাহেব এক-একা ফিরলেন। বিনু বলল, উনি আজও অফিসে আসেন নি, তাই না?

হুঁ, তাই।

ওরা ঠিকানা জানা আছে?

না।

বিনু আর কিছু বলল না। নিজাম সাহেব রাতে খেতে বসে দেখলেন, আজও অনেক আয়োজন। খাবার শেষে পায়েসও আছে। তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। ছেলেটাকে এ বাড়িতে আনা বোধহয় ঠিক হয় নি। ভুল হয়েছে। ভুলটা কোথায়, তা তিনি ধরতে পারছেন না।

বিনু!

বল বাবা।

আমাদেরও তো কার্ডটার্ড ছাপাতে হয়।

ছাপাতে হলে ছাপাও।

না, মানে …ওই দিন তুই হঠাৎ বললি-মানে ওই বিয়ের ব্যাপারটা, মানে…

পায়েস নাও বাবা। পায়েসটা ভালো হবার কথা।

খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। রোজ এ-রকম খাওয়া হলে ব্লাড প্রেসার হয়ে যাবে।

তোমার কিছুই হবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে খাও তো।

নিজাম সাহেবের বুকের পাথর নেমে গেল। তিনি তার পুরনো, পরিচিত মেয়েকে খুঁজে পেলেন। এই লক্ষ্মী মেয়ে সারাজীবন কাউকে যন্ত্রণা দেয় নি, এখনো দেবে না।

রাতে মশারি গুঁজতে এসে বিনু চেয়ার টেনে পাশে বসল। নিজাম সাহেব নিদারুণ আতঙ্ক বোধ করলেন। একবার ভাবলেন–ঘুমিয়ে পড়েছেন এমন ভাব করবেন, ডাকলে সাড়া দেবেন না।

বাবা।

কি?

আগামীকাল তুমি যে করেই হোক, ভদ্রলোকের ঠিকানা বের করবে।

কেন?

আমি মিসির আলি নামে এক জন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই!

সে আবার কে?

তুমি চিনবে না, উনি এক বার এ-বাড়িতে এসেছিলেন। মুনির সাহেবকে চেনেন।

তুই কি বলছিস, আমি তো কিছুই বুঝছি না।

আমিও বুঝতে পারছি না। বাবা। উনি একটা অদ্ভুত ছবি নিয়ে এসেছিলেন। মনে হয় আমার বিয়ের ছবি।

কি আবোল-তাবোল বকছিস! তোর বিয়ের ছবি মানে? তোর বিয়েটা হল কবে?

নিজাম সাহেব উত্তেজনায় মশারি থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর ভ্রূকুঞ্চিত। কপালের চামড়ায় গভীর ভাঁজ।

ব্যাপারটা কী, আমাকে গুছিয়ে বল।

আমি জানলে তো গুছিয়ে বলব। আমাকে জানতে হবে না? আমার মনে হয়। উনি জানেন।

কি বারবার উনিী-উনি করছিস, উনিটা কে?

মিসির আলি সাহেব।

কী মুশকিল, মিসির আলিটা কে?

একবার তো বলেছি বাবা, মুনির সাহেবের বন্ধু।

সে-রাতে নিজাম সাহেবের ভালো ঘুম হল না। বারবার জেগে উঠলেন। শেষরাতের দিকে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন প্ৰকাণ্ড একটা মাকড়সার পেটের সঙ্গে তিনি সেঁটে রয়েছেন। মাকড়সাটা তাঁকে পেটে নিয়ে দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। ঐ মাকড়সার পেছনে-পেছনে আরো কয়েকটা মাকড়সা তাঁর দখল নেবার চেষ্টা করছে। বড় মাকড়সাটার সঙ্গে পারছে না। মাকড়সাটার গা থেকে পিচ্ছিল কি একটা বের হচ্ছে। তাঁর গা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ঘুমের মধ্যেই ফুঁপিয়ে কোঁদে উঠলেন। কী ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন!

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ