হাসপাতালের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর নির্দিষ্ট তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসতে পারবেন কিনা জানার জন্য হোসেন ঢাকায় খালেক চাচার বাড়িতে এসে উঠল। সবার সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়ার বরকতে হাসপাতালের কাজ শেষ হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করাবার জন্য ওঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে এসেছি।

খালেক বলল, শুনে খুব খুশী হলাম। দোয়া করি, “আল্লাহ তোমার সব নেক মকসুদ পূরণ করুক, তোমাকে সুখী করুক, তোমার হায়াত দারাজ করুক।” তারপর স্ত্রীকে বলল, ইকবালকে নাস্তা দাও।

মালেকা কয়েকদিনের ছুটিতে গতকাল বাড়িতে এসেছে। সে তখন বাড়িতে ছিল না। কিছু কেনা-কাটা করতে মার্কেটে গিয়েছিল। হোসেন আসার কিছুক্ষণ পর ফিরল।

মেয়েকে ফিরতে দেখে খালেক বলল, ইকবাল এসেছে। তারপর কেন এসেছে। বলল।

মালেকা বলল, স্যার কোথায়?

খালেক বলল, গেষ্ট রুমে তার থাকার ব্যবস্থা করেছি। সেখানে নাস্তা খাচ্ছে।

মালেকা উপরে গিয়ে মার্কেটিং জিনিসগুলো রেখে বোরখা খুলে কাপড় পাল্টাল। তারপর মুখে হাতে পানি দিয়ে ওড়না জড়িয়ে যখন গেষ্টরুমে এল তখন ইকবাল নাস্তা খেয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল।

মালেকা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন স্যার?

আজ প্রায় এগার বছরের বেশি হয়ে গেছে মালেকার সঙ্গে হোসেনের যোগাযোগ নেই। তার কথা যে মনে পড়ে না তা নয়। তাকে ভালবেসে মালেকা বিয়ে করেনি মনে পড়লে বেশ কষ্ট অনুভব করে। ভাবে রুকসানাকে যদি ভুলতে পারত, তাহলে মালেকাকে গ্রহণ করত।

এত বছর পর আজ তার কণ্ঠস্বর শুনে হোসেন চমকে উঠল। সামলে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে মৃদু হেসে বলল, এখনো স্যার বলে সম্বোধন করবে?

তা হলে কি বলে করব?

কেন? ইকবাল ভাই বলবে।

তা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। কেন?

যাকে ছোটবেলা থেকে স্যার বলে এসেছি, তার নামের সঙ্গে ভাই বলা আর কারো পক্ষে সম্ভব হলেও আমার পক্ষে নয়। তা কেমন আছেন বললেন না যে?

বস না, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসার পর বলল, আল্লাহ এক রকম ভালই রেখেছেন। তুমি কেমন আছ বল?

আমাকেও আল্লাহ একরকম ভাল রেখেছেন। শুনলাম, হাসপাতাল করেছেন। হাসপাতাল উদ্বোধন করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে এসেছেন?

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। তারপর বলল, তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ফরিদপুর গিয়েছিলাম, চাচার কাছে নিশ্চয় শুনেছ?

হ্যাঁ শুনেছি।

অধ্যাপনা কেমন লাগছে।

মন্দ না; তবে বলে থেমে গেল।

থামলে কেন বল?

না থাক।

ঠিক আছে, বলতে অসুবিধা থাকলে বলার দরকার নেই। একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না তো?

আপনি আমার স্যার, নিশ্চয় মনে করার মতো কিছু বলবেন না। বলুন কি বলবেন।

তুমি একজন ধার্মিক ও শিক্ষিতা মেয়ে হয়ে মা-বাবার মনে অশান্তি দেওয়া কী ঠিক হচ্ছে?

মালেকা ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে অবাক কণ্ঠে বলল, আমি আবার তাদের মনে কি অশান্তি দিচ্ছি?

আমার তো মনে হচ্ছে, কথাটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করছ। তবু বলছি, প্রত্যেক মা-বাবা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হতে চান। তুমি বিয়ে করতে রাজি না হয়ে তাদেরকে অশান্তি দিচ্ছ না কী?

আপনার কথা অবশ্য ঠিক। তবে আমারও মনে হচ্ছে, বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ বুবতে পেরেও না বোঝার ভান করছেন। তবু বলছি, রাজি না হওয়ার কারণ একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। আমার কথা থাক, এবার আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করব। অবশ্য ছাত্রী হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করা বেয়াদবি হবে। তাই অনুমতি চাচ্ছি।

অনুমতি দিলাম।

হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “বিবাহ করা আমার সুন্নত যে ইহাকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করিবে, সে আমার দলভুক্ত নহে।” [বেহেশতী জেওর ৪র্থ খণ্ড- ৬৫ পৃষ্ঠা]

হাদিসে আরো আছে, “বিবাহ করা ইন্দ্রিয়ের আধিক্যে ফরয, ওয়াজীব ও সুন্নত। হইয়া থাকে।” [বেহেশতী জেওর ৪র্থ খণ্ড- ৬৫ পৃষ্ঠা]

এই হাদিসগুলো আপনিও নিশ্চয় জানেন। তবু কেন বিয়ে করছেন না?

হ্যাঁ জানি। আর তাই বিয়ে করব না, এরকম সিদ্ধান্ত নিইনি। এবার আমিও যদি ঐ হাদিসগুলোর রেফারেন্স টেনে তোমাকে জিজ্ঞেস করি?

উত্তরে আপনার কথাটাই বলব। তারপর বলল, এতদিনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমার অনুমান সত্য।

তা হলে এবার মা-বাবার ইচ্ছা নিশ্চয় পূরণ করবে?

সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব, যদি অনুমতি দেন।

বল, কি জানতে চাও।

কে সেই ভাগ্যবতী? যার প্রতীক্ষায় এত বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন?

তার কথা বলতে পারব না। তাকে সারা জীবনে পাব কিনা তাও জানি না। এ পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই। মা-বাবাকে হারাব বলে হয়তো আল্লাহ আমাকে তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তোমাদেরকেই আপন বলে জানি। তাই তোমাদের কারো দুঃখ দেখলে আমিও দুঃখ পাই। তুমি বিয়ে করে সংসার করছ শুনলে, চাচা-চাচির চেয়ে আমিও কম শান্তি পাব না।

স্বার্থপরের মতো আপনি শুধু নিজের শান্তির কথা বলছেন, কিন্তু কখনও কী ভেবেছেন, যার জন্য আপনি দুঃখ পাচ্ছেন সেও আপনার জন্য দুঃখ পাচ্ছে? তারপর কান্না সামলাতে না পেরে মালেকা সেখান থেকে চলে গেল। হোসেন চিন্তা করল জেনেশুনে প্রসঙ্গটা তোলা খুব ভুল হয়েছে।

ঢাকায় দু’তিন দিন থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রী নির্দিষ্ট দিনে আসবেন সিওর হয়ে আজ দশ দিন হল হোসেন ফিরে এসেছে। আসার সময় চাচা-চাচিকে সে কথা জানিয়ে উদ্বোধনের চার পাঁচ দিন আগে সবাইকে নিয়ে আসতে বলে এসেছে। এক ফাঁকে মালেকাকেও বলেছে, তুমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসবে। মালেকা হা-না কিছু না বলে তার কাছে থেকে চলে গেছে।

গ্রামে ফিরে হোসেন তাদের আসার কথা বলে দাইহানকে একটা ঘর বানাবার দায়িত্ব দিয়েছিল। দাইহান এক সপ্তাহের মধ্যে ঘরটা কমপ্লিট করে বলল, এবার তো ঘরের আসবাবপত্র লাগবে। হোসেন তাকে কিছু টাকা দিয়ে বুলল, যা কিছু দরকার তুমিই ব্যবস্থা কর।

এর মধ্যে একদিন আসমা হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, রুকসানার খোঁজ খবর রাখ?

হোসেন বলল, কয়েকদিন আগে স্কুলে মনিরার কাছে শুনেছি, বেশ কিছুদিন থেকে রুকসানা অসুস্থ। শোনার পর দেখতে যাব মনে করেছিলাম, চৌধুরী সাহেবের কথা। চিন্তা করে যাইনি। মনিরাও এই কয়েকদিন স্কুলে আসছে না। তাই কিছু বলতে পারছি না।

আসমা বলল, আমি তোমার ভাইকে নিয়ে কাল একবার যাব ভাবছি।

তাই যাও। দেখে এসে জানাবে কেমন আছে। এদিকে হাসপাতাল উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। খুব ব্যস্ত রয়েছি।

ঢাকা থেকে কারা যেন আসবেন বলেছিলে, কই তারা তো এলেন না?

দু’এক দিনের মধ্যে আসতে পারে।

আসমা রাত্রে স্বামীকে রুকসানার অসুখের কথা জানিয়ে বলল, কাল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে দেখতে যাব। তুমি মাঠ থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে।

পরের দিন হোসেন স্কুলে যাওয়ার সময় ভাবল, আজ যদি মনিরা আসে, রুকসানার খবর জানা যাবে। স্কুলে পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সে আসেনি। মনিরা না আসার কারণ ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, রুকসনার অসুখ বাড়বাড়ি হয়নি তো? তারপর আজ আসমার যাওয়ার কথা মনে পড়তে ভাবল, সে ফিরে এলে জানা যাবে।

বেলা তিনটের দিকে আসমা ও দাইহান যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে এমন সময় লম্বা কোর্তাপরা একজন টুপি দাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে দু’জন বোরখাপরা মেয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।

দাইহান বলল, লোকটাকে অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, ঢাকা থেকে যাদের আসার কথা হোসেন বলেছিল, এরা তারাই।

আসমা বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক।

খালেক স্ত্রীকে নিয়ে পরশু ফরিদপুরে এসে মেয়ের কাছে ছিল। মালেকা কাল কলেজে গিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আজ সকালে মা বাবাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে। বাস থেকে নেমে রিকশা নিয়ে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে এসে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে হেঁটে আসছিল। আসমা ও দাইহানকে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে খালেক সালাম দিল।

দাইহান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনারা কোথায় যাবেন?

খালেক বলল, আমরা ঢাকা থেকে আসছি। মরহুম কাজেম সেখের ছেলে ইকবালের বাড়িতে যাব।

আসমা স্বামীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, আজ আর যাওয়া হবে না, কাল যাব। ইনাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

দাইহান খালেকের দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন আমাদের সঙ্গে। তারপর যেতে যেতে বলল, ইকবাল আমার চাচাতো ভাই। তার বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ি। সে এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি।

বাড়ি করে ডাক্তারী শুরু করার পর হোসেন রশিদা নামে একজন বয়স্কা বিধবা গরিব মেয়েকে ঘরের সব কাম-কাজ করার জন্যে রেখেছে। তাকে সবাই রশিচাচি বলে ডাকে। সে সারাদিন থাকে। এশার নামাযের পর হোসেনকে খাইয়ে নিজে খায়। তারপর ঘরে চলে যায়। আগে সে ভিক্ষা করে দিন গুজরান করত। আর রাজ্জাক, নামে একজন লোককে কম্পাউন্ডার রেখেছে। সে আগে হোমিও বই দেখে দেখে ডাক্তারী করত। ইকবাল তাকে বেতন দিয়ে রেখেছে।

হোসেন যে নতুন ঘর বানিয়েছে, মেহমানদেরকে সেই ঘরে নিয়ে এসে বসতে বলল। তারপর আসমা স্বামীকে বলল, রশিচাচি বোধ হয় হোসেন ভাইয়ের ঘরের মেঝেয় পাটি মেলে ঘুমাচ্ছে, তাকে ডেকে নিয়ে এস। মেহমানদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে।

দাইহান বলল, আমি রশিচাচিকে ডেকে দিয়ে ঘর থেকে একটু ঘুরে আসি।

আসমা বলল, তাই এস। তারপর মেহমানদেরকে বলল, উনি আমার স্বামী। হোসেন ভাইয়ের আব্বা আর আমার শ্বশুর চাচাতো ভাই। এই ভিটের উত্তর পাশে আমাদের বাড়ি। আপনাদের বোধহয় জোহরের নামায পড়া হয়নি। কাপড় পাল্টে নামায পড়ে নিন। অজুর ব্যবস্থা করছি।

মালেকা বোরখা খুলতে খুলতে বলল, আপনারা কোথাও যাচ্ছিলেন মনে হয়।

আসমা বলল, হ্যাঁ, এক আত্মীয়ের বাড়ি যাব বলে বেরিয়েছিলাম। আপনাদেরকে ফেলে তো আর যেতে পারি না, অন্য দিন যাব। আপনারা যে আসবেন, হোসেন ভাই আমাদের বলেছে।

মালেকা বলল, স্যার আমাদের আসার কথা বললেও পরিচয় তো জানেন না। বলছি শুনুন, আমি মালেকা। ফরিদপুর মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করি। আর ওঁরা হলেন আমার আব্বা আম্মা। আমাদের বাড়িতে থেকে স্যার লেখাপড়া করেছেন।

ততক্ষণে রশিচাচি এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখিয়ে আসমা বলল, ইনি হোসেন ভাইয়ের সংসারের সব কাজ করে। তারপর রশিচাচিকে বলল, মেহমানদের অজুর পানি দিয়ে রান্নাঘরে এস, রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে। কথা শেষ করে চলে গেল।

আসমা তাড়াতাড়ি করে আলুভাতে ডাল রান্না করল। তারপর ডিম ভাজি করে মেহমানদের খেতে দিয়ে বলল, এত অল্প সময়ে বেশি কিছু করতে পারিনি। এই দিয়েই একমুঠো খান।

খাওয়া শেষ করে মেহমানরা উঠে বসেছে। এমন সময় রহিমন এসে আসমাকে বলল, যয়নাব খুব কাঁদছে। তাকে দুধ খাইয়ে এস। আমি ততক্ষণ এখানে আছি।

আসমা রশিচাচিকে থালা-বাসন ধুতে বলে ঘরে চলে গেল।

রহিমন আলাপ পরিচয় করে বলল, হোসেনের মুখে আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। তাই দেখতে এলাম। আপনারা ইকবালকে মানুষ না করলে আজ এতবড় হতে পারত না। এর বদলা আল্লাহ আপনাদেরকে দেবে। আজ যদি ওর মা-বাপ বেঁচে থাকত, তাহলে কতই না খুশী হত। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসীব করুক।

ফরিদা জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলে মেয়ে কয়জন।

রহিমন বলল, এক ছেলে তিন মেয়ে। ছেলের প্রথম স্ত্রীর একটা ছেলে রেখে মারা গেছে। সেই নাতিকে আমি মানুষ করি। এখন তার কাছেই আছি। আমার ছেলে আবার বিয়ে করেছে। তার ঘরে চার পাঁচটা ছেলে মেয়ে হয়েছে।

মালেকা বলল, আসমা আপা তা হলে আপনার নাত বৌ?

রহিমন বলল, হ্যাঁ। আসমার মতো নাতবৌ পেয়ে আল্লাহ আমাকে খুব সুখে রেখেছে।

এমন সময় আসমা ফিরে এসে বলল, দাদি আপনি এবার যান। যয়নাবকে ওর বাপের কাছে দিয়ে এসেছি। সে যেন কোথায় যাবে।

রহিমন মেহমানদের উদ্দেশ্যে বলল, এখন যাই। পরে আবার আসব।

রহিমন চলে যাওয়ার পর হোসেন স্কুল থেকে ফিরে মেহমানদের দেখে খুশী হল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কখন এলেন? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

খালেক বলল, তিনটের দিকে এসেছি। তারপর বলল, মালেকা সঙ্গে না থাকলে অসুবিধা একটু হত। আমরা পরশু মালেকার কাছে এসে ছিলাম।

স্যারকে দেখে মালেকা ওড়নাটা নাকের উপর দিয়ে মুখ ঢেকে দিল।

হোসেন আসমাকে বলল, মেহমানদের খাওয়া-দাওয়া করিয়েছ?

হ্যাঁ, ঘরে যা ছিল তাই রান্না করে খাইয়েছি। তুমি খাবে চল।

আমি এমন সময় কিছু খাই না। তোমাদের আজ বাহিরবাগ যাওয়ার কথা ছিল না?

আমরা যাওয়ার জন্য বেরিয়ে রাস্তায় এসে ওঁদের সঙ্গে দেখা। তাই আর যাওয়া হল না। ইনশাআল্লাহ কাল যাব।

দাইহান ভাই কোথায়?

মেহমানদের সঙ্গে এসেছিল। এখন ঘরে আছে। কোথায় যেন যাবে বলছিল।

তুমি গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এস বাজারে যাব।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর হোসেন আসমাকে বলল, মেহমানদের ঘুমাবার ব্যবস্থা করে তারপর যেও। আমি দাইহানকে নিয়ে তোমার আব্বার ওখানে যাচ্ছি। সেখানে কমিটির মেম্বাররা আসবেন। তাদেরকে নিয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করব। কথা শেষ করে দাইহানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

হোসেনের ঘরেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আসমা মেহমানদেরকে বলল, আপনারা এখানেই বসুন, আমি বিছানা করে দিয়ে আসছি।

কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, এবার আপনারা ওঘরে যান।

মালেকা আব্বা-আম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা যাও, আমি আসছি। তারা যাওয়ার পর আসমাকে বলল, আপনি বসুন, কিছুক্ষণ গল্প করি।

আসমা বসে বলল, আমি গ্রামের মেয়ে কি আর গল্প করব, তার চেয়ে আপনি শহরের গল্প করুন।

গল্প করতে করতে একসময় কথা প্রসঙ্গে মালেকা বলল, স্যার আপনাকে বাহিরবাগ যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে ওঁর কেউ আছেন নাকি?

আসমা উত্তরটা একটু পাশ কেটে বলল, বাহিরবাগের চৌধুরীদের মেয়ে রুকসানা আমার সই। তার অসুখ। তাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মাইণ্ড করবেন না তো?

মালেকা প্রথম থেকে আসমার কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে বুঝতে পেরেছে সে শিক্ষিত। বলল, মাইণ্ড করার কি আছে? আপনি বলুন।

ছাত্র জীবনে না হয় হোসেন ভাইকে স্যার বলতেন, এখনও বলেন কেন?

দুঃখিত বলতে পারব না। তবে আমার মতে ছাত্র-ছাত্রীর বয়স যতই হোক না কেন, শিক্ষককে স্যার বলাই উচিত। আচ্ছা, স্যারের বয়স তো অনেক হয়েছে, বিয়ে করেন না কেন?

আসমা বুঝতে পারল, হোসেন ভাই ও রুকসানার সম্পর্কের কথা এরা জানে না। বলল, হোসেন ভাই ছোটবেলা থেকে আপনাদের কাছে অনেক বছর ছিল, আপনাদেরই তো জানার কথা।

তা অবশ্য ঠিক, স্যার আমেরিকা যাওয়ার আগে আম্মা-আব্বা বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। স্যার তখন রাজি হননি। আমেরিকা থেকে ফেরার পরও তারা বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন। স্যার বললেন, গ্রামে থাকবেন এবং গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবেন। প্রায় এক বছর হতে চলল গ্রামে এসেছেন। এখনও করেনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আর একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে, স্যারের নাম তো ইকবাল, আপনারা হোসেন বলছেন কেন?

ওর পুরো নাম ইকবাল হোসেন। এখানে হোসেন নামেই পরিচিত।

আপনারা তো স্যারের নিকট আত্মীয়, তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কিছু বলেন নি?

আসমা গ্রামের মেয়ে। তার ধারণা নেই, শহরের শিক্ষিত মেয়েদের পঁচিশ ত্রিশ বছরের আগে বিয়ে হয় না। তাই মালেকাকে বিবাহিত মনে করে বললেন, হোসেন ভাই ঢাকায় যাওয়ার আগে কিশোর বয়সেই একটা মেয়েকে ভালবাসত। সেই মেয়েটাও হোসেন ভাইকে ভালবাসত। তার কথা আজও ভুলতে পারেনি। তাই বিয়ে করেনি।

মালেকা খুব অবাক হয়ে বলল, সে তো ছোটবেলার ঘটনা। মেয়েটি নিশ্চয় এতদিনে স্বামী ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করছে?

আপনার ধারণা ভুল। মেয়েটিও একই কারণে এখনও বিয়ে করেনি।

মালেকা আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, তা কি করে সম্ভব। আমি যতদূর জানি, স্যার ঢাকায় যাওয়ার পর একেবারে এস.এস.সি পাশ করে চার-পাঁচ বছর পর গ্রামে মাত্র একবার এসে তিন চার দিন ছিলেন। তারপর প্রায় পনের ষোল বছর পর গ্রামে এসেছেন। এরমধ্যে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি করে ভাবতে খুব অবাক লাগছে।

আসমা মৃদু হেসে বলল, শুনলে আরো অবাক হবেন, হোসেন ভাই ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে তিন চার মাস আগে পর্যন্ত তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া তো দূরের কথা, চিঠি-পত্রও আদান-প্রদান হয়নি এবং দু’জনেই একে অপরকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে ভাবত।

মালেকা বলল, সত্যিই এটা একটা অকল্পনীয় ঘটনা। তারপর বলল, আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে, এখন দেখা-সাক্ষাৎ হয় এবং একে অপরের বিয়ে না করার কারণও নিশ্চয় জেনেছেন?

হ্যাঁ জেনেছে।

তা হলে বিয়ে করছেন না কেন?

কারণ তারা দু’জনেই জানে, বিয়ে হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কেন?

দুঃখিত, এর থেকে আর বেশি কিছু বলতে পারব না।

মালেকা খুব আশ্চর্য হয়ে আসমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, মেয়েটির বাড়ি কোথায় বলতে নিশ্চয় বাধা নেই?

না, তা নেই।

তা হলে বলুন।

এই গ্রাম থেকে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার পূর্ব দিকে বাহিরবাগ গ্রামে।

আপনি যখন এতকিছু জানেন তখন মেয়েটির মা-বাবাকে নিশ্চয় চেনেন?

হ্যাঁ, তাদের সবাইকে চিনি।

আমরা এক সপ্তাহ থাকব। আমি মেয়েটির মা-বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। তবে স্যার যেন জানতে না পারেন। আপনি কী এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন?

আসমার সন্দেহ হল। ভাবল, মালেকা এতকিছু জানতে চাচ্ছে কেন? কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এক্ষুনি কথা দিতে পারছি না। আপনি তো কয়েকদিন থাকবেন বললেন, আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে জানাব। এবার আমি দু’একটা প্রশ্ন করব। কিছু মনে করতে পারবেন না কিন্তু।

বেশ তো কি জানতে চান বলুন।

আপনি অধ্যাপনা করেন, আপনার স্বামী কি করেন?

মালেকা কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আব্বা-আম্মা বিয়ে দিতে চেয়েছেন, আমি রাজি হইনি।

আসমার সন্দেহটা বেড়ে গেল। বলল, কেন রাজি হননি বলবেন?

দুঃখিত বলতে পারব না।

যদি বলি আপনার কথা-বার্তায় বোঝা যাচ্ছে, আপনি হোসেন ভাইকে ভালবাসেন। তাই বিয়ে করেন নি; তাহলে কী অস্বীকার করবেন?

মালেকা কিছু বলতে না পেরে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আসমা বলল, কিছু বলছেন না যে?

আপনি শিক্ষিতা, জিজ্ঞেস না করে বুঝে নেওয়া উচিত ছিল।

হোসেন ভাই জানেন?

একথা তাকেই জিজ্ঞেস করবেন।

এমন সময় হোসেন এসে আসমাকে বলল, এখনো তুমি ঘরে যাওনি? দাইহান ভাই তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। যয়নাব খুব কাঁদছে।

আসমা বলল, মালেকা আপার সঙ্গে গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। এক্ষুনি যাচ্ছি। তারপর মালেকাকে বলল, ইনশাআল্লাহ কাল দেখা হবে। কথা শেষ করে বাইরে এসে স্বামীকে বলল, চল।

পরের দিন আসমা স্বামীকে নিয়ে রুকসানাকে দেখতে বাহিরবাগ গেল। স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসিয়ে আসমা উপরে গেল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় বারান্দায় উঠে সুরাইয়া ভাবিকে দেখে সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, সই কেমন আছে?

সূরাইয়া বলল, ভালো নয়। তারপর জিজ্ঞেস করল, দাইহান ভাইয়ের সঙ্গে এসেছেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ, উনি নিচে বসে আছেন। আমি সই-এর রুমে যাই।

বড় আপা নেই। গতকাল তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এমন সময় করিমনকে আসতে দেখে সুরাইয়া তাকে বলল, নিচে মেহমান আছে, চা-নাস্তা দিয়ে এসে আমার ঘরেও আসমা আপার জন্য নিয়ে আসবে। তারপর আসমাকে বলল, আপনি আমার ঘরে চলুন, কথা আছে।

ঘরে এসে আসমাকে বসতে বলে নিজেও বসল। তারপর বলল, বড় আপার শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছিল দেখে আমি আপনার ভাইদেরকে একদিন বড় আপার বিয়ে না করার কারণ ও হোসেন স্যারের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় পরামর্শ করলাম। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব বলে বলল, আমার দৃঢ় ধারণা, বড় আপা আমার ও আব্বার সব কথা-বার্তা শুনেছে। কারণ সেই রাতেই বড় আপা ঘরের মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে বড় আপার অবস্থা এমন হল যে, কয়েকদিনের মধ্যে বিছানায় পড়ে গেল। গোপালগঞ্জ থেকে বড় ডাক্তার আনিয়ে চিকিৎসা করিয়েও কোনো কাজ হয়নি। শেষে সেই ডাক্তারের কথামতো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আমার কেবলই মনে হয়, বড় আপার এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। আমি যদি সেদিন আব্বাকে ওদের সম্পর্কের কথা না বলতাম, তাহলে বড় আপার অবস্থা এরকম হত না।

আসমা বলল, সবর করুন সুরাইয়া ভাবি। তকদিরে যা লেখা আছে, তা যে কোনো অসিলায় হবেই। আজ আর চাচা-চাচির সাথে দেখা করব না। ঢাকা থেকে হোসেন ভাইয়ের বাড়িতে তিনজন মেহমান এসেছেন। আমাকেই সবকিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে। পরশু হাসপাতাল উদ্বোধন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রী আসবেন। হোসেন ভাইও খুব ব্যস্ত। ইনশাআল্লাহ উদ্বোধনের পরের দিন এসে চাচার হাতে পায়ে ধরে রাজি করাব। এখন যাই, সইকে হাসপাতালে দেখে বাড়ি যাব।

এমন সময় করিমন নাস্তা নিয়ে এলে সুরাইয়া বলল, একটু মুখে দিয়ে যান।

নাস্তা খেয়ে আসমা বিদায় নিয়ে নিচে এসে স্বামীকে বলল, সই গোপালগঞ্জ হাসপাতালে। চল, তাকে দেখে তারপর ফিরব।

হাসপাতালে এসে রুকসানাকে দেখে আসমা ও দাইহান চোখের পানি রোধ করতে পারল না। বেডে যেন একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। আসমা সেই কঙ্কালকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এ তোর কি হাল হয়েছে সই? কাউকে দিয়ে আমাকে একটা খবরও দিলি না? তারপর ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আল্লাহগো, তুমি আমার সই-এর উপর রহম কর।

একজন নার্স দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে আসমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাগের সঙ্গে বললেন, এ কী করছেন আপনি? রুগীর অবস্থা খুব খারাপ। একটু উত্তেজিত হলে হার্টফেল করবেন। যান, চলে যান এখান থেকে।

রুকসানা ক্ষীণ স্বরে নার্সকে বলল, সিস্টার ওকে থাকতে দিন। চলে গেলেই বরং আমি হার্টফেল করব। আপনি যান, ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলব।

নার্স বলল, কিন্তু স্যারের অর্ডার, কেউ যেন আপনাকে এতটুকু ডিস্টার্ব না করে।

রুকসানা বলল ও তো ডিস্টার্ব করছে না, বরং ওকে দেখে বেশ সুস্থ বোধ করছি। প্লিজ, আপনি একটু যান।

নার্স বিরক্ত হয়ে চলে গেল।

রুকসানা দাইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,তোমাদের হাসপাতাল উদ্বোধন হয়ে গেছে?

না বড় আপা, পরশু হবে। তারপর ভিজে গলায় বলল, বড় আপা, আপনার অবস্থা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাদের যে উপকার করেছেন, আজীবন ভুলতে পারব না। সব থেকে বড় দুঃখ, আমরা আপনার কোনো উপকার করতে। পারলাম না। কথা শেষ করে চোখ মুছল।

সুরাইয়া বলল, তোমরা অত বিচলিত হচ্ছ কেন? জান না, সারা বিশ্ব জগতে যা কিছু হচ্ছে, আল্লাহপাকের ইশারাতেই হচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। দুঃখ করো না দাইহান ভাই, আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নেওয়াই প্রকৃত মুমীনের লক্ষণ। তারপর আসমাকে বলল, সই, তোরা আমার জন্য দোয়া করিম, “আল্লাহ যেন ঈমানের সঙ্গে আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন।” আর হোসেনকে বলবি, হাসপাতাল উদ্বোধনের পরের দিন যেন অতি অবশ্যই আসে। তোরাও আসবি। শেষ বারের মতো তোদের সবাইকে একবার দেখতে চাই। দুনিয়াতে বোধ হয় আমাদের মিলন আল্লাহর ইচ্ছা নয়। তাই আমাকে তুলে নিচ্ছেন। অনেকবার ভেবেছি, গোপনে হোসেনের কাছে গিয়ে বলব, চল, আমরা বিয়ে করে আমেরিকা চলে যাই। কিন্তু আব্বার কথা ভেবে তা না করে সবর করেছি।

এমন সময় নার্সের কাছে খবর পেয়ে ডাক্তার এসে আসমা ও দাইহানকে একপাশে ডেকে নিয়ে এমন কিছু কথা বললেন, যা শুনে তারা এক্ষুনি চলে যেতে রাজি হল। তারপর আসমা একা এসে বলল, সই, কিছু মনে করিস নি, তোর ভালোর জন্যে চলে যেতে হচ্ছে। এই কথা বলে চোখ মুছতে মুছতে স্বামীর কাছে এসে বলল, চল।

হাসপাতাল থেকে ফিরে আসমা যখন হোসেনের ঘরে এল তখন সে রুগীদের ওষুধ দিচ্ছিল। তাকে দেখে হোসেন রুগীদের একটু বসতে বলে আসমার কাছে এসে বলল, রুকসানার খবর কি বল।

আসমা বলল, তোমার ঘরে চল।

ঘরে এসে তাকে বসতে বলে নিজেও বসল।

আসমা বসে বলল, সই-এর অবস্থা খুব খারাপ। গতকাল গোপালগঞ্জের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি বাহিরবাগে গিয়ে সেকথা জেনে হাসপাতালে সইকে দেখে এসেছি। তারপর সুরাইয়া ভাবি ও রুকসানা যা কিছু বলেছে, তা বলে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, আল্লাহ না করুক, আমার মনে হচ্ছে, সই বেশি দিন বাঁচবে না।

আসমার কথা শুনে ইকবালের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, কেঁদে কী হবে? রুকসানা ঠিক কথা বলেছে, “সারা বিশ্ব জগতে যা কিছু ঘটছে, আল্লাহর ইশারাতেই ঘটছে। কেউ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না।” আমারও মনে হচ্ছে দুনিয়াতে আমাদের মিলন আল্লাহর ইচ্ছা নয়। এখন যাই, রুগীরা বসে আছে বলে ইকবাল চলে গেল।

.

আজ সকাল থেকে আসমাকে না দেখে মালেকা বুঝতে পারল, সে বাহিরবাগ গেছে। দুপুরে খাওয়ার পর সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন মালেকা বিছানায় শুয়ে চিন্তা করছিল, স্যার যখন আমাদের বাড়িতে যায় তখন সেভেনে পড়তেন। সে সময় তার বয়সই বা কত ছিল? বড় জোর তের চৌদ্দ। আর মেয়েটিরও হয়তো তাই অথবা দু’এক বছর কম। অত ছোটবেলার ভালবাসা দীর্ঘ বিশ-একুশ বছর যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও এত গম্ভীর হল কি করে? যদি আসমার কথা সত্য হয়, তাহলে এটা একটা অলৌকিক ঘটনা। এই সব চিন্তা করতে করতে শুয়ে থাকতে ভালো লাগল না। উঠে হোসেনের ঘরে গেল। ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, বুকসেলফের বইগুলো এলোমেলো। টেবিলের উপরেও কয়েকটা বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, আলনার জামা-কাপড়গুলোর অবস্থাও ঐ একই রকম। বিছানার চাদর অর্ধেক গুটান, বালিশ দুটো জায়গামতো নেই। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে সবকিছু গুছাল। তারপর ঘরে ঝাট দেবে বলে ঝাটার খোঁজ করল। না পেয়ে বাইরে এসে রান্না ঘরের বেড়ায় ঠেস দেওয়া একটা ঝাটা দেখতে পেয়ে সেখানে গেল। এমন সময় আসমাকে ডিসপেন্সারীর দরজার বাইরে থেকে স্যারকে পাশের ঘরে যাওয়ার কথা বলতে শুনে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তাদেরকে ঘরে ঢুকে যেতে দেখে পিছনের দিকের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। তাদের কথা-বার্তা শুনে যখন বুঝতে পারল, আসমার সই-ই স্যারের প্রেমিকা তখন সেখান থেকে চলে এল।

রাত্রে খাওয়ার পর মালেকা গল্প করার কথা বলতে পারে ভেবে আসমা যয়নাবের শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ঘরে চলে গেল।

পরের দিন আসমা এক ফাঁকে হোসেনকে বলল, মালেকা আপার সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি, উনি এখনও বিয়ে করেন নি। কেন করেন নি তুমি জান?

হোসেন বলল, আমি জানব কি করে? তাকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।

জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, দুঃখিত, বলতে পারব না। আমার মনে হয় তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাই বিয়ে না করে আজও তোমার প্রতীক্ষায় রয়েছেন।

এখন এসব কথা আলাপ করার সময় নেই বলে হোসেন তার কাছে থেকে চলে গেল।

আসমা তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। হোসেন ভাই নিশ্চয় মালেকা আপার মনের কথা জানে।

.

আজ হাসপাতাল উদ্বোধন হবে। সকাল থেকে হোসেন খুব ব্যস্ত। বেলা দশটার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রী পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে এসে গেলেন। এগারটার সময় তিনি ফিতে কেটে হাসপাতাল উদ্বোধন করলেন।

দাইহান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসার সময় আসমা, মালেকা ও তার মা-বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

কুরআন তেলাওয়াতের পর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বক্তৃতা দিলেন। সব শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতাল চালু রাখার কর্মসূচীর ব্যাপারে বক্তৃতা দিয়ে বললেন, এই হাসপাতাল যাতে সরকারী অনুমোদিত হয় এবং অনুদান পায়, সে ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় করব। তারপর জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আরো অনেক কিছু বলে অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করলেন।

অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণার পর আসমা ও মেহমানদেরকে দাইহান ঘরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। তারা বড় রাস্তায় উঠেছে, এমন সময় একটা লোক রিকশা থেকে। নেমে একটা ভাঁজ করা কাগজের উপর লেখা ঠিকানা দেখিয়ে দাইহানকে বলল, এই মহিলার বাড়িটা দেখিয়ে দিন তো।

কাগজটায় আসমার নাম ঠিকানা দেখে দাইহান জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে আসছেন?

গোপালগঞ্জ হাসপাতাল থেকে।

দাইহান বলল, এটা আমার স্ত্রীর নাম। তারপর কাগজটা আসমার হাতে দিল।

লোকটা বিদায় নিয়ে ঐ রিকশাতেই চলে গেল।

আসমা কাগজটা খুলে পড়ে স্বামীকে বলল, সুরাইয়া ভাবি চিঠি দিয়েছেন। সই-এর অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। এক্ষুনি যেতে হবে। তুমি হোসেন ভাইকে ডেবে নিয়ে এস। আমি ইনাদের নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।

হোসেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বিদায় করে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছিল।

দাইহান এসে তাকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে আসমার কথাগুলো বলল।

হোসেন শুনে চমকে উঠল। তারপর কমিটির সদস্যদের কাছে ফিরে এসে বলল, বিশেষ প্রয়োজনে ঘরে যেতে হচ্ছে। পরে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করব। তারপর সালাম বিনিময় করে দাইহানের সঙ্গে ঘরে এল।

আসমা চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বলল, হাসপাতাল থেকে সুরাইয়া ভাবি পাঠিয়েছেন। পড়ে দেখ।

হোসেন পড়তে শুরু করল,

আসমা আপা,

সালামান্তে জানাই যে, বড় আপার অবস্থার অবনতি জেনে আমরা সবাই এসেছি। শুধু আব্বা আসেননি। এখানে আসার পর আমরা ডাক্তারকে বললাম, রুগীকে ঢাকায় নিয়ে যাব। ডাক্তার বললেন, “কোনো লাভ হবে না। রুগী ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। আপনারা নিশ্চয় কারণটা জানেন। তা যদি বলেন, তাহলে বাঁচাব চেষ্টা করতে পারি।” আমি তোমার ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে সেই ছোটবেলার ঘটনা থেকে শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে ডাক্তার বললেন, “কথাটা চেপে রেখে আপনারা খুবই অন্যায় করেছেন। আমরা এতদিন যত চিকিৎসা করেছি, সব ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। যা বলছি শুনুন, আপনারা রুগীর বাবাকে ও সেই ছেলেকে অতি সত্বর নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন। আল্লাহ যদি ওঁর হায়াত রেখে থাকেন, তাহলে ওদেরকে কাছে পেলে রুগীর মানসিক যন্ত্রণা কমবে এবং আমাদের চিকিৎসায় কাজও হবে।” ডাক্তারের কথা শোনার পর আমরা আম্মাও আব্দুল করিমকে আব্বাকে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়েছিলাম, উনি আসেন নি। বড় আপা হোসেন স্যারকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে পড়েছে। তাকে ডেকে আনার জন্য বার বার তাগিদ দিচ্ছে। বলছে “আমি আর বাঁচব না। শেষ বারের মতো একবার তাকে দেখতে চাই।” চিঠি পাওয়া মাত্র আপনি তাকে নিয়ে আসবেন। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।

ইতি
আপনার সুরাইয়া ভাবি

চিঠি পড়ে হোসেনের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আসমার দিকে তাকাল।

আসমা বলল, আমি তোমার ভাইকে নিয়ে বাহিরবাগ যাচ্ছি। চাচাকে যেমন করে হোক হাসপাতালে নিয়ে আসব। তুমি মালেকা আপাকে নিয়ে যাও। তারপর মালেকাকে বলল, আপনি যাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে গেলে তাদের সঙ্গে দেখা হবে।

আসমার কথা শুনে হোসেন অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আসমা বলল, হোসেন ভাই, আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছ তাই না? পরে সব কিছু বলব, এখন ওঁকে নিয়ে রওয়ানা দাও। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে চল আমরা যাই বলে হাঁটতে শুরু করল।

চিঠি পাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত খালেক সবকিছু লক্ষ্য করছে। দাইহান ও আসমা চলে যাওয়ার পর হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার বলতো বাবা, তোমাদেরকে খুব পেরেশান দেখাচ্ছে? হাসপাতালে কে আছে?

হোসেন বলল, বাহিরবাগের চৌধুরীদের মেয়ে রুকসানা আসমার সই। সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে। এখন তার অবস্থা খুব খারাপ। তারপর মালেকার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী যাবে?

চিঠি পড়ে আসমা যখন হোসেনকে ডেকে নিয়ে আসার কথা দাইহানকে বলে তখন থেকে মালেকা চিন্তা করছিল, আসমার সই-এর অসুখ, সে দেখতে যাবে; কিন্তু স্যারকে ডেকে পাঠাল কেন? তারপর চিঠি পড়ে স্যারের চোখে পানি দেখে আসমার সই-ই স্যারের ভালোবাসার পাত্রী হোসেনের কথার উত্তরে বলল, হ্যাঁ যাব, চলুন।

সবকিছু দেখে শুনে খালেকেরও কেমন যেন সন্দেহ হল। ভাবল, তাহলে কি এই মেয়ের জন্য হোসেন এখনও বিয়ে করেনি? মেয়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলল, চল মা, আমরাও তোদের সঙ্গে যাব।

.

আসমা ও দাইহান বড় রাস্তায় এসে একটা স্কুটার নিয়ে বাহিরবাগ এল। আসমা স্বামীকে নিচে ড্রইংরুমে বসতে বলে উপরে এসে দেখল, চাচা বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে আছেন। কাছে এসে সালাম দিল।

আব্দুল মতিন চৌধুরীর আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। তার উপর রুকসানা তাদের দারোয়ানের চরিত্রহীন ছেলেকে ভালবেসে এতদিন বিয়ে করতে চায়নি জানার পর থেকে মেয়ের উপর ভীষণ রেগে আছেন। তাই সে যতদিন ঘরে শয্যাশায়ী ছিল, একদিনও তার কাছে যায়নি। এমন কি কারো কাছে তার ভালো-মন্দ জিজ্ঞেসও করেন নি। মেয়ের অবস্থার অবনতি জেনে সবাই হাসপাতালে গেলেও তিনি যাননি। কিছুক্ষণ আগে স্ত্রীও ছোট ছেলে এসে ডাক্তারের কথা বলে নিয়ে যেতে চাইলেও যাননি। এখন আসমা ও দাইহানকে উঠোন পার হয়ে আসতে দেখে ভাবলেন, মেয়েটা বুঝি শেষ পর্যন্ত মরেই গেল। নিজের অজান্তে চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। হাজার হোক বাবা তো। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেললেন। আসমা সালাম দিতে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিয়ে বললেন, কেন এসেছ?

আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সই-এর অবস্থা খুব খারাপ।

আব্দুল মতিন গর্জন করে উঠলেন, যে মেয়ের আত্মমর্যাদাবোধ নেই, যে মেয়ে বংশের মান-সম্মান ডুবিয়ে দিতে চায়, সে মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তুমি চলে যাও, আমি যাব না।

আব্দুল মতিনের দু’পা জড়িয়ে ধরে আসমা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, তাহলে আপনি কেন আমার আব্বার মান-সম্মান ডুবিয়ে দিয়ে একটা কামলার ছেলে কামলা, যে নাকি আমাদের কামলা ছিল, তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন? আমি আপনার মেয়ের সই, আমাকে বাঁচাতে পারলেন অথচ নিজের মেয়েকে পারছেন না কেন? সন্তানের চেয়ে আপনার আত্মমর্যাদা ও বংশের মান-সম্মান বড় হল?

আব্দুল মতিন রাগের সঙ্গেই বললেন, শুধু মান-সম্মান ও বংশ মর্যাদাই নয়, এমন আরো একটা কারণ আছে, যা তুমি জানলে তার জন্য সুপারিশ করতে আসতে না।

আসমা বলল, কারণটা আমি জানতে চাই।

সে একটা চরিত্রহীন লম্পট ছেলে। জেনেশুনে তাকে জামাই করতে পারি না।

এবার আসমা রেগে উঠে বলল, হোসেন ভাইকে আপনি কতটা চেনেন জানি না। আমরা তো জানি, তার মতো চরিত্রবান ছেলে এ যুগে বিরল।

আব্দুল মতিন বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তোমরা তার বর্তমান দেখেছ, অতীতটা দেখনি।

চাচার কথা শুনে আসমা অনুমান করে বলল, আপনি কী সেই ছেলেবেলার ঘটনার জন্য তাকে চরিত্রহীন বলছেন? তাই যদি হয়, বলব, আপনি বিরাট ভুল করছেন।

আব্দুল মতিন কুচকে বললেন, তুমি কী বলতে চাচ্ছ?

আসমা বলল, তখন যা ঘটেছিল সেটা যে অন্যায়, তা বোঝার মতো বয়স তাদের কারই হয়নি। তবু হোসেন ভাই শাস্তি পেয়েছিল। আমি যতটুকু জানি, ঐ শাস্তির কারণেই সেই সময় হোসেন ভাই রুকসানাকে বিয়ে করার প্রতিজ্ঞা করে তার উপযুক্ত হওয়ার জন্য পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে আসমা আবার বলল, সে যদি চরিত্রহীন হত, তাহলে ঢাকায় কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক কিছু করতে পারত। তাছাড়াও আমেরিকায় দীর্ঘ দশ বছর চাকরি করে প্রচুর টাকা রোজগার করেছে। সেখানেও ফুর্তি-আমোদ করে টাকা নষ্ট করে ফেলতে পারত। অথবা বিয়ে করে সেখানে থেকে যেতেও পারত। কিন্তু সেসব কিছু না করে রুকসানার উপযুক্ত হয়ে তারই জন্য গ্রামে ফিরে এসেছে। তারপরও আপনাদের মান সম্মান ও বংশ গৌরবের কথা চিন্তা করে আত্মগোপন করেছিল। এমন কি সই-এর কাছেও। ষাড়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় উভয়কে চিনতে পারে এবং একে অপরের মনের কথা জানতে পারে। তবু তারা দুজনে আপনার কথা চিন্তা করে ধৈর্য ধরে ছিল। সুরাইয়া ভাবি ও আপনার মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল, সেসব শুনেই সই এর এই পরিনতি। এই পর্যন্ত বলে আসমা চাচার চোখের দিকে চেয়ে বলল, সই তো আপনারই মেয়ে। সে একটা চরিত্রহীন ছেলেকে ভালবেসে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে, একথা ভাবলেন কী করে?

আসমার কথা শুনে আব্দুল মতিনের ভুল ভাঙ্গল। কিন্তু তা স্বীকার করতে না পেরে চুপ করে রইলেন।

আসমা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ডাক্তার যে কথা বলেছেন, তা বলে বলল, এরপরও যদি আপনি হাসপাতালে গিয়ে সইকে বাঁচাতে না চান, তাহলে আপনার সামনেই মাথা ঠুকে জান দিয়ে দেব। এই কথা বলে মেঝেয় মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলল, আমি আত্মঘাতী হব জেনে আমাকে রক্ষা করেছিলেন। এখন সইকে বাঁচাবার জন্য আপনার সামনেই আত্মঘাতী হব। দেখব, আপনার ভুল ধারণাটাই বড়, না। আমার ও আমার সই-এর জীবন বড়? বারবার পাকা মেঝেয় মাথা ঠুকার ফলে আসমার কপাল কেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।

তাকে মাথা ঠুকতে ও তার রক্তাক্ত মুখ দেখে আব্দুল মতিন স্থির থাকতে পারলেন না। এক হাতে মাথা ধরে কোলে টেনে নিয়ে ভিজে গলায় বললেন, তুমি আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছ মা। আমি তোমার সব কথা মেনে নিচ্ছি। আমাকে রুকসানার কাছে নিয়ে চল।

আসমা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে করতে চাচার কোলে মুখ গুঁজে কিছুক্ষণ কাদল। তারপর বাথরুম থেকে রক্তধুয়ে এসে বলল, আপনার কাপড়ে রক্ত লেগে গেছে, পাল্টাতে হবে।

আব্দুল মতিন বললেন, লাগুক। তুমি করিমনকে ডেকে নিয়ে এস।

করিমন অল্প দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। শুনতে পেয়ে এগিয়ে এল।

তাকে দেখে আব্দুল মতিন বললেন, সামসুকে একটা স্কুটার ডেকে নিয়ে আসতে বল।

আসমা বলল, আমরা স্কুটার নিয়ে এসেছি। তারপর করিমনকে বলল, ইব্রাহিমের আব্বা নিচে বসে আছেন, তাকে ডেকে নিয়ে এস। চাচাকে ধরে নিয়ে যাবে।

.

হোসেন মালেকা ও তার মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে বারান্দায় পাঁচ ছয়জন মেয়ে-পুরুষকে নীরবে কাঁদতে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে এসে আব্দুর রসিদকে চিনতে পেরে সালাম দিল।

আব্দুর রশিদ ও হোসেনকে চিনতে পারল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আসমা আপা কী আব্বাকে আনতে গেছে?

হ্যাঁ বলে হোসেন জিজ্ঞেস করল, রুকসানা কেমন আছে?

আব্দুর রশিদ বলল, ভালো না। ডাক্তার আমাদেরকে বার করে দিয়েছে। সূরাইয়া ও আম্মা আছেন। তারপর খালেক ও বোরখা পরা মালেকা ও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ইনারা?

হোসেন বলল, ঢাকা থেকে এসেছেন। ইনাদের কাছে থেকে আমি মানুষ হয়েছি।

আব্দুর রশিদ খালেকের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, আপনারা এখানেই থাকুন। ডাক্তার কাউকেই ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না। তারপর হোসেনকে বলল, আসুন। আমার সঙ্গে। যেতে যেতে বলল, বড় আপাকে কেবিনে রাখা হয়েছে। মেয়েরা কান্নাকাটি করছিল, তাই ডাক্তার বার করে দিয়েছেন।

ডাক্তার রুকসানাকে ইঞ্জেকসান দিয়ে অবজার্ভ করছিলেন। আব্দুর রশিদ ও ইকবালকে ঢুকতে দেখে বিরক্ত প্রকাশ করে হাত দিয়ে ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বললেন।

আব্দুর রশিদ কাছে এসে হোসেনকে দেখিয়ে বলল, আপনি যাকে নিয়ে আসতে বলেছিলেন, উনি সেই।

ডাক্তার এগিয়ে এলে ইকবাল সালাম দিল।

ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন। আপনি এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। পেসেন্টের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আপনার নাম বার বার বলছিলেন। আর খুব অস্থিরতা অনুভব করছিলেন। তাই কিছুক্ষণ আগে ইঞ্জেকশান দিয়েছি। ঘণ্টা খানেক ঘুমাবেন। তবে তার আগেও ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। আপনি এখানেই থাকুন, কোথাও যাবেন না। ঘুম ভাঙ্গার পর আপনাকে দেখে পেসেন্টের অবস্থা ভালো-মন্দ দুটোই হতে পারে। আশা করি, ভালই হবে। আর যদি মন্দ কিছুর লক্ষণ দেখা যায়, আমাকে খবর দেবেন। তারপর আজিজা বেগম ও সুরাইয়াকে দেখিয়ে আব্দুর রশিদকে বললেন, ইনাদেরকে নিয়ে আপনি বাইরে থাকুন। কথা শেষ করে নার্সকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

আজিজা বেগম হোসেনকে চিনতে না পারলেও ছেলের কথা শুনে বুঝতে পারলেন এই সেই ইকবাল।

ডাক্তার বেরিয়ে যাওয়ার পর আব্দুর রশিদ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়াল।

অন্যরা দেখতে পেয়ে তাদের কাছে এল।

সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর রুকসানার দিকে তাকিয়ে হোসেন চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। মুখটা ছাড়া সারা শরীর চাঁদরে ঢাকা। তবু তার মনে হল শরীরে এতটুকু মাংস নেই। হাড়ের সঙ্গে শুধু চামড়া লেগে রয়েছে। পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছে সংযত হওয়ার চেষ্টা করল।

ঠিক আধ ঘণ্টা পর রুকসানা একটু নড়ে উঠে চোখ মেলে তাকাল। হোসেনকে দেখে চমকে উঠে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চারপাশে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। অল্পক্ষণ পর আবার চোখ মেলে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল; কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বার হল না। দু’চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। আর সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

হোসেন বুঝতে পারল, রুকসানা তাকে দেখে এত খুশী হয়েছে যে, কথা বলতে পারছে না। বলল, বিশ্বাস কর রুকসানা, তোমার অবস্থা যে এ রকম হয়েছে তা জানতাম না। এই কথা বলার পর তাকে আরো বেশি কাঁপতে দেখে বিপদ হতে পারে ভেবে ডাক্তারকে খবর জানাবার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।

সবেমাত্র আব্দুল মতিন আসমা ও দাইহানের সঙ্গে এসে আব্দুর রশিদকে। রুকসানার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। হোসেন স্যারকে দেখে সকলের সঙ্গে তিনিও তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

হোসেন আব্দুল মতিনের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে আব্দুর রশিদকে বলল, শিগগির ডাক্তার নিয়ে আসুন, রুকসানা কেমন করছে। তারপর রুকসানার কাছে ফিরে এল।

আব্দুর রশিদ তাড়াতাড়ি করে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য চলে গেল। আর ওরা সবাই ঢুকে রুকসানার বেডের কাছে এসে দাঁড়াল।

রুকসানা তখনও হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সবাই আসার পর তাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘন ঘন মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগল। আর খুব জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।

হোসেন বলল, তুমি এরকম করছ কেন রুকসানা? প্লিজ, শান্ত হও। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমার কাছে থাকব। দেখ না, আসমা ও দাইহান ভাই তোমার আব্বাকে নিয়ে এসেছে। বাড়ির অন্যান্য সকলে ও আমি ঢাকায় যাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেছি, তারাও এসেছেন।

হোসেনের কথা শুনে রুকসানা আর একবার সকলের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে শান্ত হল। সেই সাথে তার কপালে ঘাম দেখা দিল।

হোসেন হাদিসে পড়েছে, “মুমীন বান্দা-বান্দীর মউতের সময় কপালে ঘাম দেয়। সেই সময় কাছে যে থাকবে সে কালেমা তৈয়েব ও কালেমা শাহাদাৎ শব্দ করে পড়বে। ভুলেও মুমূর্ষ ব্যক্তিকে কলেমা পড়ার জন্য তাগিদ দেবে না।” রুকসানার কপালে ঘাম দেখে হোসেনের হাদিসটা মনে পড়ল। রুমাল বার করে ঘাম মুছতে যাবে এমন সময় মালেকা এগিয়ে এসে বলল, আপনি সরে আসুন, যা করার আমি করছি।

এই কয়েকদিনে মালেকা যা অনুমান করেছে, এখানে এসে সবকিছু দেখেশুনে তা নিশ্চিত হয়েছে। সেও ঐ হাদিস জানে। আরো জানে স্যার যা করতে যাচ্ছেন, গায়ের মোহাররম লোক হিসাবে তা করা উচিত নয়। তাই তাকে সরে যেতে বলল।

মালেকার কথা শুনে হোসেনেরও কথাটা খেয়াল হল। রুমালটা তার হাতে দিয়ে সরে দাঁড়াল।

মালেকা রুমাল দিয়ে রুকসানার ঘাম মুছে দেওয়ার সময় শব্দ করে কলেমা তৈয়েব ও কালেমা শাহাদাৎ পড়তে লাগল। তারপর চামচে পানি নিয়ে তার মুখে দিতে গেল।

ঠোঁটে চামচ ঠেকতে রুকসানা মালেকার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে দু’তিন চামচ পানি খেল। তারপর ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করার সময় মাথাটা একপাশে কাৎ হয়ে গেল।

রুকসানা মারা গেছে বুঝতে পেরে মালেকা ভিজে গলায় “ইন্নালিল্লাহে—– রাজেউন” পড়ে বলল, উনি ইন্তেকাল করেছেন।

হোসেন কিছুক্ষণ রুকসানার নাড়ী ধরে পরীক্ষা করল। তারপর নিশ্চিত হয়ে ইন্নালিল্লাহে— রাজেউন পড়ে যখন গায়ের চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিচ্ছিল তখন তার চোখের পানি টপ টপ করে রুকসানার বুকের উপর পড়তে লাগল।

অন্য সবাই বুঝে উঠার আগেই আব্দুর রশিদের সঙ্গে ডাক্তার এসে ভীড় দেখে রাগের সঙ্গে বললেন, নিষেধ করা সত্ত্বেও আপনারা এসেছেন? যান শিগগির বেরিয়ে যান। আব্দুল মতিনকে দেখতে পেয়ে বললেন, ঠিক আছে, আপনি থাকুন। তারপর বেডের কাছে এগিয়ে এলে হোসেন বলল, পরীক্ষা করার দরকার নেই, সী ইজ ডেড।

ডাক্তার তার কথায় কান না দিয়ে চাদর সরাবার জন্য হাত বাড়ালেন।

হোসেন হাতটা ধরে ফেলে বলল, প্লিজ ডক্টর, ডোন্ট টাচ দা ডেডবডি।

ডাক্তার রেগে উঠে বললেন, হাত ছাড়ন, আমাকে আমার কর্তব্য করতে দিন।

হোসেন এবার তার দুটো হাত ধরে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, বিলীভ মী, আই এম অলসো এ ডক্টর। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছল।

হোসেনের কথা শুনে ও তার চোখে পানি দেখে ডাক্তারের রাগ পড়ে গেল। বললেন, এক্সট্রমলি সরি। প্লিজ, এক্সকিউজ মী।

একটা অনুরোধ করব রাখতেই হবে।

বলুন, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।

পোষ্টমর্টম না করে ডেডবডি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।

তা কি করে সম্ভব? ডাক্তার হিসাবে আপনিও তো হাসপাতালের নিয়ম কানুন জানেন।

জানি। আর এটাও জানি, ক্ষেত্র বিশেষে সব আইনের ব্যতিক্রম আছে। আমার মতে এরকম ক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের পোস্টমটম না করে লাশ দিয়ে দেওয়াই উচিত। শুধু শুধু মেয়েদের লাশের বেইজ্জতী করা ঠিক নয়।

আপনার সঙ্গে আমিও একমত। ঠিক আছে, আমি সেই ব্যবস্থা করছি। আপনি একটু পরে আমার রুমে আসুন। কথা শেষ করে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।

কেবিনে ঢোকার পর থেকে হোসেনের ও মালেকার কাজ-কর্ম ও কথা-বার্তা শুনে সবাই এত অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে, তারা যেন এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সকলের হুশ হল। মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আসমা রুকসানার লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সই, তুই আমাকে মাফ করে দে, আমি তোর জন্যে কিছুই করতে পারলাম না।

হোসেন দাইহানকে বলল, ওকে সরিয়ে নাও। তারপর আসমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কী হাদিসে পড়নি? আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “উচ্চস্বরে যাহার জন্য বিলাপ করা হয়, বিচার দিবসে তাহার দ্বারা তাহাকে শাস্তি দেওয়া হউবে।” [বর্ণনায় : হযরত মুগীরাহ বিন শোবাহ (রাঃ) বুখারী মুসলিম]

তিন ভাই আব্বাকে ধরে কাঁদছিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, বড় আপা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেল আব্বা। তারপর আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আব্দুল মতিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমাদের বড় আপা তোমাদেরকে ছেড়ে যায়নি, আমিই তাকে থাকতে দিলাম না। তোমরা আমাকে মাফ করে দাও। তারপর মেয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহ আমাকে মাফ করবে কিনা জানি না, তুই আমাকে মাফ করে দে মা। এই কথা বলে ছেলেদের গায়ের উপর এলিয়ে পড়লেন।

আব্দুর রশিদ আব্বা আব্বা বলে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে অন্য দু’ভাইকে বলল, আব্বা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারপর ধরাধরি করে অন্য বেডে শুইয়ে দিল।হোসেন এগিয়ে এসে নাড়ি ধরে বলল, হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আপনাদের কেউ একজন গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসুন।

<

Super User