বছর পাঁচেক আগে স্ট্রোক করে আব্দুল মতিনের ডান হাত ও পা প্যারালাইজ হওয়ার পর একা নিচে নামতে পারেন না। তাই লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্যে উপরের তলাতে একটা ড্রইংরুম করেছেন। যারা দেখা করতে আসেন, তাদেরকে প্রথমে নিচের তলার ড্রইংরুমে বসিয়ে, আব্দুল মতিনকে খুরর দেওয়া হয়। উনি হুইল চেয়ারে করে উপরের ড্রইংরুমে আসার পর লোকজনকে উপরে নিয়ে আসা হয়।

রুকসানা হোসেন স্যারকে নিচের ড্রইংরুমে বসিয়ে উপরে গিয়ে আব্বাকে বলল, হোসেন স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

আব্দুল মতিন আনন্দিত হয়ে বললেন, কোথায় বসিয়েছিস?

নিচের ড্রইংরুমে।

যা উপরে নিয়ে আয়, আমি আসছি।

রুকসানা আব্বার রুম থেকে বেরিয়ে মনিরাকে দেখতে পেয়ে বলল, হোসেন স্যার নিচে বসে আছেন, উপরে নিয়ে আয়।

মনিরা চলে যাওয়ার পর রুকসানা সুরাইয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে তার নাম ধরে ডাকল।

সুরাইয়া কিচেনে যাবে ভাবছিল? বড় আপার গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল।

রুকসানা বলল, হোসেন স্যার এসেছেন, আরেফা ও মমতাজকে নিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা কর। তারপর আব্বার রুমে ফিরে এল।

আজিজা বেগম স্বামীর ড্রেস পাল্টে দিচ্ছিলেন। বললেন, স্যারকে উপরে এনেছিস?

রুকসানা বলল, মনিরাকে পাঠিয়েছি। এতক্ষণে হয়তো নিয়ে এসেছে।

মনিরা নিচে এসে স্যারকে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।

হোসেন স্যার মনিরার সঙ্গে উপরের ড্রইং রুমে এসে বসেছে, এমন সময় রুকসানা আব্বার হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে ঢুকল।

হোসেন স্যার সালাম দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ওঁর এই অবস্থার কথা মনিরা বা রুকসানা তো জানায় নি?

আব্দুল মতিন সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলে বললেন, মনে হচ্ছে, আপনি আমার এই অবস্থার কথা জানতেন না?

হোসেন স্যার দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, জি না জানতাম না। তারপর বলল, বেয়াদবি নেবেন না, বিশেষ কারণে আমি বসতে পারছি না। আর আমি আপনার ছেলের বয়েসি, আমাকে তুমি করে বলুন।

আব্দুল মতিন বললেন, ঠিক আছে। তারপর বললেন, তুমি আমার মেয়েকে খুব বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। সেজন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বিপদের ঘটনা শোনার পর তোমাকে দেখার জন্য রুকসানাকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। অনেক পরে এলেও আমি খুশি হয়েছি। মানুষের কল্যাণের জন্য তুমি যা কিছু করছ, তার কিছু কিছু আমি শুনেছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, “তিনি যেন তোমাকে আরো মানুষের কল্যাণকর কাজ করার তওফিক দিন।” তোমার মতো ছেলে প্রতি গ্রামে জন্ম। নিলে দেশের অনেক উন্নতি হত।

হোসেন স্যার বলল, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আমাকে অতবড় করে বলবেন না। কাজের ব্যস্ততায় কথা দিয়েও আসতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর হাসপাতালের ব্যাপারে যা প্লন প্রোগ্রাম করেছে বলে বলল, আমি আপনার সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করি।  আব্দুল মতিন বললেন, নিশ্চয় পাবে। এমন মহৎ কাজে সাহায্য সহযোগিতা করা সকলেরই উচিত। তবে মিটিং এ যাওয়ার কথা যে বললে, তা সম্ভব নয়। কারণটা তো দেখতেই পাচ্ছ।

এমন সময় কাজের মেয়ে করিমন চা-নাস্তা নিয়ে এলে আব্দুল মতিন মনিরাকে বললেন, তোর স্যারকে নাস্তা খাওয়া।

হোসেন স্যার কেন বসল না রুকসানা তা বুঝতে পেরেছে। তাই আব্বা যখন মনিরাকে নাস্তা খাওয়াতে বলল তখন ভাবল, হোসেন স্যার আব্বার সামনে বসে কিছুতেই নাস্তা খাবে না। আবার না খেলে আব্বা হোসেন স্যারকে দাম্ভিক ভাববে। তাই কি বলে আব্বাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ওষুধ খাওয়াবার কথা মনে পড়ল। ঘড়ি দেখে আব্বাকে সে কথা বলে বলল, তোমাকে নিয়ে যাই?

আব্দুল মতিন বললেন, একটু পরে যাবখন।

রুকসানা বলল, ওষুধ সময় মতো খেতে ডাক্তার বারবার বলে দিয়েছেন।

আব্দুল মতিন হোসেন স্যারকে বললেন, জান বাবা, এই মেয়েটা নিজে যেমন নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে তেমনি এ বাড়ির সবাইকে মেনে চলতে বাধ্য করে। কারো এতটুকু ক্ষমতা নেই ওর কথার অবাধ্য হয়। তুমি সময় করে মাঝে মাঝে এস।

রুকসানা বলল, আব্বা যেন কী? ওঁর সামনে এসব কথা বলছ কেন? তারপর হুইল চেয়ার ঠেলে আব্বাকে নিয়ে চলে গেল।

হোসেন স্যার চা-নাস্তা খেয়ে মনিরাকে বলল, এবার আসি।

মনিরা বলল, বড় আপার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাবেন? একটু বসুন, বড় আপাকে ডেকে নিয়ে আসি।

আবার যখন আসব তখন দেখা তো হবেই, এখন আর ডাকার দরকার নেই বলে হোসেন স্যার বিদায় নিয়ে চলে গেল।

মনিরা ভাবল, বড় আপা আসেনি বলে স্যার হয়তো মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ঐ কথা বললেন। হনহন করে আব্বার রুমে এসে তাকে না পেয়ে তার রুমে গেল।

রুকসানা ইচ্ছা করে হোসেন স্যারকে বিদায় দিতে যায়নি। মনিরা যা চালাক, কথা-বার্তা একটু এদিক ওদিক হলেই অন্য কিছু ভাবতে পারে। তাই আব্বাকে, ওষুধ খাইয়ে নিজের রুমে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সদরের দিকে তাকিয়েছিল হোসেন স্যারকে দেখার জন্য।

মনিরা রুমে ঢুকে তাকে দেখতে পেয়ে বলল, বড় আপা, স্যার চলে গেছেন। তুমি আব্বাকে ওষুধ খাইয়ে গেলে না কেন? স্যার কি মনে করলেন? আমি তোমাকে ডাকতে চেয়েছিলাম। স্যার নিষেধ করে বললেন, “আবার যখন আসব তখন তো দেখা হবেই।”

রুকসানা বলল, স্যার তো ঠিক কথাই বলেছেন, তুই না থাকলে বরং উনি কিছু মনে করতেন। আসরের আযান হয়ে গেছে। যা নামায পড়ে নে। আমিও পড়ব।

মনিরা আর কিছু বলতে না পেরে সেখান থেকে চলে গেল।

হোসেন ফিরে এসে রুকসানা ও তার মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছে সে সবের যতটা বলা সম্ভব, আসমা ও দাইহানকে বলে বলল, এখন তোমারাই চিন্তা কর, কিভাবে আমাদের মনের আশা পূরণ হতে পারে?

আসমা বলল, আমি আব্বাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাব।

হোসেন হেসে উঠে বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন? আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে। কোনো ধনী ও উচ্চ বংশের বাবা কী তাদের দারোয়ানের ছেলেকে জামাই করতে পারে?

আসমা বলল, আমারও তোমার ভাইয়ার তো প্রায় একই রকম ব্যাপার ছিল। রোকসানার আব্বাই যখন আমাদের ব্যাপারটা সমাধান করলেন, তখন নিজের মেয়ের বেলায় করবেন না কেন?

হোসেন বলল, মানুষ অপরের কোনো বিষয় সমাধান করে ঠিক; কিন্তু ঐ একই বিষয়ে নিজেরটা করে না। এটাই দুনিয়ার রীতি।

আসমা বলল, রুকসানা আমাকে আত্মঘাতী থেকে বাঁচিয়েছে। আমিও তার জন্য জানের বাজী রাখব। চৌধুরী চাচার পায়ে ধরে কেঁদে হলেও রাজি করাব।

হোসেন বলল, তা হয় না। আমি তোমাকে তা করতে দেব না। মুসলমান হিসাবে তকদিরকে বিশ্বাস করি। আর তকদির আল্লাহপাক লিখেছেন। তাই আমি তকদিরের উপর নির্ভর করে এতবছর যখন ধৈর্য ধরে আছি তখন বাকি জীবনটাও থাকব। তবু চৌধুরী বংশের এতটুকু অসম্মান করতে পারব না। শোনো, তুমি যদি আমার ও রুকসানার উপকার করতে চাও, তাহলে এই ব্যাপারে কোনো রকম তদবীর করবে না। ধৈর্য ধরে দেখ, আল্লাহ আমাদের কুদিরে কি লিখেছেন।

আসমা বলল, তকদীরের উপর বিশ্বাস করা যে প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর উপর ফরয, একথা জানি। কিন্তু তিনি তো তকূদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকতে বলেন। নি। বরং চেষ্টা করে তকুবীর করতে বলেছেন।

হোসেন বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু চেষ্টা তদবীরের সঙ্গে যেখানে মান সম্মান ও অসম্ভব কিছু জড়িত থাকে, সেখানে চেষ্টা তদবীর করা শুধু ভুল নয়, অন্যায়ও।

আসমা বলল, তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না। আর তুমি যতই নিষেধ কর না কেন, চেষ্টা তদবীর আমি করবই।

দাইহান এতক্ষণ চুপ করেছিল। স্ত্রী থেমে যেতে বলল, আসমা ঠিক কথা বলেছে। রুকসানা আমাদের যা উপকার করেছে, তার প্রতিদান হিসেবে, আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবই ইনশাআল্লাহ।

হোসেন ভাবল, এদেরকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। বলল, তোমরা যখন আমার কথা শুনবেই না তখন যা ইচ্ছা কর। কিন্তু মনে রেখ, যদি রুকসানার কিছু। হয়, তাহলে তোমাদের সঙ্গে চিরকালের জন্য সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে।

আসমা বলল, এটা তুমি ঠিক বললে না হোসেন ভাই। হাদিছে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে ইচ্ছা করে যে তাহার উপার্জন বৃদ্ধি হউক এবং তাহার মৃত্যু বিলম্বে হউক, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।” [বর্ণনায়- হযরত আনাস (রাঃ) বুখারী-মুসলীম]

হাদিছে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, সে বেহেশতে যাইবে না।” [বর্ণনায় হযরত জাবেরবীন মোতয়েম- বুখারী, মুসলীম]

তুমি নিশ্চয় এই হাদিসগুলো জান। তারপরও এই কথা বলতে পারলে?

হোসেন তওবা আস্তাগফির পড়ে বলল, আল্লাহ মাফ করুন। হাদিসগুলো আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাকে উপলক্ষ করে আল্লাহ আমাকে অনেক বড় গোনাহ থেকে রক্ষা করলেন। সে জন্যে তার পাক দরবারে জানাই লাখোকোটি শুকরিয়া। তারপর বিদায় নিয়ে চলে এল।

.

কমিটির লোকজন মাইক দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মিটিং এর কথা প্রচার করিয়েছেন।

আজ মিটিং এর দিন। তিনটের সময় মিটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরের পর থেকে লোকজন আসতে শুরু করল। হাসপাতালের সামনে অনেক খানি মাঠ। সেখানে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা অতিথি হয়ে আসবেন তাদের জন্য ও বক্তাদের জন্য আলাদা কোনো স্টেজ করা হয়নি। হাসপাতালের বারান্দাতে চেয়ার টেবিল দেওয়া হয়েছে। তিনটের পর থেকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও তিনটে ওয়ার্ডের আটজন মেম্বার একে একে আসতে আরম্ভ করলেন। হোসেন নিজে গিয়ে আব্দুল মতিনকে গাড়ি করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তিনি অপারগতার কথা বলে বড় ছেলে আব্দুর রশিদকে পাঠাবার কথা বলেছিলেন। সেও এসেছে। সাড়ে তিনটের সময় চেয়ারম্যান আজিজুল হককে সভাপতি করে মিটিং এর কাজ শুরু হল। প্রথমে একটা চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে কুরআন তেলাওয়াত করল। তারপর অতিথি বৃন্দের অনেকে হোসেন স্যারের এই মহৎ কাজের প্রশংসা করে কিছু বক্তব্য রেখে সব রকমের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আব্দুল মতিনের বড় ছেলে আব্দুল রশিদ বক্তৃতা করার সময় আব্বার কথামত পঁচিশ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিল।

সব শেষে সভাপতি চেয়ারম্যান আজিজুল হক সমাপ্তির ভাষণে বললেন, যিনি একা নিজের চেষ্টায় এতবড় মহৎ কাজে হাত দিয়েছেন এবং কাজও প্রায় শেষ করে এনেছেন। সেই মহান লোকটিকে আমরা একজন ভালো শিক্ষক, ভালো ডাক্তার ও একজন জনদরদী হিসাবে জানি। আমরা তার কাজ-কর্মে ও আচার ব্যবহারে এতই অভিভূত হয়েছি যে, তার পরিচয় জানতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। যেদিন উনি আমাকে এই মিটিং-এ আসার জন্য অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, সেদিন আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে যা বললেন, তা শুনে ভীষণ অবাক হয়ে দোয়া করেছি। এখন তার পরিচয় বলছি শুনুন, তারপর হোসেনের আসল পরিচয় ও কিভাবে লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে গ্রামে ফিরে এল বলে বললেন, হোসেন স্যার আসল পরিচয় বলার পর আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, কথাটা গোপন রাখার জন্য। আমি রাজি না হয়ে বলেছিলাম, আপনি আমাদের দেশের কৃতী সন্তান। আপনার আসল পরিচয় সকলের জানা উচিত। তাই আপনাদেরকে জানালাম। ইনশাআল্লাহ আমিও যতটা সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করব। জনসাধারণের কাছে অনুরোধ করছি, আপনারাও এই মহৎ কাজে যে যা পারেন, তাই দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোক, এই দোয়া করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করে মিটিং-এর সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আল্লাহ হাফেজ।

গ্রামের লোকজন হোসেন স্যার মরহুম কাজেম সেখের ছেলে জেনে যেমন অবাক হল তেমনি আনন্দিতও হল।

বাহিরবাগ গ্রাম থেকে অনেকে এসেছিল। তাদের মধ্যে রুকসানা, রাবেয়া ও কায়সার ছিল। রুকসানা ভেবেছিল, মিটিং-এর পরে আসমার সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যাবে। সঙ্গে রাবেয়া ও কায়সার থাকায় সম্ভব হল না। তাছাড়া বেলাও বেশি ছিল না। তাই তাদের সঙ্গে ফিরে আসতে লাগল।

এক সময় রাবেয়া রুকসানাকে জিজ্ঞেস করল, তুই কাজেম সেখকে দেখেছিস?

রুকসানা বলল, হ্যাঁ দেখেছি। আমি যখন সিক্সে পড়তাম তখন ইকবাল পালিয়ে যায়। তার মাস ছয়েক পর কাজেম সেখ চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যায়।

তোর সঙ্গে তো হোসেন স্যারের দু’তিন বার আলাপ হয়েছে, চিনতে পারিস নি?

প্রায় বিশ একুশ বছর পর কাউকে দেখলে কি আর চেনা যায়? তবে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয়েছে।

কায়সার বলল, আমি কিন্তু ওঁর সম্পর্কে আগেই জেনেছি।

রুকসানা জিজ্ঞেস করল, কার কাছে জেনেছ? হোসেন স্যার বলেছেন?

কায়সার বলল, না, আমার মামাত ভাই আশরাফ ভাইয়ের কাছে। তিনি আর হোসেন স্যার ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়তেন। আশরাফ ভাই কিছুদিন আগে এসেছিলেন। আসার সময় পথে হোসেন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বাড়িতে এসে সেকথা আমাকে বললেন। তার কাছে আরো যা কিছু শুনেছিলাম চেয়ারম্যানের কথার নঙ্গে মিলে গেছে।

রুকসানা আর কিছু না বলে হাঁটতে লাগল।

গ্রামে ঢুকে কায়সার-রাবেয়ার ও রুকসানার পথ আলাদা। সেখানে পৌঁছে রুকসানা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর রাবেয়া স্বামীকে বলল, তুমি হোসেন স্যারের আসল পরিচয় জেনেও আমাকে এতদিন বলনি কেন?

কায়সার বলল, ভেবেছিলাম, হোসেন স্যার যখন আত্মগোপন করে আছেন তখন নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। তাই একজন জ্ঞানী-গুনী লোকের পরিচয় প্রকাশ করা উচিত হবে না ভেবে বলিনি।

রাবেয়া অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, আমি বুঝি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার পরিচয় বলে বেড়াতাম?

তা হয়তো করতে না, তবে মেয়েদের পেটে কোনো কথা হজম হয় না। এক কান দু’কান করে একদিন প্রচার হয়ে যেতই।

থাক, কথাটা জিজ্ঞেস করাই আমার অন্যায় হয়েছে।

আহ, রাগ করছ কেন? ঠিক আছে, তোমাকে না জানিয়ে আমিই অন্যায় করেছি। মাফ করে দাও।

রাবেয়া স্বামীর পিঠে একটা আদরের কিল দিয়ে বলল, এই মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করছ কেন? রাগ দেখিয়ে আমিও অন্যায় করেছি। আমারই মাফ চাওয়া উচিত। বল মাফ করে দিয়েছ?

কায়সার মৃদু হেসে বলল, মেয়েদের মন বোঝা মুশকিল। এই রাগ, এই পানি। তারপর বলল, অন্যায় কেউ-ই করেনি। অতএব এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা না। বলাই ভালো।

.

আব্দুর রসিদ ঘরে ফিরে আব্বাকে বলল, জান আব্বা, হোসেন স্যার দক্ষিণ ফুকরার কাজেম সেখের ছেলে। তারপর চেয়ারম্যান হোসেন স্যারের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন বলল।

আব্দুল মতিন খুব অবাক হয়ে চমকে উঠে বললেন, কী বলছ তুমি? এটাও কি সম্ভব? তখন তার বিশ-একুশ বছর আগের ঘটনা মনে পড়ল, “এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে রুকসানার বুকে হাত দিয়েছিল বলে তার বাপকে দিয়ে শংকর মাছের চাবুক মেরে শাস্তি দিয়েছিলেন।”

আব্বাকে চুপ করে থাকতে দেখে আব্দুর রসিদ বলল, আমি এখন যাই আব্বা?

আব্দুল মতিন বললেন, হ্যাঁ যাও।

আজিজা বেগম সেখানে ছিলেন। কথাটা শুনে তিনিও খুব অবাক হয়েছেন। বড় ছেলে চলে যাওয়ার পর বললেন, আল্লাহ কখন কাকে কি করেন, তা তিনিই জানেন। হোসেন স্যার কাজেম সেখের ছেলে, ভাবতেই পারছি না।

আব্দুল মতিন বললেন, আমারও খুব অবাক লাগছে। যাকগে, মনিরাকে একটু ডাকতো?

আজিজা বেগম বাইরে এসে ছোট বৌ মমতাজকে দেখতে পেয়ে বললেন, মনিরাকে ডেকে দাও।

আব্দুর রশিদ আব্বার কাছ থেকে এসে স্ত্রীকে হোসেন স্যারের আসল পরিচয় বলছিল। মনিরাও সেখানে ছিল। ছোট ভাবির ডাক শুনে তার কাছে এসে বলল, কেন ডাকলে?

মমতাজ বলল, আম্মা ডাকছেন।

মনিরা রুমে ঢুকে বলল, আম্মা ডেকেছ?

আজিজা বেগম বলার আগে, আব্দুল মতিন বললেন, হোসেন স্যারের আসল পরিচয় শুনেছিস?

আগে জানতাম না, এখন বড় ভাইয়ার কাছে শুনলাম।

আব্দুল মতিন গম্ভীর স্বরে বললেন, ছুটির পর তার কাছে আর পড়বি না।

মনিরা খুব স্পষ্টভাষিনী। তাই আব্বাকে ভয় করলেও বলল, কেন?

আব্দুল মতিন রাগের সঙ্গে বললেন, কেন আবার। নিষেধ করলাম পড়বি না। কাজেম সেখ ও তার বাবা আমাদের বাগানের দারোয়ান ছিল। জেনে শুনে দারোয়ানের ছেলের কাছে তোকে পড়তে দিতে পারি না। শোন, আমাদের বংশের মান সম্মান আছে। লোকে শুনলে কী বলবে?”

মনিরা বলল, আব্বা তোমার কথা মানতে পারব না। সেজন্য ক্ষমা চাইছি। হোসেন স্যারের বাপ-দাদারা হয়তো গরিব ছিল, তাই তারা তোমাদের কাছে দারোয়ানীর চাকরি করেছে। তাই বলে তাদের ছেলেকে ঘৃণা করা কি ঠিক হচ্ছে? তা ছাড়া হোসেন স্যার আমার শিক্ষক। বড় আপার কাছে শুনেছি, হাদিসে আছে, “আল্লাহ ও তার রাসূলের পরে মা-বাবার স্থান, তার পরেই শিক্ষকের স্থান। উনি আমার শিক্ষক, আমি তার কাছে পড়বই। কথা শেষ করে হনহন করে চলে গেল।

আব্দুল মতিন ছোট মেয়ের স্বভাব জানেন, তবু বললেন, আব্দুল করিম ঠিকই বলে, মনিরা সত্যিই দিন দিন, বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। তারপর চোখ বন্ধ করে ইকবালের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।

রুকসানা ঘরে ফিরে ওষুধ খাওয়ার জন্য আব্বার রুমে এল। তাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে আব্বা বলে ডাকল।

আব্দুল মতিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আয় বস।

রুকসানা বলল, আগে ওষুধ খেয়ে নাও, তারপর বসছি। তারপর ওষুধ খাইয়ে আব্বার পাশে বসে বলল, কিছু বলবে আব্বা?

তুই কী দক্ষিণ ফুকরায় মিটিংএ গিয়েছিলি?

হ্যাঁ, আমাদের অফিসের রাবেয়া ও কায়সারের সঙ্গে গিয়েছিলাম।

আব্দুল করিম একটু আগে এসে যখন বলল, হোসেন স্যার কাজেমের ছেলে তখন বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপর চেয়ারম্যান সাহেবের কথা বলতে বিশ্বাস হল। এখন বুঝতে পারছি, সেদিন তাকে বসতে বলার পরও কেন বসল না। চাকরের ছেলে হয়ে কি মনিবের সামনে সোফায় বসতে পারে? আগে যদি জানতাম হোসেন স্যার আমাদের দারোয়ানের ছেলে, তা হলে তোকে নিয়ে আসতে বলতাম না। আর মনিরাকেও তার কাছে পড়তে দিতাম না। শোন, একটু আগে মনিরাকে তার কাছে পড়তে নিষেধ করেছি; কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। তাকে তুই নিষেধ করে দিস। আমার বিশ্বাস, তোর কথা সে শুনবে।

তুমি তাকে পড়তে নিষেধ করলেন কেন আব্বা?

আব্দুল মতিন বিরক্ত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আশ্চর্য? কারণট বোঝা তোর উচিত ছিল। ভুলে যাচ্ছিস কেন, কয়লা হাজারবার ধুলেও তার কালো র যায় না। একটা চরিত্রহীন লম্পটের কাছে মনিরার পড়া কি…..

রুকসানা আর সহ্য করতে না পেরে আব্বার কথা শেষ করার আগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই আব্বা, এখনও কাপড় পাল্টাইনি। কথা শেষ করে চলে গেল।

আব্দুল মতিন অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, মনিরাকে যা বলতে বললাম, বলে দিস।

আব্বার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তার কথাগুলো রুকসানার মনে তীরের মতো বিধেছে। তার সামনে এতক্ষণ সহ্য করতে পারলেও নিজের রুমে এসে আর পারল না। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আজান হচ্ছে শুনে উঠে কাপড় পাল্টে বাথরুম থেকে অযু করে এল। তারপর নামায ও অজিফা পড়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মোনাজাতের সময় আল্লাহর কাছে জানাল, “হে মহান প্রভু আল্লাহ, তুমি সর্বজ্ঞ। সারা সৃষ্টি জগৎ তোমার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে। তুমি সমস্ত সৃষ্টি জীবের মনের খবর জান। আমি তোমার একজন নাদান বান্দী। আমার মনের নেক বাসনাগুলো তুমি পূরণ করো। তুমি তো জান, আমি ইকবালের জন্য কত বছর ধৈর্য ধরে রয়েছি। ইকবালও আমার জন্য এতবছর ধৈর্য ধরে আমার উপযুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে। আমাদেরকে জোড়া হিসাবে কবুল কর। আমাদের মিলনের পথে যে বাধা, তা দূর করে দাও। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর শতকোটি দরুদ ও সালাম পেশ করছি। তোমার রহমতে ও তোমার পেয়ারা হাবিবের অসিলায় আমার গোনাহ খাতা মাফ করে দিয়ে আমার স্বপ্ন সফল করে দাও, আমিন।” তারপর বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে গেল।

নাস্তা খেয়ে ফিরে আসার সময় রুকসানা মনিরাকে বলল, আমার রুমে আয়।

মনিরা তখন চা খাচ্ছিল। খাওয়া শেষ হতে কাপটা নামিয়ে রেখে বড় আপার রুমে এসে বলল, কেন ডেকেছ বল।

আব্বা তোকে হোসেন স্যারের কাছে পড়তে নিষেধ করা সত্ত্বেও তুই নাকি বলেছিস, তার কাছে পড়বি?

হ্যাঁ বলেছি। আচ্ছা বড় আপা, তুমিই বল তো, স্যারের বাবা আমাদের দারোয়ান ছিল, তাতে স্যারের কাছে পড়তে দোষ কোথায়? বড় বড় মনিষীদের বাবারাও অনেকে গরিব ছিলেন, অনেকে চাষী ছিলেন। আবার অনেকে ছোটখাট চাকরিও করতেন।

তোর কথা ঠিক, তবে আব্বা যখন নিষেধ করেছে তখন না পড়াই ভালো।

বড় আপা, তুমিও নিষেধ করবে ভাবতে পারিনি। স্যার দারোয়ানের ছেলে বলে যদি তুমিও নিষেধ কর, তোমার নিষেধও শুনব না বলে মনিরা হনহন করে চলে গেল।

তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রুকসানার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।

এরপর থেকে রুকসানা দিনের পর দিন মুষড়ে পড়তে লাগল।

<

Super User