পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম আমি আর রাফেলা। হাতে সারাদিন কোন কাজ নেই, আর দ্বীপটায় শুধু আমরা আছি, কথাটা মনে পড়তেই অদ্ভুত এক পুলক অনুভাব করলাম শরীরে। রডরিক আর ল্যাম্পনি বিকেলের আগে ফিরবে না।

ব্রেকফাস্ট সেরে দুই সারি পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত বারান্দা ধরে হেঁটে নেমে এলাম আমরা সৈকতে।

অগভীর পানিতে ছুটোছুটি করে খেলছি আমরা। রাফেলা আমাকে, আমি রাফেলাকে লক্ষ করে মুঠো মুঠো বালি ছুঁড়ছি। রীফের বাইরের পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে বুম বুম বোমা ফাটাচ্ছে ঢেউগুলো, সেই ভারী বিস্ফোরণের গুরুগম্ভীর আওয়াজ ছাপিয়ে উঠছে রাফেলার তীক্ষ্ণ, মিষ্টি, খিলখিল হাসি, আর কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছি না আমি। স্রেফ কপালগুণে মুখ তুলে ওপর দিকে একবার তাকাতেই দ্বীপের পেছন দিক থেকে হালকা প্লেনটাকে ছুটে আসতে দেখলাম আমি।

দৌড়াও! ঝট করে মুখ নামিয়ে রাফেলার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। কিন্তু ও মনে করছে আমি ঠাট্টা করছি। দ্রুত হাত তুলে আকাশের প্লেনটাকে দেখালাম ওকে। দৌড়াও। পাইলট যেন আমাদেরকে দেখতে না পায়।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করল রাফেলা। কিন্তু বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পেরে পর মুহূর্তে সমস্ত সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে দিল ও, বিবস্ত্র অবস্থায় ছুটে উঠে এল পানি থেকে।

ওকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি আমি, বালির ওপর দিয়ে উঠে যাচ্ছি সৈকতের ওপর দিকে। এতক্ষণে কানে আসছে ইঞ্জিনের শব্দ। ঝট করে ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছন দিকে তাকালাম। দ্বীপের দক্ষিণ দিকের পাহাড়টার একেবারে গা ছুঁয়ে আড়াআড়িভাবে ছুটে আসছে প্লেনটা, লম্বা সৈকতের ওপর পৌঁছে একটু দিক বদলে সোজা এগোচ্ছে এখন আমাদের দিকে।

কুইক! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। আমার আগে রয়েছে রাফেলা। লম্বা ভিজে পায়ে সন্ত্রস্ত হরিণীর মত ছুটছে ও, কালো এলো চুল খোলা পিঠের ওপর নিতম্বের কাছে ঝাপটা মারছে ঘন ঘন।

আবার পেছন দিকে তাকালাম আমি। এখনও এক মাইল দূরে রয়েছে প্লেনটা, কিন্তু এগিয়ে আসছে সোজা আমাদের দিকে। দেখতে পাচ্ছি, ডবল ইঞ্জিনের একটা প্লেন ওটা, তুষার সাদা প্রবাল বালির বিস্তৃতির দিকে ঝুলে পড়ছে একটু।

গতি মন্থর না করেই ঝুঁকে পড়ে, ছোঁ মেরে তুলে নিলাম আমাদের খুলে রাখা কাপড়চোপড়। তারপর শেষ কয়েক গজ পেরিয়ে এসে একটা ধরাশায়ী নারকেল গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলাম। ঝড়ের দিনে পড়ে গেছে এই গাছ, সব পাতা ঝরে গেছে তার, কিন্তু মাথা নিচু করে কাণ্ডের নিচে গা ঢাকা দিতে কোন অসুবিধে হল না আমাদের। হাঁপাচ্ছে রাফেলা, বসে থাকতে না পেরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল ও। বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে আমিও লম্বা হলাম ওর গা ঘেঁষে।

এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ওটা একটা ডবল ইঞ্জিনের সেসনা প্লেন। লম্বা সৈকতের ওপর দিয়ে সোজা ছুটে এল, তীরবেগে উড়ে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। পানিরেখার বড়জোর বিশ ফুট ওপর দিয়ে। ফিউসিলেজটা হলুদ রঙ করা, সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে-Africair, চিনতে পারলাম প্লেনটাকে, সেন্ট মেরীর এয়ারপোর্টে বার ছয়েক এর আগে দেখেছি আমি, হয় ধনী ট্যুরিস্টদেরকে নামিয়ে দিয়েছে, নয়ত তুলে নিয়েছে। Africair-এর হেড অফিস মেইন ল্যাণ্ডে, এটা একটা প্লেন চার্টার কোম্পানি। এরা ঘন্টা হিসেবে ভাড়া খাটায় নিজেদের প্লেন। ভাবছি, কে ভাড়া করেছে সেসনাটাকে?

প্লেনের সামনের সিটে দুজন লোককে দেখতে পেয়েছি আমি। একজন নিঃসন্দেহে পাইলট, আরেকজন আরোহী। সগর্জনে আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় আমাদের দিকে ফেরানো ছিল ওদের মুখ দুটো। দ্রুত গতির জন্যেই মুখ দুটো ভাল করে দেখতে পাইনি আমি, তাই চিনতে পারার প্রশ্ন ওঠে না। তবে, দুজনেই শ্বেতাঙ্গ।

খাড়ির ওপর পৌঁছে যথাসম্ভব কম এলাকা জুড়ে একটা চক্কর। দিয়ে বাঁক ঘুরল সেসনা, তারপর আবার ফিরে আসতে শুরু করল সোজা আমাদের দিকে।

এবার মাথার আরও কাছ দিয়ে উড়ে গেল প্লেনটা, মুহূর্তের জন্যে পাইলটের পাশে বসা আরোহীর চোখে চোখ আটকে গেল আমার-মনে হল, চিনি আমি লোকটাকে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারব না।

সৈকতের ওপর দিয়ে খানিকদূর এগিয়ে বাঁক নিল সেসনা, কোর্স বদলে নিল মেইন ল্যাণ্ডের দিকে। তার চলে যাবার সাবলীলতার মধ্যে বিজয়ীর একটা ভঙ্গি ফুটে উঠেছে, কিছু আবিষ্কার করে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাচ্ছে সে।

হামাগুড়ি দিয়ে গাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি আর রাফেলা, ভিজে শরীরে লেপ্টে থাকা শুকনো পাতার টুকরো আর বালি পরিষ্কার করছি।

তোমার কি মনে হয়, আমাদেরকে দেখে ফেলেছে ওরা? সসঙ্কোচে জানতে চাইল রাফেলা।

রোদ লেগে জোড়া আয়নার মত ঝকঝক করছিল তোমার পাছা দুটো-ওরা কানা নাকি?

স্থানীয় জেলে বলে ভুল করতে পারে আমাদেরকে ওরা।

ওর দিকে তাকালাম আমি, ওর মুখের দিকে নয়, তারপর নিঃশব্দে হাসলাম। জেলে? তা যদি মনে করে থাকে তাহলে এখনও ওরা মাথা ঘামাচ্ছে সমস্যাটা নিয়ে।

সমস্যা? কিসের সমস্যা?

ওরা ভাবছে, জেলের বুকে অমন বড় বড় ও দুটো কি?

মাসুদ রানা, তুমি একটা ইয়ে, মানে, তুমি একটা জানোয়ার, বলল রাফেলা। ঠাট্টা নয়, রানা, সত্যি বল তো, কি ঘটতে যাচ্ছে এরপর?

তা আমিও জানতে চাই, ডারলিং, জানতে পারলে খুব খুশি হতাম, বললাম ওকে। রূপোর ডিশ আর প্লেটগুলো সঙ্গে করে সেন্ট মেরীতে নিয়ে গেছে রডরিক আর ল্যাম্পনি, কথাটা মনে পড়ে যেতে একটু স্বস্তি বোধ করছি আমি। ওরা সম্ভবত ইতিমধ্যেই টার্টল বে-তে আমার বাড়ির পেছনের মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলেছে সেগুলো। ভাবছি, এখন যদি অভিযান এবং উদ্ধার পর্ব ত্যাগ করতে হয়, তাতেও আমাদের লোকসান নেই।

প্লেনটা চেহারা দেখিয়ে যাওয়ায় আমাদের সবার মনে একটা জরুরী ভাব সেঁধিয়ে গেছে। এখন আমরা নিঃসন্দেহে জানি, গোণা-গুণতি মাত্র অল্প কয়েকটা দিন রয়েছে আমাদের হাতে। যা করার ঝটপট করে ফেলতে হবে।

সমান অস্বস্তিকর আরেকটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে রডরিক।

দক্ষিণ দ্বীপমালিকার আশপাশে একনাগাড়ে পাঁচ দিন ঘুর ঘুর করেছে বুমেরাং। কুলি পীক থেকে অনেকেই প্রায় প্রতিদিন দেখতে পেয়েছে তাকে, দেখে মনে হয়েছে কি করছে তা নিজেরই। যেন জানা নেই তার। প্রকাণ্ড মুখের ভাঁজগুলো খুলে সমান হয়ে গেছে রডরিকের, তার মানে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে সে। সংবাদটাকে। তারপর হঠাৎ করে সোমবারে আবার সে ফিরে এসে নোঙর ফেলেছে গ্র্যাণ্ড হারবারে। টমসন আমাকে জানাল, বুমেরাং-এর মালিক আর তার বেগম হোটেলে গিয়েছিল লাঞ্চ খেতে, সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ফ্রবিশার স্ট্রিটে চলে আসে।

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল আমার, ঢ্যাঙা রামাদীনের কথা মনে পড়ে যেতে ভুরু কুঁচকে উঠল। তারপর?

গোখলে রামাদীনের সঙ্গে তার অফিসে এক ঘন্টা কাটায় ওরা, বলল রডরিক। মিস্টার রামাদীন ওদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পৌঁছে দেয় বন্দরে, সেখান থেকে ওরা বুমেরাং-এ ফিরে যায়। এর একটু পরই বুমেরাং নোঙর তুলে রওনা হয়ে যায়।

এইটুকুই সব?

হ্যাঁ, বলল রডরিক। না, আর একটু আছে। বন্দর থেকে মিস্টার রামাদীন সোজা ব্যাংকে চলে আসে, নিজের সেভিংস অ্যাকাউন্টে জামা দেয় পনেরোশো ডলার।

তা তুমি জানলে কিভাবে?

আমার বোনের মেঝো মেয়ে ব্যাংকে চাকরি করে।

কুৎসিত একদল পোকা আমার তলপেটের চারদিকে হেঁটে বেড়াচ্ছে অনুভব করলেও, মুখে খুশির ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম আমি। বললাম, যাই হোক, মন খারাপ করে কোন লাভ নেই। এসো, পাম্পটা জোড়া লাগাবার কাজটা সেরে ফেলা যাক। কালকের জোয়ারটা ধরতে চাই আমি।

ওয়াটার পাম্পটা ধরাধরি করে গুহায় বয়ে নিয়ে এলাম আমরা। কাউকে কিছু না বলে একা আবার ছোট্ট বে-তে হোয়েলবোটের কাছে ফিরে গেল রডরিক। খানিকপর যখন ফিরে এল, ওর হাতে ক্যানভাসে মোড়া লম্বা একটা প্যাকেট দেখতে পেলাম আমি।

ওটা কি, রডরিক? জানতে চাইলাম আমি।

একটু ইতস্তত করল রডরিক, সঙ্কোচের সাথে প্যাকেটটা খুলল।

এফ. এন কারবাইন আর তার সঙ্গে এক ডজন স্পেয়ার ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছে রডরিক। ভাবলাম কাজে লাগতে পারে এটা, ব্যাখ্যা করল সে।

কারবাইনটা ওর কাছ থেকে নিয়ে জেলিগনাইটের বাক্সগুলোর সঙ্গে মাটির নিচে পুঁতে রাখলাম। ওকে বললাম, কাজটা মন্দ করনি।

.

রাত জেগে গ্যাস লণ্ঠনের আলোয় কাজ করছি আমরা। মাঝরাতের পর পাম্প আর ইঞ্জিনটা বয়ে নিয়ে এলাম হোয়েলবোটের কাছে। ভারী টিম্বারের তৈরি একটা মেকশিফট মাউন্টিং-এর সঙ্গে বেঁধে সেটাকে আমরা বোটে তুললাম। বোটের ঠিক মাঝখানে রাখলাম সেটাকে। পাম্প নিয়ে আমি আর ল্যাম্পনি সকালবেলাও কাজ করছি, এরই মধ্যে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে হোয়েলবোট ছেড়ে দিয়েছে রডরিক।

পুলে পৌঁছে আধঘন্টা স্থির হয়ে থাকল হোয়েলবোট, তারপর শেষ হল আমাদের কাজ। জোড়া লাগানো হয়ে গেছে, এখন আমরা পরীক্ষা করতে পারি পাম্পটা।

রডরিক, রাফেলা আর আমি পানির নিচে এলাম। কালো, মোটা সাপের মত হোস পাইপটা ধরাধরি করে গানপোর্টের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। হোল্ডের কুয়ায় নিয়ে গিয়ে জায়গা মত। ওটাকে বসাতে প্রচুর সময় আর খাটনি গেল আমাদের। রডরিকের কাঁধে চাপড় মেরে ইঙ্গিতে ওকে ওপর দিকটা দেখালাম আমি। ফিন দিয়ে পেডাল করে জাহাজের খোল থেকে বেরিয়ে পানির ওপর উঠে গেল সে।

বেশ খানিকপর হোয়েলবোট থেকে পাম্পের ইঞ্জিনে স্টার্ট। দিল রডরিক, অস্পষ্ট গুঞ্জন আর হোসের গায়ে মৃদু কাঁপুনি অনুভব। করে তা টের পেলাম আমরা।

হোল্ডে ঢোকার মুখে কাঠের মোটা একটা থাম রয়েছে, সেটাকে বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে স্থির করে রেখেছি নিজেকে, দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছি হোস পাইপের শেষ প্রান্তটা। কার্গোর কালো স্তুপের দিকে ফেলে রেখেছে রাফেলা টর্চের আলো। হোসের খোলা মুখটা ধীরে ধীরে সেদিকে ঘোরালাম আমি।

সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম বুদ্ধিটা কাজে দেবে, জঞ্জালের খুদে টুকরোগুলোকে চুম্বকের মত টেনে নিচ্ছে হোস পাইপটা, চোখের পলকে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সব পাইপের মুখের ভেতর। শক্তিশালী একটা স্রোতের মত পাইপে ঢুকছে পানি, ফলে আশপাশে ছোট ছোট ঘূর্ণি সৃষ্টি হচ্ছে।

ইঞ্জিনের ক্ষমতা আর পানির গভীরতার কথা মনে রেখে হিসেব কষে বুঝলাম ঘন্টায় ত্রিশ হাজার গ্যালন পানি টানছে। পাম্পটা। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই কাজের জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেললাম আমি, এখন আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি বেশ কিছুদূর পর্যন্ত। স্কুপে জেনি বার ঢুকিয়ে বড় বড় টুকরো আলাদা করে নিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছি আমাদের পেছন দিকের প্যাসেজে।

ভারী একটা কেস সরাবার জন্যে মাত্র একবার কপিকলটা ব্যবহার করতে হল আমাকে, তাছাড়া বাকি সময় হোস আর জেনি। বার দিয়েই কাজ সারতে পারছি।

প্রায় পঞ্চাশ কিউবিক ফুট কার্গো সরাবার পর ওপরে উঠে আমাদের এয়ার বটল বদলাবার সময় হল। প্যাসেঞ্জার ডেকে হোসটাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে পানির ওপর উঠে আসতেই বিজয়ীর সম্মান দেখিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হল আমাদেরকে। ল্যাম্পনি আনন্দে লাফাচ্ছে, এমন কি রডরিক পর্যন্ত হাসছে।

হোয়েলবোটের চারদিকের পানি জঞ্জাল আর আবর্জনার কণায় ঘোলাটে নোংরা হয়ে গেছে। পাম্পের আউটলেট দিয়ে রেরিয়ে আসা ছোট ছোট নানান জিনিস একটা বালতিতে তুলেছে ল্যাম্পনি, সেটা প্রায় ভরে গেছে এরই মধ্যে। উঁকি দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলাম বোতাম, চুলের কাটা, আঙটি, খুদে গহনা, পদক, সেই সময়কার রূপো আর সোনার মুদ্রা-কাচ, ধাতু আর হাড়ের বিচিত্র একটা সংগ্রহ।

কাজের জায়গায় এখুনি আবার ফিরে যাবার জন্যে অস্থিরতা অনুভব করছি আমি নিজেও, আর রাফেলা তো অধৈর্য হয়ে উঠে আমাকে ঘাড় ধরে নামাতে চাইছে-শেষ পর্যন্ত মাত্র দুটো টান দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুরুটটা খয়রাত করে দিতে হল রডরিককে। আবার আমরা পানির নিচে নেমে এলাম।

কাজে হাত লাগাবার পনেরো মিনিট পর বড়সড় একটা বাক্সের কিনারা দেখতে পেলাম স্যুপের ভেতর। এ-ধরনের বাক্স আগেও দেখেছি আমরা, এবং পেছন দিকে সরিয়ে রেখেছি। এটার ওপরের কাঠ পাটখড়ির মত নরম হয়ে গেলেও লোহার পাত আর বড় বড় পেরেক দিয়ে আটাকান বলে প্রথম টুকরোটা টেনে হিঁচড়ে খুলতে বেশ সময় লেগে গেল। প্ল্যাঙ্কটা আমাদের পেছন দিকে সরিয়ে দিলাম আমি। পরের প্ল্যাঙ্কটা সহজেই বেরিয়ে এল। নিচে দেখা যাচ্ছে বিশৃক্সখল ভাবে গুঁজে রাখা ভিজে খড়। হাত ভরে এর খানিকটা বের করে আনলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে স্রোতের টানে হোসের মুখের কাছে গিয়ে আটকে গেল সেগুলো। তবে এক সেকেণ্ড পরই পথ করে নিয়ে ঢুকে গেল পাইপের ভেতর। হোসটা আবার পানি টানতে শুরু করেছে।

বাক্সটার ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অন্যদিকে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি, কিন্তু আমাকে বাধা দিচ্ছে রাফেলা। তার দাবি, বাক্সটার ওপর আরও সময় ব্যয় করি আমি। রেগে গেছে আমার ওপর ও, হাত নেড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। যখন দেখল ওর। আবদারে কান দিচ্ছি না, টর্চের আলো অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল সে।

অগত্যা ওকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই বাক্সটার দিকে আবার ফিরলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো ফেলল সেটার দিকে রাফেলা। 

বাক্সের ভেতর থেকে অল্প করে টেনে বের করছি খড়, আবার। যাতে পাইপের মুখ বন্ধ করে না দেয়। ইঞ্চি ছয়েক গভীর গর্ত। হবার পর খড়ের ফাঁক-ফোকরের ভেতর প্রথম চোখে পড়ল ধাতব। পদার্থের ধোঁয়াটে কয়েকটা বিন্দু। তলপেটের গভীরে প্রত্যাশায় কাঁপুনি এই প্রথম অনুভব করছি আমি। ব্যগ্র ব্যস্ততার সঙ্গে আরেকটা প্ল্যাঙ্ক ভেঙে সরিয়ে দিলাম পেছন দিকে। ফাঁকটা বড় হওয়ায় আরও সহজে খড় বের করতে পারছি এখন।

ভেতর দিকে স্তরে স্তরে চেপে বসে আছে খড়, সেগুলো আমি। অত্যন্ত ধীরে যত্নের সঙ্গে একটু একটু করে বের করে আনছি। স্বপ্নের মধ্যে একটা মুখ ধীরে ধীরে ফুটে ওঠার মত আত্মপ্রকাশ করছে জিনিসটা।

প্রথমে জটিল কারুকাজ করা এক টুকরো ধাতুর সোনালি আভা ঝিকমিক করে উঠল। পেছন থেকে আমার ঘাড়ের ওপর প্রায় চড়ে বসে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে রাফেলা, আমার কাঁধটা পাঁচ আঙুল দিয়ে খামচে ধরল ও।

একটা মুখের আভাস দেখতে পাচ্ছি, ঠোঁট জোড়া মুখ। ব্যাদানের ভয়াবহ ভঙ্গিতে প্রসারিত, ভেতরে দেখা যাচ্ছে এই বড়। বড় সোনালি দাঁত আর বাঁকানো একটা তলোয়ারের মত বিশাল জিভ। উঁচু, চওড়া কপালটা আমার কাঁধের মত বড় চকচকে হলুদ খুলির সঙ্গে প্রায় সেঁটে রয়েছে কান দুটো। চওড়া দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানে দেখতে পাচ্ছি একটা মাত্র খালি গর্ত, অক্ষিগোলক। আরেকটা চোখের অভাব জানোয়ারটার চেহারার মধ্যে একটা অন্ধ বীভৎস ভাব এনে দিয়েছে, এটা যেন পৌরাণিক যুগের কোন দেবতা, অভিশাপে পড়ে চেহারা এবং বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

প্রকাণ্ড, আর অপূর্ব সুন্দর করে গড়া বাঘের মাথাটার দিকে তাকিয়ে ভক্তি মেশানো ভয় আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছি আমি। কেমন যেন একটা ভীতিকর ঠাণ্ডা অনুভূতি আমার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসছে, নিজের অজান্তে চারদিকের অন্ধকারে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলাম মুঘল রাজকুমারদের অতৃপ্ত আত্মারা ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কিনা।

কাঁধের মাংসের ভেতর রাফেলার আঙুলের নখ সেঁধিয়ে যাচ্ছে, ব্যথ্যা পেয়ে কাঁধটা ঝকালাম আমি, আবার ফিরে তাকালাম সোনার মূর্তির দিকে। কিন্তু ভয় আর বিস্ময় আমাকে এমনভাবে আড়ষ্ট করে ফেলেছে যে ওটার দিকে একটানা কয়েক সেকেণ্ডের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারছি না আমি। বাধ্য হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি, জোর করে নিজের কাঁধে চাপিয়েছি ওটার চারপাশ থেকে জঞ্জাল সরাবার কাজটা।

যত্নের সঙ্গে কাজ করছি আমি, জানি এর কোথাও একটু আঁচড় লাগলেই ঝপ করে অনেক নেমে যাবে এর মূল্য, হানি ঘটবে এর অতুলনীয় সৌন্দর্যের।

আমাদের কাজের সময় উতরে গেল, পিছিয়ে এসে উন্মোচিত মাথা আর কাঁধের দিকে তাকালাম আমরা। টর্চের আলো লেগে প্রতিবিম্বগুলো সোনালি তীর-এর মত অন্ধকার গহূরের সমস্ত দিকে ছুটে যাচ্ছে, ঝলমলে আলো অদ্ভুত একটা পবিত্রতা এনে দিয়েছে পরিবেশে।

অটুট নিস্তব্ধতা আর গভীর অন্ধকারে ওকে রেখে ঘুরে দাঁড়ালাম আমরা, জাহাজের খোল থেকে বেরিয়ে এসে উঠতে শুরু করলাম। ওপর দিকে। যেন অন্য এক জগৎ থেকে ফিরছি আমরা।

আমাদেরকে দেখেই রডরিক বুঝতে পারল অর্থপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু তখুনি কোন প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকল সে। হোয়েলবোটে উঠলাম আমরা। নিঃশব্দে স্কুবা গিয়্যার নামাচ্ছি শরীর থেকে। তারপর একটা চুরুট ধরিয়ে কড়া আর লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া নিলাম বুক ভরে, ভিজে চুল থেকে মুখ বেয়ে সাগরের লোনা পানির ধারা নামছে, সেগুলো মুছে ফেলার ঝামেলায় যাচ্ছি না। আমাদেরকে লক্ষ করছে রডরিক। ওদিকে আমাদের কাছ থেকে একটু সরে গেছে রাফেলা, একা বসে। গোপন কি যেন ভাবনাচিন্তায় মগ্ন।

পেয়েছ, মাসুদ? অবশেষে জানতে চাইল রডরিক।

ওপর-নিচে একবার মাথা ঝকালাম আমি। হ্যাঁ, রডরিক, রয়েছে ওটা ওখানে, আমার কণ্ঠস্বর কাঁপা কাঁপা আর খসখসে, নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের গলা শুনে।

ধনুকের ছিলার মত উত্তেজনায় টান টান পরিবেশটা টের পায়নি এতক্ষণ ল্যাম্পনি, আমাদের গিয়ারগুলো সামলে রাখছিল ও, আমার কথা শেষ হতেই ঝট করে মুখ তুলে তাকাল। কিছু বলার জন্যে মুখটা খুলল ও, কিন্তু তারপর সেটা ধীরে ধীরে বন্ধ করে ফেলল শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশটা অনুভব করতে পেরে।

হঠাৎ যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে আমাদের। কথা না বলে নড়াচড়া করছি। ব্যাপারটা এরকম হবে তা আমি আশা করিনি। রাফেলার দিকে তাকালাম আমি। বুঝতে পারছে ও, আমি ওর দিকে তাকিয়েছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের দিকে তাকাল না ও। কিন্তু আমি নজর ফেরাচ্ছি না অনুভব করে শেষ পর্যন্ত। তাকাল আমার চোখে। ওর চোখে কি এক চকচকে আলো দেখতে পেলাম আমি। আলোটা আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। এটা ভয়, বিস্ময় অথবা লোভেরও প্রতিবিম্ব হতে পারে।

চল ফেরা যাক, রানা, চাপা স্বরে বল রাফেলা।

রডরিকের দিকে ফিরে মাথা কাত করলাম আমি। ইঞ্জিন থেকে হোসটা খুলে হোয়েলবোটের কিনার থেকে পানিতে ফেলে দিল ও, কাল আবার পুলের মেঝে থেকে তুলে নেব আমরা।

গিয়ার দিয়ে বোটের বো ঘুরিয়ে নিল চ্যানেলের দিকে রডরিক।

গলুইয়ে আমার পাশে এসে বসল রাফেলা। ওর কাঁধে একটা হাত তুলে দিলাম আমি, কিন্তু দুজনের কেউ কোন কথা বলছি না।

সূর্যাস্তের সময় আমাদের ক্যাম্পের ওপরে চূড়ায় উঠে পাশাপাশি বসলাম আমি আর রাফেলা। রীফ-এর দিকে তাকিয়ে দেখছি সাগর থেকে মুছে যাচ্ছে দিনের আলো।

কেমন যেন অপরাধী লাগছে নিজেকে আমার, ফিসফিস করে বলল রাফেলা। আমি যেন কি এক ভয়ঙ্কর নিষিদ্ধ কাজ করে বসেছি।

হ্যাঁ, বললাম আমি, কি বলতে চাইছ বুঝতে পারছি।

ওটা…ওটা যেন রক্ত-মাংসের জ্যান্ত একটা কিছু। কি আশ্চর্য, ভেবে দেখ, এত থাকতে আমরা ওর মাথাটাই আগে আবিষ্কার করলাম-প্রচণ্ড রাগে বিকৃত হয়ে ওঠা একটা মুখ হঠাৎ দেখতে পেলাম আমরা। শিউরে উঠল ও, কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল। অথচ অদ্ভুত একটা তৃপ্তিও অনুভব করছি, জানো, ব্যাপারটা ঠিক ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না তোমাকে আমিতার কারণ দুটো অনুভূতি পরস্পরবিরোধী, অথচ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে আমার ভেতর।

আমি বুঝতে পারছি। আমার অবস্থাও তাই।

কি করবে এখন, রানা? ওটা নিয়ে কি করতে চাও তুমি?

মূল্য, ক্রেতা এসব বিষয়ে এই মুহূর্তে আলাপ করতে সায় দিচ্ছে না মন, তাতে যেন গোটা পরিবেশের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়া হয়, তাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে রাফেলাকে বললাম, চল, নিচে যাই। ডিনার নিয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে ল্যাম্পনি।

পেটের খালি জায়গাটা গরম আর সুস্বাদু খাবারে ভরে নিয়ে আগুনের ধারে সবার সঙ্গে গোল হয়ে বসেছি আমি, আমার এক হাতে হুইস্কির গ্লাস, আরেক হাতে জ্বলন্ত চুরুট। এতক্ষণে ঘটনাটা। বর্ণনা করার একটা আগ্রহ অনুভব করছি নিজের মধ্যে।

কিভাবে আবিষ্কার করেছি ওটা তা ব্যাখ্যা করার পর ভীতিকর সোনার মাথাটার বর্ণনা দিলাম আমি। নিঃশব্দে শুনল ওরা।

কাঁধ পর্যন্ত মুক্ত করেছি মাথাটা আমরা। আমার ধারণা, ওখানেই শেষ হয়েছে এই অংশটা। খাজ কাটা দাগ দেখেছি। সম্ভবত পরবর্তী অংশটা ওখানে জোড়া লাগবে। কাল আমরা পানির ওপর তুলে আনব ওটাকে, কিন্তু কাজটা খুব জটিল। কপিকল দিয়ে সেফ টেনে, তুলে নেয়া চলবে না। একচুল নড়াবার আগে ভাল করে দেখে নিতে হবে কোথাও একটু আঁচড়, যেন না লাগে।

একটা পরামর্শ দিল রডরিক, সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম আমরা। আলোচ্য বিষয়, ক্ষতির যথাসম্ভব কম ঝুঁকি নিয়ে মাথাটাকে কি করে ওপরে তোলা যায়।

আমরা আশা করতে পারি গুপ্তধনের পাঁচটা বাক্সই এক সঙ্গে, এক জায়গায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত এই হোল্ডেই বাকি বাক্সগুলো পেয়ে যাব আমরা। বাক্সগুলো দেখতেও একই রকম হবার কথা…

শুধু পাথরগুলো কাঠের বাক্সে নেই, আমাকে বাধা দিয়ে বলল রাফেলা। কোর্ট-মার্শালে দাঁড়িয়ে সুবাদার রাম পানাত সাক্ষী দেয়ার সময় কি বলেছিল মনে নেই তোমার? লোহার একটা আয়রন সেফে আছে পাথরগুলো।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমার।

সেটা দেখতে কেমন, খুলতে পারা যাবে কিনা… রডরিক কিছু বলতে যাচ্ছিল।

কাল জানতে পারব, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল রাফেলা।

<

Super User