মায়ানমারে আজ রানার দ্বিতীয় দিন।

মড়ার মত ঘুমাচ্ছিল ও, ঘন ঘন নক হওয়ায় ভেঙে গেল সেটা।

সম্ভব? আমি নন্দিনী! করিডর থেকে চিল্কার করছে মেয়েটা। তোমার ঘুম ভেঙেছে?

এক সেকেন্ড, বিড়বিড় করল রানা। চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বিছানা থেকে নামল। নাগালের মধ্যে যা পেল তাই পরে সিটিং রুমে এসে দরজা খুলছে।

সত্যি দুঃখিত, বলল নন্দিনী, রানাকে শুধু একজোড়া শর্টস। পরে থাকতে দেখে এতটুকু বিব্রত নয়। আমি ঠিক তোমার ঘুম ভাঙাতে চাইনি।

তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল রানা। না, ঠিক আছে, ঘুম জড়ানো গলায় বলল ও। কমিনিট সময় দাও, মাথাটা ভার হয়ে আছে।

হ্যাঙওভার? জিজ্ঞেস করল নন্দিনী। কিন্তু তুমি কি কাল রাতে খুব বেশি ড্রিঙ্ক করেছিলে? বাথরুমের দরজা পর্যন্ত রানাকে অনুসরণ করছে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

হ্যাঁ, একটু বেশিই হয়ে গেছে, মিথ্যে বলল রানা। ভাগ্যই বলতে হবে যে জানতে চাইছে না রাত দুপুরে তার কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল কেন। কথাটা রাখতে পারল, নিজেকে পুরোপুরি সচেতন করে তুলতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিল না ও। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল বেডরুমের একটা চেয়ারে বসেছে নন্দিনী, তার রূপের আলোয় ঝলমল করছে কামরাটা।

পোর্টাররা কি বলাবলি করছে শুনবে? শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না! বলল নন্দিনী, রানাকে কাপড় পরতে দেখছে।

কী?

ন্যাশনাল মিউজিয়ামে ডাকাত ঢুকেছিল।

তুমি সিরিয়াস?

তাই তো শুনলাম। তুমি তো কাল প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলে, তাই না?

মাথা ঝাঁকাল রানা, যতটা সম্ভব কম কথা বলতে চায়।

আমিও তাই ভেবেছি, ক্ষোভ মেশানো সুরে বলল নন্দিনী। মানে প্রদর্শনী দেখলে, কিউরেটরের সঙ্গে ডিনার খেলে। শুধু হতাশ নই, সম্ভব, মনে হচ্ছে আমাকে যেন ঠকানো হয়েছে।

তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না, বলল রানা, শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে।

শোনো, ইয়াঙ্গুনে আমার আসার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল হান সাম্রাজ্যের ওই প্রদর্শনীটা দেখা।

কে তোমাকে দেখতে বারণ করেছে? আয়নার দিকে পিছন ফিরে নন্দিনীর সামনে দাঁড়াল রানা, কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।

কে আমাকে দেখতে বারণ করেছে? রানার প্রশ্নটাই পুনরাবৃত্তি করল নন্দিনী। আমার সন্দেহ হচ্ছে, এখনও তুমি ঘুমিয়ে আছ। কিংবা আমি হয়তো কথাটা বলিনি।

বলোনি…কী? প্রায় একই নিঃশ্বাসের সঙ্গে আরও একটা প্রশ্ন করল রানা, যেন ব্যাপারটায় ওর তেমন আগ্রহ নেই, খিদে। পেয়েছে?

ভীষণ। চেয়ার ছেড়ে সিধে হলো নন্দিনী। দুঃখের বিষয়টা হচ্ছে, প্রদর্শনী বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিনারা। সমস্ত কিছু। বেইজিঙে ফেরত যাচ্ছে।

সত্যি? কেন? জিজ্ঞেস করল রানা, চেষ্টা করল উদ্বেগ আর উত্তেজনা চেপে রাখতে।

সম্ভব, তুমি কি সত্যি ঘুমাচ্ছ?

মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল রানা।

কেন আবার, ব্যাখ্যা করল নন্দিনী, ডাকাত পড়েছিল, তাই।

খারাপ কথা, বলল রানা, ভাব দেখাল সামান্য একটু হতাশ হয়েছে। তবে ঘুম ঘুম আধবোজা চোখের পিছনে সজাগ ও। সত্যি যদি আর্টিফ্যাক্টগুলো চিনে ফেরত নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, যা করার দ্রুত করতে হবে ওকে।

নন্দিনীকে নিয়ে স্যুইট থেকে বেরুল রানা, দরজায় তালা দিল, এলিভেটরে চড়ে নেমে এল নীচের রেস্তোরায়।

ব্রেকফাস্ট শুরু করে নন্দিনী জানাল, কাল ইয়াঙ্গুন ত্যাগ করছে সে। এবার আমাকে পেগানে গিয়ে কাজে হাত দিতে হয়, বলল সে, চামচ দিয়ে প্লেটের মার্মালেড নাড়াচাড়া করছে। তারপর। মুখ তুলে সরাসরি রানার চোখে তাকাল। কটা দিন আমার সঙ্গে বেড়াতে পারো না, সম্ভব? তোমার কী…আমার সান্নিধ্য তোমার ভালো লাগবে?

এ কী কথা বলছ! অবশ্যই তোমার সান্নিধ্য ভালো লাগবে। আসলে, বিলিভ মি, আমি নন্দিনী ফিভারে আক্রান্ত। তবে…

তবে?

তবে, মুশকিল হলো…

মুশকিল? যেন বোমার মত বিস্ফোরিত হতে না পেরে ফুলছে। মেয়েটা।

মুশকিল হলো, আবার বলল রানা, সত্যি আমার হাতে সময় নেই এবার। পরে…

ওহ্! স্টপ ইট! ক্লান্ত আর পরিত্যক্ত লাগছে নন্দিনীকে।

অনেস্ট টু গড। যদি সময় করতে পারতাম আমার চেয়ে খুশি বা ভাগ্যবান কেউ হত না।

যাক, নিজেকে অন্তত বলতে পারব যে চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। আসলে মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে এখনও আমি নাবালিকাই রয়ে গেছি।

তুমি শুধু শুধু অভিমান করছ। হাতছানি দিয়ে ওয়েটারকে ডাকল রানা, চেক সই করে বিল মেটাল, তারপর চেয়ার ছাড়ল। খেয়েই এভাবে দৌড়াতে পছন্দ করি না, নন্দিনী, কিন্তু…

না, ঠিক আছে; যাও তুমি, কাজ করো। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকাল নন্দিনী, মৃদু শব্দ করে একটু হাসল, তারপর নিজের প্লেটের দিকে চোখ নামাল।

তা হলে পরে দেখা হবে। হ্যাভ আ গুড ডে, বলে রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে এল রানা। নন্দিনীর জন্য দুঃখ হচ্ছে ওর। দুঃখ নিজের জন্যও কম হচ্ছে না। সময় না থাকায় এভাবে বঞ্চিত হতে কারই বা ভালো লাগে।

.

হ্যালো, মিস্টার থাইগন লোবাং? আমি কুমার সম্ভব বলছি। এইমাত্র শুনলাম…হ্যাঁ, কী একটা জঘন্য কাজ। আশা করি কিছু চুরি যায়নি।

জঘন্য! কিউরেটর ভদ্রলোক রানার কথাই পুনরাবৃত্তি। করছেন। অতি জঘন্য! কারও কল্পনাতেও ছিল না ইয়াঙ্গুনে এধরনের কিছু ঘটতে পারে। সবচেয়ে খারাপ কী হলো, জানেন? চিনারা ব্যাপারটাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছে।

শুনলাম ওরা নাকি প্রদর্শনী বন্ধ করে দিতে চাইছে, বলল। রানা, কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি।

ঠিকই শুনেছেন, লোবাং বললেন। চাইছে মানে কী, বন্ধ। করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে প্রদর্শনীর আর্টিফ্যাক্ট বাক্সে ভরার কাজ সুপারভাইজ করছেন ওদের কালচারাল অ্যাটাশে।

ও।

ভাগ্য ভালো যে কোন কিছু চুরি যায়নি, তবে একটা বাক্সের কিছু ক্ষতি হয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, চোরেরা জেড ফিউনেরারি আর্মারটার জন্য এসেছিল…

যেটা রাজকুমারী তো ওয়ানের জন্য তৈরি করা হয়?

 হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, ওটার কথাই বলছি আমি। ভাবা যায় না! ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কিউরেটর, কল্পনার চোখে রানা দেখল বাষ্প লেগে ঝাপসা হয়ে এল তাঁর চশমার কাচ। সারা রাত জেগে বসে ছিলাম আমি। গার্ডরা কেউ বলছে, লোক এসেছিল তিনজন। আবার কেউ বলছে চারজন।

চারজন? জিজ্ঞেস না করে পারল না রানা।

হ্যাঁ। সন্দেহ নেই ডাকাতদের একটা গ্যাঙ।

তা হলে মিস্টার এক্স এখনও পিছনে লেগে আছে, ভাবল রানা। অজ্ঞাতপরিচয় এবং রহস্যময় তৃতীয় পক্ষকে যদিও এখন পর্যন্ত দেখেনি ও, তবে সে নিশ্চয়ই দেখেছে ওকে। কেউ হতাহত হয়নি তো? রানা আসলে জানতে চায় বিআইবি এজেন্ট সাদা কোটের কী পরিণতি হয়েছে।

হতাহত হয়নি মানে? রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কিউরেটর ভদ্রলোক। বুঝতে পারছি, সমস্ত বিবরণ আপনি পাননি। দরকার নেই, বিকেলের কাগজে সব দেখতে পাবেন।

বিকেলের কাগজে কেন?

সরকারের কিছু বিধিনিষেধ আছে, মিস্টার সম্ভব, ফলে কী ছাপা যাবে না যাবে তা তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে জেনে নিতে হয়। তারমানে মায়ানমারে সেন্সরশিপ চালু আছে, প্রেস-এর স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।

ও, আচ্ছা, তা হলে হতাহতের ঘটনা…

হ্যাঁ, ঘটেছে। আমাদের গার্ড গুলি করে মেরে ফেলেছে। একজনকে। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি। লোকটা বিদেশী, শ্বেতাঙ্গ। একটা হোটেলে আরেকজন শ্বেতাঙ্গের লাশ পাওয়া গেছে। সম্ভবত সে-ও আমাদের গুলিতে মারা গেছে। তবে আমাদের কেউ মারা যায়নি, শুধু দুতিনজন আহত হয়েছে। আর একটা জিপ চুরি হয়েছে।

বলেন কী! জিপ চুরি হয়েছে? কিছুটা স্বস্তি বোধ করছে। রানা-যাক, সিআইএ আর বিআইবি-র অন্তত দুজন এজেন্ট ওকে বিরক্ত করবে না।

হা। তবে পরে সেটা পাওয়াও গেছে ইরাবতী নদীর কাছে।

যাক, তবু ভালো। তবে দুঃখ কি জানেন, ভেবেছিলাম আর্টিফ্যাক্টগুলো আরেকবার দেখব, কিন্তু তা আর হলো না। আপনি নিশ্চিত, মিস্টার লোবাং, সিদ্ধান্তটা ওরা বদলাবে না?

নাহ্, প্রশ্নই ওঠে না। বললাম না, আর্টিফ্যাক্ট সব বাক্সে ভরে ফেলছে ওরা।

তারমানে দুএকদিনের মধ্যেই প্লেনে তুলে বেইজিঙে পাঠিয়ে দেবে।

তাই তো দেবার কথা, কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বেইজিং আর ইয়াঙ্গুনের মাঝখানে মাসে মাত্র দুটো কার্গো প্লেন আসাযাওয়া করে। পরবর্তী প্লেন ছাড়তে এখনও আটদিন বাকি, তাই আর্টিফ্যাক্টগুলো ট্রেনে তুলছে ওরা।

আশ্চর্য তো! ট্রেনে তুলে কীভাবে… থেমে গেল রানা, ওর খেপে ওঠা উচিত হচ্ছে না।

ট্রেনে করে ওগুলো মান্দালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, বললেন থাইগন লোবাং। মান্দালয় সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে, মিস্টার সম্ভব? ইরাবতীর কিনারায় ওটা আমাদের একটা বন্দর নগরী, একসময় বার্মার রাজধানী ছিল।

কিন্তু মান্দালয়ে কী?

মায়ানমারের মান্দালয় আর চিনের কুমিং-এর মধ্যেও কার্গো প্লেন আসা-যাওয়া করে, সেটা ধরার জন্যে কাল সকালে আর্টিফ্যাক্টগুলো ওখানে পাঠানো হচ্ছে।

আপনার এবার খানিক বিশ্রাম নেয়া দরকার, মিস্টার লোবাং, সহানুভূতির সুরে বলল রানা। আপনার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে, খুব টেনশানের মধ্যে আছেন।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। শুধু বোধহয় বিশ্রাম নয়, এবার বোধহয় অবসর নেয়াই উচিত হবে।

.

পরিচ্ছদের নীচে অতি বিশ্বস্ত পুরানো দুই বন্ধু লুকিয়ে আছে, ফোনের যোগাযোগ কেটে দিয়েই নিজের স্যুইট থেকে বেরিয়ে পড়ল রানা।

হোটেলের ভিতরই ব্যাঙ্ক থেকে কিছু ডলার ভাঙিয়ে কিয়াত করল ও। বাইরে বেরিয়ে এসে লাইনে দাঁড়ানো ট্যাক্সি না নিয়ে চড়ে বসল একটা থ্রি-হুইলারে। ড্রাইভারকে বলল, রেল স্টেশন।

মান্দালয়ের উদ্দেশে কাল মাত্র একটাই ট্রেন ছেড়ে যাবে, কাজেই রানা ধরে নিল চিনা আর্টিফ্যাক্টগুলো ওটাতেই থাকবে। ৪৩০ মাইল রেল জার্নিতে সময় লাগবে কমবেশি ছাব্বিশ ঘণ্টা।

জেড ডেথ সুটের কোথাও মাইক্রোফিল্মের রোলটা লুকানো আছে, এটা ধরে নিয়েই কাল ট্রেনটায় চড়তে যাচ্ছে রানা। তোউ ওয়ান-এর আর্মারটা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার সুযোগ চায় ও।

ট্রেনটার শেষ গন্তব্য পর্যন্ত টিকিট কেটে ট্যাক্সি নিল রানা, হোটেলে ফিরছে।

যা করার আর্টিফ্যাক্টগুলো ট্রেনে থাকতেই করতে হবে রানাকে। কারণ মান্দালয়ে পৌঁছানোর পর ওগুলো ওর নাগালের বাইরে চলে যাবে।

থাইগন লোবাং চারজন ডাকাতের কথা বললেন।

চার নম্বর লোকটা তা হলে কে? কালো নকশা চুরি হয়েছে। বেইজিং-এর মার্কিন দূতাবাস থেকে, তাদের কোন স্পাই?

কাল রাতে সেই রহস্যময় ব্যক্তি কি ডেথ সুটটা পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিল? তা যদি পেয়ে থাকে, এতক্ষণে মাইক্রোফিল্মটা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে সে।

তবে না, সে বোধহয় দেরি করে পৌঁছেছিল-সাদা কোট, সাদা। টাই আর রানার পরে। ওদেরকে সে আর্মারটা নিয়ে কাজ করতে দেখেছে বলেও মনে হয় না। তারমানে ধরে নিতে হয় এখনও সে। জানে না মাইক্রোফিল্মটা কোথায় লুকানো আছে।

আর সেজন্যই বাঁচিয়ে রাখা দরকার মাসুদ রানাকে। আসল কথাটা জানে সে, তাই মিন ভাই বা তাদের ম্যানেজারের মত এখনই ওকে মারা যাচ্ছে না-তার আগে পিছু নিয়ে জেনে নিতে। হবে কোথায় আছে মাইক্রোফিল্মটা।

.

আর্কিওলজির ছাত্রী, ভারতীয় বাঙালী, নন্দিনী অপরূপার চোখে। চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল রানা, আরেকটু ওয়াইন?

মাত্র কয়েক ফোটা, বলল মেয়েটা। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো? ডিনার তো ছুঁয়েও দেখছ না।

মন খারাপ, তাই খিদে নেই।

কী যেন বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল নন্দিনী। ওদের ডিনার টেবিলের পরিবেশ বিষন্ন হয়ে উঠল। হঠাৎ পরিচয়, হঠাই। বিচ্ছেদ। ওদের ধর্ম আলাদা, দেশ আলাদা, পেশা আলাদা; আলাদা রুচি, অভ্যাস, নীতিবোধ, আদর্শ আর লক্ষ্যও; তা সত্ত্বেও পরস্পরকে ভালো লাগাটা খুব সত্যি। আবার সত্যি এই বিচ্ছেদটাও। রানা ভাবছে-শেষ পর্যন্ত কোন লাভ নেই, সম্পর্ক। দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব নয়, এ-কথা জানে বলেই বোধহয় নন্দিনী একবারও জানতে চায়নি কী করে ও, কী কাজে মায়ানমারে। এসেছে।

এটা কিন্তু ঠিক নয়, সম্ভব! মুখ তুলে বলল নন্দিনী। কিছু না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বে তুমি।

তোমার ভেতর একজন মা লুকিয়ে আছে, হেসে উঠে বলল রানা। সব মেয়ের মধ্যেই যেমন থাকে আর কী।

হঠাৎ নন্দিনীর চোখ-মুখ অন্যরকম হয়ে উঠল। এই জিনিসটা আমি সবচেয়ে অপছন্দ করি-কারও সঙ্গে তুলনা।

সব সন্তোষজনক তো, সার? হঠাৎ কোত্থেকে ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল রানাকে।

হ্যাঁ, ঠিক আছে সব, জবাব দিল রানা। কফি, নন্দিনী?

চা, বলল নন্দিনী।

লেডি চা খাবেন, আমি কফি।

ইয়েস, সার!

ওয়েটার চলে যাবার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর নন্দিনী জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সিদ্ধান্তটা সত্যি বদলাবে না?

কোন্ সিদ্ধান্ত? পাল্টা প্রশ্ন করল রানা, নন্দিনীর মুখটা খুঁটিয়ে দেখছে। শুধু বোধহয় চোখ দুটো আরও একটু সুন্দর হওয়ার অবকাশ ছিল—এতটা ঠাণ্ডা আর সরু না হলেই যেন ভালো হত। তার বাকি সব কিছু একেবারে নিখুঁত।

সত্যি তুমি আমার সঙ্গে পেগানে যাচ্ছ না? এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করল নন্দিনী।

এই সময় ফিরে এল ওয়েটার।

তার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা, তারপর নিজের কাপে কফি ঢালার সময় বলল, আমি আসলে কাল সকালে মান্দালয়ে যাচ্ছি।

মান্দালয়? আগ্রহে বড় বড় হয়ে উঠল নন্দিনীর চোখ।

মাথা ঝাঁকাল রানা। হ্যাঁ। শুনলাম ট্রেন জার্নিটা নাকি দারুণ রোমাঞ্চকর, ট্রপিক্যাল সিনারিও ভীষণ শ্বাসরুদ্ধকর ইত্যাদি ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকবে, তাই তার সঙ্গে পেগানে যাওয়া সম্ভব নয়, একবার এ-কথা বলার পর এখন বলছে মান্দালয়ে বেড়াতে যাবে, উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, নন্দিনীর কী প্রতিক্রিয়া হয় দেখা।

কিন্তু রানার কথা শুনে নন্দিনীর কোন প্রতিক্রিয়াই হলো না। রানাকে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা দিয়ে সে বলল, ও, আচ্ছা, তা হলে তো ভালোই হলো। তারমানে তুমি কাল সকাল সাড়ে দশটার। ট্রেন ধরছ, তাই না?

হ্যাঁ, কিন্তু…

এর মধ্যে শুধু হ্যাঁ আছে, মশাই, কোন কিন্তু নেই-বুঝলেন? ওই ট্রেনে আমিও যাচ্ছি। চেহারাই বলে দিচ্ছে, এত খুশি জীবনে খুব কমই হয়েছে সে।

তাই? রানা চেষ্টা করছে ওকেও যাতে খুশি দেখায়। তবে মেয়েটা সত্যি বিস্মিত করেছে ওকে। কাউকে ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে পাবে বলে ভাবেনি ও; যদিও এ-ব্যাপারে এখন আর কিছু করারও নেই ওর।

মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী, ছোট্ট প্রাণচঞ্চল বাচ্চার মত ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মান্দালয়ের ট্রেনে উঠলেও, শেষ মাথা পর্যন্ত যাচ্ছি না আমি। অর্ধেকের কিছু বেশি যাব, তারপর নামব। কথার মাঝখানে থেমে টেবিলের কিনারায় আঙুল দিয়ে টোকা। মারল। থাজি…হ্যাঁ, শহরটার নাম থাজি। এখান থেকে কত দূরে। জানো?

আপাতত রানা বোবা। শুধু মাথা নাড়তে পারল।

তিনশো মাইল! বলল নন্দিনী, আনন্দে টগবগ করছে। তিনশো মাইল উত্তরে। স্টেশন থেকে আমাকে ওরা বলল, পনেরো থেকে আঠারো ঘণ্টার জার্নি। কাজেই, সম্ভব, আমরা চুটিয়ে…তুমি জানো।

তোমার মুখ রাঙা হয়ে উঠছে।

সত্যি?

আয়না বের করো।

কাঁধ ঝাঁকাল নন্দিনী। আমি অসহায়, সম্ভব! লালচে রঙটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তার সারা মুখে।

সত্যি মুগ্ধ হবার মত, বিড় বিড় করল রানা। এটা কীসের লক্ষণ জানো? এটা…

নিস্পাপ? সরলতা?একেবারে আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছ। হাসিটা জায়গা মত ধরে রেখে নন্দিনীকে নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এল। রানা। কিন্তু হাসির আড়ালে ভুরু কুঁচকে আছে ও। হঠাৎ করে সব কিছু খুব জটিল লাগছে ওর। এখন এই পরিস্থিতিতে ওর প্ল্যানে নন্দিনীকে না রেখে কোন উপায় নেই, ব্যাপারটা ভালো লাগুক। আর নাই লাগুক।

<

Super User