হোসেন স্যারের আসল পরিচয় চৌধুরী বাড়ির সবাই জেনে অবাক হলেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না। কিন্তু বড় বৌ সুরাইয়া মাথা না ঘামিয়ে পারল না। এক ছুটির দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রুকসানার রুমে গেল।
রুকসানা শুয়ে শুয়ে ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিল। তাকে দেখে উঠে বসে বলল, কি ব্যাপার? এমন সময় তো তুমি আমার রুমে কখনো আসনি? কিছু দরকার থাকলে বলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়।
সুরাইয়া তার পাশে বসে বলল, বড় আপা, তুমি কাকে সব থেকে বেশি ভালবাস বলবে?
রুকসানা বলল, তাহলে কোনো দরকারে আসনি? করিম বুঝি ঘরে নেই? তাই ফাজলামী করতে এসেছ? যাও ভাগো। আমার শরীর ভালো না, একটু ঘুমাব।
আমার কথার জওয়াব না দিলে যাব না।
তুমি একটা আস্ত পাগল, তাই পাগলের মতো কথা বলছ। তোমাকে সবার। থেকে বেশি ভালবাসি বললে মনিরা মমতাজ ও আরেফা কি মনে করবে ভেবে দেখেছ?
আমি কিন্তু তা জানতে চাইনি। শোন বড় আপা, তোমার ভাইয়ের কাছে ইকবাল হোসেন স্যারের সব কথা শুনেছি। তোমার কাছে ওয়াদা করেছিলাম বলে আজও কাউকে বলিনি। কিন্তু এখন আর সেই ওয়াদা রাখতে পারব না। তাই অনুমতি নিতে এসেছি, তুমি যে ইকবাল হোসেন স্যারের জন্য আজও অপেক্ষা করে আছ, সে কথা তোমার ভাইকে জানিয়ে বিহিত করার জন্য।
এমন সময় করিমন বুয়া এসে রুকসানকে বলল, আপনার সই এসেছেন। তিনি চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে কথা বলছেন। আম্মা আপনাকে খবরটা দিতে বললেন।
রুকসানা তাকে বলল, তুমি যাও, আমি আসছি। করিমন চলে যাওয়ার পর সুরাইয়াকে বলল, এখন যাও। তোমার সঙ্গে পরে আলাপ করব। তারপর দুজনে একসঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে এসে রুকসানা আব্বার রুমে গেল।
আসমা স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসিয়ে উপরে উঠে আজিজা বেগমকে দেখে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল। তারপর বলল, চাচি আম্মা আপনারা কেমন আছেন?
আজিজা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, বেঁচে থাক মা, আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। তারপর বললেন, আল্লাহর রহমতে আমি এক রকম আছি মা; কিন্তু তোমার চাচার সেই একই অবস্থা। এতবছর চিকিৎসা চলছে কোনো উন্নতিই নেই।
আসমা বলল, চলুন চাচার কাছে যাব।
আজিজা বেগম করিমনকে ডেকে বললেন, রুকসানাকে বল, তার সই এসেছে। তারপর আমাকে বললেন এস মা। রুমে ঢুকে আজিজা বেগম স্বামীকে বললেন, দক্ষিণ ফুকরা থেকে রুকসানার সই তোমাকে দেখতে এসেছে।
আসমা সালাম দিয়ে কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে চুমো খেয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?
আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, আমার আর থাকা না থাকা মা। তোমার আব্বা ভালো আছেন?
জ্বি, ভালো আছেন।
এমন সময় আব্দুল মতিন বড় মেয়েকে আসতে দেখে বললেন, রুকসানা আসছে। যাও মা তার ঘরে গিয়ে গল্প কর।
দরজার দিকে আসমার পিঠ ছিল, তাই রুকসানাকে আসতে দেখেনি। চাচার কথা শুনে ঘুরে তাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, সই, কেমন আছিস?
রুকসানা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তারপর একটা হাত ধরে বলল, আমার রুমে চল। যেতে যেতে বলল, এবারে প্রায় দেড় বছর পর এলি। সয়াকে বলে এক সপ্তাহ রেখে দেব।
বিয়ের পর আসমা প্রতি বছর এসে দু’তিন দিন বেড়িয়ে যায়। চৌধুরী বাড়ির সবাই তাকে চিনে। বাচ্চা হওয়ায় ও ইকবাল আসার ফলে দেড় বছর আসতে পারেনি। রুকসানার কথা শুনে বলল, পাগলামী করবি না। এবারে একদিনও থাকতে পারব না। কোলের বাচ্চাকে রেখে এসেছি এক্ষুনি চলে যাব। তাই তোর সয়াকে নিচে বসিয়ে রেখেছি।
তুই বড় স্বার্থপর। কোলের বাচ্চাকে নিয়ে এলি না কেন? দেখতাম কেমন হয়েছে।
আজ বিশেষ কাজে এসেছি। কয়েকদিন পর আবার যখন আসব তখন বাচ্চাকে নিয়ে এসে এক সপ্তাহ থাকব।
কি নাম রেখেছিস?
যয়নাব বিনতে দাইহান।
বাহ! খুব সুন্দর নাম তো!
বড় আপা, আব্বার রুমে ঢুকে যেতে সুরাইয়া ফিরে এসে তার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে আসমা সালাম বিনিময় করে বলল, ভাবি কেমন আছেন।
সুরাইয়া বলল, ভালো আপনি ভালো আছেন?
আসমা বলল, ভালো না থাকলে এলাম কি করে?
রুকসানা সুরাইয়াকে বলল, নিচে মেহমান আছে। করিমনের হাতে নাস্তা পাঠিয়ে আমাদের জন্যও পাঠাবে। তারপর রুমে ঢুকে বলল, মিটিং এর পরে তোর কাছে যাব ভেবেছিলাম, অফিসের দু’জন সঙ্গে ছিল তাই যেতে পারিনি।
আসমা বলল, আমি মনে করেছিলাম তুই মিটিং-এ আসিসনি। তারপর খাটের উপর পা ঝুলিয়ে দু’জনে পাশাপাশি বসল। প্রথমে আসমা বলল, তুই যে বললি, ভালো আছিস, আমিতো ভালোর কিছু দেখছি না। কত রোগা হয়ে গেছিস আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখিসনি?
রুকসানা বলল, কিছুদিন থেকে একদম খেতে পারছি না, রাত্রেও চোখে এক ফোঁটা ঘুম আসে না। আমার কথা বাদ দে। তোদের দিন কেমন কাটছে বল।
আল্লাহর রহমতে ভালই। কিন্তু তোর অবস্থা দেখে আমার কান্না পাচ্ছে। তুই যে উপকার করেছিস, আমার গায়ের চামড়া দিয়ে তোর পায়ের জুতো বানিয়ে দিলেও। সেই ঋণ শোধ হবে না। তুই-ই বল, কিভাবে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি? বছর খানেক আগে ইকবাল ভাই যেদিন আসে, সেদিনই আমি তাকে তোর কথা মনে আছে কিনা জিজ্ঞেস করি। তারপর তখন থেকে রুকসানার চিঠি পড়া পর্যন্ত এবং চিঠি নিয়ে পরের দিন রুকসানার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে সবকিছু বলে বলল, তাই আজ এলাম তোর সাথে পরামর্শ করতে, কিভাবে তোদের স্বপ্ন সফল করা যায়।
সুরাইয়া করিমনকে নাস্তার কথা বলে ফিরে এসে দরজার বাইরে থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। করিমন নাস্তা নিয়ে এলে তার সাথে রুমে ঢুকে আসমাকে। উদ্দেশ্য করে বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিন, তারপর স্বপ্ন সফল করার পরামর্শে আমিও অংশগ্রহণ করব।
করিমন টেবিলের উপর নাস্তা রেখে জগ থেকে দু’টো গ্লাসে পানি ঢেলে রেখে চলে গেল।
সুরাইয়া ভাবির কথা শুনে আসমা রুকসানার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
করিমন চলে যেতে রুকসানা তাকে বলল, সুরাইয়া ছাড়া এ বাড়ির আর কেউ এসব কথা জানে না। নে নাস্তা খা। তারপর সুরাইয়াকে বলল, তুমিও বস।
নাস্তা খাওয়ার পর করিমন তিন কাপ চা দিয়ে গেল।
চা খাওয়ার সময় সুরাইয়া রুকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু আগে আমরা ঐ ব্যাপারে কথা বলছিলাম। আপনি এসে ভালই হল। তিনজনে পরামর্শ করে ওদের দুজনের স্বপ্ন। সফল করার উপায় বার করব।
রুকসানা কিছু বলতে যাচ্ছিল, আসমা তাকে থামিয়ে দিয়ে সুরাইয়াকে বলল, আপনি এ বাড়ির বড় বৌ। উপায়টা আপনাকেই বার করতে হবে।
সুরাইয়া বলল, আমি ভেবেছি, প্রথমে আপনার ভাইকে ওদের দুজনের সম্পর্কের কথা বলে রাজি করাব। তারপর দুজনে মিলে আব্বা-আম্মাকে জানিয়ে রাজি করাবার চেষ্টা করব।
এবার সুরাইয়া বাধা দেওয়া সত্ত্বেও রুকসানা বলল, তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? এসর কথা…..।
আসমা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, তুই চুপ কর। সুরাইয়া ভাবি ঠিক কথা বলেছেন। ওদের আগে আজই আমি চাচি আম্মা ও চাচাকে সবকিছু বলে রাজি করাব। সেই জন্যে তো এলাম। হোসেন ভাইও অনেক নিষেধ করে আমাকে ভয় দেখিয়েছে। তার নিষেধ না শুনে এসেছি, তোর নিষেধও শুনব না।
রুকসানা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তোরা যদি আব্বা-আম্মাকে কিছু বলিস, তাহলে। কাল সকালে আমার মরা মুখ দেখবি।
সুরাইয়া চমকে উঠে বলল, তুমি ধার্মিক মেয়ে হয়ে এমন কথা বলতে পারলে বড় আপা?
আসমাও চমকে উঠেছিল। সুরাইয়া থেমে বলল, সই, তুই আমাকে এত কঠিন কথা শোনাতে পারলি? তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, জানিস না, একথা মুখে উচ্চারণ করাও গোনাহ? তারপর সামলে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আজ আমি কিছু বলব না; কিন্তু দু’একদিনের মধ্যে আব্বাকে পাঠাব। সে নিশ্চয় চাচাকে রাজি করাতে পারবে। তারপর সুরাইয়াকে বলল, আপনি এখন কিছু করতে যাবেন না। আব্বা এসে যদি রাজি করাতে না পারে, তখন আমি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করব।
সুরাইয়া বলল, বেশ তাই হবে।
এমন সময় করিমন এসে নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপ নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় সুরাইয়াকে বলল, আপনাকে আম্মা ডাকছেন।
সুরাইয়া বলল, তুমি যাও, আমি আসছি।
রুকসানা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। বলল, তোদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, এই ব্যাপার নিয়ে কোনো কিছু করিসনি। আব্বা এমনিই স্ট্রোক করে কত বছর পঙ্গু হয়ে আছে। এসব কথা শুনলে হয়তো হার্টফেল করবে। তাই তোদের কাছে হাত জোড় করে বলছি, আমাকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দে। ভাগ্যে যা আছে, তা তো তোরা বদলাতে পারবি না।
রুকসানার কথা শুনে সুরাইয়া ও আসমা আর কোনো কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সুরাইয়া বলল, আমি যাই আম্মা ডাকছেন।
সুরাইয়া চলে যাওয়ার পর আসমা ভিজে গলায় বলল, তোর শত নিষেধ মানতাম না, শুধু চাচার কথা চিন্তা করে আজ চলে যাচ্ছি। তবে শুনে রাখ, ভাগ্যে যা থাকে তা নিশ্চয় হবেই, তবু মানুষকে চেষ্টা করতে আল্লাহ বলেছেন। তাই আমি আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও চেষ্টা চালিয়ে যাব। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তুই আমার মুখ বন্ধ করে দিলি এটাই আমার দুঃখ।
রুকসানার চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, দুঃখ কেন দিলাম বুঝলি না? তুই-ই বল না, আমি চৌধুরী বংশের বড় মেয়ে। গ্রামের ছোট বড় সবাই আমাকে শ্ৰেণীমতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। ছোট ভাইবোনেরা আমাকে সম্মান করে এবং আব্বা আম্মা কত স্নেহ করে, কত বিশ্বাস করে। স্বপ্ন সার্থক করতে গেলে তাদের কাছে কত ছোট হয়ে যাব চিন্তা করে দেখ। তাছাড়া চৌধুরী বংশের যে গৌরব রয়েছে তা ধূলায় মিশে যাবে। সবকিছু চিন্তা করে আমি নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তোরাও তাই কর। তারপর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আসমার চোখ মুখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, থাকতে যখন পারবি না তখন আর দেরি করিসনি। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। চল সয়ার সঙ্গে দেখা করি।
আসমা চাচা-চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুকসানার সঙ্গে নিচে এল।
বিয়ের পর দাইহান যখন আসমাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে প্রথম আসে তখন রুকসানাকে সবাই বড় আপা বলতে শুনে সেও তাকে বড় আপা বলে সম্বোধন করে ছিল। শুনে রুকসানা বলেছিল, দাইহান ভাই, তুমি আমার থেকে বড় ও আমার সইয়ের স্বামী। আমাকে তুমি বড় আপা বলছ কেন? নাম ধরে ডাকবে। দাইহান বলেছিল তুমি বয়সে ছোট হলেও সব দিক থেকে আমার থেকে অনেক বড়। তাই তোমাকে বড় আপাই বলব।
দাইহান স্ত্রীর অপেক্ষায় বসেছিল। আসমার সঙ্গে এসে রুকসানা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ দাইহান ভাই?
দাইহান বলল, ভালো আছি বড় আপা, কিন্তু তুমি তো দেখছি একদম শুকিয়ে গেছ।
রুকসানা মৃদু হেসে বলল, মানুষ সব সময় কি একরকম থাকে? কোলের বাচ্চাকে রেখে না এলে আজ তোমাদেরকে যেতে দিতাম না। বেশি বেলাও নেই, তাই দেরি করাব না। আবার যখন আসবে তখন বাচ্চাকে নিয়ে আসবে।
ফেরার পথে রুকসানার সঙ্গে যা কিছু আলাপ হয়েছে আসমা স্বামীকে বলল।
দাইহান বলল, আমরা যে এখানে এসেছি হোসেন জানে না। তাই বলছিলাম, এসব কথা তাকে এখন জানাবার দরকার নেই।
আসমা বলল, আমিও তাই ভেবেছি। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে অন্য কোনো উপায় আছে কিনা।
দাইহান বলল, তাতো করতেই হবে।
.
রুকসানা মরামুখ দেখার ভয় দেখিয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও সুরাইয়া একদিন স্বামী, দুই দেবর ও দুই জাকে নিয়ে বৈঠক করল।
সবাই আসার পর বলল, আব্বা অসুস্থ। আম্মা তাকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। এ সংসারে সমস্ত দায়-দায়িত্ব বড় আপার উপর। তার পরেও সে সমাজ কল্যাণের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কি উচিত না, তার ভাল মন্দের দিকে লক্ষ্য রাখা?
বড় আব্দুর রশিদ বলল, নিশ্চয় উচিত।
তাহলে সে যে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে, কই তোমরা তো কোনো লক্ষ্য করনি?
ছোট আব্দুল করিম বলল, আমরা আর কতক্ষণ ঘরে থাকি। খাওয়ার সময় ছাড়া বড় আপার সঙ্গে তেমন দেখা হয় না। এ বাড়ির বড় বৌ হিসাবে সকলের দিকে তোমারই তো লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব। তুমি বললে আমরা ডাক্তার নিয়ে আসব।
মেজ আব্দুস সামাদ বলল, করিম ঠিক কথা বলেছে।
সুরাইয়া বলল, তাই যদি হয়, তাহলে বড় আপার অসুখের ও তার চিকিৎসা করার ব্যাপারে যা বলব, তা মেনে নেবে তো?
আব্দুর রশিদ বলল, অসুখ হলে চিকিৎসা করাবে এতে মানা না মানার প্রশ্ন তুলছ কেন?
সুরাইয়া বলল, প্রশ্ন আছে বলেই তুলেছি।
মেজ জা আরেফা বড় আপার রোগ অনুমান করতে পেরে বলল, বড় আপাকে সুস্থ করার জন্য যে চিকিৎসার দরকার তা করাতে আমাদের কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তুমি কিভাবে চিকিৎসা করাতে চাও বল বুবু।
মেজ আব্দুল করিম বলল, আরেফা ঠিক কথা বলেছে। তুমি বল।
সুরাইয়া বলল, আমরা সবাই মনে করতাম বড় আপার চোখ খুব বড় বড় বলে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। আসল ঘটনা হল, বড় আপা ছোটবেলা থেকে একটা ছেলেকে ভালবাসে। ছেলেটা খুব ছোট ঘরের। কিন্তু প্রতিভা ও অধ্যাবসায়ের দ্বারা সে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে এবং বিদেশে চাকরি করে প্রচুর টাকা পয়সা উপার্জন করে ফিরে এসেছে। এখন সে প্রতিষ্ঠিত ও সুনামের অধিকারী। দীর্ঘ একুশ বাইশ বছর ছেলেটার সঙ্গে বড় আপার যোগাযোগ না থাকলেও তার প্রতীক্ষায় ছিল। তাই বিয়ে করতে রাজি হয়নি। আর ছেলেটাও ছোটবেলা থেকে বড় আপাকে ভালবাসে। তাই আজও সে বিয়ে করেনি। এখন সে প্রতিষ্ঠিত হলেও ছোট ঘরের ছেলে বলে বড় আপার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এবং বিয়ের প্রস্তাব দিতেও সাহস করেনি। কিছুদিন আগে দৈব দুর্ঘটনার মধ্যে ছেলেটার সঙ্গে বড় আপার দেখা। প্রথমে বড় আপা তাকে চিনতে না পারলেও পরে আলাপের মাধ্যমে চিনতে পারে এবং জানতে পারে ছেলেটাও তার প্রতিক্ষায় আজও বিয়ে করেনি। নিজের ও তোমাদের মান সম্মান ও বংশ মর্যাদার কথা চিন্তা করে বড় আপা মনের কথা কাউকে প্রকাশ করতে না পেরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। তাই দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, কথাটা আমি অনেক চেষ্টা করে জেনেছি। বড় আপাকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তোমাদের বংশের মান সম্মানের দিকে না তাকিয়ে সেই ছেলের সঙ্গে বড় আপার বিয়ে দিতে হবে। এখন সবাই চিন্তা করে বল, কি করবে। আমার মতামত আগেই বলছি, বড় আপাকে সুস্থ ও সুখী করার জন্য এই কাজ করতে আমি রাজি।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
সুরইয়া বলল, কি হল? তোমরা কিছু বলছ না কেন?
বড় আব্দুর রশিদ গম্ভীর স্বরে বলল, ছেলেটার পরিচয় নিশ্চয় তুমি জান?
হ্যাঁ জানি।
তাহলে বলছ না কেন?
ইকবাল ওরফে হোসেন স্যার।
নাম শুনে সবাই চমকে উঠলেও কেউ কিছু বলল না।
সুরাইয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল নাম শুনে সবাই বোবা হয়ে গেলে নাকি? শোন, কথাটা জানার পর আমি যখন বললাম, তোমার ভাইকে জানিয়ে আমি আব্বাকে আম্মাকে রাজি করাব তখন বড় আপা বলল, যেদিন জানাবে তার পরের দিন আমার মরা মুখ দেখবে। তবু আমি তোমাদেরকে জানালাম। তোমাদের সবাইয়ের কাছে আমার মিনতি তোমরা যদি হোসেন স্যারকে এ বাড়ির জামাই করতে না চাও, তাহলে এমন কিছু করো না যার ফলে আপা যেন বুঝে না ফেলে যে, তোমরা তার ব্যাপারটা জেনে গেছ।
সব ভাই শিক্ষিত, তাদের বৌ-রাও শিক্ষিত। তারাও হোসেন স্যারের পরিচয়। জেনেছে। ছোট বৌ মমতাজ অন্য দুজনের চেয়ে বেশি শিক্ষিত। সে ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে। সেই প্রথম বলল, বংশ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মোটেই ঠিক নয়। উচ্চ বংশের ছেলেরা চরিত্রহীন হলে যেমন বংশের দুর্নাম হয়, নিচ বংশের ছেলেরা চরিত্রবান হলে তেমনি বংশের সুনাম হয়। কোনো এক মনীষী বলেছেন “জন্ম হউক যথা তথা-কর্ম হউক ভালো।” ইকবালের সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি তার বাপ দাদা গরিব ছিল। তাই আমাদের বাগানের দারোয়ান ছিল। কিন্তু তারা কোনোদিন এতটুকু অন্যায় করেনি। বরং তারা ভালো লোক ছিল বলে তাদেরকে আমাদের মুরুব্বিরা ভালো চোখে দেখতেন। তারা ভালো ছিল, তাই তাদের বংশে ইকবালের মতো ভালো ছেলে জন্মেছে। আমি বড় বুবুর সঙ্গে একমত।
মেজ বৌ আরেফা বলল, আমিও বড় বুবু ও ছোটর সঙ্গে একমত।
বড় আব্দুর রশিদ প্রথমে রেগে গেলেও তিন জায়ের কথা শুনে রাগ পুড়ে গেছে। ছোট দু’ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা কি বল?
তাদেরও বড় ভাইয়ের মতো অবস্থা। প্রথমে মেজ আব্দুস সামাদ বলল, বড় আপার ভালোর জন্য আমি সব কিছুতে রাজি।
ছোট আব্দুল করিম বলল, মেজ ভাই যা বলল, আমিও তাই বলব। তবে তোমার মতামতই চূড়ান্ত।
আব্দুর রশিদ বলল, তোমাদের কথাই ঠিক। সব কিছুর বিনিময়ে হলেও বড় আপাকে মানষীক কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু আম্মা আব্ব কিছুতেই রাজি হবেন না। তাদেরকে নিয়েই সমস্যা। আর আব্বার যে অবস্থা, শুনে যদি উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাহলে হার্ট এ্যাটাক করতে পারে।
ছোট আব্দুল করিম সুরাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বা আমাদের সবার চেয়ে বড় আপাকে বেশি ভালবাসলেও তোমার স্থান তার পরেই। তুমিই কথাটা আব্বাকে। জানাও। আব্বা যদি আমাদেরকে ডেকে কিছু বলেন, তখন আমরা আমাদের মতামত জানাব।
সুরাইয়া বলল, বেশ আজ রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আমি আব্বাকে জানাব। তোমরা আমার ঘরে থাকবে।
খাওয়া দাওয়ার পর রুকসানা আব্বাকে ওষুধ খাইয়ে চলে যাওয়ার পর আজিজা বেগম স্বামীর পায়ে হাতে সর্ষের তেল মালিশ করছিলেন। বড় বৌকে আসতে দেখে বললেন, কিছু বলবে মা?
জ্বি বলব বলে সুরাইয়া ভয় পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আজিজা বেগম বললেন, বল মা কি বলবে?
সুরাইয়া সাহস করে বলল, আমি বড় আপার বিয়ের ব্যাপারে দু’একটা কথা বলতে চাই।
বি.এ পাশ করার পর থেকে যে মেয়ে কত ভালো ভালো পাত্র ফিরিয়ে দিয়েছে, সেই মেয়ের বিয়ের কথা বড় বৌকে বলতে শুনে আব্দুল মতিন ও আজিজা বেগম যেমন খুব অবাক হলেন তেমনি আনন্দিতও হলেন। স্ত্রী কিছু বলার আগে আব্দুল মতিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যে কথা বলতে এসেছ রুকসানা জানে?
জ্বি না আব্বা। বড় আপা কেন বিয়ে করতে চায় না, আমি তা জানতে পেরে আপনাদেরকে বলতে এসেছি।
বেশ কি জেনেছ বল।
বড় আপা দক্ষিণ ফুকরার মরহুম কাজেম সেখের ছেলে ইকবালকে বলে চুপ করে গেল। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এল। তাই কথাটা শেষ করতে পারল না।
ইকবালের নাম শুনে আব্দুল মতিন খুব রেগে গিয়ে ধমকের সুরে বললেন, থামলে কেন? ইকবাল কি?
সুরাইয়া আরো বেশি ভয় পেয়ে ঢোক গিলে কাঁপাস্বরে বলল, তাকে ছোটবেলা থেকে বড় আপা ভালবাসে। আর ইকবালও বড় আপাকে ভালবাসে। তাই বড় আপা যেমন বিয়ে করতে চায় না, তেমনি ইকবালও বিয়ে করেনি।
বিনা মেঘে ঘরে বাজ পড়লেও বোধ হয় আব্দুল মতিন অতটা চমকে উঠতেন না। ভীষণ চমকে উঠে নির্বাক দৃষ্টিতে সুরাইয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাগে ফুলতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, কথাটা কার কাছে জেনেছ? রুকসানা তোমাকে বলেছে?
শ্বশুরের অবস্থা দেখে সুরাইয়া খুব ভয় পেলেও বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, না আব্বা। একদিন অনেক রাত্রে বড় আপার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ভাবলাম, বড় আপাতো প্রতিদিন এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আজ এত রাতে কেন জেগে আছে জানার জন্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম, ডাইরীতে কি যেন লিখছে। পরের দিন সেকথা। মনে পড়তে বড় আপা কারখানায় চলে যাওয়ার পর কৌতূহলবশতঃ তার ঘরে গিয়ে ডাইরিটা বালিশের তলায় পাই। তারপর সেটা পড়ে জানতে পারি। পরে একসময় তাকে ডাইরি পড়ার কথা বলি। শুনে বড় আপা খুব রেগে যায়। আমি তার কাছে মাফ চাইতে বলল, ডাইরি পড়ে যা কিছু জেনেছ, তা যদি আমার জীবিতকাল পর্যন্ত গোপন রাখার ওয়াদা কর, তাহলে মাফ পাবে। আর যদি ওয়াদা খেলাপ কর, তাহলে পরের দিন আমার লাশ দেখবে।
আব্দুল মতিন আরো গম্ভীর স্বরে বললেন, ওয়াদা খেলাপের পরিণতি জেনেও ওয়াদা খেলাপ করলে কেন? তা ছাড়া তুমি কী জান না, ওয়াদা খেলাপ অতি জঘন্য অপরাধ?
জানি আব্বা।
আব্দুল মতিন গর্জন করে উঠলেন, তবু খেলাপ করলে কেন?
সুরাইয়া শ্বশুরের ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলল, ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলল, ইকবাল হোসেন স্যার হিসাবে যখন এসেছিল তখন থেকে বড় আপার পরিবর্তন লক্ষ্য করি। খুব কম খাওয়া দাওয়া করে। আমাদের সঙ্গে আগের মতো কথাও বলে না। ইদানিং বড় আপা সারারাত জেগে নামায পড়ে, কুরআন পড়ে, ডাইরি লেখে। দিন দিন খুব। রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কেবলই মনে হয়, বড় আপা অল্প দিনের মধ্যে কঠিন
অসুখে পড়বে। তাই আমি ভয় পেয়ে–।
আব্দুল মতিন আবার ধমক দিয়ে গর্জে বললেন, তুমি এ বাড়ির বৌ হয়ে মাত্র কয়েক বছর এসেছ। আমাদের বংশের মান ইজ্জত কত, তা এখনো জাননি। তোমার সাহস দেখে আমি খুব অবাক হচ্ছি। একটা কথা জেনে রেখ, বংশের মান ইজ্জৎ রক্ষার জন্য শুধু একটা রুকসানাকে নয়, দশটা রুকসানা থাকলেও সবাইকে দু’টুকরো করে উঠোনে পুঁতে ফেলতাম। আর একটা কথা, তুমি কি এই ব্যাপারটা কাউকে জানিয়েছ?
শ্বশুরের কথা শুনে সুরাইয়া ভয় পেয়ে কাঁপছিল। তাই আপনা থেকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, জি না আব্বা, কাউকেই বলিনি।
আব্দুল মতিন কর্কশ স্বরে বললেন, জীবনে কোনোদিন কাউকেই বলবে না। আর তুমি রুকসানার ডাইরি পড়ে যা জেনেছ, তা ভুলে যাও। সাবধান করে দিচ্ছি, এর পরও যদি কোনো কিছু কানে আসে, তাহলে এ বাড়িতে তোমার স্থান হবে না। যাও, এবার তুমি যেতে পার।
সুরাইয়া চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এসে সবাইকে শ্বশুর যা কিছু বলেছেন বলে বলল, তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই লাগে, এসব কথা নিয়ে আর কোনোদিন কানাকানি কর না। কিছুদিন চুপচাপ থাক, আব্বার রাগ পড়লে উনি হয়তো তোমাদেরকে ডাকতে পারেন। তখন যা বলার বলো।
রুকসানা আব্বার রুম থেকে এসে বাথ রুমে গিয়েছিল। ফেরার সময় সুরাইয়াকে আব্বার রুমে যেতে দেখে সন্দেহ হল। দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমে সুরাইয়ার কথা শুনে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। তারপর আব্বার কথা শুনে মনে হল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কোনো রকমে টলতে টলতে এসে বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অনেকক্ষণ কাদার পর হঠাৎ তার মন বলে উঠল, কাল সকালে মা বাপের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? তার চেয়ে মরণ ভালো। ইকবালকে পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তাকে জীবনেও পাবে না। বেঁচে থেকে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তোমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। বেঁচে থাকলে তোমার আব্বা হয়তো ইকবালকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। তাই আজ রাতেই তুমি গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাও। রুকসানা উদভ্রান্তের মতো ঘরময় পায়চারী করতে লাগল। হঠাৎ আবার কে যেন তার মনের ভিতর থেকে বলে উঠল, তুমি না ধার্মিক মেয়ে, তুমি কি জান না, আত্মহত্যা করা মহাপাপ? আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে?
এবার রুকসানা খুব ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।
রুকসানা প্রতিদিন সকালে ফজরের আজানের সময় উঠে সবাইয়ের দরজা নক করে জাগিয়ে বলে, ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে নামায পড়।
আজিজা বেগম অবশ্য আযানের সাথে সাথে উঠে প্রথমে স্বামীকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যান। বাথরুমের কাজ শেষ হলে বাইরে এনে অজু করিয়ে ঘরে এনে মসল্লা বিছিয়ে বসিয়ে দেন। আব্দুল মতিন বসে নামায পড়েন। স্বামীকে মসল্লায় বসিয়ে নিজে অজু করে এসে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করেন। আজও সময় মতো উঠে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, আজ রুকসানার গলা পেলাম না কেন? তাহলে কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি? কুরআন বন্ধ করে রুকসানার রুমের দিকে যাওয়ার সময় ভেন্টিলেটরের দিকে লক্ষ্য পড়তে বুঝতে পারলেন, রুমে আলো জ্বলছে। ভাবলেন, ঘুমোবার সময় হয়তো, আলো নেভাতে ভুলে গেছে। কাছে এসে তাকে জাগাবার জন্য দরজা নক করতে যেতে দরজা খুলে গেল। ভিতরে তাকাতে দেখতে পেলেন, আলুথালু বেশে রুকসানা ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছে। আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বললেন, এই রুকসানা, মেঝেয় শুয়ে আছিস কেন? কয়েকবার নাড়া দিয়ে ডেকে সাড়া না পেয়ে মুখে হাত দিয়ে জানতে পারলেন, অজ্ঞান হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি জগ থেকে হাতে পানি নিয়ে মুখে ঝাঁপটা দিয়ে নাম ধরে কয়েকবার ডাকলেন। কাজ না হতে আব্দুর রশিদ ও সুরাইয়াকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে এলেন।
তারা এসে রুকসানাকে খাটে শুইয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল।
আজিজা বেগম অন্য দু’ছেলে ও বৌকে ঘটনা জানিয়ে যেতে বলে স্বামীর কাছে এলেন।
আব্দুল মতিন বললেন, কি ব্যাপার? কুরআন পড়া বন্ধ করে এদিক ওদিক করছ কেন?
আজিজা বেগম রুকসানার কথা বলে স্বামীকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে এলেন।
সবকিছু দেখে শুনে আব্দুল মতিনের সন্দেহ হল। ভাবলেন, তাহলে কী রুকসনা আমার ও বৌমার কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়েছিল?
বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর রুকসানার জ্ঞান ফিরল। সুরাইয়া পানি ঢালা বন্ধ করে ঝাড়ন দিয়ে মাথার চুল মুছে দিল।
আব্দুল মতিন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল মা? মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি কেন?
রুকসানা উঠে বসে প্রথমে পরিস্থিতি উপলব্ধি করল। তারপর বলল, এক ঘুমের পর বাথরুমে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই। তারপর। আর কিছু মনে নেই।
আজিজা বেগম বললেন, ফজরের নামায পড়ে তোর সাড়া না পেয়ে এসে দেখি তুই মেঝেয় পড়ে আছিস। তারপর যা কিছু হয়েছে বললেন।
সুরাইয়া ঘড়ি দেখে বলল, তোমরা সব যাও, আমি এখন ফজরের কাযা নামায পড়ব।
সেখান থেকে এসে সুরাইয়া স্বামী, দেবর ও জায়েদেরকে বলল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বড় আপা আমার ও আব্বার কথা-বার্তা শুনে রুমে এসে অজ্ঞান হয়ে সারারাত মেঝেয় পড়েছিল।
আব্দুর রসিদ বলল, আমারও তাই মনে হয়। তারপর বলল, এবার তোমরা সব যাও, অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের এখন কিছু করার নেই।
এরপর থেকে যতদিন যেতে লাগল, রুকসানা তত শুকিয়ে যেতে লাগল। মাস খানেকের মধ্যে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল।আব্দুর মতিন মেয়ের পরিণতির কথা বুঝতে পেরেও এতটুকু নরম হলেন না। ছেলেদেরকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালের একজন বড় ডাক্তারকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে বললেন।
<