এপ্রিলের চার তারিখ। আমার চলে যাবার দিন। এয়ারফ্রান্সে প্যারিস থেকে ব্যাংকক, থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা, কলকাতায় কদিন কাটিয়ে আবার ঢাকা। যারা আমাকে প্যারিসে এনেছেন, তাদের আজ প্যারিসের দিকে হাত নেড়ে আমার বলতে হবে, প্রিয় প্যারিস, তোমাকে বিদায়, প্রিয় প্যারিস, জ তেম। ত্রিশ্চান বেস আমার যাবার খবর শুনে হোটেলে চলে এলেন। সই করার জন্য কনট্রাক্ট ফরম এনেছেন ক্রিশ্চান। সই করার পর বললেন, পৌঁছেই যেন তাঁকে কোরানের নারী যে বইটি মাত্র লিখে শেষ করেছি, পাঠিয়ে দিই। নাতালি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরে দিচ্ছে। অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, হল না। সময়ের অভাবে হল না। ক্রিশ্চান বেস কে পই পই করে বলে দিয়েছি, আমার লেখা কোনও ফরাসি জানে এমন বাঙালিকে দিয়ে অনুবাদ করাবেন। ক্রিশ্চান কথা দিয়েছেন যে তিনি তাই করবেন, তবে লজ্জার অনুবাদ জ্যঁ শার্ল প্রায় শেষ করে এনেছেন, এটি নতুন করে অনুবাদ করার সম্ভবত প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই, এ কথা আমি ঠিক মেনে নিই না।

প্যারিস ছেড়ে চলে যাবো, ভাবতেই বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। জানি না আর কখনও আসা হবে কী না প্যারিসে, হয়ত কোনওদিনই আর হবে না। অথবা হলেও এত ভালবাসা এত আদর হয়ত পাবো না।

ক্রিশ্চান বললেন, কাল তোমার আর্তে অনুষ্ঠান দেখলাম। কে ছিল তোমার অনুবাদক?

— না। ওরাই যোগাড় করে নিয়েছিল। তবে শুনেছি যে মেয়েটি অনুবাদ করেছে, ওর বাবা ফরাসি, আর মা বাঙালি। খুব ভাল বাংলা যে বলতে পারে তা নয়। শক্ত শক্ত শব্দ বুঝতে পারে বলে মনে হয়নি।

ক্রিশ্চান বলল, তোমার আসলে ইংরেজিতে বলা উচিত।

আমার ইংরেজির যে হাল! কোনওরকম কাজ চালাই। এ দিয়ে কোনও সাক্ষাৎকার চলে না। ওরাই বলে আমাকে বাংলায় বলতে।

–কী বল তোমার ইংরেজির হাল খারাপ। সেদিন দুপুরে নোভেল অবজারভেটরের জ্যঁ দানিয়েলের সঙ্গে বেশ গুছিয়ে তো বললে। তোমার লেখালেখি, তোমার সংগ্রাম। সময় পেলে তুমি বেশ সুন্দর বলতে পারো। এখন থেকে সিদ্ধান্ত নাও তুমি ইংরেজিতে দেবে যে কোনও সাক্ষাৎকার।

–দেখ, আমাদের দেশে ইংরেজি চর্চা একেবারেই নেই। মুখে বলতে গেলে দেখি অভ্যেস না থাকায় শব্দ খুঁজতে হয়।

–তোমার বক্তব্য যেন সব জায়গায়, যেখানেই কথা বলছ, স্পষ্ট হয়, সে কারণেই বলছি। কারণ অনুবাদক, ধরো হঠাৎ করে একজন অনুবাদক পেলে, তোমার চিন্তাচেতনাবিশ্বাস সম্পর্কে যার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, সে তোমাকে, তুমি যাই বল, ভাল বুঝতে পারবে না। অনুবাদও করতে পারবে না।

ক্রিশ্চান গম্ভীর হয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি যেমন ভাল, তাঁর সহমর্মিতাও দেখার মত। সুটকেস গোছাতে গোছাতেই কথা বলছিলাম ক্রিশ্চানের সঙ্গে।

হঠাৎ পার্কার কলমটি খুঁজে পাচ্ছি না। ক্রিশ্চান ঢুকে গেল তাঁর ওই মিনিস্কার্ট পরা শরীর নিয়ে খাটের তলে, নাতালি আতি পাতি করে খুঁজছে, আর চুক চুক করে দুঃখ করছে, ক্রিশ্চান খুঁজছে আর বলছে, কি রকম রং বল, আমি দৌড়ে দোকানে গিয়ে এক্ষুনি কিনে নিয়ে আসছি। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষ অবদি পাওয়া গেল কলম যে শার্টটি পরা ছিলাম, তার পকেটে।

আবারও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের কথা ওঠালেন ক্রিশ্চান। বললেন, তোমার বিশ্বাস আর আদর্শ সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু আর্তের অনুষ্ঠানে তোমার বক্তব্য খুব বলিষ্ঠ মনে হয়নি। আরেকটি কথা, তুমি যখন মৌলবাদিদের বাকস্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব কর, এর পেছনে তুমি কোনও ভাল যুক্তি দেখাতে পারো না। আমি বললাম, কেন, আমি তো বলেইছি যে মৌলবাদীরা সমাজকে পেছন দিকে টানছে। নারী পুরুষের সমান অধিকার মানে না তারা। মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে, ওদের পুড়িয়ে মারছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে। মুক্ত বুদ্ধির যে কোনও মানুষের ওপর হুমকি আসছে। ধনী আরব দেশগুলো থেকে টাকা আসে তাদের কাছে, হাতে তাদের অস্ত্র। মাদ্রাসা গড়ে উঠছে প্রচুর, আর মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর বেরোচ্ছে অগুনতি মৌলবাদী। এরা দেশের সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই করছে না। একসময় আমাদের দেশে তো ছিলই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ। সেরকম তো আবার হতে পারে!

ক্রিশ্চান, মনে হয়নি, আমার যুক্তিতে তুষ্ট। কাটিয়ে নিয়ে বললেন, অনুবাদক যেভাবে বলেছে, তাতে যুক্তিটি বলিষ্ঠ হয়নি।

আমি বুঝি যে ক্রিশ্চান গণতন্ত্রের কথা ভাবছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকলের অধিকার থাকা উচিত রাজনীতি করার। এটা নিষিদ্ধ ওটা নিষিদ্ধ এসব শুনলে ইউরোপের মানুষ পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের চিত্র কল্পনা করে শিউরে ওঠে। সোভিয়েতের ভয় সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরও যায়নি। কিন্তু মৌলবাদীরা যদি গণতন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসে যায় কোনও দিন, তবে তো প্রথম যে কাজটি করবে তা হল কবর দেবে গণতন্ত্রের, কবর হয়ে যাবে মুক্তচিন্তার, বাক্‌ স্বাধীনতার। নির্বাচনে জেতা খুব কি কঠিন হবে ওদের জন্য! ধর্মকে ব্যবহার করছে যাচ্ছেত!ই ভাবে। অশিক্ষিত অজ্ঞ মূর্খ মানুষগুলো আল্লাহ খোদার মান রক্ষা করতে গিয়ে এদের দলে যোগ দিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতায় না এসেই সরকারের আশকারা পেয়ে মৌলবাদ বিরোধী নেতাদের গলা কাটতে দ্বিধা করছে না। এরকম তো নয় যে তারা কোনও আলোচনায় যেতে চায়। আমি কলম ব্যবহার করেছি আমার মৌলবাদ বিরোধী লড়াইয়ে, মৌলবাদীরা কি আমার যুক্তি কলম ব্যবহার করে খণ্ডাতে চায়? না, তা চায় না। তারা তলোয়ার নিয়ে পথে নামে। কোমরে তাদের রাম দা। ক্রিশ্চান যদি মনে করেন গণতন্ত্র মানেই হল যে কোনও আদর্শ নিয়েই রাজনীতি করার অবাধ অধিকার, তবে ইউরোপের অনেক দেশেই তো নাৎসি রাজনীতি নিষিদ্ধ। এমনকী রাস্তায় সোয়াস্তিকার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়ালে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তবে? এখানে গণতন্ত্র কোথায় গেল। আর গণতন্ত্রই যদি এত সবকিছুর উর্ধ্বে, তবে হিটলারের নাৎসি দল তো বিপুল ভোটেই জিতেছিল জার্মানির নির্বাচনে!হিটলার তো ক্যু করে ক্ষমতায় আসেনি।

ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরাই। নাতালি ধমকে বলল, সিগারেট রাখো, খেতে হবে না।

–এই শেষ।

–না, ফেলে দাও। খেও না।

নাতালির চোখে আদর, শাসন।

নীলাঞ্জনা সুন্দরীটি এত আপন হয়ে উঠছে কেন আমার! তাঁর নীল চোখে আমার জন্য ভালবাসা স্থির হয়ে আছে। কেন নাতালি আমাকে ভালবাসে! আমি বাঙালি বলে, যেহেতু সে বাংলা শিখেছে? নাকি আমার কথা পত্রিকায় ছাপা হয় বলে, আমাকে রেডিও টেলিভিশনে ডাকে বলে সে ভেবেছে আমি বিখ্যাত মানুষ, তাই? নাকি আমার ওপর ফতোয়া জারি হয়েছে বলে করুণায়? নাকি আমার কিছু পদ্যের ফরাসি অনুবাদ পড়ে তার ভাল লেগেছে বলে? কোনটি? আমি অনুমান করার চেষ্টা করি। স্থির হতে পারি না কোনও একটি কারণে। এর মধ্যে জিল চলে এসেছে, সেও গুছিয়ে নিয়ে এসেছে তার ব্যাগ। আজ সে চলে যাচ্ছে মপোঁলিও।

নাতালিকে বলি, প্যারিসের শেষ সিগারেট আমাকে খেতে দাও।

নাতালি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, না।

নাতালিকে যত দেখি, অবাক হই। বাংলায় কবিতা লেখার ইচ্ছে তার। জিলকে বলেছিলাম নাতালি বেশ ভাল বাংলা বলে। জিল বলেছিল, তবে নিশ্চয়ই ওই নীলরতনের প্রেমে পড়েছে সে, প্রেমে পড়লেই ভাষা শেখার আগ্রহ হয়, প্রেমিকের সঙ্গে বাংলা চর্চা করছে বলেই ভাল বাংলা বলছে। অবশ্য নাতালির বেলায় তা হয়নি। ও বলেছে সেদিনই নীলরতনকে প্রথম দেখেছে। নাতালি বাংলাকে ভালবেসেই বাংলা শিখেছে, বাঙালি ছেলের প্রেমে পড়ে নয়। নীলরতনের জন্য মায়া হয়, আমাকে বড় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, ‘দিদি আমাকে তো তাড়িয়ে দেবে এ দেশ থেকে, লেখাপড়া শেষ, পাশ করে বেরোচ্ছি আর দু মাস পর, এখন তো আর থাকার উপায় নেই। আপনি যদি চেষ্টা করেন, তাহলে আমার হয়ত থাকা হবে এখানে। কারণ দেশে যে ফিরে যাবো, দেশে গিয়ে কি করব? ওখানে তো চাকরি নেই, কিছু নেই।’ নীলকে বলেছি, কিন্তু আমি কি করে চেষ্টা করব, কোথায় কার কাছে কি বলব? নীলরতন চুপ করে ছিল। কতটা অনিশ্চয়তা আর দুর্ভাবনা থেকে আমাকে অনুরোধ করেছে সে, বুঝি! জিলকে বলেছি যদি সম্ভব হয় নীলরতনকে যেন সাহায্য করে। জানিনা জিলের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না। হবে না হয়ত। নীলরতন কেন প্যারিসেই থেকে যেতে চায়! আমি নীলরতন হলে দেশে ফিরে যেতে চাইতাম। নিজের দেশের জন্য যা হোক কিছু ভাল করতে চাইতাম। কিন্তু আবারও ভাবি, দেশের জন্য চাইলেই কি কিছু করা সম্ভব! নীলরতন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করে, তবে কি খুব সহজে সে শিক্ষকের চাকরিটি পাবে? হিন্দু হওয়ার অপরাধে তাকে কি দুর্ভোগ পোহাতে হবে না! হবে! মুসলমান নামের মানুষেরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে না, তা নয়। আসলে ক্ষমতাসীনদের পেয়ারের লোক না হলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়ই কোনও না কোনওভাবে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এই যে বলি এত, বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, আসলেই কি এটি কোনও গণতন্ত্র। ভোটের বাজারে কিছু টাকা খাটিয়েই গরিবের ভোট যদি কেনা যায়, তবে তাকে গণতন্ত্র বলি কি করে! সত্যিকার গণতন্ত্র কোনওদিন আমরা পাবো না যতদিন না দারিদ্র্য মোচন হচ্ছে, যতদিন না শিক্ষার প্রসার হচ্ছে, যতদিন না সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সচেতনতা আসছে। ততদিন পর্যন্ত কি? গণতন্ত্রের চর্চা তো চলতেই হবে নাকি কোনও একনায়ক বা একনায়িকার শাসন চাও? প্রশ্নটি ক্রিশ্চান হয়ে আমি আমাকে করি। আপাতত নিশ্চুপ থাকি আমি। গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদ মৌলবাদ এসবের মধ্যে মানবাধিকার বাক্‌ স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা এক চিমটি করে করে দিতে থাকি আর ভাবতে থাকি। আমার ভাবনার সুতো হারিয়ে যায় নাতালির সুরে।

–আমি ঢাকায় যাবো আগস্টে।

–হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। আমার বাড়িতে থাকবে।

–আমার জন্য কিছু কবিতা পড়ে দেবে? আমি ক্যাসেটে তুলে রাখব।

নাতালি মহাখুশিতে আমার পড়া বাংলা কবিতাগুলো তুলে নেয়। নারীদ্রব্য কবিতাটি তার খুব ভাল লাগে বার বার বলল। এরপর আমার হাতদুটো ধরে সে বলল, আমার জন্য তো অনেক করলে, এবার একটি জিনিস করতে পারো আমার জন্য?

–নিশ্চয়ই করব। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। বল কি চাই?

–আমার জন্য তুমি সিগারেট ছাড়ো।

আমি হেসে উঠি। বলি, আমি তো ভাই ধরিনি সিগারেট যে সিগারেট ছাড়ব! এ আমার শখের খাওয়া।

জিল আমার ভারি সুটকেসটি নিয়ে নিচে নেমে যায়। আমিও নিচে নেমে আনমনে একটি সিগারেট ধরাই। নাতালি আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিয়ে বলল, সিগারেট খেলে কি হয় জানো?

শান্ত কণ্ঠে বলি, জানি। ক্যান্সার।

সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আমার বাবা আকাশে থাকে। কেন জানো?

সিগারেটের কারণে?

হ্যাঁ। কি হয়েছিল বল তো!

ব্রংকোজেনিক কারসিনোমা। সে জানি।

জানো?

হেসে বলি, হ্যাঁ।

তারপরও খাও?

আমি ম্লান হাসি।

নাতালি তার জ সুই লিব্রে লেখা ব্রোজটি তার জামা থেকে খুলে আমার শার্টে লাগিয়ে দেয়।

চিঠি লিখবে তো!

হ্যাঁ লিখব।

নাতালির চোখ ছলছল করে।

জিল বলে, নাতালি তো আছেই তোমার সঙ্গে। তুমি না হয় এয়ারপোর্টে ওর সঙ্গে চলে যাও। আমি যাবো অন্য এয়ারপোর্টে, অরলিতে।

হেই জিল, আজ শেষ দিন, আজও পালাতে চাও!

নাতালি বলল, ও আসলে নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে চায়।

ঠিক বলেছো।

জিল ধমকে ওঠে, পাগল হয়েছো। আমি ওর বাড়িতে যাবো না। আমি তো অরলিতে যাবো।

তিনজন আমরা ট্যাক্সিতে উঠে বসি। জিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, কাল রাতে খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে কাটাই। কিন্তু তুমি তো চলে গেলে ওদের সঙ্গে।

–তুমিও যেতে পারতে।

–আমাকে নেমন্তন্ন করেনি, আমি যাবো কেন!

–তাতে কি!

–নাহ, তোমাদের ব্যবসায়িক কথাবার্তায় আমাকে মানাতো না।

— মোটেও ব্যবসায়িক কথাবার্তা ছিল না। ছিল নারীবাদী আলোচনা।

অনেকটা পথ গিয়ে নাতালি বলল, বিমান বন্দরে গিয়ে কী লাভ। আমার খুব খারাপ লাগে প্রিয়জনদের চলে যাওয়া দেখতে। আমাকে বরং এখানে নামিয়ে দাও। আমি সরবনে যাবো, দুদিন ক্লাস করি না।

নাতালি নেমে গেলে আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার বাসে উঠে পড়ি। প্যারিসে মেট্রো চড়া হল, বাস চড়া হবে না কেন! তাই বাস চড়ার আবদার আমার। বাসটি সোজা বিমানবন্দর যাবে। বাসে দুজন পাশাপাশি বসি। জিল বলে, তুমি যখন বন্ধুবেষ্টিত থাকো, আমার তখন তোমার সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে না। তুমি যখন একা থাকো, তখন আমার ভাল লাগে, দুজন বসে গল্প করতেই তো ভাল।

–কবে তুমি প্যারিসে আসবে জিল?

— জুলাইয়ের শেষ দিকে। তখন একটি বাড়ি ভাড়া নেব প্যারিসে।

— বাড়ি ভাড়া কেন? নাতালির বাড়িতেই তো থাকতে পারবে।

–আরে না। তোমাকে তো বলেছি যে নাতালির সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে।

–যাহ আমার বিশ্বাস হয় না। কেন শেষ হবে সম্পর্ক! খুব চমৎকার মেয়ে নাতালি।

–কেন তোমার বিশ্বাস হয় না? আমি কি মিথ্যে বলছি? নাতালিকে আমি ভালবাসি না।

জিল আজ আমার ঘরে ঢুকতেই বলেছিলাম, জিল কাল নাতালিকে আমি বলেছি জিলের সঙ্গে আমার একটি ব্যাপারে মিল আছে। জিল এক নাতালির সঙ্গে থাকছে, আমি থাকছি আরেক নাতালির সঙ্গে। জিল লাজুক হেসেছে। ্‌উদাস তাকিয়ে থাকি জানালায়। জিল বলে, তুমি যদি জুলাইয়ের আগে জার্মানিতে আসো, তবে জার্মানি থেকে সোজা চলে যাবে মঁপেলিয়েতে। ওখানে আমার বাড়িতে থাকবে। সামনে সমুদ্র। তোমার খুব ভাল লাগবে। দুজন আমরা স্পেনে বেড়াতে যাবো। স্পেন খুব সুন্দর দেশ।

মঁপেলিয়ে। মঁপেলিয়ে। জিল মঁপেলিয়ের স্বপ্নে বিভোর।

আর তা যদি না হয়!

আর যদি না হয়, তবে কী?

তুমি তো সেপ্টেম্বরে আসছোই। ক্রিশ্চান বেস তোমাকে তো নিয়ে আসছেন তোমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে। তখন তো আমাকে চিনবেই না। বলবে জিল, কোন জিল? জিল নামে কাউকে তো চিনি না।

জিলের পেটে কনুইয়ের গুঁতো পড়ে, বাজে বোকো না তো!

—বাজে বকছি না। যা সত্যি তাই বলছি। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি তোমাকে ঘিরে থাকবে সাংবাদিকরা, প্রকাশকরা। এডিশন স্টক ফ্রান্সের খুব বড় প্রকাশনী। তাছাড়া ক্রিশ্চান বেসের তো টাকার অভাব নেই। ওকে বোলো তোমাকে যেন ক্রিয়োঁতে রাখে। বলবে ক্রিয়োঁ ছাড়া আমি থাকব না। তখন ক্রিশ্চান কিছুতেই না বলতে পারবে না। তাছাড়া তার লোক দেখানোও হবে, বলবে দেখ দেখ আমার লেখককে আমি ফ্রান্সের সবচেয়ে দামি হোটেলে রেখেছি। এটা তার প্রচারের কাজেও দেবে। ক্রিয়োঁতে যদি থাকো, আর জিল নামের এই বেচারাকে যদি চিনতেই পারো, তবে এরকম টি শার্ট পরে তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সোজা বলে দেবে, সুট টাই পরে এসো, তাছাড়া দেখা হবে না।

—না জিল। বড় বড় হোটেলে আমার থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে খুব সাধারণ ভাবে থাকি আর ঘুরে ঘুরে জীবন দেখি মানুষের। পুরো জগতটা দেখি। মানুষের চেয়ে আকর্ষণীয় আর কী আছে। বিশাল দামি হোটেলে থেকে কি আমি মানুষের সত্যিকার জীবন দেখতে পারি!

জিল মাথা নাড়ে। ঠিক বলেছো।

বিমান বন্দরে নেমে আমার সুটকেসখানি ট্রলিতে উঠিয়ে ঠেলছিল যখন, জিলকে অপলক দেখছিলাম। জিলের জন্য আমার হৃদয়ে রিন রিন করে একটি বীণা বাজে, বেজেই চলে।

যখন বিমানের পথে যাবো, জিল দাঁড়ায় আমার মুখোমুখি। বলে, আমি তোমাকে চিঠি লিখব। তুমি অবশ্যই অবশ্যই লিখবে। মনে থাকবে তো!

বিষণ্নতার ওপাশ থেকে আমি মাথা নাড়ি। লিখব।

বিদায় বলেছি। চলে যাচ্ছি। জিল বলে, আর পাঁচমিনিট থাকো। মনে মনে বলি, কী হবে আর এই পাঁচ মিনিটে?

জিল হঠাৎ আমাকে আলতো করে জড়িয়ে দু গালে গাল ছুঁইয়ে চুমু খেলো। এ ফরাসিদের অভ্যেস। সবার সঙ্গে ফরাসিরা এই করে। এমনকী একদিনের পরিচয়েও করে। তবুও জিলের এই স্পর্শ, এই চুম্বন আমাকে অদ্ভুত এক ভাল লাগা দেয়। জিলের হাত ছুঁয়ে বলি, কষ্ট ছুঁয়ে কণ্ঠ খানিক কাঁপে, বলি, যাই।

চলমান সিঁড়ি যখন আমাকে ক্রমশ এক একাকীত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, পেছনে ফিরে আর দেখিনি জিল দাঁড়িয়ে আছে কি নেই।

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন