তুমি এখানে কী করছ? হিসহিস করে উঠল রানা, গলার আওয়াজ চড়তে দিচ্ছে না।
কী করছি…আমি? এ প্রশ্ন তুমি আমাকে করছ? নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে নন্দিনী, কিন্তু রানার সঙ্গে সুবিধে করতে পারছে না।
কী বলব ভালো করে শুনবে, বলল রানা। এক হাতের ভিতর নন্দিনীর চিবুকটা ভরে নিল ও, সে যাতে ওর প্রতিটি কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তোমাকে এখন আমার নির্দেশ মত চলতে হবে, ঠিক আছে?
না, ঠিক নেই! নন্দিনীও হিসহিস করে উঠল। তার কণ্ঠস্বরে জেদ, চোখের দৃষ্টিতে মরিয়া ভাব।
নন্দিনীকে যা বলার পরে বলবে রানা, তার আগে জরুরি একটা কাজ শেষ করতে হচ্ছে ওকে।
কাল কিনেছে, আজ সঙ্গে আনতে ভোলেনি, মাঝারি আকারের ইয়েল লকটা পকেট থেকে বের করল ও। স্লাইডিং ডোরের বাইরের দিকে ঝুলিয়ে দিল ওটা। বিলম্ব মাত্রই ওর অনুকূলে যাবে। তালাটা খুলতে বা ভাঙতে পাঁচ থেকে দশ মিনিট লাগবে। যেখানে এক মিনিটেই অনেক দূর চলে যাওয়া যায়, সেখানে পাঁচ বা দশ মিনিট নিঃসন্দেহে রানাকে পালাতে বিরাট সাহায্য করবে।
নন্দিনীকে ছাড়েনি রানা, এক হাতে ধরে রেখেছে। কাজটা শেষ হতে তাকে নিয়ে দরজার কাছ থেকে সরে এল ও, দাঁড়াল ব্যাগেজ কার আর সংলগ্ন কোচ-এর মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায়।
ওদের পায়ের তলায় লোহার মেঝে কাঁপছে। রাতের বাতাস চাবুক কষছে নন্দিনীর মুখে, চারদিকে উড়ছে তার রেশমি কালো চুল। এক হাতে সেগুলো সরাতে ব্যস্ত সে, তবে নিজেকে ছাড়াবার জন্য এখনও ধস্তাধস্তি করছে।
এবার তাকে আরও শক্ত করে ধরল রানা। তুমি আমার পিছু নিয়েছ, বলল ও। আমি জানতে চাই কেন।
পিছু নিয়েছি? নন্দিনী অবাক। রুদ্ধশ্বাস মনে হলো তাকে, ভয়টা যেন আগের চেয়ে কমেছে। না, অসম্ভব, আমি কেন তোমার পিছু নিতে যাব?
অস্বীকার করলে লাভ হবে না, চাপা গলায় ধমক দিল রানা। নাই যদি পিছু নেবে, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?
আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ, নন্দিনীর কথায় আর চেহারায় বিস্ময়ের সঙ্গে অভিমান ফুটে উঠল। তোমার যে এরকম একটা রূপ আছে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
নন্দিনীর পিছনে তাকাল রানা। লোকজন ঠাসা কার-এর ভিতর কেউ নড়াচড়া করছে না। আমি জানতে চাই তুমি আমার পিছু নিয়েছিলে কেন, আবার বলল রানা।
এবারও অভিযোগটা অস্বীকার করল নন্দিনী। তোমার অসুস্থতা দেখে খুব…চিন্তায় পড়ে যাই আমি, উত্তেজনায় হোক বা আবেগে মুখে কথা বেধে যাচ্ছে। ফলে আমি ঘুমাতে পারিনি। মশাগুলোও পাগল বানিয়ে ছাড়ছিল। তাই এক সময় কেমন আছ। দেখার জন্যে তোমার কমপার্টমেন্টে গেলাম। ওটা খালি দেখে নার্ভাস হয়ে পড়লাম। কী করব, কাকে বলব-মাথাটা কাজ করছিল না। মায়ানমার অদ্ভুত এক দেশ, জানোই তো অনেক বিদেশী। ট্যুরিস্ট এখানে গায়েব হয়ে যায়…
কেউ ওদেরকে দেখছে না, নিশ্চিত হয়ে নন্দিনীকে নিয়ে। অন্ধকার কার-এর ভিতর দিয়ে এগোল রানা। ব্যাগেজ কার থেকে। যত দূরে সরে আসছে, ততই স্বস্তি বোধ করছে।
আমাকে প্রশ্ন না করে, দয়া করে এবার আমার একটা প্রশ্নের। জবাব দাও, বলল নন্দিনী। ওখানে কী করছিলে তুমি, ব্যাগেজ। কারের ভেতরে?
স্রেফ বোবা হয়ে থাকো, নন্দিনী, ফিসফিস করল রানা। মানে, যদি না চাও যে আমরা দুজনেই খুন হয়ে যাই।
খুন হয়ে যাব?
তবে আর বলছি কী, সুইট হার্ট। আমি কোন খেলা খেলছি। এটা প্রাণ রক্ষার বাজি। কাজেই আমি যা বলব তাই তোমাকে মেনে চলতে হবে, ঠিক আছে? বিশ্বাস করো, একেবারে বাধ্য না হলে আমি চাইব না তোমার কোন ক্ষতি হোক।
এরপর শান্ত হয়ে গেল নন্দিনী, ওরা স্লিপিং কমপার্টমেন্টে না ফেরা পর্যন্ত একটা শব্দও করল না।
ভিতরে ঢুকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল রানা।
চিনাদের আর্টিফ্যাক্ট থেকে কিছু একটা সরিয়েছ তুমি, তাই না? তারমানে তুমি একটা চোর! আহত, সেই সঙ্গে কাতর দেখাল নন্দিনীকে। সেজন্যেই শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্তটা বদলাও তুমি, তাই না?
কোন্ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বদলাই?
মান্দালয়ে যাবার ব্যাপারটায়। বললে কাজে ব্যস্ত থাকবে, সময় নেই, তাই আমার সঙ্গে পেগানে যেতে পারবে না। তারপর হঠাৎ জানালে মান্দালয়ে যাবে। মুখে হাত বুলাল নন্দিনী, যেন অদৃশ্য ক্ষত আর চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টায়। ঈশ্বর, আমি জানি না কী বিশ্বাস করা উচিত, কী নয়। আমি ভেবেছিলাম…ভেবেছিলাম তুমি…
কী? জিজ্ঞেস করল রানা, তারপরই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তার আগে বলো, তুমি জানলে কীভাবে চিনা আর্টিফ্যাক্ট এই ট্রেনে যাচ্ছে?
আমাকে তুমি বোকা মনে করো, না? জবাব দিল নন্দিনী। আজ সকালের কাগজে খবরটা ছিল, বুঝলে মশাই!
থাকলেই বা কী, বলল রানা, তুমি তো বার্মিজ পড়তে পারো না।
বার্মায় অন্তত হাফ ডজন ইংরেজি দৈনিক আছে, সে খবর রাখো? আশ্চর্য! অপরাধ করেছ তুমি, অথচ চোটপাটও দেখাচ্ছ। সেই তুমিই। সন্দেহ নেই, এরকম চোর সহজে দেখা যায় না।
আমি চোর নই, নন্দিনী, বলল রানা, হঠাৎ নিজের কাভার নষ্ট না করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার একটা তাগাদা অনুভব করল ও। শোনো, আমি আসলে সত্যি কিছু চুরি করিনি… নিজেকে সামলে নিল রানা, ভাবল, কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে, আমার সঙ্গে হান সাম্রাজ্যের কোন আর্টিফ্যাক্ট আছে? দুহাজার বছরের পুরানো। একটা পাত্র কোথায় আমি লুকিয়ে রেখেছি দেখাও…
হঠাৎ থেমে ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল রানা, শব্দ করতে নিষেধ করল নন্দিনীকে। তালা দেওয়া দরজার বাইরে থেকে ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। লোকজন চেঁচিয়ে কথা। বলছে বিস্মিত আর উদ্বিগ্ন।
সানঅভআ বিচ! মনে মনে গালি দিচ্ছে রানা। কী ঘটেছে বুঝে। ফেলেছে এরই মধ্যে। শালার কপাল!
এখন কী হবে?
কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অতিরিক্ত পাসপোর্টটা ফেলে রেখে এলেও, রানা উপলব্ধি করছে তাতে খুব একটা কাজ হবে না। জ্ঞান ফেরার পর সৈনিকরা পাসপোর্টের ফটো দেখে মাথা নেড়েছে, জানিয়েছে-এই লোক ব্যাগেজ কারে ঢোকেনি।
এই মুহূর্তে রানার আকার-আকৃতি আর চেহারার সঙ্গে মেলে, এমন একজন বিদেশীকে খুঁজছে ওরা।
সময় পাওয়া গেল না, নক হলো দরজায়। ঠক-ঠক, ঠক-ঠকঠক! যে-ই নক করুক, রেগে আছে, যেন ধৈর্য ধরতে রাজি নয়।
রানা দিশেহারা, নন্দিনীর দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে একমাত্র সে-ই ওকে বাঁচাতে পারে। তার সাহায্য ছাড়া এখনই সব শেষ হয়ে যাবে।
হেই! হেই! বাইরে থেকে কেউ একজন অমার্জিত সুরে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। হ্যালো, মিস…অপরূপা? ওপেনিং প্লিজ। আমরা এখানে পোর্টার, মিস অপরূপা। আমাদের সঙ্গে কাস্টমসের একজন অফিসার রয়েছেন। ওপেনিং প্লিজ।
আরেকবার নন্দিনীর দিকে তাকাল রানা। মুখের ভাব আর চোখের দৃষ্টির সাহায্যে বোঝাতে চেষ্টা করছে—ও নিরপরাধ।
কী? বলল নন্দিনী, ঘুমে জড়ানো কণ্ঠস্বর। দ্রুত হাতে ব্লাউজ আর স্কার্ট খুলে ফেলছে। ওগুলো বদলে স্বচ্ছ নাইলনের তৈরি বাথরোব পরল। এক সেকেন্ড, প্লিজ। আমি ঘুমাচ্ছিলাম।
রানার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল সে।
স্লিপার-এর নীচে ঢুকে মেঝেতে শুয়ে পড়ল রানা। তবে কমপার্টমেন্ট সার্চ করলে ধরা পড়ে যাবে ও।
সুইচ অফ করে কামরাটা অন্ধকার করে দিল নন্দিনী। তাকে দরজার ছিটকিনি খুলতে দেখে দম আটকাল রানা।
দরজাটা অবশেষে খুলে গেল। তবে মাত্র এক কি দেড় ইঞ্চি, যেন নিজের আবরু বা শ্লীলতা রক্ষার চেষ্টা করছে নন্দিনী। ইয়েস? কী ব্যাপার? জানতে চাইল সে, তারপরই মস্ত একটা হাই তুলল।
আমরা আপনার কমপার্টমেন্ট সার্চ করতে চাইছি, কাস্টমস ইন্সপেক্টর কর্তৃত্বের সুরে বলল।
কেন? খানিকটা লাজুক, কিশোরীসুলভ হাসির সঙ্গে জিজ্ঞেস করল নন্দিনী। আমি একটা মেয়ে, সময়টা গভীর রাত, দরজা খুলতে বাধ্য করে বলছেন আমার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করবেন-ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝছি না, মিস্টার। ইয়াঙ্গুনে একবার তো কাস্টমস সব দেখেইছে।
অসুবিধের জন্য দুঃখিত, ম্যাডাম, বলল অফিসার। কিন্তু পোর্টার বলছিল, আপনাকে আজ বিকেলে শ্রীলঙ্কান লোকটার সঙ্গে দেখা গেছে। কথাটা কি সত্যি?
আপনি সম্ভবত মিস্টার কুমার সম্ভবের কথা বলছেন, ধরে নিচ্ছি, বলল নন্দিনী। হ্যাঁ, পোর্টার ঠিকই দেখেছে। আপনি জানতে চাওয়ায় অদ্ভুত লাগছে আমার।
কেন, ম্যাডাম, অদ্ভুত লাগছে কেন? জিজ্ঞেস করল পোর্টার।
কারণ ওই ভদ্রলোক বড়ই আশ্চর্য একজন মানুষ। সন্দেহ নেই, বিচিত্র একটা টাইপ-এদেরকেই বোধহয় খামখেয়ালী বলা হয়। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ তিনি নেমে গেলেন…কী যেন নাম জায়গাটার-নয়াঙ্গুলি বিনের আগে…
তাউঙ্গো?
হ্যাঁ, আরেকটা মস্ত হাই তুলে বলল নন্দিনী। নিশ্চয়ই তাই হবে। ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। কেন, তিনি কী করেছেন?
ট্রেন থেকে নামেনি সে, কাস্টমস অফিসার জানাল।
নামেননি? নন্দিনী এক সেকেন্ডে বোধহয় দশবার চোখের পাতা ফেলল। কী বলেন নামেননি! আমি তাঁকে নিজের চোখে। নেমে যেতে দেখেছি…।
পোর্টার জানতে চাইল, তাউঙ্গোর পর তাকে আপনি আর ট্রেনে দেখেননি?
না।
এ তো দেখছি অদ্ভুত ব্যাপার, বলল পোর্টার। কারণ ওই বিদেশী লোক ব্যাগেজ কারে ঢুকে সৈনিকদের ক্ষতি করেছে, চুরি। করেছে মূল্যবান আর্ট কালেকশন।
কাজেই, কাস্টমস অফিসার বলল, তাকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
কী আশ্চর্য! ভদ্রলোক চোর? ছি-ছি, তা হলে তো সে মোটেও ভদ্রলোক নয়। ইস্, বড় বাঁচা বেঁচি গেছি! আমার জিনিস-পত্রও তো চুরি করতে পারত, তাই না? মায়ানমার নিরাপদ দেশ বলেই। জানতাম, কিন্তু…
মায়ানমার নিরাপদই, আপনার চিন্তার কিছু নেই। প্রতিটি কারে এখন আমরা সৈনিক পাঠাচ্ছি…
এত সৈনিক রয়েছে ট্রেনে, অথচ এখনও তাকে ধরা যাচ্ছে।? নন্দিনী বিস্মিত।
ধরা তাকে পড়তেই হবে, জবাব দিল কাস্টমস ইন্সপেক্টর। সামনে থাজিতে থামছে ট্রেন। থাজি থেকে সেই মান্দালয় পর্যন্ত। লাইনের দুধারে ব্যারিকেড দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে এই মুহূর্তে আমরা আপনার কমপার্টমেন্টটা দেখতে চাইছি, মিস নন্দিনী।
বেশ, ঠিক আছে, বলল নন্দিনী। কিন্তু তবু না বলে পারছি না যে এর কোন যুক্তি নেই। গত কয়েক ঘণ্টা গভীর ঘুমে ছিলাম আমি।
দরজা খুলে যেতে মেঝেতে চৌকো আলো পড়ল, একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে নন্দিনী। স্লিপারের তলা থেকে একজোড়া স্যান্ডেল, একজোড়া রাবার সোল লাগানো ক্যানভাস শু্য দেখতে পাচ্ছে রানা। পোর্টারের নীল ট্রাউজার ইউনিফর্মের অংশ।
স্লিপিং প্লাটফর্মের নীচে জায়গা খুব কম, তার পরও যতটা সম্ভব পিছিয়ে আনল রানা শরীরটাকে। ওর দৃষ্টিপথের এক কোণে এসে থামল পোর্টারের স্যান্ডেল জোড়া। বিছানাটাকে আড়াল করে রাখা পরদাগুলো সরিয়ে খোঁজাখুঁজি করছে সে।
রানা গা ঢাকা দিয়েছে নন্দিনীর লাগেজ-এর পিছনে। ওরা যদি এখন তার ওই লাগেজ সার্চ করতে চায়, নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবে ও।
ওখানে কী? কাস্টমস অফিসারকে প্রশ্ন করতে শুনল রানা।
ওগুলো আমার ব্যাগ, বলল নন্দিনী। দাঁড়ান, একটা কথা মনে পড়ে গেছে…
রানা দেখল মেঝেতে হাঁটু ঠেকিয়ে একটা সুটকেসের ঢাকনি খুলল নন্দিনী, ফলে ওর সামনে পাঁচিলের মত একটা আড়াল তৈরি হলো। বাহ, যেমন সাহস তেমনি বুদ্ধি আছে মেয়েটার।
আমার কাছে কিছু আমেরিকান সিগারেট আছে-এই যে। নিতে পারেন, ভালো লাগবে।
আমেরিকান সিগারেট? পোর্টার গদগদ হয়ে বলল। হ্যাঁ, দিলে নেব না কেন। ধন্যবাদ, ম্যাডাম, অসংখ্য ধন্যবাদ।
দুই প্যাকেট সিগারেট নিয়ে চলে গেল ওরা। দরজাটা বন্ধ করে দিল নন্দিনী।
এক মিনিট অপেক্ষা করার পর স্লিপারের নীচ থেকে বেরিয়ে এল রানা। দেয়ালে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছে নন্দিনী। ওর দিকে এমনভাবে তাকাল, ও যেন অচেনা কোন আগন্তুক।
তুমি কে আমি জানি না, বলল নন্দিনী, গলার আওয়াজ এত নিচু যে কোন রকমে শুনতে পেল রানা। কিন্তু ইতিমধ্যে আমি তোমার দোসর বনে গেছি। তুমি অপরাধ করেছ, কিন্তু আমি তোমাকে লুকিয়ে রেখেছি। একেই বোধহয় নিজের সর্বনাশ করা বলে।
ধন্যবাদ, বলল রানা। এক সময় মনে হচ্ছিল আর এক মিনিটের মধ্যে খেলাটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি ওদেরকে অত্যন্ত কৌশলে বোকা বানিয়েছ।
এখন কী হবে, সম্ভব? চেহারা না দেখিয়ে ট্রেন থেকে তুমি নামতে পারবে না। আর দেখামাত্র ওরা তোমাকে অ্যারেস্ট করবে। যদি ছুটে পালাতে চেষ্টা করো, গুলি করে মারবে।
হ্যাঁ, আমার খুব বিপদ। আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও।
ওরা কী বলল শুনেছ তুমিও। প্রতিটি কারে সৈনিক পাঠানো হয়েছে। থাজি স্টেশনের পর লাইনের দুধারে ব্যারিকেড দেয়া হবে। একটু দম নিল নন্দিনী। সত্যি কথাটা বলবে আমাকে-এরকম একটা কাজ কেন তুমি করতে গেলে?
শোনো, নন্দিনী, বিশ্বাস করো-সব কিছুরই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। চিনা আর্টিফ্যাক্ট থেকে কিছুই আমি চুরি করিনি…
তা হলে কী ঘটেছে ওখানে? জিজ্ঞেস করল নন্দিনী, সন্তোষজনক একটা ব্যাখ্যা পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। বলছ ব্যাখ্যা আছে-কই, দাও! ঠিক আছে, প্রথমে বলো ব্যাগেজ কারে কী করছিলে তুমি। সৈনিকদের হাত-পা বাঁধা ছিল কেন? ওদের মুখে কাপড় খুঁজতে হয়েছে কেন?
সবই তোমাকে বলব, নন্দিনী, তবে এখন নয়। যদি পারতাম এখনই বলতাম, কিন্তু তা সম্ভব নয়। আপাতত আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে।
বিশ্বাস কি এরই মধ্যে তোমাকে আমি করিনি! জনান্তিকে করা প্রশ্ন, উত্তর দাবি করে না। নিস্তেজ একটু শব্দ করে হাসল মেয়েটা, উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা। অর্থাৎ পছন্দ করি বা না করি, সুদর্শন একটা চোরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। বাহ্, নন্দিনী, তোর প্রশংসা করতে হয়! রানার দিকে তাকাল সে। এখন তা হলে কী করতে হবে আমাকে?
রানা জানতে চাইল থাজিতে পৌছানোর পর নন্দিনীর কাজ কী।
থাজিতে ট্রেন বদলে মেকাটলা পর্যন্ত যাবার কথা আমার। ওখান থেকে বাকি পথ ট্যাক্সি করে যেতে হবে। পেগানে পৌছাতে দুতিন ঘণ্টা লেগে যাবে।
বিছানার কিনারায় বসে সাবধানে চিন্তা করছে রানা। হিসাবে ভুল হলে চলবে না। আবার যখন মুখ তুলে তাকাল, দেখল নন্দিনীর চোখ জোড়া আধবোজা হয়ে আছে। তুমি শুচ্ছ না কেন? জিজ্ঞেস করল ও। যতক্ষণ পারো ঘুমিয়ে নাও।
আমার কথা ভাবতে হবে না তোমাকে, বলল নন্দিনী। নিজের বিপদের কথা ভাবো। কী করতে চাইছ?
গোটা ব্যাপারটা তোমার ওপর নির্ভর করে, অবশেষে বলল রানা। তারপর যে প্ল্যানটা তৈরি করেছে সেটা ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করে শোনাল নন্দিনীকে, প্রতিটি অংশ আলাদাভাবে।
সমস্ত মন ঢেলে শুনল নন্দিনী।
সবশেষে জিজ্ঞেস করল রানা, পারবে বলে মনে করো?
ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল নন্দিনী। মনে হয়। কিন্তু ঠিক জানো। তো, তুমি আহত হবে না?
সেটাই শুধু দেখা বাকি। হাতঘড়িতে চোখ বুলাল রানা। ২:৩৯। তিন ঘণ্টা সময় আছে, ভাবল ও। স্লিপারের নীচে ঢুকে। লাগেজগুলো জায়গামত টেনে নিল আবার; বলা তো যায় না, কাস্টমস ইন্সপেক্টরকে নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে পোর্টার।
গুড নাইট, অন্ধকারে ফিসফিস করল নন্দিনী।
সুইট ড্রিমস।
তিক্ত একটু হেসে চোখ বুজল রানা।
<