পরদিন পয়লা মে। ঘুম ভাঙে ফোনের কর্কশ শব্দে। জিল হলে শব্দটি হয়ত এত কর্কশ মনে হত না, ক্যামেরুনের সাংবাদিক পিয়েস বলেই হয়। আজও তার একসঙ্গে নাস্তা খাওয়ার আবদার। এক হোটেলে পাশের ঘরে থাকছে, অথচ দেখা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে না। কাল চারটের সময় চা খাওয়ার কথা ছিল, ফিরতে পারিনি চারটেয়। নটায় নিচতলায় নেমে পিয়েসএর সঙ্গে নাস্তা করলাম। আমার পরনে ছিল সার্ট প্যান্ট, খাচ্ছিল!ম শখের সিগারেট। পিয়েস বলল, তুমি কি মুসলিম দেশে এরকম পোশাক পরতে পারো, সিগারেট খেতে পারো? আমি বললাম, সার্ট প্যান্ট পরা যায়, তবে রাস্তাঘাটে খুব য়চ্ছন্দে চলাফেরা করা যায় না। আর মেয়ে হয়ে সিগারেট খেলে লোকে ছি ছি করে। পিয়েস হেসে বলল, ক্যামেরুনে এসবে কোনও অসুবিধে নেই। পিয়েসের আরেকটি আবদার, আমার একটি সাক্ষাৎকার তার চাইই চাই। জ্ঞচলুন আমার ঘরে যাই, ওখানে আমার রেকর্ডার আছে। বাড়তি শব্দ কম হবে ঘরে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে পিয়েসের আবদার নাকচ করে দিই। যদিও তাকে রজার মিল্লারের মত দেখতে লাগে, তবু দানবের মত বিশাল দেখতে লোকটির ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। কী জানি, ভয় ভয়ও হয়ত করে। এটি কি, আমি জানি না, মস্তিষ্কের গোপন কোনও কোষে, বিশ্বাসের মত আছে, কালো কুচকুচে কিছু মানেই ভূত বা ওই জাতীয় ভয়ংকর কিছু। জ্যঁ শার্ল আসার আগে, জিলকে করব না করব না করেও ফোন করি।

ফোন পেয়ে জিল বলল, কি খবর তোমার! তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে গেছি।

–আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলে! কেন তুমি নিজে একবার ফোন করোনি।

–তুমি কখন হোটেলে থাকো না থাকো তার ঠিক নেই। তার চেয়ে, আগেই তো বলেছি, তুমি যখন ব্যস্ত থাকবে না, আমাকে ফোন করো। আমি চলে যাবো তোমার কাছে। এখন বল, কি প্রোগ্রাম তোমার আজকে? আমি চাইছি তুমি আমার সঙ্গে প্যারিসটা ঘুরে দেখ!

–না হবে না। জ্যঁ শার্ল আসবে এখন। বেরোবো। তারপর বিকেলে মিশেল আসবে নিতে।

–এত ব্যস্ততা!

আমি হেসে ফোন রেখে জ্যঁ শার্ল এলে বেরিয়ে পড়ি। জ্যঁ শার্ল গাড়ি আনেনি আজ। রাস্তায় মিছিল মিটিং হচ্ছে, পুলিশ সব জায়গায় গাড়ি চলতে দিচ্ছে না, তাই। মে দিবস আজ। দোকান পাট বন্ধ। অন্যরকম প্যারিসের চেহারা। আমরা হেঁটে হেঁটে জোন অব আর্কের মূর্তির পাশে গেলাম। মূর্তির সামনে প্রচুর ফুল পড়ে আছে। খুব অবাক হলাম শুনে যে চরম ডানপন্থী দল মে দিবসে জোন অব আর্কের পাদদেশে ফুল দেয়, এবং জোন অব আর্ককে ডানপন্থীরাই নিজেদের প্রতীক হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। জোন অব আর্কের মূর্তিতে ফুল দিতে চাইলে জ্যঁ শার্ল না না করে উঠল, বলল এতে ফুল দেওয়া মানে তুমিও ফ্যাসিস্ট দলের মত আচরণ করলে।

–বল কি!

–ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কেউ ফুল দেয় না জোন অব আর্কের মূর্তিতে?

–না।

–জোন অব আর্ক তো ফ্রান্সের গৌরব। কেন নয়?

–কারণ চরম ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী লিপেনের দলের রানী সে।

–কেন এরকম হল?

–হল কারণ জোন অব আর্ক ফ্রান্সের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। লিপেনও ভাবছে, তারাও তাই করছে। এই চরমপন্থীরা সব বিদেশি ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ হচ্ছে জঘন্য জাতীয়তাবাদ।

–জাতীয়তাবাদ তো আমাদের উপমহাদেশে পজেটিভ একটি শব্দ।

–হিটলার জাতীয়তাবাদী ছিল। ইউরোপে জাতীয়তাবাদ শব্দটি খুব নিগেটিভ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য শোষিতদের জাতীয়তাবাদী হওয়া আর স্বদেশে বসে ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদী শাসককুলের ভিন্ন জাতের প্রতি ঘৃণা পোষা, তাদের দূর দূর করে তাড়ানো আর নিজের জাতের অহংকারে জাতীয়বাদী হওয়া দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

জ্যঁ শার্ল পেশায় সায়কোএনালিস্ট। তাকে বাইরে থেকে দেখলে মানসিক রোগী মনে হলেও ভেতরে মানুষটি বুদ্ধিমান। আমি ফরাসি ভাষা জানলে অথবা জ্যঁ শার্ল ভাল বাংলা জানলে আমাদের আড্ডা চমৎকার জমতে পারতো, পরস্পরকে আমরা আরও বুঝতে পারতাম নিশ্চয়ই। হাঁটতে হাঁটতে অচিরে আমরা দেখতে পেলাম ল্যুভর মিউজিয়ামের পেছনে একটি খোলা জায়গায় লিপেনের দলের বিশাল সভা। লাল নীল সবুজ হলুদ বেলুন উড়ছে, মঞ্চে বসে আছে কিছু লোক, মঞ্চের সামনে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শুনছে বক্তৃতা। বক্তা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সোশ্যালিস্ট দলের নেতা ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর কথা কিছু বলছে, আর শুনে খুশিতে লাফাচ্ছে শ্রোতা। জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, মিতেরোঁকে কি বলছে?

–গালি দিচ্ছে।

–কী বলে গালি দিচ্ছে?

জ্যঁ বলল, শুয়োর।

মঞ্চে কেবল পুরুষ নেতাই নন, নারী নেষনীও বসে আছেন। আশ্চর্য, তাঁরা কি গণতন্ত্রের চর্চা করছে মঞ্চের ওপর! এই ডানপন্থী দলটিই তো মেয়েদের চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে, বলছে ঘরে ফিরে যেন মেয়েরা শাদা শাদা সন্তানের জন্ম দেয়, কারণ কালো আর বাদামীরা জন্মে জন্মে পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে। সুতরাং এই চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট দলের উপদেশ হল, মেয়েরা এতকাল ধরে সংগ্রাম করে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা যেন দেশের স্বার্থে শাদা বর্ণের স্বার্থে বিসর্জন দেয়! মিশেল ইডেল বলেছেন সেদিন, লিপেনের দল এরকম একটি আইন তৈরি করতে চাইছে, যে বাচ্চা বিয়োলে মেয়েরা কাজ করে যে টাকা উপার্জন করত, সেই পরিমাণ অথবা তারও চেয়ে বেশি টাকা কাজ না করেই ঘরে বসে পেয়ে যাবে। চাকরি বাকরি করার জন্য মেয়েরা সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হচ্ছে না, এটি নিয়ে লিপেনের খুব মাথা ব্যথা। তাহলে তো সর্বনাশ গো। মিশেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেয়েরা কি এখন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়ার আদিম ব্যবস্থায় ফিরে যাবে বসে বসে টাকা পাওয়ার লোভে? মিশেল বলেছেন, জ্ঞনাহ! ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন এমন কিছু ভাল নয়। এটি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। মেয়েরা বেকার হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। ভাল যে লিপেন ক্ষমতায় নেই।’ আমার আশঙ্কা কবে না জানি আবার লিপেনের দল ভোটে জিতে যায়! ফ্রান্সে ভোট দিতে যাওয়ার লোক খুব কম। ভোটের দিন তারা হয় দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়, নয়ত ঘরে বসে আরাম করে। ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের এই অনীহার এই সুযোগে আবার লিপেনের দল কোনও দিন না জিতে যায়! তখন কালো বাদামী মানুষের জন্য তো সমস্যাই, শাদা মেয়েদের জন্যও সমস্যা।

বয়স্ক কিছু লোক তাদের এককালের বুকে ব্যাজ লাগানো মেডেল লাগানো সেনা- পোশাক পরে এসেছে লিপেনের সভায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার বাঁ পাশেই এক ইয়া মোচঅলা লোক সেনা পোশাকে দাঁিড়য়ে ছিল, জ্যঁ বলল, লোকটি আলজেরিয়ায় যুদ্ধ করেছে। লোকের সঙ্গে একটি বুড়ো কুকুর। দেখে জ্যঁ চোখ বড় বড় করে বলে, কুকুরটিরও ট্রেনিং আছে আলজেরিয়ানদের কামড়ানো। বলে কি! তাই নাকি? জ্যঁ নিশ্চিত স্বরে বলল, নিশ্চয়ই। লোকটির হাতে একটি বড় পোস্টার, ফরাসি ভাষায় কি লেখা আছে জানতে চাইলে জ্যঁ বলল, ইওরোপ এক হওয়ার বিরোধী। জাতীয়তাবাদ যাকে বলে। আমরা ফরাসি, আমাদের জাত অন্য জাতের চেয়ে ভাল। আমরা অন্য কোনও জাতের সঙ্গে এক হব না।

সামনে নির্বাচন ফ্রান্সে। আমি জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, এরা যদি জিতে যায়!

জ্যঁ ঠোঁট উল্টে বলল, আরে না! এরা খুবই ছোট দল।

যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে সরে ল্যুভরের বারান্দায় ধরে হাঁটতে গিয়ে লক্ষ করি, কিছু লোক তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখছে। হঠাৎ জ্যঁ আমাকে টেনে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ওদিকে যেও না।

–কেন যাবো না?

–বিদেশিদের ওপর ওদের খুব রাগ। গালাগাল করতে পারে।

–গালাগাল করবে? আমি তো বুঝবও না গালি।

–তুমি না বুঝলেও আমি তো বুঝব।

–কী বলে গালি দেবে?

–বলবে নিজের দেশে ফিরে যা। এখানে এসেছিস আমাদের দেশের সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে। আমাদের চাকরি খেতে!

–আমি তো সে কারণে আসিনি। আমাকে তো আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে, আমি তো অতিথি।

–তোমার গায়ে তো লেখা নেই যে তুমি অতিথি।

–গালাগাল করলে আমার কী! চল হাঁটি ওদিকে, লোকেরা জট পাকিয়ে কি করছে, দেখে আসি।

–দরকার নেই বাবা। চল এ জায়গা থেকে সরে যাই।

জ্যঁ বড় বড় পা ফেলে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। জ্যঁকে থামিয়ে বলি, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কি হচ্ছে এখানে। জ্যঁ আমার হাত ধরে টেনে বলছে, চল সরে যাই! হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি ধমকে উঠি, — গালাগালকে তোমার এত ভয়!

–গালাগাল তো তেমন কিছু না। এরা মেরেও ফেলতে পারে তোমাকে।

–বল কি!

–ঠিকই বলছি। এদের সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা নেই। এরা খুব ভয়ংকর।

জ্যঁ জোরে হেঁটে হেঁটে বামপন্থীদের মিছিলে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু মিছিল ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। মিছিল আর সভা ছাড়া রাস্তায় খুব লোক নেই। এসময় নাকি প্রতিবছরই ডামে আর বামে কিছু মারপিট হয় রাস্তায়। মারপিট হয়? মারপিট দেখব। গোঁ ধরলে জ্যঁ বলল, ‘ও আশা ছেড়ে দাও। বামের সভা শেষ হয়ে গেছে।’ অগত্যা কাছেই এক ক্যাফেতে দুজন বসে চা কফি খেতে খেতে দেখতে থাকি রাস্তার কিনারের দৃশ্যগুলো। এক লোক মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ন চড়ন নেই, সামনে মাথার টুপি উল্টো করে রাখা, কেউ যদি পয়সা দেয়। তিনটে ছেলে মূকাভিনয় করছে। তাদেরও সামনে টুপি। জ্যঁ বলল, ‘এরা সম্ভবত পোলান্ডের ছেলে। ছাত্র। ফ্রান্সে বেড়াতে এসেছে। এভাবেই পয়সা তুলে চলছে।’ বাহ। বেশ তো। বসন্তের প্রথম থেকে একবারে গ্রীষ্মের শেষ অবদি ছাত্র ছাত্রীরা বেড়াতে যায় বিভিন্ন দেশে। যাদের টাকা পয়সা নেই ঘুরে বেড়াবার, তারা রাস্তায় গান গেয়ে, অভিনয় দেখিয়ে, মূর্তি সেজে টাকা উপার্জন করে সেই টাকায় রেলের টিকিট কাটে, থাকা খাওয়ার খরচা মেটায়। আমি ওদের দেখতে দেখতে ভাবি আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা এভাবে বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর জন্য মোটেও আগ্রহী নয় কেন! পকেটে টাকা পয়সা না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না কেন! অনেকে এখানে স্কুল কলেজ ছুটি হলেও রেস্তোরাঁয় বাসন মাজার কাজ নিয়ে নেয়, তা থেকে যা উপার্জন করে, তা দিয়ে অন্য দেশে বেড়াতে যায়। মধ্যবিত্ত কোনও ছেলে কি আমাদের দেশে বাসন মাজার কাজ করবে? আমি নিশ্চিত তা করবে না। এতে তাদের মান যাবে। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় এসে আমাদের শিক্ষিত আদরের দুলালেরা কিন্তু তাই করছে, এতে মান যায় বলে মনে করছে না। আবার এও ঠিক, দেশের রেস্তোরাঁয় বাসন মাজলে কত টাকা আর পাবে! রাস্তায় সং সেজে দাঁড়ালেই বা তাদের কে দেবে টাকা! এখানে ছোট ছোট কাজেও ম্যালা টাকা মেলে। ছোট কাজ বলে ঠকানোর তেমন কোনও রাস্তা নেই। খুব কম করে হলেও ঘন্টায় পঞ্চাশ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি টাকায় চারশ টাকা। ঘন্টায় কোন বাসনমাজনেওয়ালাকে চারশ টাকা দেবে আমাদের লোকেরা! তা ই বা দেবে কোত্থেকে! কজনের হাতে টাকা আছে দেশে! চাকরি করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররাই যে টাকা রোজগার করে, তা দিয়ে বাড়িভাড়া তো দূরের কথা, প্রতিদিন দুবেলা খাবারও জুটবে না। তাইতো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় সবাইকে। পুলিশের দুর্নীতির কথা লোকে হামেশাই বলে! ঘুষ কেন খাবে না একজন পুলিশ! মাসে বেতন কত পায় সে! যে টাকা বেতন পায়, সেই টাকায় তার বউ বাচ্চা নিয়ে তার কি বেঁচে থাকা সম্ভব! দুর্নীতি দমন নিয়ে কত বড় বড় কথা লোকে বলে, কিন্তু দুর্নীতি কোনওদিন ঘুচবে না যতদিন না সকলের উপার্জন এমন হয়, যে উপার্জন দিয়ে থাকা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা যায়। আবার এও ভাবি, বড় দুর্নীতিগুলো বড় বড় লোকেরাই করে। যাদের অনেক আছে। গুটিকয়েকের হাতে অঢেল টাকা। বেশির ভাগ কায়ক্লেশে জীবন চালায়। কোনওমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দিনে দুবেলা ভাতের জোগান হলেই আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুশি। ধনী দেশেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের পর আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে সবাই, তা হল আনন্দ, স্ফূর্তি। আনন্দ স্ফূর্তিকে আমাদের দেশে মোটেও প্রয়োজনীয় বলে ভাবা হয় না, ভাবা হয় বিলাসিতা। এটি কেন! দর্শনের এই তফাৎ কি দারিদ্র্যের কারণে! নাকি অন্য কোনও কারণ আছে। একবার ভাবি জ্যঁ র সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করি। পরেই আবার উৎসাহ দেখাই না। ভাবনাগুলো আমার মাথায় যায় আসে। আসে যায়। ভাবনাগুলো কোথাও স্থির হয়ে থাকে না। বাতাসে ধুলোর মত ওড়ে, তুলোর মত ওড়ে। খেই হারিয়ে যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে। মানুষ নামের জাতি একটিই। অথচ কী বিভেদ এই মানুষের মধ্যে। কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কেউ খাবে, কেউ খাবে না। কেউ সুখে থাকবে, কেউ থাকবে না। কারও সব হবে, কারও কিছুই হবে না। কারও কাছে জীবন মানে আনন্দ, কারও কাছে জীবন দুর্বিসহ। যে শিশুটি জন্মাচ্ছে আজ ফ্রান্সে, আর যে শিশুটি জন্মাচ্ছে বাংলাদেশে, কী তাদের মধ্যে পার্থক্য! মানুষ হিসেবে কোনও পার্থক্য নেই, অথচ কী ভীষণ রকম ভিন্ন অবস্থায় পরিবেশে দুটো শিশু দু দেশে বড় হচ্ছে। আবারও ভাবি খুব কি পার্থক্য? আমি যে প্যারিসের ধনী ক্রিশ্চান বেসের বাড়ি গেলাম, আর ঢাকার গুলশানে এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ি গিয়েছিলাম, কী এমন পার্থক্য দুবাড়ির মধ্যে? কি এমন তফাৎ দু জনের জীবন যাপনে? না, খুব একটা নেই। ধনীরা, সে যে দেশেই হোক, একই রকম আরামে থাকে। তবে গরিবের অবস্থা হয়ত ভিন্ন। বাংলাদেশের গরিব আর ফ্রান্সের গরিব তো একরকম অবস্থায় থাকে না! গরিবের যে চেহারা দেখেছি বেলভিলে, এই যদি গরিব হয়, তবে তেজগাঁর বস্তিকে কি বলা যাবে! দুর্গন্ধ পাগারের ওপর বাঁশ পুঁতে ওর ওপর একখানা তক্তা বিছিয়ে ঘর বানিয়ে গু মুতের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তেজগাঁ বস্তির দুর্গন্ধটি প্যারিসের ক্যাফেতে বসেও হঠাৎ আমার নাকে এসে লাগে। চারদিকে বিশ্বায়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। কার জন্য বিশ্বায়ন! পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে বলা হয়। কিন্তু কাদের কাছে ছোট? বাংলাদেশের একজন সাধারণ লোকের কাছে বিশ্বায়নের অর্থ কি! তাকে তো কেবল শ্রম দিতে হবে ধনীর ধন বাড়াতে। বিশ্বায়নে কেবল তো পণ্যদ্রব্যই এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবাধে যাবে। গরিব দেশ থেকে কটা জিনিস বিদেশের বাজারে পৌঁছবে! গরিব দেশের কটা লোক ইচ্ছে করলেই দেশের সীমানা পেরোতে পারবে! গরিব হলে হাত পা কেমন বাঁধা পড়ে যায়। সীমানা কত মাপা হয়ে যায়! স্বাধীনতা কত সীমিত হয়ে যায়! সবাই পৃথিবীরই সন্তান, কিন্তু কারও কারও জন্য এক নিয়ম, কারও কারও জন্য অন্য। কারও জন্য বেঁচে থাকা, কারও জন্য মৃত্যু। কারও জন্য সুখ, কারও জন্য দুঃখ। হঠাৎ সুখ শব্দটি আমাকে দোলাতে থাকে। সুখ কি ধন দৌলত হলেই হয়! তেজগাঁর বস্তির এক মেয়েকে দেখেছি গায়ে ছেড়াঁ কাপড় পায়ে জুতো নেই, মায়ের চুলে বিলি কেটে কেটে উকুন আনছে আর খিলখিল করে হাসছে, রেললাইনের ধারে একটি মাটির চুলোয় শুকনো ডাল পাতা জ্বালিয়ে মেয়ের মা’টি ভাত ফুটোচ্ছে, মাও হাসছে। ওই সময়টিতে মা আর মেয়ে দুজনেই খুব সুখী ছিল। আর এখানে এই প্যারিসে ক্রিশ্চানের বাড়িতে তার অঢেল সম্পদের মালিক স্বামী টনিকে দেখেছি একটি একলা ঘরে বিষণ্ন বসে থাকতে, মোটেও মনে হয়নি তিনি খুব সুখে আছেন।

জ্যঁ শার্ল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় টেলিভিশনে। ওখানে আমার দেওয়া বাংলা সাক্ষাৎকারের ফরাসি অনুবাদ করার দায়িত্ব পেয়েছে সে। জিল হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছে আমি যেন ফিরেই একবার তাকে ফোন করি। ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি। ইচ্ছে করেই জিলের ফোন নম্বরটি আমি ভুলে যাই। ক্রিশ্চান ফোন করে, ‘উফ তোমাকে তো পাওয়াই যায় না সুন্দরী, করছ কি সারাদিন! বল, সেদিনের সেমিনার কেমন হল? নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর! নিশ্চয়ই তোমার ভাল লাগেনি।’

আমি শান্ত গলায় বলেছি, আমার ভাল লেগেছে।

–বল কি?

–হ্যাঁ ভাল লেগেছে। আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না ওখানে। তবে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, খুব ভাল মানুষ তারা।

ক্রিশ্চান হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তুমি এখনও ভাল করে চেনোনি ওদের।’

আমি আর কথা বাড়াইনি। ক্রিশ্চানের আন্তরিক কণ্ঠ বার বার ধ্বনিত হচ্ছে, বল, তোমার –কিছু লাগবে কি না বল।

–না, আমার কিছু লাগবে না।

–কেন লাগবে না! যা কিছুই লাগে, আমাকে বলবে। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। ভুলো না কিন্তু।

মিশেল ইডেল এলে মিশেলকে আমার হোটেলের ঘরে চলে আসতে বলি। ঘরে বসে দুজন খানিকক্ষণ গল্প করে ক্যাফে দ্য ফ্লোরএ যাই, ওখানে বসে দুদেশের মেয়েদের অবস্থা নিয়ে কথা বলি। কথা হয় ভোট নিয়ে। পঞ্চাশ বছর আগে ফ্রান্সের মেয়েরা ভোটের অধিকার পেয়েছে। মিশেল জানতে চান কবে আমাদের ওদিককার মেয়েরা পেয়েছে এই অধিকার। খুব সোজা, সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ দূর হল ভারতবর্ষ থেকে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল, পুরুষ এবং নারী উভয়েই ভোটের অধিকার পেল। মিশেলের একটি কথায় আমি বিস্ময়ে দুমিনিট কথা বলতে পারি না। সুইৎজারল্যাণ্ডের মেয়েরা নাকি ভোটের অধিকার পেয়েছে উনিশশ একাত্তর সালে।

সে রাত আমার কাটে আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে। বিশাল বাড়ি। আন্তোয়ানেতের এক অনুসারী, তাঁরও মিশেল বলে নাম, আমার সাক্ষাৎকার নিলেন ভিডিওতে। আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছিল। এত প্রশ্ন এত উত্তর আমার আর সইছিল না। বার বারই শেষ করতে চাইছিলাম, কিন্তু আন্তোয়ানেত ফুকের ইচ্ছে আমার যাবতীয় কথাবার্তা তিনি রেকর্ড করে রাখবেন। কিন্তু কেন? কাজে লাগবে। কি কাজে? তোমার ওপরই একটি তথ্যচিত্র করছি আমরা! আমার অস্বস্তি উত্তরোত্তর বাড়ে।

পরদিন। সকাল নটায় জিল এল হোটেলে। খবর পেয়ে গোসল করে শাদা একটি সার্ট আর বাদামী রঙের একটি প্যান্ট পরে ফুরফুরে মেজাজে নিচে যাই। চা নাস্তা নিয়ে দুজন বসি মুখোমুখি। জিল দাড়ি কামায়নি। আগের সেই কালো জিনস পরনে তার। অমল হাসি ঝলমল করে জিলের মুখে।

–কেমন আছ তসলিমা।

–ভাল। তুমি?

–ভাল। জিল হেসে ওঠে বলে।

কাল রাতে জিল বলেছিল আজ সে কাঁটায় কাঁটায় নটায় আসবে। নটার এক মিনিট দেরি হলে আমি নাকি বেরিয়ে যেতে পারি। মনে মনে বলেছিলাম, যাবোই তো। তোমার জন্য আমি কেন অপেক্ষা করব জিল?

–তোমাকে দুদিন সময় দিলাম জিল। যেন নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে পারো। যেন আমার চাকরি করতে না হয়।

–ওহ না। তসলিমা কি বলছ তুমি! আমি সবসময় অপেক্ষা করেছিলাম তোমার ফোনের।

–তুমি তো ফোন করনি!

–হ্যাঁ করেছি। তুমি নেই।

–সে তো আমি ইচ্ছে করেই নেই। যেন তুমি নাতালির সঙ্গে..

–কি বলছ তুমি!

–হ্যাঁ, সত্যি।

–নাতালির সঙ্গে, তুমি জানো, আমার কোনও গভীর সম্পর্ক নেই। ওর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতে, বিশ্বাস কর, আমার ভাল লাগে না। সময়ই কাটতে চায় না।

তবে কি আমার সঙ্গে ভাল লাগে? মনে মনে বলি তাহলে চলে এলে না কেন!

জিলের নীল দুটি চোখে চোখ রেখে বলি, তিনবার ফোন করেছো। এ কোনও ফোন করা হল? জিল হেসে বলে, ‘ঠিক আছে যাও, প্রতি দশ মিনিট পর পর এখন থেকে ফোন করব। ঠিক আছে?’

আমি বুঝিনা জিলকে দেখলে কেন মনে হয় আমি খুব ভাল আছি। যেন সব ক্লান্তি কেটে গেছে, সব দুর্ভাবনা দূর হয়েছে। আমরা বসে থাকতে থাকতেই নাতালি এল। কাল সে ফোন করেছিল, আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলেছে। এই নাতালি জিলের প্রেমিকা নাতালি নয়। নাতালি বনফুরা প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখে। আমার খবর পেয়েছে শিশির ভট্টাচার্যের কাছে। শিশির বাংলাদেশের ছেলে, প্যারিসে কয়েক বছরের জন্য বাংলা পড়াতে এসেছেন। নাতালির কাছে খবর পেয়ে তার প্রায় লেজে লেজেই এসেছে নীলরতন, ভোলার ছেলে, প্যারিসে লেখাপড়া করছে। নাতালি মেয়েটি চমৎকার। আমার খুব ভাল লাগে ওকে। যেন ওর অনেকদিনের বন্ধু আমি। নাতালি সুন্দর বাংলা বলে, সুন্দর বাংলা লেখেও। জিল আমার বাংলা লেখা দেখে বলে, এ তো কোনও ভাষা নয়, এ হচ্ছে আর্ট। নাতালি হঠাৎ বলে আমাকে সে ফরাসি ভাষা শেখাবে।

–বাহ বেশ তো শেখাও।

–কি শিখতে চাও প্রথম?

–আমি তোমাকে ভালবাসি।

–জ তেম।

এক এক করে সে লিখল, কেমন আছ, ভাল আছি। কামা সাবা? সাবা। ধন্যবাদ। ম্যারসি। জিলকে বললাম, জিল, জ তেম।

জিলের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তরে সে ফরাসি ভাষায় কি বলল বুঝিনি। নাতালি লিখে যাচ্ছে আরও কিছু ফরাসি শব্দ। জিল বলল, ‘আজ সারাদিন কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আজ তোমার চলবে না। চলবে না।’ এর মধ্যেই জ্যঁ শার্ল এসে উপস্থিত। গতকাল তিনি ন ঘন্টা টেলিভিশনে কাটিয়েছেন আমার বাংলা অনুবাদ করতে। জিলকে বিগলিত হেসে কেলিয়ে বলে দি আমাকে নিয়ে তিনি অপেরায় গিয়েছিলেন।

জিল বলল, কি ব্যাপার তুমি তো বলনি তুমি যে অপেরায় গিয়েছিলে!

হেসে বলি, মনে ছিল না।

মনে ছিল না?

জিল হেসে ওঠে। শিশুর হাসির মত হাসি।

বারোটা বেজে গেল। সকালেই ক্রিশ্চান হোটেলে ফ্যাক্স পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে আমাকে তিনি সাড়ে বারোটায় এসে নিয়ে যাবেন, ফেরত দিয়ে যাবেন তিনটেয়। অষ্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন থেকে পিটার নামের এক লোক চার পৃষ্ঠা লম্বা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন, কোত্থেকে যে এই লোক খবর পেলেন আমি কোথায় আছি, জানি না। জিলকে বলি ফ্যাক্সটি পড়ে শোনাতে, আমার পক্ষে অত লম্বা জিনিস পড়া সম্ভব নয়। জিল বাধ্য ছেলের মত শোনায়। ক্রিশ্চান এলে জিলকে সঙ্গে নিই। সোজা এডিশন স্টক, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীতে। কি বিশাল প্রকাশনীর বাড়িটি। সকলে আমাকে দেখে বিষম উচ্ছঅজ্ঞসত। দু গাল যে কত বার কতজনের কাছে পেতে দিতে হল চুমু খেতে। অভ্যস্ত নই এসবে। কিন্তু ওদের অভ্যেসের কাছে আমার গালদুখানি বিসর্জন দিতে হয়।

রাতে এলিজাবেথ আসে। তার তথ্যচিষেনর ভিডিও ক্যাসেট দিল আমাকে, যা ও তৈরি করেছিল ঢাকায় গিয়ে। বলল, বাইশটি দেশ এই তথ্যচিত্রটি কিনে নিয়েছে। সুইৎজারল্যাণ্ড, ইতালি, স্পেন, ইংলেণ্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, আমেরিকা..। এলিজাবেথ ঢাকায় যেমন রহস্যে মোড়া ছিল, এবার আর তা নয়। বলল, ঢাকায় তার ঝামেলা হয়েছিল। তিরিশ জন পুলিশ তার পেছনে যখন সে শাখারিপট্টিতে পৌঁচেছে। কি করে তার যাবার খবর পুলিশ জানে, তা এখনও তার কাছে রহস্য। ফৈয়াজ নামে যে ছেলেটি তাকে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দিয়েছিল, এলিজাবেথ চলে আসার পরই তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, থানায় নিয়ে কয়েক হাজার প্রশ্ন করেছে। পুলিশের কারণে এলিজাবেথের আর শাখারিপট্টিতে ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, বাইশটি দেশ তোমার এই ছবি কিনে নিল? আশ্চর্য! –হ্যাঁ। ভীষণ পছন্দ করেছে ওরা। প্রচুর চিঠি আসছে আমার কাছে। ওরা তোমাকে সহমর্মিতা জানাতে চায়। তোমার ঠিকানা চাইছে ।

–আর যাবে না ঢাকায়?

এলিজাবেথ হেসে বলল, আমার জন্য ঢাকা যাওয়ার পথ বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে আর ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না।

এলিজাবেথ চলে যাবার সঙ্গে নাতালি এল, সঙ্গে নীলরতন আর শ্যামল চক্রবর্তী নামে একটি ছেলে। শ্যামল নীলরতনের বন্ধু। নীলরতন রান্না করে নিয়ে এসেছে। মুরগি, ফুলকপি আর বাসমতি চালের ভাত। নীল চামচ দিয়েছিল থালায়। সরিয়ে দিয়ে হাত ডুবিয়ে দিই ভাতে। কতদিন পর ভাতের স্বাদ পাওয়া! আহা। শ্যামল বার বারই বলছে, দিদি আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছে সেই কতদিনের। কি যে ভাল লাগছে দিদি!

নাতালি এসে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে বাংলা গান শুনতে বসে গেছে। নাতালি, আপাদমস্তক ফরাসি মেয়ে, কি চমৎকার বাংলা বলে, বাংলা লেখে। বাংলা গানের পাগল। জিজ্ঞেস করি, এই তুমি শাড়ি পরতে পারো?

মাথা নেড়ে বলল, না।

ওকে একটা লাল শাড়ি দিলাম। নীলরতনকে শার্ট।

‘নিয়ে নাও। আমার লাগবে না।’ সে যে খুশি দুজন।

শ্যামল মেট্রোতে বাদাম বিক্রি করে। সে এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে। জানেনা, ফরাসি সরকার তাকে আশ্রয় দেবে কি না। না দিলে তাকে দেশে চলে যেতে হবে। বাদাম বিক্রি করে দিনে একশ ফ্রাঁ জোটে তার।

–এখানে জিনিসের সে যে কি আগুনে দাম, এই টাকায় কি চলতে পারো!

–কষ্ট করে চলি দিদি।

শ্যামল বড় করুণ স্বরে বলতে থাকে, –এক ঘরে সাত আটজন গাদাগাদি করে থাকি। বাঙালিরা মেট্রো স্টেশনে বাদাম বিক্রি করে, কাপড় বিক্রি করে, ফুল ফল বিক্রি করে। এসব বিক্রি করা মেট্রোতে নিষিদ্ধ। পুলিশ প্রায়ই ধরে নিয়ে যায়। মারধোর করে।

খেতে খেতে শ্যামলের গল্প শুনি।

–পনেরো তারিখে আপনার ওপর একটা অনুষ্ঠান হয়েছে টেলিভিশনে। দু ঘন্টা আগে থেকেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল। বসে ছিলাম আপনাকে দেখব বলে। কী যে ভাল লেগেছে দিদি।

নীলরতন বলল, এখানকার কাগজে সেদিন পড়লাম ফ্রান্সের ইস্কুল কলেজগুলো আপনার ওপর একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। গর্বে বুক ভরে গেছে। খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই মিলে বাইরে যাই। অনেকটা পথ রাতের প্যারিস জুড়ে হাঁটি। বাংলায় কথা বলতে বলতে হাঁটি। রাতে অষ্ট্রেলিয়া টেলিভিশন থেকে ফোন, আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র বানাতে ওরা বাংলাদেশে যেতে চায়। আমি রাজি কি না জানতে চাইছে। এসব কাণ্ড যত দেখছি, তত অবাক হই। আমি তো সেই আমিই! সেই অবকাশের আমি।

নাতালি রাতে থেকে যায় আমার ঘরে। অনেকটা রাত গল্প করে কাটায়। সকালে ঘুম ভেঙে যায় টেলিফোনের শব্দে। নিচে ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। গামা নয়ত সিগমা ফটোএজেন্সি থেকে এসেছে। বলে দিই যে নিচে যেতে পারব না, চাইলে ওপরে যেন চলে আসে। মেয়েটি আমার ঘরে চলে এসে পাগলের মত ছবি তুলতে থাকে। ছবি তোলা তখনও শেষ হয়নি, তুলুজ থেকে এলেন ক্যারোলিন ম্যাকোনজি। তখন চা খাচ্ছি। ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। ক্যারোলিন খুব কাছে মুখোমুখি বসে বললেন, ‘একটা উপন্যাস আমাকে ছাপতে দিন।’

‘উপন্যাস তো কিছু নেই বাকি। এডিশন স্টককে দিয়ে দিয়েছি।’

‘উপন্যাস যদি না দিতে পারেন, অন্তত একটা গল্পের বই দিন।’

‘কিছু তো নেই। গল্প যা আছে, তা স্টককে দেব বলে কথা তো দিয়ে ফেলেছি।’ ‘কিন্তু আমরা যে চাইছি। সেই কতদিন থেকে আমরা ঢাকায় আপনার কাছে ফোন করছি, ফ্যাক্স করছি। কিছু একটা আমাদের দিতেই হবে তসলিমা। দয়া করুন আমাদের। আপনার লজ্জা বেরোবে সেপ্টেম্বরে। এই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাকে ছোট গল্পের পাণ্ডুলিপি দিন। দিতেই হবে।’

না বলতে আমি পারি না। জানি না, না বলতে আমার কষ্ট হয় কেন। বড় করে একটি না বলে দেব, পারি না। কণ্ঠে স্বর ওঠে না। লজ্জা হয় না বলতে। কেমন যেন মায়া হয় মানুষটির জন্য। আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি এমন কিছু লিখিনি যা কি না ফরাসি ভাষায় প্রকাশ পেতে পারে। লজ্জা তো নয়ই। ক্রিশ্চান যখন আমার কাছে যা কিছুই এ পর্যন্ত লিখেছি সবই চেয়েছে, আমি সত্যিই লজ্জায় পড়েছি। আন্তোয়ানেত ফুক আর মিশেল ইডেল যখন চেয়ে মরেছে, লজ্জা আমার কম হয়নি। তবু বড় দ্বিধায় নির্বাচিত কলামটি দিয়েছি। যে স্বাধীনতার কথা বলেছি নির্বাচিত কলামে, সে স্বাধীনতা এখানকার মেয়েরা বহু আগেই পেয়ে গেছে। আমার নারীবাদ এদের কাছে নিতান্তই পুরোনো জিনিস। আর যে কটি লেখাই লিখেছি, সবই তো আমাদের দেশ আর সমাজ সম্পর্কিত, কতটুকুই বা ফরাসিরা অত দূর দেশের নিত্যদিনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত! ক্যারোলিন কনট্রাক্ট ফরম নিয়ে এসেছেন। বলেছি, এখন সই করব না, আগে দেশে ফিরে দেখি আদৌ কোনও গল্প আমার কাছে আছে কি না। থাকলে কোন কোনটি আপনাকে পাঠানো যায়। ক্যারোলিন একটি প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমার জন্য। খুলে দেখি একটি ঘড়ি। বললেন, জ্যঁ শার্ল বলেছে, তোমার একটি ঘড়ি দরকার।

জ্যঁ শার্লকে আমি বলিনি, আমার ঘড়ি দরকার। নিশ্চয়ই সে লক্ষ করেছে যে আমার হাতে ঘড়ি নেই। প্যারিসের অনেক মেয়েই দেখেছি রঙিন ঘড়ি পরে। রঙিন ঘড়ি আমার পক্ষে পরা সম্ভব নয়, মনে মনে বলি, কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। তখনও আমি জানি না সোয়াচ ঘড়ি, সে রঙিন হলেই কি, না হলেই কি, এর মূল্য অনেক। এদিকে ফটোগ্রাফারের মেশিনগান চলছে। ক্যাটক্যাটক্যাটক্যাটক্যাট। থামাথামি নেই। এত ছবি তুলে কি হবে গো? কি করবে এত ছবি!

নাতালি পরে বলেছে, বোঝো না কি করবে এসব ছবি? বিক্রি করবে।

বিক্রি? কোথায়?

ফ্রান্সের কাগজে। কেবল কি ফ্রান্সের! বিভিন্ন দেশের পত্রিকায়। কেবল কি পত্রিকায়! বইয়ের প্রকাশনী আছে, পোস্টার কোম্পানী আছে. টেলিভিশন আছে..।

এই ক্যাটক্যাট যেতে না যেতেই লা হিউমানিতের সাংবাদিক এলেন। লা হিউমানিতে বামপন্থীদের পত্রিকা। সাংবাদিকের সঙ্গে সমাজতন্ত্র বিষয়ে বিস্তর কথা হল। সমাজতন্ত্রে কেন আমি বিশ্বাস করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর আমি কি আশাবাদী, যদি আশাবাদী, কেন আশাবাদী। সাক্ষাৎকার যখন চলছিল, তখনই জিল এল। যেতে হবে রেডিওতে। নাতালিকেও সঙ্গে নিলাম। জ্যঁ শার্ল আগেই গিয়ে বসে আছে ওখানে। আমি আর সাংবাদিক মেয়েটি, যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে, গিয়ে বসলাম একটি গোল টেবিলের ঘরে, টেবিল ঘিরে মাইক্রোফোন, কাচের দেয়ালের ওপাশে একটি ঘর। ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হবে, আমি বাংলায় উত্তর দেব, জ্যঁ শার্ল সঙ্গে সঙ্গে আমার বাংলা ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে। নাতালিও বসেছে একটি চেয়ারে। কাচের দেয়ালের ওপাশে ঘরটিতে রেকর্ডিং কন্ট্রোল হচ্ছে, ও ঘরটিতেই দাঁড়িয়ে আছে জিল। এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিই আর জিলের দিকে তাকাই। জিল মিষ্টি করে হাসে। চোখ টিপে বাহবা জানায়। জিলকে আমার এত আপন মনে হয় যে ভুল করে তার সঙ্গে আমি প্রায়ই বাংলায় কথা বলে ফেলি। রেডিও থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পিকাসো মিউজিয়ামে যাই। পিকাসো মিউজিয়াম দেখব এরকম একটি ইচ্ছে প্যারিসে নামার পর থেকেই ছিল। জিল বলল, বোধহয় বন্ধ, তবু চল। গিয়ে ঠিক ঠিকই দেখা গেল বন্ধ। প্যারিসের মিউজিয়ামগুলো কোনওটি সোমবার, কোনওটি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে, এরকম নয় যে সপ্তাহের দুটোদিন শনি রবিবার মিউজিয়ামগুলোও বন্ধ থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও খাবো বলে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকি। জিল বলল, এটা ইহুদিদের রেস্তোরাঁ, এদের খাবার খুব ভাল হয়। রেস্তোরাঁর চেহারাটি অন্যরকম। যেন ধ্বংসস্তূপ। অথবা কোনও গুহা। এরকম করেই বানানো হয়েছে। আমাদের দেশে যেমন বাড়িঘর রং করলে ভাবা হয় সুন্দর, এখানে কিন্তু সব সময় তা নয়। যত পুরোনো বাড়ি, যত প্রাচীন, মলিন, তত তার মর্যাদা বেশি। প্যারিসের বড় বাড়িগুলো সব পাথরে বানানো, কোনও রঙের প্রয়োজন হয় না, সেগুলোই প্যারিসের সৌন্দর্য। ইট সিমেণ্টের বাড়িগুলোকে, উঁচু হোক, ঝকঝকে হোক, মোটেও সুন্দর বলে মনে করা হয় না। আমি আমাদের কথাই ভাবি, পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানানোর ধুম চলে। আমাদের অবকাশ খুব পুরোনো বাড়ি। বিশাল বিশাল দরজা জানালা, উঁচু সিলিং, দেয়ালের কারুকাজকে মোটেও ভাবা হয় না সুন্দর কিছু। অবকাশ ভেঙে নতুন ডিজাইনের বাড়ি করার ইচ্ছে বাড়ির প্রায় সবারই। তার ওপর সেই পুরোনো কাঠের কারুকাজ করা আসবাবপত্রগুলোকে পারলে ভেঙে খড়ি বানানোর ইচ্ছে সবার। সিংহের মুখ অলা খাটের পায়াগুলোকে পুরোনো পচা ভাবা হয়, তার চেয়ে কোনও পায়াহীন বাক্সের মত খাটগুলোকে মনে করা হয় সুন্দর, আধুনিক। আধুনিক আসবাবপত্র, বাড়িঘরের প্রতি ওখানে আকর্ষণ প্রচণ্ড। প্যারিসে ঠিক তার উল্টো। বিশাল ঝকঝকে তকতকে অত্যাধুনিক দোকানের জানালায় দেখেছি সাজানো আছে চটের বস্তা, পোড়া খড়ি, ভাঙা ইট, মরা ডাল। ওগুলোই এখানে সৌন্দর্য। এসব দেখে আমার একটি জিনিস মনে হয়, আধুনিকতার শীর্ষে উঠে এদের আর আধুনিকে আকর্ষণ নেই, আর প্রাচীনতম দেশগুলোয় পা পা করে যেখানে আধুনিকতা উঁকি দিচ্ছে, সেখানে মানুষ হুড়মুড় করে গিয়ে আঁকড়ে ধরছে সেটি। আধুনিকতা মানে কি? নিজের কাছেই প্রশ্ন করি। স্থাপত্যে, আসবাবে, পোশাকে নতুন ঢংএর নামই কি আধুনিকতা! মনের আধুনিকতাকে যদি সত্যিকার আধুনিকতা বলি, তবে ধনী দরিদ্র নতুন প্রাচীন সব দেশেই আছে সেই আধুনিকতা। দেশ বা সমাজ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমরা যারা পুরোনো মূল্যবোধ পেছনে ফেলে নতুন দিকে নতুন করে নতুন ভাবে নতুন সময়ের কথা ভাবছি, তাদের ভাবনাগুলো এক। আর যারা ধর্মান্ধতা, অজ্ঞতা, হিংস্রতা ইত্যাদি নিয়ে আছে, তাদের আচরণগুলোও এক।

ইহুদিদের খাবার খুব আলাদা স্বাদের। জিল বলে।

আমি বলি, তা কেন হবে? কোনও খাবারই ধর্মভিত্তিক নয়। এগুলো দেশভিত্তিক, এলাকা ভিত্তিক।

জিল সবেগে মাথা নেড়ে আমাকে অস্বীকার করে বলে, না, ইহুদিদের খাবার অন্যরকম।

–কী বলছো আবোলতাবোল! কোনও খাবারকে তুমি বলতে পারো না এই খাবার ইহুদিদের, এই খাবার মুসলমানদের বা খ্রিস্টানদের। ফ্রান্সে যে ইহুদিরা হাজার বছর থেকে বাস করছে, তাদের খাবার ইহুদি-খাবার হবে কেন, হবে ফরাসি খাবার! বাংলাদেশের মুসলমানের খাবার আর ইরাকের মুসলমানের খাবার এক নয়। ভারতের খ্রিস্টানদের খাবার আর ইতালির খ্রিস্টানদের খাবার এক নয়। আরবের ইহুদি আর জার্মানির ইহুদির খাবারও এক নয়।

জিল বলে, এক।

এক হওয়ার তো কারণ নেই।

জিল আবারও বলে, এক। এক, কারণ সব দেশেই তাদের বিশেষ খাবারগুলো তারা এক রকম করে তৈরি করে।

না, আমি তোমার কথা মানতে পারলাম না।

না মানতে পারলে আমার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি যা বলছি, তা ঠিক। ইহুদিরা প্রতিটি দেশেই একরকম করে খাবার তৈরি করে।

আমি সজোরে মাথা নেড়ে বললাম, ধর্মের সঙ্গে খাবারের কোনও সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। আমি নিশ্চিত ভারতের ইহুদি আর ফ্রান্সের ইহুদি একরকম খাবার তৈরি করে না। ভারতের উত্তরাঞ্চলের হিন্দু আর দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুদের খাবারই ভিন্ন। এসব নির্ভর করে এলাকার ওপর। নির্ভর করে সেই এলাকার সংস্কৃতির ওপর।

জিল তার মত ফেরায় না। আমিও না।

যে কটি খাবারের কথা বলা হয়েছে, এক এক করে সব আসে। সবগুলোর মধ্যে কিছু না কিছু বেগুন আছে, তাও আবার বিস্বাদ। ঝাল। জিলের থালায় বড় একটি মরিচ সেদ্ধ। শাকপাতার ভেতর ভাত ভরে মুড়ে দিয়েছে। কি অদ্ভুত খাবার বাবা! আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। আমার থাল থেকে জিল খেল, আমি জিলের থেকে খানিকটা। ব্যাস।রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটছি, হঠাৎ দেখি একটি রেস্তোরাঁর নাম ভলতেয়ার রেস্তোরাঁ, ভলতেয়ারের নামে রাস্তা।

এখানে কি ভলতেয়ার থাকতেন?

জিল বলে, না, সম্মান জানানো হচ্ছে।

জ্যঁ শার্ল বলে, তসলিমার নামেও একদিন প্যারিসে রাস্তা হবে।

হো হো করে হেসে উঠি।

মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আস্ত একটি তেলের কারখানা। নানারকম নল দিয়ে বানানো মিউজিয়ামের দেয়ালটি। এলাকাটিতে লোকের ভিড়, কিছু না কিছু লেগেই আছে। নাতালি বলল এখানে নাকি বেশ কিছু বাঙালি কাজ করে। পথে কোনও বাঙালি দেখলেই সে হেসে আমার দিকে তাকায়, কানে কানে বলে, দেখলে বাঙালি। কিছু বাঙালি দেখলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চালের মধ্যে নাম লিখে লকেট বিক্রি করছে। অত ছোট চালের মধ্যে কি করে নাম লেখা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। মেট্রোয় রেল চড়া হল, কোনও বাদামঅলা বাঙালি চোখে পড়ল না। নাতালি বলল, গরম পড়ে গেছে, ওরা বাইরে চলে এসেছে।

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন