হা। তারপর থামিয়ে দেব। সারপ্রাইজড?

খুবই, স্বীকার করল রানা, মনে পড়ল ইয়াঙ্গুন শেরাটনের ডাইনিং রুমে এই শব্দটা কীভাবে উচ্চারণ করেছিল সে। তোমার জন্যে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম আমি।

কেন? এখনও ভুল ভাঙেনি তোমার?

সে তো কবেই ভেঙে গেছে।

তা হলে?

তোমাকে জ্যান্ত ধরতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমিই ধরলাম তোমাকে। যাই হোক, একথা বলতে পারবে না যে কটা রাত তুমি উপভোগ করোনি।

শুধু উপভোগ বললে সম্পর্কটার প্রতি অবিচার করা হয়, বলল রানা; তাকিয়ে আছে স্থির ম্যাগনাম, ঠোঁটের চারপাশে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ভাব আর হিমবাহের মত ঠাণ্ডা চোখ দুটোর দিকে। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, আমার সব সময় মনে হয়েছে, চোখগুলোয়। কোনও গোলমাল আছে।

গোলমাল?

মাথা ঝাঁকাল রানা। অগভীর। একটু বেশি ঠাণ্ডা। একটু বেশি কঠিন। সামান্য থেমে আবার বলল ও, প্রতিবেশী বাঙালী মেয়েটির চেয়ে একটু যেন বেশি স্বাধীনচেতাও। আসলে তুমি আমেরিকান, তাই না?

মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী। সেকেন্ড জেনারেশন আমেরিকান। বেইজিং দূতাবাসের কালচারাল সেকশনে যোগ দিচ্ছি আগামী মাসে। তবে আমার ভারতীয় বাঙালী পরিচয়টাও মিথ্যে নয়।

তোমাদের দূতাবাস আমার সম্পর্কে কখন জানল?

খবরটা আসে ঢাকা থেকে। আমাদেরকে জানানো হয় চিন থেকে একটা ফ্লাইট ধরে জিয়া ইন্টারন্যাশন্যালে ল্যান্ড করেছ। তুমি। দূতাবাস থেকে নির্দেশ পাঠানো হয়, তোমার ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখতে হবে। বাকিটা পানির মত সহজ।

শ্রীলঙ্কা থেকে হংকঙে এলাম আমি, আর আমার ওপর নজর রাখার জন্য তোমাকেও হংকঙে পাঠানো হলো?

মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী। ভালো কথা, রানা, আমি কিন্তু সত্যি আর্কিওলজি নিয়েই পড়াশোনা করেছি।

আমারও একটা ভালো কথা আছে, বলল রানা, পিছিয়ে টেরেসে ফিরে এসে রোদের মধ্যে দাঁড়াল, তারপর ইঙ্গিতে পিছন দিকটা দেখাল। তোমার পার্টনার লবুয়াং লোবু উড়তে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, তার ডানা ছিল না।

আমি জানি, দেখেছি। ওর মত বহু খুঁটি দুনিয়ার সব জায়গায় ছড়িয়ে রেখেছে আমেরিকান এনএসআই-ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি। লোবু মরেছে, তার জায়গায় আরেকজন আসবে…

মরেছে আরও একজন…

হ্যাঁ, তা-ও জানি, বলল নন্দিনী। জো টাইসন। সিআইএ। মিউজিয়ামে গার্ডদের গুলি খায়, মারা যায় হোটেলে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টেরেসে ঢুকল সে। এ-সব কথা থাক, রানা। আমি। শুধু ফিল্মটা চাই।

কেন তুমি ভাবছ ওটা আমার কাছে আছে?

মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে হেসে উঠল নন্দিনী। তার এই হাসিটা আগে কখনও শোনেনি রানা। আওয়াজটা যেন একেবারে নন্দিনীর গভীর থেকে উঠে এল, যার সঙ্গে ওর পরিচয় নেই, যেখানে যায়নি ও, যেটা দেখেনি আগে। হাসিটা চোখের মতই। ঠাণ্ডা। পরিচয় হবার পর এই প্রথম নিজের মুখোশ খুলল মেয়েটা।

হাতদুটো ওপরে তোলো, রানা, বলল নন্দিনী, মেজাজ খারাপ করছে। হাত দুটো মাথার দুপাশে তুলল রানা। গুড। এবার তোমার পিস্তলটা তুলে নেবে তুমি-দুআঙুলে ধরে। দুআঙুলে, রানা। তিন বা চার আঙুলে নয়, ঠিক আছে? দুটোর বেশি আঙুল যদি ব্যবহার করতে দেখি, ট্রিগার টেনে দেব আমি। এই কাজ, মানে মানুষ খুন, এর আগেও অনেকগুলোই করেছি আমি-কাজেই ঝুঁকি নিতে চাইলে ভুল করবে। সব পরিষ্কার?

পরিষ্কার। নন্দিনীর কথামতই সব করল রানা। পিস্তলটা। হোলস্টার থেকে বের করে এনে ছেড়ে দিল। মেঝেতে পড়ে আওয়াজ করল ওটা। তারপর আবার মাথার উপর হাত তুলল ও। মনে মনে প্রার্থনা করছে শার্টের ভিতর, বাহুর সঙ্গে ট্র্যাপের সঙ্গে আটকানো ছুরিটার অস্তিত্ব নন্দিনী যেন টের পেয়ে না যায়।

এবার, রানা, মাইক্রোফিল্মটা দাও, বলল নন্দিনী। ওটা। তোমার সুটকেসে নেই-নেই এমনকী ওটার ফলস বটমেও।

ছি-ছি, তুমি ওখানেও সার্চ করেছ?

করব না? অসহিষ্ণু দেখাচ্ছে নন্দিনীকে। আমাকে তুমি কী মনে করো, গাধী?

না-না, ওটা তুমি নও, তার চেয়ে ভালো। জবাব দিল রানা। জানি, ফিল্মটা তোমাকে না দিয়ে আমার কোন উপায় নেই। তবে অন্তত দুচারটে প্রশ্নের জবাব পেলে কৌতূহল খানিকটা মিটত।

কী জানতে চাও? হাসছে নন্দিনী। ফেরিতে মিন ভাইদের ম্যানেজারকে কে খুন করল?

হ্যাঁ।

ও আমাকে চিনে ফেলে, আমার পরিচয় জেনে ফেলে, বলল নন্দিনী। তাকে খুন না করে আমার কোনও উপায় ছিল না-তোমাকে ও আমার কথা বলে দিচ্ছিল আর একটু হলে।

তুমি সেদিন ইয়াঙ্গুনের মিউজিয়ামেও ছিলে, তাই না?

আমি পৌঁছে শুনি অ্যালার্ম বাজছে। দুঃখিত, রানা। আমি তোমার আর কোন প্রশ্নের জবাব দেব না। ফিল্মটা!

ও, হ্যাঁ। দিতেই যখন হবে, কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ওটা আমি জুতোর ভেতর লুকিয়ে রেখেছি। গোড়ালিটা আসলে ফাঁপা। ঝুঁকে একটা জুতোর দিকে হাত বাড়াল। ছুঁড়ে মারার জন্য এখানে বালি নেই, কাজেই পা থেকে খোলা জুতোটা হাতে নিয়ে সিধে হতে হলো ওকে।

ছেড়ে দাও, নির্দেশ দিল নন্দিনী।

ছাড়ল রানা।

এবার পা দিয়ে ঠেলে দাও আমার দিকে।

মাই প্লেজার, বলল রানা। একটা পা সামনে ঠেলে দিল। তবে নন্দিনী যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে নয়।

পা উঁচু করল রানা, হাঁটু উঠে এল বুকের অনেকটা কাছে। সময় নিল একবার নিঃশ্বাস ফেলতে যতটুকু লাগে। এক সঙ্গে দশটা আঙুল মটকালে যে শব্দ হবে, সেরকম একটা আওয়াজ শোনা গেল; সামনের দিকে সোজা একটা লাথি ছুঁড়েছে রানা। তবে লাগাতে পারল না।

আঘাতটা আসছে দেখে কেউটের মত ক্ষিপ্র বেগে সরে গেল নন্দিনী, একই সঙ্গে ট্রিগার টেনে দিল। রানার মাথাকে পাশ কাটাল বুলেট। আরেকটা লাথি চালাল ও, সেটা নন্দিনী ঠেকিয়ে। দিল ভাজ করা বা হাত সামনে ঠেলে দিয়ে।

তার মানে কারাতে জানে মেয়েটা, ভাবল রানা। তবে তার মার্শাল আর্ট ট্রেনিং নিয়ে চিন্তিত নয় ও। সুযোগ পেয়ে আবার ম্যাগনামের ট্রিগার টেনে না দেয় মেয়েটা, সেটাই ভয়। দিল।

বিদ্যুদ্বেগে সরে গেল রানা। কিন্তু গুলি হলো না। জ্যাম হয়ে গেছে মেকানিজম, বুলেট বেরুল না পিস্তল থেকে।

সন্দেহ নেই, এর জন্য দায়ী রানার ওয়ালথারটা। মিনিট দশেক আগে ম্যাগনামের ব্যারেলে একটা কামড় দিয়েছিল।

চমকে উঠে হাতের অস্ত্রটা একবার দেখল নন্দিনী, তারপর। পিছু হটতে শুরু করল, ট্রিগারটা বারবার টানছে আর ছাড়ছে। জ্যাম ছুটে গিয়ে যে-কোন মুহূর্তে বুলেট বেরিয়ে আসতে পারে।

ঝুঁকে ওয়ালথারটা তুলল রানা। লক্ষ্যস্থির করে মাত্র একবার ট্রিগার টানল।

ছিটকে রেইলিঙে গিয়ে পড়ল নন্দিনী। ধীরেসুস্থে ডিগবাজি খেল, তারপর লবুয়াং লোবুর পথ অনুসরণ করল।

***

<

Super User