আজ রীমাও স্বামী-শাশুড়ীর সঙ্গে শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে। আর আরিফ আবসারের সনে দেখা করার জন্য তাদের বাসায় গিয়েছিল, সেও তাদের সঙ্গে এসেছে।

আবসার বাসায় চলে যাবার পর আরিফের পাশে একটা দাড়ি-টুপিওয়ালা ছেলে এসে বসল। আরিফ তাকে ঘটাখানেক আগে একজন রুগীকে নিয়ে হাসপাতালের ভিতর যেতে দেখেছিল। পাশে এসে বসার পর জিঞেস করল, আপনার রুগী কেমন আহে? 

ছেলেটার নাম ফয়সাল। বলল, একই রকম।

এমন সময় একটা বেবী এসে গেটের কাছে থামতে সবার দৃষ্টি সেদিকে পড়ল। একজন বয়স্কা মেয়ে তাড়াতাড়ি বেবী থেকে নেমে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেল।

দারোয়ান জিজ্ঞেস করল, ভিতরে কেন যাবেন? জানেন না, রুগী দেখার সময় বিকেল চারটেয়।

মেয়েটি বলল, আমি রুগী দেখতে আসিনি। আমার সাহেবের মেয়ে পায়খানা বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে এসেছি।

দারোয়ান বলল, সাহেবদের কেউ আসেনি?

মেয়েটি বলল, সাহেব গতকাল রাজশাহী গেছেন। তার আর কেউ নেই। দারোয়ান একবার বেবীর দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, কারো সাহায্যে নিয়ে আসুন।

মেয়েটি নিরুপায় হয়ে যেখানে রুগীদের লোকজন বসে আছে, সেখানে এসে কাতরে বলল, আপনারা কেউ আমাকে সাহায্য করুন। আমার সাহেবের মেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় বেবীতে রয়েছে।

সেখানে সব বয়সের অনেক মেয়ে-পুরুষ রয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, যে মেয়েটি বেবীতে রয়েছে তার কলেরা হয়েছে। তাই কেউ কোন কথা না বলে একবার বেবীর দিকে আর একবার মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখতে লাগল।

কেউ সাহায্য করতে আসছে না দেখে মেয়েটি আরো বেশি কাতরম্বরে বলল, আপনারা কেউ আসছেন না কেন? আপনাদের কারো মা-বোনের কলেরা হলে কি চুপ করে থাকতে পারতেন?

আরিফ এতক্ষণ দেখছিল, কেউ সাহায্য করতে যায় কিনা। এবার সে দাঁড়িয়ে ফয়সালের দিকে চেয়ে বলল, আসুন আমরা মেয়েটিকে সাহায্য করি।

ফয়সাল আরিফের কথায় সাড়া না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল।

আরিফ যা বোঝার বুকে গেল। মৃদু হেসে মেয়েটিকে বলল, চলুন আমি যাচ্ছি। তারপর বেবীর কাছে এসে রুগীকে দেখে মনে হোঁচট খেল। প্রথমে বয়স্কা মেয়েটিকে দেখে মনে করেছিল, কোন সাধারণ মধ্যবিত্ত সাহেবের বাড়ীতে কাজ করে। কিন্তু রুগীকে দেখে তার সে ভুল ভাঙল। এ যে কোটিপতির অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। রুগীর মুখের চেহারায় ও পোশাকে উঁচু আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। আরিফ অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল।

ততক্ষণে ঐ মেয়েটি বেবীর কাছে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আপনি একা কি পারবেন? আমি ধরছি বাবা।

আরিফ রুগীর রূপলাবণ্য দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। মেয়েটির কথায় বাস্তবে ফিরে এসে বলল, ইনশাআল্লাহ পারব। তারপর রুগীকে পাঁজাকোলা করে হাসপাতালের ভিতরে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারের সামনের স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল।

ঠিক সেই সময় রীমা স্বামীকে কিছু বলবে বলে গেটের দিকে আসছিল। একটা মেয়েকে আরিফ পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসে স্ট্রেচারে শোয়াতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

মেয়েটিকে শুইয়ে গিয়ে আরিফ যখন চলে যেতে উদ্যত হল তখন রীমার ডাক শুনতে পেল, আরিফ ভাই এদিকে একটু আসুন।

আরিফ রীমার কাছে গিয়ে বলল, খালুজান এখন কেমন আছেন?

: জ্ঞান ফিরেছে; তবে এখনো খিচুনী অল্প অল্প হচ্ছে। ডাক্তার পাউরুটি ও কলা খাওয়াতে বললেন। আপনার বন্ধুকে কিনে আনতে বলুন।

তাকে আমি কিছুক্ষণ আগে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। খেয়ে-দেয়ে আপনাদের ভাত নিয়ে আসবে।

রীমা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে বলল, তাহলে আপনি রুটি ও কলা নিয়ে আসুন। তার আগে বাইরের কলে হাত, পা ও মুখ ভাল করে ধুয়ে ফেলুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।

আরিফ টাকা না নিয়ে বলল, ওটা রেখে দিন, আমার কাছে আছে। তারপর রীমা কিছু বলার আগে সে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

প্রায় পনের বিশ মিনিট পর রুটি-কলা কিনে এনে রীমার হাতে দিল।

রীমা বলল, আপনার বন্ধু তো কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন। আপনার এখানে থাকার দরকার নেই। এক্ষুনি আপনি বাসায় গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করবেন। তারপর বিকেলের দিকে না হয় আসবেন। আর শুনুন, এই কাপড় চোপড় বাসায় গিয়ে লন্ড্রিতে পাঠিয়ে দেবেন।

আরিফ বলল, আবসার না আসা পর্যন্ত যাব না। আমি হোটেল থেকে খেয়ে এসে বাইরে থাকব। দরকার হলে ডাকবেন।

রীমা আতঙ্কিত স্বরে মিনতি করল, না আরিফ ভাই না। আপনাকে থাকতে হবে। আপনি একটা কলেরা রুগীকে দুহাতে জড়িয়ে ভিতরে এনেছেন। একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলে হয়ে এটা জানেন না, আপনার সর্ব প্রথম কর্তব্য হল, সাবান দিয়ে গোসল করে অন্য পোশাক পরা!

আরিফ মৃদু হেসে বলল, আপনার কথা অস্বীকার করছি না; তবে আপনি বোধ হয় জানেন না, সাবধানের যেমন মার নেই, তেমনি মারের সাবধান নেই।

রীমা বলল, দোহাই আপনার কথা না বাড়িয়ে যা বললাম তাই করুন।

আরিফ বলল, আপনি তো মায়ের জাত, তাই সব কিছুতেই অমঙ্গল চিন্তা করেন।

রীমা অধৈর্য হয়ে বলল, আহ আরিফ ভাই, তর্ক না করে শিগগির বাসায় যান।

আরিফ দৃঢ়স্বরে বলল, আপনি ওগুলো নিয়ে ভিতরে যান। আবসার আসার পর আপনার আদেশ পালন করব।

রীমা জানে আরিফ ভাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করে না, তাই তার কথা শুনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেল।

আরিফ আগের জায়গায় বসার জন্য আসবার সময় দেখল, ফয়সাল ফুটপাতে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছে। তার কাছে এসে পাশে বসে বলল, তখন আপনি মেয়েটিকে সাহায্য করতে আমার সঙ্গে এলেন না কেন? কোন অসুখকেই ভয় করা উচিত নয়।

ফয়সাল বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না। অসুখকে ভয় করে নয়, মেয়েরুগী বলে যাইনি।

কেন? রুগী রুগীই। সে মেয়ে হোক অথবা পুরুষ হোক। বিপদের সময় মেয়ে পুরুষ বিচার করা অজ্ঞতার পরিচয়।

 বেগানা মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া শক্ত গোনাহ।

আরিফ খুব অবাক হয়ে বলল, আপনি নিশ্চয় পড়াশুনা করছেন?

জ্বী, আলিয়া মাদ্রাসার ফাজেলের ছাত্র।

তবু এমন কথা বলতে পারলেন?  

কেন? কোন অন্যায় বলেছি নাকি?

নিশ্চয়ই।

আপনারা কোরআন-হাদিস পড়েন নি, আপনাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ অন্য রকম।

 আপনার কথা মানতে পারলাম না। আমি মুদ্রাসায় না পড়লেও আল্লাহপাকের রহমতে অনেক ধর্মীয় বই পড়েছি। কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাও পড়েছি। সেগুলোর মধ্যে বিপন্না নারীকে সাহায্যার্থে তার গায়ে হাত দিলে শক্ত গোনাহ হবে, একথা কোথাও পাইনি। জানেন না বুঝি, খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলা। জায়েজ? হারাম খাদ্য ছাড়া বাঁচার অন্য কোন উপায় না থাকলে, হারাম খাওয়া জায়েজ। অবশ্য বিপদ দূর হবে এবং হালাল খাবার পাওয়া গেলে ঐ সব নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তখন আল্লাহপাকের কাছে তওবা করে মাফ চেয়ে নিতে হয়। আসল কথা কি জানেন, মানুষ যা কিছু করুক না কেন আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে করলে তাকে গোনাহ স্পর্শ করতে পারে না। সব থেকে বড় কথা, মানুষ জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে সেগুলো মেনে চলবে এবং আল্লাহকে ভয় করে নিজেকে চরিত্রবান করে গড়ে তুলবে। তা যদি কেউ করতে পারে, তাহলে শয়তান তাকে দিয়ে কোন গোনাহর কাজ করাতে। পারবে না। একটা কথা না বলে থাকতে পারছিনা, আমি যতটুকু জ্ঞান লাভ করেছি, তাতে করে আমার মনে হয়, ধর্ম ও কিছু আনুষ্ঠানিক জিনিস নয়। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হল একত্ববাদ এবং নির্মল চরিত্র গঠন। হাদিস সম্বন্ধে আপনি আমার চেয়ে বেশি জান রাখেন; তবু একটা হাদিস না বলে পারছি না— রসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, মুসলমানদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উওম যে অধিক ধর্ম ভীরু ও চরিত্রবান। আর একটা কথা মনে রাখবেন, সমস্ত মানবকুলের উপকার করাই ইসলাম ধর্মের প্রধান হুকুমগুলোর মধ্যে অন্যতম।

এমন সময় আবসারকে আসতে দেখে বলল, এবার আসি, আমার কথায় মনে কি নিবেন না। তার সালাম বিনিময় করে আবসারের দিকে এগিয়ে গেল

আবসার সাড়ে তিনটের সময় ফিরে এসে আরিফকে দেখে বলল, তোর জন্য। ভাত এনেছি।

আরিফ বলল, তোর বৌয়ের হুকুম বাসায় গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে জামা-কাপড় পরে তারপর যেন খাঁই।

এরকম হকুম জারি করার পিছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে?

সেটা তার বৌকেই জিজ্ঞেস করিস জলে আরিফ আমার উদ্দেশ্যে রওয়ান দি।পথে আরিফের, মনে ঐ মেয়েটির ছবি ভেসে উঠল। ভাবল, এখন কেমন আর আল্লাহকে মালুম। বাসায় এসে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করে হাসপাতালে যখন ফিরে এল তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। খায়ের সাহেবের বেডের কাছে এসে তখনও স্যালাই। চলছে দেখে আবসারকে জিজ্ঞেস করল, কিরে খালুজান এখন কেমন আছেন?

আবসার বলল, খিচুনি বন্ধ হয়েছে গত?

রীমা জায়গা ছেড়ে দিয়ে বলল, বসুন আরিফ ভাই। 

আমি অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি, এবার একটু দাঁড়াই।

আরিফ বসে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলল, ভাবী এ মেয়েটি কেমন আছেন জানেন

রীমার ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলে গেল। বলল, পাশের ওয়ার্ডের দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকের বেডে মেয়েটা আছে। যান, গিয়ে দেখে আসুন। আমি কিছুক্ষণ আগে গিয়ে দেখে এসেছি। অবস্থা তেমন ভাল নয়। তার কাছে যে বয়স্ক মেয়েটি রয়েছে, তাকে আমি মেয়েটার বাবা-মার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম বলল, মা নেই, বাবা আছেন। তিনি গতকাল রাজশাহী গেছেন। দুতিন দিন পর ফিরবেন।  

আরিফ মেয়েটির বেডের কাছে এসে বয়স্কা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন আছে?

বয়স্ক মেয়েটির নাম আকাশী। সে বলল, বমি বন্ধ হয়েছে; কিন্তু পায়খানা সমানে হচ্ছে।

আরিফ আবার জিজ্ঞেস করল, বাসায় কে কে আছে

আকাশী বলল, একজন কাজের লোক, একজন মালি ও একজন কাজের মেয়ে আছে। সাহেবের আর কোন ছেলে-মেয়ে নেই। এই মেয়েকে দশ বছরের রেখে বেগম সাহেবা মারা গেছেন। আমি সাহেবের দেশের মেয়ে! বেগম সাহেব মারা যাবার পর আমি একে মানুষ করেছি।

আরিফ তার কাছ থেকে তাদের বাসার ঠিকানা জেনে নিয়ে আসারের কাছে এসে বলল, আমি মেয়েটার বাসা থেকে একটু আসছি। তারপর ডাক্তার ও নার্সদের মেয়েটির দেকে লক্ষ রাখতে বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল।

আকাশী ঠিকানা বলেছিল- বনানী, বাড়ীর নাম্বার আটষতি আরিফ গেটের বাইরে এসে একটা বেবী নিয়ে রওয়ানা দিল। ঠিকানা মত পৌঁছে গেটে দারোয়ানের কাছে বাধা পেল।

দারোয়ান জিজ্ঞেস করল, কাকে চান? বাড়ীতে কেউ নেই।

আরিফ বলল, তা জানি। আমি মহাখালী কলেরা হাসপাতাল থেকে এসেছি। আপনাদের সাহেবের মেয়ের অবস্থা তত ভাল নয়। সাহেবকে ফোন করে জানাবার জন্য এসেছি। বাসার কাজের লোকটিকে ডাকুন।

দারোয়ান বলল, আপনি সোজা চলে যান। বারান্দায় কলিং বেল আছে।

গেট দিয়ে ঢুকে আরিফের চোখ জুড়িয়ে গেল। গেট থেকে বেশ দূরে দ্বিতল সিরামিক ইটের কারুকার্যখচিত বাড়ী। বাড়ীটার সামনে বিভিন্ন ফুলের গাছ। কত রকমের যে ফুল ফুটে রয়েছে, আরিফ তাদের বেশির ভাগ নাম জানে না। একজন মালি প্লাস্টিকের পাইপ ধরে যা গাছে পানির ফোয়ারা দিচ্ছে। লোকটা আরিফের দিকে একবার চেয়ে নিজের কাজ করতে লাগল। আরিফ পা চালিয়ে বারান্দায় এসে কলিংবেলের বোতাম চাপ দিল।

মিনিট খানেক পরে একটা বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোক দরজা খুলে বেশ অবাক হয়ে আরিফের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল

আরিফ সালাম দিয়ে বলল, আমাকে চিনবেন না। আমি হাসপাতাল থেকে আসছি। সাহেবের মেয়ের অসুখ খুব বাড়াবাড়ি। রাজশাহীতে সাহেবকে ফোন করতে হবে। আপনি সেখানকার টেলিফোন নম্বর জানেন?

লোকটির নাম আসগর। সে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমিটেলিফোন নাম্বার জানি না। আপনি আমার সঙ্গে আসুন, টেলিফোনে টেবিলে একটা বই আছে সেটা দেখে সাহেবকে ফোন করতে দেখেছি। তাতে হয়তো থাকতে পারে।

আরিফ তার সঙ্গে ভিতরে এসে দেখল, টেবিলের উপর একটা টেলিফোন ইনডেক্স রয়েছে। সেটা নিয়ে রাজশাহীর তিন-চারটে নাম্বার দেখতে পেয়ে একটার পর একটা ডায়াল করে চলল। কিন্তু রিং হলেও ধরছে না। শেষে লাস্ট নাম্বারে ডায়াল করতে ওপারে একজন লোকের গলা পাওয়া গেল। টেলিফোন করার আগে আরিফ আসগরের কাছে সাহেবের নাম জেনে নিয়েছিল। ওপারের লোকটা হ্যালো বলতে আরিফ সালাম দিয়ে বলল, আমি ঢাকা থেকে ফোন করছি, এখানে কি ইলিয়াস সাহেব আছেন?

লোকটি সালামের উত্তর দিয়ে বলল, না, নেই। উনি একটা কাজে বাইরে গেছেন। আপনি কে বলছেন?

আমাকে চিনবেন না। আপনি ইলিয়াস সাহেবকে দয়া করে বলবেন, ওনার মেয়ে ডাইরীয়া হয়েছে। মহাখালী কলেরা হাসপাতালে আছে। যত তাড়াতাড়ি সব আসতে বলবেন।

লোকটি আতঙ্কিত স্বরে বলল, তাই নাকি! ঠিক আছে, আমি ওনাকে খবরটা দেবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আপনার নামটা অন্তত বলুন।

আরিফ নাম বলে সালাম দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল। তারপর সেখান থেকে হাসপাতালে ফিরে এসে দেখল, খিচুনি বন্ধ হয়েছে। সাহেবকে ফোন করার কথা আকাশীকে বলে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি বাইরে থাকব। দরকার মনে করলে ডাকবেন।

আরিফ যখন সাহেবের মেয়েকে বেবী থেকে হাসপাতালের ভিতর নিয়ে আসে তখন কতজ্ঞতায় আকাশীর চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এখন তার কথা শুনে আবার চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, আপনি যা করছেন তা অতি আপনজনও করবে না। আল্লাহ আপনার ভাল করবেন।

 আরিফ বলল, আমি কি আর করছি মা, সবকিছু আল্লাহপাকের ইচ্ছ। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কি হাসপাতালের খাবার খেতে পারেন, না আমি হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসব।

আকাশী বলল, আমি হাসপাতালের খাবারই খাব। হোটেল থেকে কিছু আনতে হবে না। আরিফ আর কিছু না বলে খায়ের সাহেবের বেডের কাছে এসে ওঁর স্ত্রীকে বলল, খালাআ, আবসার কি ভাবীকে নিয়ে বাসায় গেছে?

আকলিমা বেগম বললেন, হ্যাঁ বাবা, বৌমাকে রেখে রাতের খাবার নিয়ে আসবে।

আরিফ বলল, আমি বাইরে আছি, ও এলে দেখা হবে।

আকলিমা বেগম কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

রাত আটটার সময় আবসার ভাত নিয়ে এসে আরিফকে দেখে বলল, কিরে তুই। এখনো আছিস?

তাতো দেখতেই পাচ্ছিস।

মেয়েটার বাসায় গিয়ে কোন কাজ হল?

রাজশাহীতে ফোন করেছিলাম; কিন্তু ওর বাবাকে পাইনি, তবে যে লোক ফোন ধরেছিল, তাকে খবরটা ওর বাবাকে জানাতে বলেছি।

চল, ভাতটা মাকে দিয়ে আসি। সেই সাথে মেয়েটাকেও দেখে আসব।

দুজনে ভিতরে এসে আবার বেডের কাছে আবসার ভাতের টিফিন বাক্সটা রাখল।

ওদের দেখে আকলিমা বেগম বললেন, বমি আর হয়নি। পায়খানাও কমেছে। তোরা বাসায় যা। সকালে আসবি।

আবসার বলল, সে দেখা যাবে, আমরা ঐ মেয়েটাকে একটু দেখে আসি। তারপর মেয়েটার বেড়ে গিয়ে আকাশীর কাছে শুনল পায়খানা-বমি কমলেও এখনো জ্ঞান ফিরেনি।

আরিফ আকাশীকে বলল, আমি মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নেব। তারপর বাইরে এসে আবসারকে বলল, তুই বাসায় চলে যা, আমি তো রয়েছি। আবার রাজি না হতে জোর করে তাকে একটা বেবীতে তুলে দিল।

পরের দিন সকালে রীমা তার দেব সাকিবকে নিয়ে এল। রীমা সাকিলের সনে আকলিমা বেগমকে বাসায় পাঠিয়ে দিল। বেলা বারোটার সময় খায়ের সাহেবের অবস্থার উন্নতি হলে তিনি বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। আবসার ডাক্তারদের সনে পরামর্শ করে বাবাকে নিয়ে বাসায় চলে গেল।

যাবার আগে ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়তে তাকে দেখতে গেল। গিয়ে দেখল তার জ্ঞান ফিরেছে। জিঞ্জেস করল, এখন কেমন আছেন?

: ভাল, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না।

 আমাকে চিনবেন না। গতকাল আমার বাবাকে নিয়ে এখানে এসেছি। যে ছেলেটা আপনাকে সাহায্য করেছে আমি তারই বন্ধু। এখন বাবাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম, আপনাকে একটু দেখে যাই। আয় এবার আলি, আল্লাহ হাফেজ।

ঐ মেয়েটির নাম ফাল্গুনী। সকালের দিকে জ্ঞান ফিরে পেয়ে চারদিকে চেয়ে বুঝতে পারল, হাসপাতালে আছে। আকাশীকে জিজ্ঞেস করল, খালা, আমাকে এখানে কখন নিয়ে এলে?

আকাশী বলল, গতকাল বেলা দুটোর সময় তুমি যখন অজ্ঞান হয়ে গেলে তখন একটা বেবিতে করে নিয়ে আসি। তারপর কিভাবে আরিফ তাকে সাহায্য করল সে কথা বলে আরো বলল, মনে হয় ছেলেটা এখনো বাইরে বসে আছে। রাতে কয়েকবার তোমাকে দেখে গেছে। ডাক্তার ও নার্সকে তোমার দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছে। এই তে কিছুক্ষণ আগেও এসেছিল। আবার হয়তো আসবে।

ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে খবর দেওয়া হয়েছে?

আকাশী বলল, ঐ ছেলেটা আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাসায় গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, রাজশাহীতে টেলিফোন করে খবর দেওয়া হয়েছে।

ফাল্গুনীর মন আরিফের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। ভাবল, যার মধ্যে এত মানবতা রয়েছে নিশ্চয় সে দেখতেও সুন্দর। আকাশীকে বলল, তাকে ডেকে নিয়ে এস।

আকাশী বাইরে এসে আরিফকে পেল না। ফিরে এসে বলল, তাকে পেলাম না।

আরিফ ভোরে মেয়েটিকে দেখে মসজিদে ফযরের নামাজ পড়তে গিয়েছিল। নামাজ পড়ে পাঞ্জে সূরা তেলাওয়াত করে মেয়েটির রোগমুক্তির জন্য দেওয়া করল। তারপর এসরাকের নামাজ পড়ে ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, মেয়েটি যদি ভাল থাকে, তাহলে বাসায় গিয়ে গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করে আসবে। হাসপাতালে ঢুকে ওয়ার্ডের কাছে গিয়ে দেখল, মেয়েটির জ্ঞান ফিরেছে। মনে মনে আল্লাহপাকের শোকর গোজারি করে বেডের কাছে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, এখন কেমন বোধ করছেন? সারারাত খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

আরিফের রাতজাগা মলিন চেহারা দেখে ফাল্গুনীর মন ব্যথায় টনটন করে উঠল। তারপর কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভিজে গলায় বলল, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার নেই। আকাশী খালার মুখে যা শুনেছি তা অতি আপনজনও করে না।

আরিফ বলল, কি আর এমন করেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন। আপনাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেন। এখন আমি একটু বাসায় যাব, পরে আবার আসব।

ফাল্গুনী কিছু বলার আগে আকাশী বলল, হ্যাঁ বাবা তাই যান। সারারাত কষ্ট তো আর কম করেননি? বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিন।

আরিফ ফাল্গুনীর মুখের দিকে চেয়ে বলল, আসি কেমন? তারপর সেখান থেকে বাসায় এসে গোসল করে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

 দুপুরে ওমরের ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠে বলল, এত ডাকাডাকি করছ কেন ওমর চাচা?

গোফরান সাহেব আর সুফিয়া বেগম সাড়ে তিন বছরের আরিফকে যখন নিয়ে আসে তখন তাকে দেখাশুনা করার জন্য গোফরান সাহেব এমরকে মাসিক বেতনে নিজের বাড়ীতে এনে রাখে। আরিফের সঙ্গে সবসময় থাকাটাই ওমরের কাজ। তাকে অন্য কোন কাজ করতে দেওয়া হয় না। বলাবাহুল্য, নেসার ফকিরের দেওয়ার বরকতে এই ওমরেরই গুলো পা ভাল হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক আরিফ যতদিন গ্রামের বাড়ীতে লেখাপড়া করেছে, ততদিন ওমর তার নিত্যসঙ্গী ছিল। ঢাকায় পড়তে আসার সময়। গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম তাকে আরিফের সেবাযত করার জন্য আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে ওমরকে তার কাছে রেখেছে। মাঝে মাঝে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম এসে বেশ কিছুদিন থেকে আবার চলে যান। তারা সময়মত ওমরের বিয়ে দিয়েছেন। বেয়ের নাম আনোয়ারা। আনোয়ারা গরিব ঘরের মেয়ে। কিন্তু খুব কর্মঠ ও স্বামীভক্ত। ওমরকে সব সময় আরিফের কাছে থাকতে হয়। আরিফ যখন বাড়ী যায় তখন ওমরও তার সঙ্গে যায়। গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম আনোয়ারাকে নিজেদের কাছে রেখেছেন। তাদের কোন ছেলেমেয়ে হয়নি।

আরিফের কথা শুনে ওমর বলল, কাল সারাদিন ও সারারাত কোথায় ছিলেন? বন্ধুর বাসায় যাবার কথা বলে সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। আমি সারারাত জেগে কাটিয়েছি। সকালে এসে নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়েছেন, এখন বেলা দুটো বাজে। ডাকাডাকি করব না তো কি করব? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত না করলে শরীর টিকবে কেন? সাহেব বেগম এসে আপনার শরীর রোগা হয়ে গেছে দেখলে, আমাকে বকাবকি করবেন। a ওমর নিরেট মূ। দেশে থাকাকালীন সময়ে ওমর তাকে ছোটবেলা থেকে একরকম মানুষ করেছে বলে তুমি করেই বলত। ঢাকায় আসার পর আরিফ তাকে কিছু কিছু বাংলা-ইংরেজী শিখিয়েছে। কার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও শিখিয়েছে। প্রথম দিকে ওমর অভ্যাসমত সবাইকে তুমি করে বলত। তারপর আরিফের কথামত এখন আর সেরকম করে না। বেশ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে।

আরিফ বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে যাবার সময় বলল, তুমি যাও, আমি নামাজ পড়ে ভাত খাব।

খাওয়া-দাওয়ার পর আরিফ ওমরকে বলল, আচ্ছা ওমর চাচা, কখনো কখনো কারো দিকে তাকালে তার ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই, তার মনের কথা বুঝতে পারি, এরকম কেন হয় বলতে পার?

ওমর আরিফের আসল পরিচয় জানে। তার মা বাবাকে ও নানা নানীকে জানে। আরও জানে আরিফের ছোট বেলার ইতিহাস। আরিফের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন একদিন মাদ্রাসা থেকে ঘরে ফেরার সময় ওমরকে বলল, ওমর চাচা, এ বছর গ্রামে বসন্ত হয়ে অনেক লোকজন ও হেলেমেয়ে মারা যাবে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কয়েকটা ছেলেমেয়ের নাম বলে বলল, এরাও মারা যাবে। এর আগেও আরিফ ওমরকে এমন কিছু কথা বলেছিল যা কিছুদিনের মধ্যে ঘটেছিল। তখন ওমর মনে করেছিল, আরিফ পরীর পেটে জন্মেছে, তাই হয়তো আগাম ঘটনা জানতে পারে। তারপর যখন আরিফ খাঁমে বসন্ত হয়ে অনেকে মারা যাবার কথা বলল তখন ওমর ভাবল, এই কথা গ্রামের লোকজন জানতে পারলে খুব খারাপ হবে। ঘরে এসে গোফরান সাহেবকে সে কথা জানিয়ে বলল, আগেও সে আমাকে এরকম যত কথা বলেছে তা সব সত্য হয়েছে।

গোফরান সাহেবের তখন নেসার ফকিরের কথা মনে পড়ল। আরিফ যে এরকম কথা বলবে তা তিনি বলেছিলেন। ওমরকে বলল, তুমি এসব কথা অন্য কাউকে বলবে

ওমর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চলে গেল।

গোফরান সাহেব স্ত্রীকে ওমরের কথা বলে জিজ্ঞেস করল, আরিফের বয়স কত হল বল তো?

সুফিয়া বেগম হিসাব করে বলল, পাঁচ বছর পার হয়েছে। নেসার ফকির যে তাবিজ পরাবার জন্য দিয়েছিলেন তার এখনো এক বছর দেরি আছে। তারপর আরিফের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, তুমি তোমার ওমর চাচার কাছে যে সব কথা বলেছ, সে সব অন্য কারো কাছে বলো না। আবার যখন এরকম কথা তোমার মনে হবে তখন ওমরকে বা অন্য কারো কাছে না বলে আমাদের কাছে বলবে।

 সে বছর সত্যি সত্যি বসন্ত হয়ে অনেক লোক মারা গিয়েছিল। এর কিছুদিন পর আরিফ স্কুলে ভর্তি হল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে মা বাবাকে বলল, সামস চাচা আজ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল; কিন্তু আমার গলায় চাপ দিতে পারেনি। কয়েকবার চেষ্টা করে যখন পারল না তখন বলল, তোর মা পরী ছিল তাই বেঁচে গেলি। তারপর ওর চাচাকে আসতে দেখে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।

সুফিয়া বেগম ভয়ার্ত করে জিজ্ঞেস করল, তোর ওমর চাচা তোকে রেখে কোথায় গিয়েছিল?

 আরিফ বলল, সে আমাকে রাস্তার একপাশে দাঁড়াতে বলে একটু দূরে পায়খানা করতে গিয়েছিল।

 গোফরান সাহেব জিজ্ঞেস করল, তাকে এই কথা বলেই নাকি?

আরিফ মাথা নেড়ে বলল, না। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আচ্ছা আশা, সামস চাচা আমাকে মেরে ফেলতে চায় কেন? আর কেন সে বলল, আমার মা পরী ছিল? তাহলে তুমি কে?

সুফিয়া বেগম চমকে উঠে আরিফকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোর সামসু চাচা মিথ্যে বলেছে। তার কথা বিশ্বাস করিস না। সে আমাদের সকলের দুশমন।

গোফরান সাহেব বলল, হ্যাঁ বাবা, তোমার আশা ঠিক কথা বলেছে। সাম আমার চাচাতো ভাই হলে কি হবে আমাদের দুশমন। তোমাকে মেরে ফেললে, সে আমাদের সব সম্পত্তি পাবে, তাই তোমাকে মেরে ফেলতে চায়। তারপর ওমরকে ডেকে বলল, তুমি আরিফকে রাস্তাঘাটে একা রেখে কোথাও যাবে না। আজ রাস্তায় রেখে তুমি যখন পায়খানা করতে গিয়েছিল, সেই সময় সামসু ওকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তোমাকে আসতে দেখে পালিয়ে যায়।

ওমর চমকে উঠে বলল, তাই নাকি দাদা? আমিও এবার সজাগ থাকব, দেখব কে আরিফের গায়ে হাত দেয়।

তার পর আরিফের বয়স সাত বছর হতে গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম নেসার ফকিরের কথা মত তার গলায় একটা তাবিজ বেঁধে দিল।

গোফরান সাহেবের চাচাতো ভাই সামস। সেও বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তার চার মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটা সবার ছোট। নাম রফিক। রফিক খুব দুরন্ত ছেলে। কোন কিছুতে ভয় পায় না। তার সঙ্গে আরিফের খুব ভাব। আরিফও তার বাবার প্রথম জীবনের মত ডানপিটে হয়েছে। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা আরিফকে গোফরান সাহেবের শালার ছেলে এবং নেশার ফকিরের নাতি বলে জানলেও অনেকে গোফরান সাহেবের ছেলে বলেই জানে। তাই আরিফের ডানপিটে স্বভাবের কথা জেনেও কেউ কিছু বলে না। কিন্তু সামসু আরিফের সব কিছু জানে। গোফরান সাহেবের ছেলেমেয়ে হয়নি বলে সে খুব খুশি ছিল। কারণ নিঃসন্তান চাচাতো ভাইয়ের মালিক সে একসময় হত। গোফরান আরিফকে পোষ্যপুত্র করায় তার সে আশায় বাজ পড়ে। তাই সে আরিফকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায়। আল্লাহপাকের কি কুদরত, সামসুর ছেলে রফিকের সঙ্গে আরিফের বন্ধুত্ব দিনের পর দিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ছোটবেলা থেকে দুজনের ভাব-চরিত্রও প্রায় একই রকম। এত বড় হতে লাগল, তত গ্রামের লোকজন তাদের দুরন্তপনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। গোফরান সাহেব ও সুফিয়া বেগম শাসন করতে পারে না, তবে অনেক বোঝায়। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

সামসুও ছেলেকে আরিফের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে, অনেক বোঝায় এবং তাতে কাজ না হতে শাসনও করেছে; কিন্তু ফলাফল কিই হয়নি। শেষে সামসু ছেলে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর যখন ম্যাট্রিক পাস করল তখন একদিন রফিককে আরিফের আসল পরিচয় জানিয়ে বলল, ও পরীর পেটে হয়েছে। ওর সঙ্গে মেলামেশা ছেড়ে দে। ওর নানার জীন-পরীর সাথে কারবার ছিল। সেও একদিন তাই করবে। ওর সাথে সব সময় একজন জীন থাকে। সেই জীন তোর ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া ও পরের ছেলে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ও না থাকলে তোর গোফরান চাচার সব সম্পত্তির মালিক আমরা হতাম। আরিফের বাপেরও অনেক বিষয়-সম্পত্তি ও ব্যবসাপত্র আহে। সে সব ওর চাচা ভোগদখল করছে। বড় হয়ে আরিফ সেসব পাবে। তার উপর তোর গোফরান চাচার সব বিষয়-সম্পত্তি পেয়ে কত বড়লোক হয়ে যাবে। আর তুই কি পাবি? আমার আর কতটুকু আছে। ওকে এখান থেকে তাড়াতে পারলে তোর গোফরান চাচার সবকিছু তুই পাবি। তারা আরিফকে তার আসল মা-বাপের কথা বলেনি। তুই তাকে ববি। বললে, আমি মনে কষ্ট পেয়ে তার চাচার কাছে চলে যাবে। তারপর গোফরান ও তার বৌ মারা যাবার পর তাদের সম্পত্তি তুই একা পেয়ে যাবি।

রফিক বাবার কথা শুনে বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারটা যতটা না বিশ্বাস করল, তার চেয়ে জীন-পরীর কথাটা বেশি বিশ্বাস করল। রণ তখন তার গত বছরের একদিনের ঘটনা মনে পড়ল তখন গরমের সময়। স্কুল বন্ধ। অনেক দিন বৃষ্টি না হওয়ায় গরম খুব জানাচ্ছে। সেদিন দুপুরের পর লোকজন সখন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন ওরা দুজন কবরস্থানের পাশে যেখানে নেসার ফাঁক ঘর করে বসবাস করেছিলেন, সেখান গেল। এখন সেখানে বাড়ির চিহ্ন নেই। জলে ভরে গেছে। তবে নেসার ফকির চলে যাবার পর অনেক গরিব মেয়ে জ্বালানির জন্য গাছের শুকনো পাতা ও ডালপালা নিতে সেখানে যায়। কি আগের মত কেউ আর অসুস্থ হয়ে মারা যায় না। নেশার ফকির তিন-চারটে নারকেল গাছ লাগিয়েছিলেন। সেগুলোতে এর নারকেল হয়। কেউ সেসব পেড়ে আনতে সাহস পায় না। গাছেই শুনো হয়ে যখন পড়ে তখন ঐসব গরিব মেয়েরা কুড়িয়ে নিয়ে আসে। আগের দিন বিকেলে দুবাতে অন্য গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। ফেরার পথে কবরনের পাশ দিয়ে আসবার সময় সেই সব গাছে প্রচুর ভাব দেখেছে। তাই আজ দুজনে বুক্তি করে একটা বড় চাকু নিয়ে এখানে ডাব খেতে এসেছে। দুজনেই গাছে চড়তে ওস্তাদ। সেখানে এসে আরিফ বলল, প্রতিদিন এখানে ডাব খেতে আসব, কি বলিস।

রফিক বলল, তুই ঠিক বলেছিস। শালা এইসব গাছে এত ভাব আছে আগে জানলে এমের লোকের ডাব চুরি করে খেতাম না। রফিক ও আরিফদের প্রচুর ডাব গাছ থাকলেও তারা দুম করে অন্যের গাছের ডাব খেত।

আরিফ বলল, আজ আমি উঠি, কাল তুই উঠিস। তারপর সে তর করে গাছে উঠে ডাব পেড়ে নামার সময় সেখীর কাছ থেকে হাত ফসকে পড়ে গেল।

রফিকের বুক ধড়াস করে উঠল। ভাবল, অত উঁচু থেকে পড়ে আরিফ হয়তো মরেই গেল। ভয়ে ও আতকে কয়েক সেকেন্ড নড়তে-চড়তে পারল না। তারপর আরিফকে ওঠহাত-পায়ের ধুলো ঝড়তে দেখে খুব অবাক হল। তার কাছে এসে বলল, কিরে তুই বেঁচে আছিস? আমি মনে করেছি তুই মরেই গেছিস। যা ভয় পেয়েছিলাম না।

আরিফ বলল, আরে মরণ কি এতই সহজ। যার যখন হায়াৎ শেষ হবে, সে তখন মরবে।হায়াৎথাকতে কেউ মরে না, বুঝলি।

রফিক বলল, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু অত উঁচু থেকে পড়ে গেলি অথচ তোর হাত পা ভাঙল না,এটা অবাক লাগবে।

আরিফ বলল, তোর মত আমিও খুব অবাক হচ্ছি। হাত রুমকে যেতে ভাবলাম, পড়ে গিয়ে হয়তো মরেই যাব অথবা হাত-পা ভেঙে গুড়ো হয়ে যাবে। সে কথা ভেবে খুব ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আমাকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিল। দেখ না পড়ে গিয়ে আমার গায়ে একটুও আঁচড় লাগেনি। এই কথা বলে হাত-পা দেখাল।

রফিক বলল, আব্বা একদিন আমাকে এদিকে আসতে নিষেধ করেছিল। এখানে নাকি জীন-পরীরা বাস করে। তাদেরই কেউ হয়তো তোকে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে। তাই তোর কোন ক্ষতি হয়নি।

আরিফ বলল, আমাকেও আব্বা একদিন ঐ কথা বলে এদিকে আসতে নিষেধ করেছিল। আমি কিন্তু ওসব বিশ্বাস করিনি।

রফিক বলল, বাদ দে ওসব কথা, এখন ডাব খাওয়া যাক।

ডাব খাওয়ার পর আরিফ বলল, ডাব গাছে উঠ উওর দিকে একটা পাকা কবর দেখেছি। চল দেখে আসি।

রফিক অবাক হয়ে বলল, তাইনাকি! চল ত দেখি।

কবরের কাছে এসে তারা খুব অবাক হল। কবরটা যেন মাত্র কয়েক দিন আগে তৈরি হয়েছে। আরিফ বলল, কি ব্যাপার বল তো? প্রায় ছয়-সাত মাসের মধ্যে আমাদের গ্রামে কেউ মারা গেছে বলে শুনিনি। তাছাড়া কবর পাকা করার মত টাকা, আমাদের আর তোদের ছাড়া কার আছে?

রফিক বলল, আমিও সে কথা ভাবছি। আরো একটা কথা ভাবছি, মনে হচ্ছে কেউ যেন কবরের চারপাশ প্রতিদিন ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে।

আরিফ বলল, হ্যাঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে।

রফিক বলল, চল এবার ঘরে যাই।

ফেরার পথে রফিক বলল, তুই যেন আবার ঘরে গিয়ে তোর আবা-আম্মাকে এসব কথা বলিসনা। তা না হলে তারা তোকে আর এদিকে আসতে দেবে না। এমনিতেই ওমর সব সময় তোর সঙ্গে থাকে।

আরিফ বলল, তুই পাগল হয়েছিল। একথা কাউকে বলব না। আর তুইও কাউকে বলবি না।

 এর পর থেকে তারা প্রায়ই ডাব খেতে এখানে আসে।

আজ আবার মুখে আরিফের আসল পরিচয় পেয়ে রফিক ভাবল, আব্বার কথাই ঠিক, নচেৎ সেদিন অত বড় ভাব গাছ থেকে পড়ে গিয়েও তার কিছু হল না কেন? আর আরিফও সেদিন বলেছিল, তাকে কেউ যেন ধরে মাটিতে শুইয়ে দিল।

ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে সামসু ভাবল, এবার হয়তো কাজ হবে। বলল, খবরদার আরিফের সঙ্গে মিশবি না, ওর সাথেও জীন-পরী থাকে।  

রফিক কবরের কথাটা এতদিন কাউকে না বললেও আজ আব্বাকে জানাল।

সামসু শুনে চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ! করেছিস কি? ঐ জায়গাটা হল জীন পরীদের আডডা। আর ঐ কবরটা হল আরিফের মায়ের। জীন-পরীরা প্রতিদিন কবরের চারপাশ পরিষ্কার করে। আরিফ পরীর ছেলে, তাকে তারা কিছু বলবে না বরং সাহায্য করবে। তাই তো সেদিন গাছ থেকে পড়ে যাবার সময় জীনেরা তাকে ধরে নামিয়েছে। খবরদার, আর কখনও ঐদিকে যাবি না।

আব্বার কথাগুলো রফিকের দৃঢ় বিশ্বাস হল। বলল, ঠিক আছে আবা, আমি আর আরিফের সঙ্গে মিশব না, ঐ জায়গাতেও কোনদিন যাবনা। আর আরিফকে তার আসল পরিচয় জানাব।

সামসু চিন্তা করল এবার হয়তো তার মনের ইচ্ছা পূরণ হবে।

<

Super User