দ্বিতীয় অভিযান

এরপর একদিন বিকেলবেলা মিত্তিরদের বাগানে খেলা করছে পাণ্ডব গোয়েন্দারা, এমন সময় হঠাৎ গুলঞ্চ গাছের ডাল থেকে কে যেন বলে উঠল, চোর চোর।

সেই না শুনেই চেঁচিয়ে উঠল পঞ্চু, ভৌ। ভৌ-ভৌ।

বাবলু বলল, কী ব্যাপার বল তো?

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, আরে, কী চমৎকার একটা কাকাতুয়া পাখি রে। বাবলুদা শিগগির ধরো পাখিটাকে।

বাবলু অবাক হয়ে বলল, এই বনে কাকাতুয়ার বাসা আছে নাকি? জানতুম না তো।

বিলু বলল, অসম্ভব। কাকাতুয়া পাখি এখন তো বিরল হয়ে এসেছে। যাও-বা পাওয়া যায়। তারও দাম বাজারে অনেক।

বাবলু বলল, এ নিশ্চয়ই কারও পোষা-পাখি।

ভোম্বল বলল, যারই হোক। ধরতেই হবে পাখিটাকে।

পঞ্চু তখনও সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, ভৌ-ভৌ-ভৌ-ভৌ-ভৌ।

ভোম্বল বলল, তুই পঞ্চুকে ধরে থাক। বাবলু। আমি পাখিটাকে কায়দা করি। না হলে ওর চেচানিতেই উড়ে যাবে পাখিটা।

বলতে বলতেই উড়ে গেল পাখিটা। বেশি দূরে অবশ্য যেতে পারল না। খানিক গিয়েই একটা ঝোপের ওপর ছোট্ট একটি ডালে বসে পড়ল।

ভোম্বল বলল, তোরা যেন আসবি না কেউ। আমি পিছু নিচ্ছি পাখিটার। ওটাকে ধরতে না পারলে আমার মনে শান্তি আসবে না। এই বলে পাখিটাকে ধরবার জন্য ঝোপের দিকে ছুটিল ভোম্বল।

পাখিটা আবার উড়ে পড়ল। উড়ে আর একটু দূরে গিয়ে বসল। ছোট্ট একটা টগর ফুলের গাছ ছিল, তার ডালে।

ভোম্বল সেখানেও যেই গেল পাখিটা সেখান থেকেও উড়ে গেল।

এইভাবে পাখিটার পিছু নিতে নিতে ভোম্বল একেবারে বাগানের শেষ-প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুল। এইখানে একটা মস্ত কাঁঠাল গাছ ছিল। সেই কাঁঠাল গাছের ঘন ডালপালার আড়ালে গিয়ে লুকল পাখিটা।

ভোম্বল তখন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও সে পাখিটার লোভে একটু একটু করে ডাল বেয়ে সেই গাছের মগডালে উঠতে লাগল। ওই তো দেখা যাচ্ছে পাখিটাকে। কেমন নিশ্চিন্তে বসে আছে বাছাধন। ধূর্ত বেড়ালের মতো চুপিসারে ভোম্বল পকেট থেকে রুমালটা বার করে যেই না ধরতে যাবে, দুষ্ট পাখিটা আমনি ক্যাঁ-ক্যাঁ করেই ফুড়ুত। বাগান পেরিয়ে একেবারে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসল। পাখিটা। আর সেদিকে যেই না তাকানো, অমনি চক্ষুস্থির হয়ে গেল ভোম্বলের। দেখল এক বিজাতীয় চেহারার লাল মুখ বারান্দার থামের আড়াল থেকে একদৃষ্টি তাকিয়ে দেখছে ওকে। সে দেখা এমনই দেখা যে ভেম্বলের বুকের একদম ভেতরের জায়গাটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। এ মুখাবয়ব অমানুষিক। ভৌতিক ছাড়া আর কিছুই নয়। যেই না। এ কথা মনে হওয়া আমনি সুড় সুড় করে গাছ থেকে নেমেই একেবারে তিরবেগে ছুটে চলল ভোম্বল সেই পোড়ো বাড়ির দিকে, যেখানে আর সকলে ওর জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

 

পরদিন সকালবেলা প্ৰত্যেকটি খবরের কাগজে এক চাঞ্চল্যকর খবর ছাপা হল। প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মালিকের স্ত্রীকে কে বা কারা যেন নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এবং তাঁর সমস্ত গয়না চুরি করে নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নিয়ে গেছে একটি পোষা কাকাতুয়া পাখি। পাখিটা অবিকল মানুষের মতো কথা বলতে পারত। পুলিশ এই খুনের বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তায় পড়ে গেছে। কেন না, আততায়ীর পায়ের ছাপা ঘরের ভেতরে পাওয়া গেলেও ঘরের বাইরে উঠোনে মাঠে সিঁড়িতে কোনওখানেই তার এতটুকু পদচিহ্ন নেই।

খবরটা পড়েই লাফিয়ে উঠল ভোম্বল। যাকে দেখে সে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিল আসলে সেই লোকটাই যে খুনি তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না তার। ভাগ্যে পাখিটা উড়ে এসে চাের চাের’ বলে ডেকেছিল, তাই তো পাখিটাকে ধরতে গিয়ে আসল ঘুঘুকে দেখে ফেলেছে সে। দৃশ্যটা মনে পড়তেই শিউরে উঠল। ভোম্বল। উঃ, কী সাংঘাতিক সেই মুখ!

ভোম্বল আর একটুও দেরি না করে বাচ্ছু-বিচ্ছু আর বিলুকে নিয়ে বাবলুদের বাড়িতে গেল। তারপর সবাই জড়ো হল বাবলুদের ছাদে।

কালকের ঘটনাটা কালই ওদের বলেছিল ভোম্বল। শুনে সবাই হেসেছিল। কিন্তু আজকের কাগজে খবরটা পড়ার পর কেউ আর হাসতেও সাহস করল না।

ভোম্বল বলল, এই কেন্সটা কি আমাদের হাতে নেওয়া যেতে পারে।

বাবলু বলল, নিশ্চয়ই। খুনিকে যখন দেখেছিস তুই, তখন আর তাকে চিনে ফেলতে খুব একটা দেরি হবে। না। আমাদের। ওকে আমরা ধরবই ধরব।

বিলু বলল, দরকার হলে এ ব্যাপারে আমরা পুলিশেরও সাহায্য নেব। পুলিশ তো চিনেই গেছে আমাদের।

বাবলু বলল, ঠিক। কালকের ঘটনার কথা এখনই আমরা গিয়ে পুলিশকে বলি চল। তাতে করে খুনিকে ধরতে ওদেরও একটু সুবিধে হবে।

সবাই তখন দল বেঁধে থানায় চলল খুনির বর্ণনা দিতে। পঞ্চুও অবশ্য ওদের সঙ্গে যেতে বাদ পড়ল না।

 

থানায় গিয়ে ভোম্বল সব কথা খুলে বলতেই ও সি অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার। তারপর বললেন, ঠিক কী রকম সময়ে দেখেছি বল তো?

আজ্ঞে, সন্ধের মুখে। আর লোকটার মুখ কী রকম যেন। আমাদের সাধারণ লোকের মুখের মতো নয়। ও সি গভীরমুখে সব কথা শুনে যা যা নোট করবার সব নোট করে নিলেন। তারপর বললেন, আমরা এ ব্যাপারে জোর তদন্ত চালাচ্ছি। যদি প্রয়োজন হয় তোমাদের ডাকব। তোমরা এখন থেকে চেষ্টা করবে। সেই মুখ আর কখনও দেখতে পাও কিনা। যেই পাবে আমনি জানাবে আমাকে। যদি দূরে কোথাও দেখতে পাও, তা হলে তাড়াতাড়ি ফোন করে সেই জায়গাটার নাম বলে জানাবে। সঙ্গে সঙ্গে ধরব ব্যাটাকে। আর সেই সঙ্গে খবরের কাগজেও নাম ছাপিয়ে দেব তোমাদের। পাণ্ডব গোয়েন্দা নামটা দেখবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবে।

ওরা থানা থাকে বেরিয়ে এক জায়গায় হঠাৎ একটা ডুগডুগ বাজনা শুনে থমকে দাঁড়াল। আরও অনেকেই দাড়িয়েছে সেখানে। ওরাও দাঁড়াল।

বাঁশ আর দড়ি দিয়ে একটা অংশকে ঘিরে খেলা দেখাচ্ছে একজন ইরানি যাযাবর ও এক জিপসি মেয়ে। মেয়েটি ঘাগরা উড়িয়ে এক অদ্ভূত কায়দায় অপূর্বভাবে নোচে চলেছে। আর ইরানিটা সেই নাচের তালে তালে ঢোল বাজিয়ে কসরত দেখাচ্ছে। পাশেই একটি ছোট্ট তাঁবু। সেই তাঁবুর আশেপাশে কতকগুলো মুরগি ঘোরাঘুরি করছিল। বেশ নধর চেহারা মুরগিগুলোর। একটা ছাগল এবং একটা কুকুরও বাঁধা ছিল সেখানে। পঞ্চু হঠাৎ সেই মুরগিগুলোর দিকে ভৌ-ভৌ করে তেড়ে গেল। যেই-না-যাওয়া ইরানিদের কুকুরটাও আমনি দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে তার প্রতিবাদ করে উঠল। নেহাত বাঁধা ছিল তাই রক্ষে। না হলে যা তেজি কুকুর, ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত বোধ হয়।

ইরানিটা ঢোল থামিয়ে একটা লাঠি হাতে তেড়ে এল পঞ্চাকে। যেই-না-আসা অমনি খুব কাছ থেকে লোকটার মুখ দেখেই চমকে উঠল। ভোম্বল। তারপর চুপি চুপি বাবলুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, বাবলু! এই মুখই কাল আমি দেখেছি। এই সেই লোক।

তাড়া খেয়ে পঞ্চু তখন পালিয়ে এসেছে।

আর ভোম্বল বাবলুর পিছনে এমনভাবে এসে দাঁড়িয়েছে যে ইরানিটা যেন ওকে দেখে না ফেলে।

পঞ্চুকে তাড়িয়ে লোকটা আবার ঢোল পিটতে লাগল।

আবার শুরু হল জিপসির নাচ।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা চলে এল সেখান থেকে।

খানিকটা তফাতে এসে বাবলু বলল, তুই ঠিক বলছিস ভোম্বল? এই সেই লোক?

আমার এতটা ভুল হবে না। বাবলু। এই সেই লোক। শুধু লোকটা এতক্ষণ পিছন ফিরে ঢোল বাজাচ্ছিল বলে ওর মুখটা আমি দেখিনি ভাল করে।

বিলু বলল, এই লোকটাই তা হলে খুনি বলতে চাস?

ভোম্বল বলল, খুনি কিনা তা বলতে পারি না। তবে কাল প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির বারান্দায় এই মুখই আমি দেখেছি। এ মুখ আমি জীবনে ভুলব না।

বাবলু বলল, তা যদি হয় তবে এই লোকটাই হত্যাকারী।

বাচু-বিচ্ছু বলল, তা হলে কি একবার থানায় গিয়ে জানিয়ে আসব?

বাবলু বলল, না। এখনই তার কোনও প্রয়োজন নেই। যেমন করেই হোক চোরাই মাল আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। আজ বিকেলবেলা আবার আসব আমরা এইখানে এবং দুপুরবেলা একবার আমরা স্পটে যাব।

ভোম্বল বলল, বেশ, তাই হবে।

ওরা সবাই চলে এল যে যার ঘরে।

 

দুপুরবেলা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরির মেইন গেটের কাছে এসে ওরা দেখল গেট বন্ধ। ফ্যাক্টরিও বন্ধ আজকে। কালকের ওই ব্যাপারের পর আজ কখনও খোলা থাকতে পারে না। সে যাই হোক, এখন মুশকিল হল ভেতরে ঢোকা যায় কী করে?

বাবলু বলল, এর ভেতরে ঢোকবার একটিমাত্র উপায় আছে।

বিলু বলল, কী উপায় বল?

মিত্তিরদের বাগানের পিছন দিক দিয়ে ভেতরে ঢোক।

ভোম্বল বলল, কিন্তু সেখানে তো কোনও ফাক নেই।

একটু বুদ্ধি খরচা করলেই ভেতরে ঢোকা যায়।

যে গাছে ভোম্বল উঠেছিল। সেই গাছের ডালে একটা বেশ শক্ত মোটা লম্বা দড়ি বেঁধে সেই দড়ি বেয়ে নীচে নামা যায়।

দি আইডিয়া! ভোম্বল বলল-ঠিক আছে, তোরা যা! তারপর আমি যাচ্ছি। আমি এখনই নিয়ে আসছি আমাদের কুয়োর জল তোলা লম্বা নাইলনের দড়িটা। এই বলে ভোম্বল চলে গেল।

বাবলুরা সবাই তখন বাগানের শেষ প্রান্তে সেই গাছের ওপর উঠেছে। এখান থেকে ফ্যাক্টরির বারান্দা খুব ভালভাবে দেখা যাচ্ছে। জায়গাটাও অনেকখানি। চারদিক ঘেরা। নীচে ফ্যাক্টরি। ওপরে মালিক থাকেন। কাজেই মেশিনের ঘরঘর শব্দে ওপরের চিৎকারও কানে যাবার নয়। কিন্তু কী সাহস ব্যাটার। অমন ভর সন্ধেবেলা দিব্যি এসে খুন করে গেল।

একটু পরেই ভোম্বল এসে পড়ল দড়ি নিয়ে।

দড়ি ধরে পাঁচিল টপকে সর্বাগ্রে বাবলু নামল ভেতরে। তারপর পাঞ্চকে বেঁধে নামানো হল। পঞ্চুর পরে বাঙ্গুচু-বিচ্ছু। সবশেষে বিলু আর ভোম্বল।

সবাই নেমে পড়ার পর প্রথমে চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল কোথাও খুনি তার সুকৌশল খুনের কোনওরকম চিহ্ন রেখে গেছে কিনা তা দেখবার জন্য। কিন্তু না। কোনও চিহ্ন কোথাও নেই। কী অদ্ভুত ও রহস্যময় হত্যাকাণ্ড। একটা মানুষ খুন হল, আততায়ীর পদচিহ্ন পাওয়া গেল অথচ সেটা ঘরের ভেতর। ঘরের বাইরে কোথাও নয়। আততায়ী কি ম্যাজিক জানে?

এমন সময় হঠাৎ পঞ্চু ভৌ-ভৌ করে একটা ঝোপের দিকে ছুটে গেল।

পঞ্চুকে ছুটতে দেখে পঞ্চুর পিছু পিছু সর্বপ্রথম ছুটে গেল বিলু। বিলুগিয়ে দেখল এক জায়গায় পঞ্চু একমনে কী যেন শুকছে। তাই দেখেই সে উৎসাহিত হয়ে বলল, এই দেখ বাবলু, এখানে কীসের যেন দাগ।

বাবলু অনেকক্ষণ ধরে গবেষকের মতো দাগগুলোর আশপাশ লক্ষ করে রায় দিল, এটা আততায়ীর কোনও চিহ্ন নয়।

ভোম্বল বলল, কী করে বুঝলি?

এখানে পুলিশ এসেছিল। চারদিকে বুটের ছাপ আছে। এ দাগ পুলিশের লাঠি ঠোকার। চলে আয়। একবার বারান্দার ওপরে উঠতে হবে আমাদের।

বিচ্ছু বলল, কী করে উঠবে? চারদিকে তা তালা দেওয়া।

পাইপ বেয়ে ওপরে উঠব। তোরা একটু গেটের দিকে নজর রাখবি, যাতে কেউ এসে না পড়ে।

বিলু বলল, এসে পড়বার ভয় নেই। কেন না মর্গ থেকে লাশ নিয়ে দাহ করে আসবে তো সব। কাজেই দেরি হবে।

বাবলু নিশ্চিন্ত মনে পাইপ বেয়ে ওপরে উঠল। উঠেই দেখতে পেল বারান্দায় পুলিশের পায়ের ছাপ এবং এক কোণে অন্য একটি পায়ের ছাপ রয়েছে। ঘর বন্ধ। ও আস্তে আস্তে ছাদের সিঁড়ির কাছে গেল! তারপর দরজার খিল খুলে ছাদে উঠে চারদিক দেখতে লাগল খুনি ছাদ দিয়ে নেমেছে বা পালিয়েছে কি না। কিন্তু না সেখানে আততায়ীর কোনও চিহ্নই সে দেখতে পেল না। হঠাৎ চিলেকোঠার সিঁড়িতে একজোড়া পায়ের ছাপ সে লক্ষ করল। বেশ বড় বড় জুতোহীন পায়ের ছাপ। কেউ যেন এই সিঁড়িতে বেশ কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়েছে।

বাবলু একটা ঝাঁটাকাঠি কুড়িয়ে সেই ছাপটার মাপ নিয়ে তাড়াতাড়ি বারান্দায় এসে অপর ছাপটার মাপ মিলিয়ে দেখল। হুবহু একই ছাপ। একই মাপ। কাঠিটা নিয়ে আবার পাইপ বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এল সে। তারপর বলল, আমাদের প্রাথমিক তদন্ত শেষ। এবার চল, স্বস্থানে প্ৰস্থান করি। এই বলে ওরা সেই ঝুলানো দড়ির কাছে গেল।

কিন্তু এ কী? দড়ি কোথায়?

ওরা ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল গাছের ডালের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা দড়িটা কে যেন খুলে নিয়ে গেছে। কে নিল? কে? কে সে?

বিলু বলল, আশ্চর্য ব্যাপার তো?

বাবলু বলল, কিছুই আশ্চর্য নয়। যে খুন করেছে সে নিজেই এসে খুলে নিয়ে গেছে ওটা।

ভোম্বল বলল, এ অসম্ভব। এটাই সম্ভব। খুনিরা চিরকাল এই ভুলটাই করে থাকে। খুনের পর ঘটনাস্থলের আশপাশেই ঘুরে বেড়ায় তারা। কেবল দেখে তার কোনও চিহ্ন কোথাও পড়ে আছে কিনা অথবা তাকে কেউ সন্দেহ করছে কি না।

বিলু বলল, তা হলে উপায়? এখন আমরা বেরোবি কী করে এর ভেতর থেকে?

বাবলু বলল, কোনও উপায় নেই। যতক্ষণ না ওরা ফিরে আসে ততক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

বিলু বলল, আশ্চর্য ব্যাপার। এরা সবাই না হয়। লাশ নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু দারোয়ান ব্যাটা? সে ব্যাটা গেল কোথায়?

ভোম্বল বলল, দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

বলতে বলতেই দেখা গেল গেট খুলে যাচ্ছে।

ওরা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ল একটা ঝোপের আড়ালে।

গেট খুলে কয়েকজন লোক ভেতরে ঢুকল। তাদের একজন হলেন এই ফ্যাক্টরি এবং বাড়ির মালিক। বাকিরা তার বন্ধুবান্ধব।। ওঁরা সবাই ভেতরে এলেন। গোটটা ভেজিয়ে দিয়ে বাড়ির তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। সেই অবসরে ওরাও সকলে বেরিয়ে পড়ল গেট দিয়ে।

বাবলুরা বাইরে এসে যেন হীপ ছেড়ে বাঁচল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল তখন।

বাবলু বলল, এখন একবার ময়দানের দিকে আমাদের যাওয়া উচিত।

ভোম্বল বলল, আমি একটু তফাতে থাকিব, কেমন? না হলে ব্যাটা আমাকে চিনে ফেলতে পারে। বাবলু বলল, সেটার আর প্রয়োজন নেই। তার কারণ গাছ থেকে দড়ি যখন খুলেছে তখন আমাদেরকে সে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছে।

বিলু বলল, তারই বা কী মানে আছে? হয়তো সে আমাদের দেখেনি। শুধু দড়িটাই ঝুলতে দেখেছে। তাই খুলে নিয়ে পালিয়েছে সে।

বাবলু বলল, যা হোক একটা কিছু হয়েছে। তবে আমরা সবাই একসঙ্গেই থাকব।

এই বলে কথা বলতে বলতে ওরা ময়দানের দিকে গেল। কিন্তু কোথায় কে? কোথায় সেই ইরানি যাযাবর আর কোথায় বা সেই জিপসি মেয়ে? ছাগল, বাঁদর, কুকুর, তাবু সবাই উধাও।

তাই দেখে হতবাক হয়ে গেল ওরা। ভোম্বল বলল, ওঃ! সকালে যদি একবার থানায় গিয়ে খবরটা দিতাম। কী ভুলই না করলাম আমরা। অথচ এখন আর মুখই নেই আমাদের।

বাবলু বলল, এত ভেঙে পড়বার কিছু নেই। একটা বেলার মধ্যে যাবে কোথায় বাছাধনরা। ওদের খুঁজে বার আমরা করবই করব।

ভোম্বলের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

আর পঞ্চু অকারণেই শুকে বেড়াতে লাগল মাঠের মাটিটাকে এবং নিজের মনেই রাগে গরগর করতে লাগল।

Super User