পঞ্চম অধ্যায়
২য় প্রকরণ—বৃদ্ধ (জ্ঞানবৃদ্ধ) জনের সহিত সংযোগ

অতএব, (আম্বীক্ষিকী, ত্রয়ী ও বার্তারূপ) তিন বিদ্যার মূলই হইল দণ্ড বা দণ্ডনীতিজ্ঞান। প্রাণধারীদিগের (অর্থাৎ প্রজাবর্গের) যোগ ও ক্ষেমসাধনকারী দণ্ড, বিনয় বা শিক্ষারূপ মূলের উপর প্রতিষ্ঠিত।

বিনয় দুই প্রকার—কৃতক (অর্থাৎ পরিশ্রমপুৰ্ব্বক ক্রিয়ার দ্বারা প্রাপ্ত) ও স্বাভাবিক (বাসনাবশতঃ স্বতঃসিদ্ধ)। কিন্তু, ক্রিয়া, দ্রব্যের বা উপযুক্ত পাত্রের উপর বিহিত হইলেই তাহাকে (সেই পাত্রকে) বিনীত বা শিক্ষিত করিতে পারে; কিন্তু, ইহা অদ্রব্য বা অপাত্রের উপর বিহিত হইলে তাহাকে বিনীত বা শিক্ষিত করিতে পারে না। যে ব্যক্তির বুদ্ধি—শুশ্রুষা (গুরুজনের উপদেশশ্রবণে ইচ্ছা), শ্রবণ, গ্রহণ, (শ্রাতবিষয়ের অর্থবোধ), ধারণ (উপদিষ্ট বিষয়ের স্মৃতিতে রক্ষণ), বিজ্ঞান (ধারিত বিষয়ের বিশিষ্ট জ্ঞান), উহ। (অল্প ক্র বিষয়ের অন্তমান), অপোহ (অন্যের তর্কনিরসন জন্য বিপরীত তর্ক) ও তত্ত্বে (বিষয়েব যাথার্থ্যজ্ঞানে), অভিনিবিষ্ট থাকে, সেই যোগ্য ব্যক্তিকেই বিদ্যা বিনীত বা শিক্ষিত করিতে পারে, অন্যকে পারে না।

বিদ্যাসমূহের প্রামাণ্য বিভিন্ন আচাৰ্য্যগণের উপর নির্ভর করে বলিয়া, শিষ্যগণ সেই সেই আচার্য্যের অনুশাসনক্রমেই বিনয় (শিক্ষা)-গ্রহণ ও নিয়ম পালন করিবে।

চৌলকৰ্ম্ম (মুণ্ডন সংস্কার) সম্পাদিত হইলে (রাজ বা রাজপুত্ৰ) লিপি (অক্ষর লেখা) ও সংখ্যান (অঙ্ক-গণনা) নিয়মপূর্বক অভ্যাস করবেন। উপনয়ন (বা গায়ত্রীর উপদেশ) প্রাপ্ত হওয়ার পর (তিনি) ত্রয়ী ও আল্পীক্ষিকী বিদ্যা শিষ্টগণ (অর্থাং ততদ্বিদ্যাভিজ্ঞ আচাৰ্য্যগণ) হইতে, বার্তা-বিদ্যা (সীতাধ্যক্ষাদি) বড় বড় অধ্যক্ষগণ হইতে এবং দণ্ডনীতি প্রবচনকুশল ও প্রয়োগকুশল নীতিবিদ আচার্শ্যগণ হইতে নিয়মপূর্বক শিক্ষা করিবেন।

(তিনি) ষোড়শ বৎসর পর্য্যন্ত ব্রহ্মচৰ্য্য পালন করিবেন। তৎপর তাহার গোদান বা কেশাস্ত-কৰ্ম্ম ও দারকর্ম বা বিবাহ হইবে। তাঁহার (কৃতদার রাজার বা রাজপুত্রের) বিনয় বৃদ্ধির জন্য তাঁহাকে নিত্যই বিদ্যাবৃদ্ধ আচাৰ্য্যগণের সহিত সংযোগ রক্ষা করিতে হইবে। কারণ, বিনয়ের মূলই হইল ইহা (অর্থাৎ বিদ্যাবৃদ্ধসংযোগ)।

দিনের প্রথমভাগে (রাজা) হস্তিবিদ্যা, অশ্ববিদ্যা, রথবিদ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রবিদ্যাতে শিক্ষা গ্রহণ করিবেন এবং শেষভাগে ইতিহাস-শ্রবণ বিষয়ে (শিক্ষা গ্রহণ করিবেন)। ইতিহাস শব্দ দ্বারা আমরা পুরাণ, (রামায়ণাদি) ইতিবৃত্ত, (দিব্যমানুষাদির চরিতকথারূপ) আখ্যায়িকা, উদাহরণ (প্রকৃতবিষয়ের উপপাদক দৃষ্টান্ত, মতান্তরে, মীমাংসাদি ন্যায়োপন্যাসবিষয়ক শাস্ত্র), (মানবাদি) ধৰ্ম্মশাস্ত্র ও (বার্হস্পত্যাদি) অর্থশাস্ত্র বুঝিব। অবশিষ্ট দিন ও রাত্রিভাগে (তিনি) নূতন নূতন বিষয়ের জ্ঞানলাভে ও গৃহীত জ্ঞানের পরিচয়ে (মনন ও চিন্তন) অভ্যাস করিবেন এবং যাহা (সম্যক্) গৃহীত হয় নাই তদ্বিষয়ে পুনঃ পুনঃ শ্রবণ করিবেন। কারণ, (পুনঃ পুঃ) শ্রবণ হইতেই প্রজ্ঞা (জ্ঞানবিকাশ) সম্ভাবিত হয়, প্রজ্ঞা হইতে যোগ (বা শাস্ত্রোক্ত বিষয়ের অনুষ্ঠান-শ্রদ্ধা), আবার যোগ হইতে আত্মবত্তা বা মনস্বিতা উপজাত হয়—এবং এই ভাবেই বিদ্যালাভের সামর্থ্য বা শক্তি উৎপাদিত হয়।

কারণ, বিদ্যাদ্ধারা বিনীত ও প্রজাদিগের বিনয়ে বা শিক্ষাতে রত রাজা সৰ্ব্বভূতের হিতে রত থাকিলে রাজান্তর-শূন্যা (অর্থাৎ একাতপত্রা) পৃথিবী ভোগ করিতে পারেন।। ১৷৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে বৃদ্ধসংযোগ-নামক পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত।

Super User