গানফায়ার ব্রেক-এর পুল রক্তাক্ত একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিস্ফোরণে নিহত কয়েক টন মাছ টেনে এনেছে ঝাঁক ঝাঁক গভীর পানির কিলার শার্ককে। মাংস আর রক্তের গন্ধ, সেই সঙ্গে স্বজাতিদের অস্থিরভাবে সাতার কাটার খবর পানির ভেতর। দিয়ে পেয়ে গেছে ওরা, দল বেঁধে ছুটে চলে এসেছে নির্বিচার নির্মমতায় মেতে ওঠার জন্যে। এই নির্দয়তার পেছনে বুদ্ধি। বিবেচনার ছিটেফোঁটাও নেই, তাই একে বলা হয় ফিডিং ফ্রেঞ্জি। এ এক ধরনের উন্মত্ত অবস্থা, তিন দিনের খাবার একবারে খেয়ে নিয়েও সামনে যা পায় তাই গোগ্রাসে গিলে নিতে থাকে-যতক্ষণ। খাবার দেখতে পায় চোখের সামনে। এর কোন বিরাম নেই।

তোমার মনে আছে, বাটু ফারেঙ্গির সেই ড্রাগন স্পটে কি হয়েছিল অবস্থাটা? অনেকটা সেই রকম। কিন্তু তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভয়ঙ্কর।

দ্রুত রাফেলাকে টেনে নিয়ে পিছিয়ে এলাম গানপোর্টের ভেতর। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি পানির আলোকিত সিলিংয়ের গায়ে বিশাল আকৃতিগুলোর দ্রুত আনাগোনা।

অপেক্ষাকৃত ছোট হাঙ্গরের ঝাঁকের ভেতর কমপক্ষে দুডজন কুৎসিত হিংস্র রক্তলোলুপ, ভয়ঙ্কর জানোয়ার দেখতে পাচ্ছি; যেগুলোকে দ্বীপবাসীরা আলবাকোর শার্ক বলে। শরীরটা ব্যারেলএর মত, অর্থাৎ মাঝখানটা মোটা, পেছনে এবং সামনেটা ক্রমশ সরু। মুখ আর নাক গোল, পেটটা ঝুলে পড়া, চওড়া নিঃশব্দ হাসি মাখা চোয়াল। কদাকার উন্মত্ত দানবের মত ছুটোছুটি করছে ওরা, শক্তিশালী লেজ ঝাপটাচ্ছে, মুখগুলো বিদ্যুৎচালিত যান্ত্রিক মেশিনের মত দ্রুত আর ঘন ঘন খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে-মাছ, রক্ত, আঁশ, মাংশের টুকরো আর কণা, ক্ষুধার্ত রাক্ষসের মত কিছুই বাদ দিচ্ছে না, গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে সব। যতদূর জানি এরা সাংঘাতিক লোভী আর বোকা, উদরস্থ করার উন্মাদনায় মেতে থাকে না যখন তখন এক আধটু ভয় দেখালেই পিছু হটে যায়। কিন্তু এখন নিজেদের ভালমন্দ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ওরা, লোভে উত্তেজিত আর অন্ধ হয়ে আছে, একবার ঘটালে আর রক্ষা নেই। কিন্তু শুধু এই দুই ডজন হলে তবু আমি ডি-কমপ্রেশনের জন্যে মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে ওপরে উঠে যাবার কল্পনাতীত ঝুঁকিটা প্রাণ বাজি রেখে হলেও নিতাম।

আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে এরা নয়, অন্য দুটো প্রসারিত আকৃতি, যারা নিঃশব্দ রাজসিক ভঙ্গিতে দ্রুত টহল দিয়ে তুমুল আলোড়ন তুলছে পানিতে। এদেরকে দেখেই হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। গভীরভাবে দুফাঁক করা চওড়া লেজের একটা মাত্র শক্তিশালী ঝাপটায় বাঁক নিচ্ছে ওরা, তাতে ছুঁচালো নাক লেজের প্রায় ডগা ছুঁই ছুঁই করছে, তারপর সমস্ত শক্তি আর গর্বিত ঈগলের সাবলীল ভঙ্গিতে উড়ে চলছে আরেকদিকে।

এই ভয়ঙ্কর মাছের যে-কোন একটা যখন সামনে খাবার দেখে থামছে, আধখানা চাঁদ আকৃতির প্রকাণ্ড মুখটা খুলে যাচ্ছে, ভেতরে দেখা যাচ্ছে আগে-পিছে অসংখ্য দাঁতের সারি, দাঁতগুলো চওড়া আর লম্বা, বাইরের দিকে ছড়ানো।

জোড়াটা একই আকৃতির, নাক থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত তেরো-চোদ্দ ফুট লম্বা, ডরসাল ফিনের দেড় হাত উঁচু ফলাটা খাড়া হয়ে আছে। পিঠের চওড়া অংশের রঙ স্লেট পাথরের মত, পেটটা তুষারের মত ধবধবে সাদা আর ঝকঝকে লেজ আর ফিনের কিনারাগুলোর রঙ গাঢ় কালো। একটা মাত্র কামড়ে একজন মানুষকে দুটুকরো করতে পারে এরা এবং টুকরো দুটো একটা মাত্র ঢোকে গিলে নিতে পারে।

গানপোর্টের মুখ থেকে উঁকি মারছি, ব্যাপারটা ওদের। একজনের চোখে পড়ে গেল। এক নিমেষে লেজ ঝাপটে আধ পাক ঘুরে গেল সে, স্যাঁত করে নেমে এল আমাদের মাথার কাছে, কয়েক ফুট ওপরে থেমে বুদ্ধি পাকাচ্ছে। আঁতকে উঠে গানডেকের অন্ধকার গহ্বরের আরও ভেতরে পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তার আগেই দেখলাম আরেকবার লেজ ঝাপটা দিয়ে বাক নিচ্ছে বিশাল আকৃতিটা, উঠে যাচ্ছে খাড়াভাবে, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বাইরে বেরিয়ে থাকা চোখা পুরুষাঙ্গটা।

এদেরকে ভয়ঙ্কর হোয়াইট ডেথ শার্ক বলে, পানির নিচে। এরাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী।

অল্প বাতাস নিয়ে ডি-কমপ্রেশনের জন্যে জরুরী বিরতি সহ পানির ওপর উঠে যাওয়ার চেষ্টা করা এখনও সম্ভব, কিন্তু হোয়াইট ডেথের উপস্থিতে ঝুঁকিটা নিলে আমার মৃত্যুর জন্যে শুধু নির্বুদ্ধিতাকেই দায়ী করা হবে।

কিন্তু নিজের কথা একবারও ভাবছি না এখন, আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা রাফেলাকে নিয়ে। আমিই ওকে নিয়ে এসেছি, ওকে বাঁচাবার দায়িত্বটাও আমারই। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হলেও নিতে হবে আমাকে। শুধু ওর জন্যে, তা নইলে এই ঝুঁকি নেবার কথা চিন্তা পর্যন্ত করা যায় না।

স্লেটে দ্রুত আঁচড় কেটে লিখলাম-অপেক্ষা কর! বন্দুক আর বাতাস আনার জন্যে ওপরে যাচ্ছি আমি।

মেসেজটা পড়েই দ্রুত প্রচণ্ডভাবে মাথা ঝাঁকাল রাফেলা, জরুরী ভঙ্গিতে হাত আর মুখ নেড়ে বাধা দিতে চেষ্টা করছে আমাকে। কিন্তু ইতিমধ্যে হারনেসের কুইক রিলিজ বাকল-এর পিন টেনে খুলে ফেলেছি আমি, শেষবার বুক ভরে বাতাস টানলাম, তারপর স্কুবা সেটটা ঠেলে দিলাম রাফেলার হাতে। ওয়েট-বেল্টটা ফেলে দিয়ে হালকা করে নিলাম নিজেকে, খখালের। গা ঘেঁষে ঝুপ করে নেমে গেলাম নিচের দিকে।

উল্টে পড়ে থাকা জাহাজের আড়ালে যতটা সম্ভব গা ঢাকা দিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে এগোচ্ছি প্রবাল প্রাচীরের দিকে। পেছনে রেখে যাচ্ছি আমার জীবনের প্রথম প্রেম-রাফেলাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করব, কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তবু জানি না আবার ওর কাছে ফিরে আসতে পারব কিনা। শেষ যেটুকু বাতাস ছিল তার সবটুকু রেখে যাচ্ছি ওর কাছে, সংযমের সঙ্গে খরচ করলে পাঁচ কি ছয় মিনিট সরবরাহ পাবে ও। আর আমার রয়েছে শুধু ফুসফুসের বাতাসটুকু, এইটুকুর ওপর ভরসা করে পেরোতে হবে আমাকে শত্রু এলাকা।

প্রাচীরের কাছে পৌঁছেছি আমি, উঠতে শুরু করেছি প্রবাল ঘেঁষে, আশা করছি আমার কালো রঙের স্যুটটা এর রঙের সঙ্গে মিশে যাবে, প্রবালের দিকে পেছনে ফিরে, খোলা পুলের দিকে মুখ করে রয়েছি আমি, সামনে দেখতে পাচ্ছি বিশাল আকৃতিগুলো দ্রুত বাঁক নিচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, চক্কর মারছে।

বিশ ফুট উঠেছি আমি, পানির চাপ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার ফুসফুসের ভেতর ক্রমশ বাড়ছে বাতাসের প্রচণ্ড চাপ। ভেতরে চেপে রাখা সম্ভব নয়, সে-চেষ্টা করলে ফুসফুসের টিস্যুগুলো ছিঁড়ে যাবে। ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে আসতে দিলাম কিছু রূপালী বুদবুদকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো একটা হোয়াইট ডেথ শার্কের চোখে পড়ে গেল।

একপাক গড়িয়ে বাঁক নিল সে, দ্রুত এবং ঘন ঘন লেজের বাড়ি মেরে তীরের মত সোজা ছুটে আসছে আমার দিকে।

মরিয়া হয়ে প্রাচীরের ওপর দিকে চোখ বুলালাম। ছয় ফুট ওপরে পচন ধরা প্রবালের গায়ে ছোট একটা গুহা দেখতে পেলাম আমি। ডাইভ দিয়ে গুহাটার ভেতর ঢুকেছি, সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক স্নান রঙের মত আমার পাশ ঘেঁষে চলে গেল হাঙ্গরটা, বাক নিল, তারপর পিছু হটে আমি আরও পেছনে সরে যাবার আগেই আবার স্যাৎ করে ছুটে গেল গুহার সামনে দিয়ে। অন্ধকারের ভেতর আমাকে দেখতে না পেয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল সে, পাক খেয়ে ছুটল ঝরা পাতার মত ডিগবাজি খেতে খেতে নেমে আসা একটা মরা স্ন্যাপারের দিকে, গপ করে মুখে পুরে নিয়ে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে চালান করে দিল সেটা ভেতর দিকে।

বাতাস থেকে অক্সিজেন হজম করে নিয়ে আমার ফুসফুস। দুটো লাফাচ্ছে এখন। রক্তে কার্বন-ডাইঅক্সাইড তৈরি হচ্ছে। অ্যানোক্সিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছি আমি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। গুহার নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলাম, প্রাচীর ঘেঁষে একটা মাত্র সুইমিং ফিনের সাহায্যে আবার উঠতে শুরু করেছি ওপর। দিকে।

ওঠার সময় ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে আবার রূপালী বুদবুদ ছাড়ছি, জানি আমার শিরাগুলোতেও নাইট্রোজেন সাংঘাতিক দ্রুত চাপমুক্ত হচ্ছে, একটু পরই জিনিসটা গ্যাসে পরিণত হয়ে বুদবুদ সৃষ্টি করবে রক্তে। মাথার ওপর পানির সিলিংটাকে ধাবমান আয়নার। মত দেখাচ্ছে, তার গায়ে ঝুলছে চুরুট আকৃতির হোয়েলবোটটা। দ্রুত উঠছি আমি, মাঝখানের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। নিচের দিকে তাকালাম আবার। আমার কাছ থেকে অনেক নিচে এখনও দেখতে পাচ্ছি হাঙ্গরের ঝকগুলো বাঁক নিচ্ছে, ডাইভ দিচ্ছে, পাক খাচ্ছে, ছুটছে দ্রুতগতিতে। দেখে শুনে মনে হচ্ছে ফাঁকি দিতে। পেরেছি আমি ওদের চোখকে।

তীব্র ব্যথা শুরু হয়েছে আমার ফুসফুসে, মাথার খুলিতে বাড়ি মারছে রক্তের চাপ। এই সময় সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রাচীরের আশ্রয় ছেড়ে খোলা পানিতে বেরিয়ে হোয়েলবোটের দিকে যাত্রা শুরুর সময় হয়েছে আমার।

প্রাচীরের গায়ে পায়ের ধাক্কা মেরে হোয়েলবোটের দিকে রওনা দিলাম আমি। রীফ-এর কাছ থেকে একশো গজ দূরে। ওটা। অর্ধেক দূরত্ব নির্বিগ্নে পেরিয়ে এসে নিচের দিকে তাকালাম একবার। যা দেখলাম তার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম আমি তবু লাফিয়ে উঠল কলজেটা।

একটা হোয়াইট ডেথ শার্ক দেখতে পেয়েছে আমাকে। এখনও ধাওয়া করতে শুরু করেনি। কিন্তু পাক খেয়ে বাঁক নেবার ভঙ্গির মধ্যে বিদ্যুৎগতি ব্যস্ততা লক্ষ করেই বুঝে নিলাম কপালে কি আছে আমার। যা ভেবেছি তাই। প্রচণ্ড বেগে আমার দিকে ছুটে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু।

নীল গভীরতা থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে এভাবে ওকে ছুটে আসতে দেখলে অন্য কোন পরিবেশে বিস্ময়ে হতভম্ব, স্থির পাথর হয়ে যেতাম আমি। এক্ষেত্রে ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া হল আমার। আতঙ্ক নতুন শক্তি যুগিয়ে দিল আমাকে, আরও দ্রুত উঠে যাচ্ছি আমি হোয়েলবোট লক্ষ করে।

তাকিয়ে আছি নিচের দিকে। এগিয়ে আসতে দেখছি শার্কটাকে। আমার দিকে যত এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে ওর আকার। ওর শরীরের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য জ্বলজ্বল করছে আমার চোখে। মুখের সামনেটা শূয়রের মত, সেখানে লম্বা দুটো ফাটল দেখা যাচ্ছে-ও-দুটো নাকের ফুটো। চোখ দুটো সোনালী, কিন্তু মণি দুটো কালো, তীর-চিত্রে মাথার মত দেখতে। চওড়া নীল পিঠ, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ভীতিকর ডরসাল ফিনের ফলাটা।

নিচ থেকে পানির গা ছুঁড়ে বেরিয়ে এলাম-এত দ্রুত যে আমার কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে শূন্যে। বাতাসে পাক খেয়ে ঘুরে গিয়েই হাত চালালাম। বোটের শক্ত গানেলের গায়ে বাড়ি খেল হাতটা। আঙুলগুলো বাকা করে ধরে ফেলেছি গানেল। সবটুকু শক্তি দিয়ে সামনের দিকে টেনে আনলাম শরীরটা। পা দুটো গুটিয়ে তুলে ফেললাম আমার চিবুকের নিচে।

ঠিক সেই মুহূর্তে আঘাত হানল হোয়াইট ডেথ।

আমার চারদিকের পানি বিস্ফোরিত হল, পানি ভেদ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল সে। ধাক্কাটা অনুভব করলাম-কর্কশ, খরখরে চামড়ার সঙ্গে আমার পায়ের স্যুট ঘষা খেয়ে ছিঁড়ে গেল। তারপরই হোয়েলবোটের খোলের গায়ে ধাক্কা খেল সে, প্রচণ্ড সংঘর্ষে নিমেষে একদিকে কাত হয়ে গেল বোটটা।

ঝাঁকি খেয়ে দুলছে হোয়েলবোট, চমকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেছে রডরিক আর ল্যাম্পনি। বিদ্যুৎগতিতে শরীরটা টেনে গুটিয়ে। নিয়েছিলাম, কিন্তু শার্কটাও দিক বদলে নিতে পেরেছিল শেষ। মুহূর্তে। একটুর জন্যে ব্যর্থ হয়েছে সে, ধাক্কা খেয়েছে খোলের সঙ্গে।

এখন আরেকটা মরিয়া চেষ্টায় পা ছুঁড়ে আর লাফ দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে গানেল টপকালাম আমি, হোয়েলবোটের তলায়। দড়াম করে পড়ে গেলাম।

ওখানে শুয়ে হাঁপাচ্ছি, প্রিয় মিষ্টি বাতাস গিলে ফুসফুসের তীব্র। ব্যথা দূর করছি। হালকা তুলোর মত লাগছে মাথাটা, কড়া মদের নেশার চেয়েও বেশি আচ্ছন্নতা বোধে আক্রান্ত হয়েছি আমি।

একটা চিৎকার ঢুকছে আমার কানে। গলাটা চিনতে পারছি। রডরিকের। চারদিক থেকে ভেসে আসছে তার বিকট চিৎকার আমার দুই কানে।

মিস রাফেলা কোথায়? ওই শার্কটা মিস রাফেলাকে ধরেছে?

গড়িয়ে চিৎ হলাম আমি, অস্বাভাবিক দ্রুত বাতাস টানতে গিয়ে হাঁপাচ্ছি আর ফোঁপাচ্ছি।

স্পেয়ার লাঙস! এক নিঃশ্বাসে বললাম আমি। নিচে, গানপোর্টে মারা যাচ্ছে রাফেলা। ওর বাতাস দরকার।

লাফ দিয়ে বোতে পড়ল রডরিক, হ্যাঁচকা টানে ক্যানভাস শীটটা সরিয়ে দুই হাত দিয়ে ধরল অতিরিক্ত স্কুবা সেটটা।

ল্যাম্পনি! হুঙ্কার ছাড়ল সে, জনি পিল বের কর! একটা মার্কিন স্পাের্টস গুডস ক্যাটালগ দেখে এই কপার অ্যাসিটেট পিল আনিয়ে রেখেছি আমি, বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে শার্ক তাড়াবার জন্যে এর নাকি জুড়ি নেই। এখনও যাচাই করা হয়নি এর কার্যকারিতা। রডরিকের কাছ থেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই জোটেনি এর কপালে। দেখা যাক, বলল রডরিক, জিনিসটা কোন কম্মের কিনা।

মাতালের মত টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম আমি, ওকে বললাম, সমস্যা শুধু ওকে নিয়ে নয়, রডরিক। বড় সাহেব গিজগিজ করছে পুলে, তাদের সঙ্গে নিচে বড় লাট রয়েছে দুজন। তাদের একজনই ধাওয়া করেছিল আমাকে।

নতুন সেটে ডিমাণ্ড ভালভ ফিট করছে রডরিক। তুমি সোজা উঠে এসেছ, মাসুদ? 

মাথা ঝাঁকালাম আমি। আমার বটল দুটো রাফেলাকে দিয়ে এসেছি। গানপোর্টে অপেক্ষা করছে ও।

তুমি পঙ্গু হতে শুরু করবে, মাসুদ? মুখ তুলে আমার চোখে তাকাল রডরিক, ওর চেহারায় উদ্বেগ লক্ষ করছি আমি।

আবার আমি মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ, রডরিক, এলোমেলো ভাবে পা ফেলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম আমার ট্যাকল বক্সটার কাছে ঢাকনি তুলে ভেতরে তাকালাম। এক্ষুনি আবার তাড়াতাড়ি নেমে যেতে হবে আমাকে-বুদবুদ সৃষ্টি হবার আগেই আবার চাপ ফেলতে হবে রক্তে। এক্সপ্লোসিভ হেড-এর বাণ্ডিলটা তুলে নিলাম বাক্স থেকে।

একটা দশ ফুট স্টেইনলেস স্টীল স্পিয়ারের শ্যাফটের সঙ্গে স্কু দিয়ে আটকাবার ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিটি হেডের। স্ট্রাপ দিয়ে বাণ্ডিলটা উরুর সঙ্গে বেঁধে নিচ্ছি দ্রুত। মোট বারোটা হেড, ভাবছি, আরও থাকলে ভাল হত। প্রতিটি হেড-এর এক্সপ্লোসিভ চার্জ একটা বারো-গজ শটগান শেলের সমান। হাতলের একটা ট্রিগার দিয়ে চার্জটা ফায়ার করতে পারব আমি। হাঙ্গর মারার ভাল একটা অস্ত্র এটা।

স্কুবা সেটের একটা আমার পিঠে হারনেস দিয়ে বেঁধে দিল রডরিক। আমার পায়ের কাছে উবু হয়ে বসেছে ল্যাম্পনি, জনি পিলের ফুটো করা প্লাস্টিক কনটেইনারগুলো বেঁধে দিচ্ছে আমার গোড়ালিতে।

আরেকটা ওয়েট-বেল্ট দরকার আমার, বললাম ওদেরকে। একটা ফিনও ফেলে রেখে এসেছি নিচে। অতিরিক্ত একটা সেট। আছে…

কথা শেষ করতে পারলাম না। আমার বাম হাতের কনুইয়ে আগুন-ধরা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম। নিজের অজান্তে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল আমার গলা থেকে, হাতটা নিজে থেকেই কনুইয়ের কাছে ভাঁজ হয়ে গেল, ছেড়ে দেয়া স্প্রিংয়ের মত ঝন্টু করে উঠে এসে বাড়ি মারল আমার বুকে। রক্তের ভেতর দিয়ে এগিয়ে বুদবুদগুলো নার্ভ আর গ্রন্থিতে গুতো মারতে শুরু করেছে।

মাসুদ মচকে যাচ্ছে! একটা হাহাকার ধ্বনি বেরিয়ে এল রডরিকের গলা থেকে। সুইট মেরি, মাসুদ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে! লাফ দিল ও। মোটরের কাছে গিয়ে পড়ল। প্রবাল প্রাচীরের দিকে তাক করল বোট। একটা ঝাঁকি খেয়ে ছুটতে শুরু করল। সেটা। তাড়াতাড়ি সার, ল্যাম্পনি, চেঁচিয়ে বলল সে, এক্ষুনি। ওকে পানিতে নামিয়ে দিতে হবে।

তীব্র, অসহ্য ব্যথাটা আঘাত করল আবার, এবার আমার ডান পায়ে। কিছু ধরে তাল সামলাবার সময়ও পেলাম না আমি, অকস্মাৎ ভাঁজ হয়ে গেল হাঁটুটা, হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম দুর্বল শিশুর মত। এগিয়ে এসে আমার কোমরে দ্রুত বেঁধে দিচ্ছে ল্যাম্পনি ওয়েট বেল্টটা। আমার অসাড়, পঙ্গু পায়ে সুইমিং ফিনটা ঢুকিয়ে দিল ও।

রীফের কাছাকাছি এসে মোটর বন্ধ করল রডরিক। ছুটে গলুইয়ে আমার কাছে চলে এল সে। হাঁটু মুড়ে বসল আমার সামনে। মাউথপীসটা আমার ঠোঁটের মাঝখানে বসিয়ে দিয়ে এয়ার বটলের ছিপি খুলে দিল দ্রুত।

ঠিক আছে, মাসুদ? বাতাস টেনে বুক ভরে নিলাম আমি,। ওর প্রশ্নের উত্তরে মাথা ঝাঁকালাম একবার।

হামাগুড়ি দিয়ে বোটের কিনারায় চলে গেল রডরিক।

পাঁচ সেকেণ্ড নড়ল না ও। পুলের পানি পরীক্ষা করছে। ঠিক আছে, মাসুদ, আশ্বাসের সুরে জানাল আমাকে, বড় লাট জনি অন্য কোনদিকে চলে গেছে।

হালকা একটা বস্তার মত দুহাত দিয়ে আমাকে শূন্যে তুলে নিল রডরিক। তারপর ধীরে ধীরে বোট আর প্রবাল প্রাচীরের মাঝখানের পানিতে নামিয়ে দিল।

আমার বেল্টের সঙ্গে অতিরিক্ত স্কুবা সেটটা আটকে দিল ল্যাম্পনি, তারপর আমার হাতে ধরিয়ে দিল দশ ফুট লম্বা স্পিয়ার গানটা। ভাবছি, হাত থেকে এটা ফেলে না দিই!

মিস রাফেলাকে ওখান থেকে তুলে আনতে হবে-তোমার মনে আছে, মাসুদ? বলল রডরিক।

একটা মাত্র পা ছুঁড়ে পানির নিচে ডুব দিলাম আমি।

পেশী আর হাড়ের সংযোগে প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও পানিতে ডুব দিয়ে সবচেয়ে আগে ভয়ে ভয়ে খুঁজছি হোয়াইট ডেথের বিশাল উড়ন্ত আকৃতিটাকে। একটাকে দেখতে পেলাম আমি, কিন্তু অনেক নিচে সেটা, এক ঝাঁক আলবাকোর হাঙ্গরের মাঝখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্রাচীরের আশ্রয় ঘেঁষে একটা পা ছুঁড়ে দিগভ্রান্ত একটা জলজ পোকার মত নেমে যাচ্ছি আমি। ত্রিশ ফুট নামার পর একটু একটু করে কমতে শুরু করল ব্যথা। পানির চাপে রক্তপ্রবাহে গজিয়ে ওঠা বুদবুদগুলো আকারে ছোট হয়ে আসছে। হাত এবং পায়ের সাড়া পাচ্ছি এখন, কাজে লাগাতে পারছি ওগুলো।

আরাম পেয়ে স্বস্তির পরশ অনুভব করছি শরীরে, হতাশার জায়গায় নতুন উৎসাহ আর আশায় ভরে উঠেছে বুক, আগের চেয়ে অনেক দ্রুত নেমে আসছি আমি। প্রচুর বাতাস রয়েছে সঙ্গে, অস্ত্র রয়েছে। অন্তত লড়ার একটা সুযোগ পাব আমি এখন।

নব্বই ফুট নিচে নেমে এসেছি আমি, এখানে সেখানে দেখতে পাচ্ছি পুলের তলার কিছু কিছু অংশ। ধোঁয়াটে নীল গভীরতা থেকে উঠে আসতে দেখছি রাফেলার বুদবুদগুলোকে, ও এখনও বাতাস পাচ্ছে বুঝতে পেরে পুলক অনুভব করলাম শরীরে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই বাতাস শেষ হয়ে যাবে ওর, কিন্তু পুরো। চার্জ করা নতুন এক সেট স্কুবা রয়েছে আমার সঙ্গে। আমাকে শুধু। এটা নিয়ে ওর কাছে পৌঁছতে হবে।

দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছি, এই সময় একটা আলবাকোর শার্ক দেখে ফেলল আমাকে। এদিকেই আসছিল, আমাকে দেখে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন তার শরীরে। অনেক দূর থেকে আসছে, ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে আকুতিটা। ইতিমধ্যেই কয়েক মন মাছ খেয়ে বেঢপভাবে ফুলিয়ে নিয়েছে পেটটা, কিন্তু সীমাহীন খিদে তাতে। মেটেনি। চওড়া লেজ দিয়ে পেডাল করে, ভীতিকর নিঃশব্দ হাসিমুখে তীরবেগে ছুটে আসছে আমার দিকে।

পিছিয়ে এলাম দ্রুত। পানিতে স্থির ভাবে ভাসছি। আমার ঠিক পেছনেই রয়েছে প্রাচীরের গা। শার্কের দিকে মুখ করে রয়েছি আমি, কিন্তু এখন আর আগের মত ভয়ে মরে যাচ্ছি না। এক্সপ্লোসিভ হেড পরানো স্পিয়ারটা বাড়িয়ে দিয়েছি সামনের দিকে। ধীরে ধীরে ফিন দিয়ে পেডাল করে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে রেখেছি, আমার চারদিকে ঘন মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ছে। শার্ক তাড়াবার পিল থেকে উজ্জ্বল নীল রঙের ডাই।

কাছে চলে এসেছে আলবাকোর। ওর মুখে আঘাত করার জন্যে তাক করে ধরেছি স্পিয়ারটা। কিন্তু নীল ডাইয়ের মেঘের গায়ে মাথা আর নাকের ছোঁয়া লাগতেই চোখের পলকে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল সেটা, ভয় আর হতাশায় ঘন ঘন লেজের বাড়ি মেরে দিক বদলাচ্ছে। নাকের ফুটো, চোখ আর মুখ পুড়ে গেছে ওর কপার অ্যাসিটেট লেগে। চমকে গিয়ে আধপাক ঘুরে পিটটান দিল ও।

পিলগুলো সাংঘাতিক কাজ দেয়, বুঝতে পেরে খুশি হয়ে উঠল মনটা। আবার আমি দ্রুত নিচের দিকে নেমে যেতে শুরু করেছি। বাঁশ-বাগানের মাথার ওপর পৌঁছে গেছি। ত্রিশ ফুট নিচে

দেখতে পাচ্ছি রাফেলাকে। গানপোর্টের মুখে অপেক্ষা করছে। আমার জন্য। মুখ তুলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিজের এয়ার বটল শেষ করে আমার দুটো ব্যবহার করছে এখন। কিন্তু বুদবুদের প্রচুর উত্থান দেখে বুঝতে পারছি আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড বাতাস পাবে ও, তারপরই নিঃশেষ হয়ে যাবে সব বাতাস।

প্রবাল প্রাচীরের আশ্রয় ছেড়ে এবার ওর দিকে এগোচ্ছি আমি। আমাকে উদ্দেশ্য করে পাগলের মত হাত নাড়ছে ও, দেখে হুঁশ হল আমার। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই লম্বা নীল টর্পেডোর মত হোয়াইট ডেথকে আমার দিকে তেড়ে আসতে দেখলাম আমি।

বাঁশ-ঝাড়ের উঁচু মাথা ঘুরে আসছে বড়লাট, চোয়ালের এক কোণে আটকে রয়েছে দেড় হাত লম্বা একটা থেঁতলানো মাছ, সম্ভবত কোন আলবাকোর হাঙ্গরের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাকে আরও সুস্বাদু খোরাক মনে করে ছুটে আসছে সে, মাছটাকে গিলে নেবার অবসর পায়নি। আমাকে পেটে ঢোকাতে হলে মুখের পথটা পরিষ্কার করা দরকার, সম্ভবত সে-কথা ভেবেই প্রকাণ্ড মুখটা খুলল সে, এক ঢোকে গিলে নিল মাছটাকে, সাপের ছড়ানো ফণার মত ধবধবে সাদা দাঁতের সারি দেখতে পেলাম আমি।

ওর দিকে মুখ করে তৈরি হয়ে আছি আমি। ঠিক যখন আঘাত হানতে যাচ্ছে ও, ফিন দিয়ে ঘন ঘন পেডাল করে দ্রুত পিছিয়ে আসছি আর বু ডাইয়ের ঘন স্মােক স্ক্রিন ছাড়ছি দুজনের মাঝখানে।

লেজের প্রচণ্ড কয়েকটা বাড়ি মেরে শেষ কয়েক গজ তীরবেগে পেরিয়ে এল সে। ব্লু ডাইয়ের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠল, আমার দিক থেকে ঘুরে যাচ্ছে আরেক দিকে। কিন্তু পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাবার সময় তার লেজের একটা ভারি ঝাপটা লাগল। আমার কাঁধে। একবার, দুবার, বারবার ডিগবাজি খাচ্ছি আমি সেই ধাক্কায়। দিগভ্রান্ত অবস্থা এখন আমার। তাল সামলে নিজের চারদিকে দ্রুত তাকাচ্ছি। প্রথমেই দেখতে পেলাম আমার শত্রুকে। নাছোড়বান্দা হোয়াইট ডেথ চক্কর মারছে আমাকে ঘিরে।

চল্লিশ ফুট দূরে রয়েছে সে। আমার চারদিকে টহল দিচ্ছে। পুরো শরীরটা একটা বিশাল যুদ্ধ-জাহাজের মত লম্বা লাগছে আমার চোখে। মেঘমুক্ত আকাশের মত গাঢ় নীল দেখাচ্ছে ওর গায়ের রঙ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার যে এই দানবরা এটার চেয়ে দ্বীগুণ বড় হয় আকারে। সেই ধাড়ীগুলোর তুলনায়। এটা এখনও শিশু-সেজন্য ধন্যবাদ দিলাম আমার ভাগ্যকে।

সরু স্টীল স্পিয়ারের ওপর এত যে ভরসা করেছিলাম, হঠাৎ সেটাকে ফালতু একটা খেলনা বলে মনে হচ্ছে আমার। হাঙ্গরটার ঠাণ্ডা হলুদ চোখে ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি আমি, চোখ গরম করে দেখছে আমাকে সে। মাঝে মাঝে মোটা পাপড়ি নেড়ে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে চোখ টিপছে আমাকে। চোয়ালের আড়ষ্টতা কাটাবার ভঙ্গিতে প্রকাণ্ড মুখটা খুলল একবার, আমার মাংসের স্বাদ কেমন হবে ভেবে যেন নিঃশব্দে হাসছে।

বিরতি নেই, সেই একই দূরত্বে, একই গতিতে, আমাকে। মাঝখানে রেখে চক্কর মারছে সে। ওর সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছি আমি, ওর। অনায়াস সাবলীল গতির সঙ্গে তাল রাখার জন্য উন্মত্তের মত। পেডাল করছি ফিন দিয়ে।

ঘুরছি, এই ফাঁকে বেল্ট থেকে স্পেয়ার লাঙটা খুলে আমার বা কাঁধের হারনেসের সঙ্গে আটকে নিলাম। স্পিয়ারের হাতলটা বগলের নিচে শক্ত ভাবে এঁটে বসিয়ে নিয়েছি, মাথার দিকটা তাক করে রেখেছি উড়ন্ত দানবটার দিকে। নিঃসন্দেহে জানি, ওর যা। সাইজ, তাতে মুখে এক্সপ্লোসিভ স্পিয়ার দিয়ে আঘাত করলে ওকে শুধু খেপিয়ে তোলাই হবে, মারাত্মক ভাবে আহত করা বা ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। সুফল পেতে হলে ওর ব্রেনে আঘাত করতে হবে আমাকে।

প্রচণ্ড রাগ আর খিদে অস্থির করে তুলেছে ওকে। ব্লু ডাইয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা হয় ভুলে গেছে ও, নয়ত গ্রাহ্য করছে না। আঘাত করার জন্যে তৈরি হয়েছে ও, মুহূর্তটা স্পষ্ট চিনতে পারলাম আমি। লেজটা যেন শক্ত হয়ে গেল ওর, সেটা দিয়ে এক দফায় কয়েকটা প্রবল ঝাপটা মারল।

আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে, বুকের সঙ্গে সেঁটে ধরে রেখেছি স্কুবা সেটটা। অকস্মাৎ এক ঝটকায় এবং চোখের পলকে দিক বদল করল হাঙ্গরটা, চওড়া বৃত্ত ভেঙে সোজা ছুটে আসছে আমার দিকে।

মুখটা খুলে যাচ্ছে ওর, দুই চোয়ালের মাঝখানে মস্ত একটা গহ্বর দেখতে পাচ্ছি, চ্যাপ্টা আর ছুঁচালো ডগার দাঁত সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যখন লাগতে যাচ্ছে আঘাতটা, এক সেকেণ্ড বাকি থাকতে, স্কুবার জোড়া স্টীল বটল সামনের দিকে ঠেলে দিলাম আমি, ঢুকিয়ে দিলাম গহ্বরটার ভেতর।

সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল দুটো বন্ধ করল হাঙ্গরটা, বটল জোড়া আমার হাত থেকে ছুটে গেল, প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে একপাশে ছিটকে পড়লাম স্রোতে পড়া গাছের পাতার মত।

আবার যখন তাল সামলে নিজের চারদিকে তাকাচ্ছি, বিশ ফুট দূরে দেখতে পেলাম হাঙ্গরটাকে। ধীর গতিতে এগোচ্ছে, কিন্তু ইস্পাতের বটল দুটোকে নিয়ে সাংঘাতিক ব্যস্ত সে। বাচ্চা কুকুর যেভাবে স্যাণ্ডেল চিবায়, ঠিক সেইভাবে বটল জোড়ার ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছে বড়লাট।

কামড়ে জোর পাওয়ার জন্যে মাথা ঝাঁকাচ্ছে হাঙ্গরটা, এর এক একটা ঝাঁকিতে মাংসের বড় বড় টুকরো ছিঁড়ে নিতে অভ্যস্ত সে, কিন্তু এক্ষেত্রে তার বদলে রঙ করা ধাতব বোতলে গভীর দাগ তৈরি হচ্ছে শুধু।

সুযোগটা দেখতে পাচ্ছি আমি, এটাই আমার শেষ এবং একমাত্র সুযোগ। দ্রুত পেডাল করে ধূমকেতুর মত ওর চওড়া। নীল পিঠের ওপর উঠে এলাম, ওর দিকে নামতে শুরু করে ঘষা খেলাম লম্বা ডরসাল ফিনের সঙ্গে। পেছনের উঁচু আকাশ থেকে একটা হানাদার ফাইটার প্লেনের মত যেখানে ওর দৃষ্টি চলে না সেখানে নেমে যাচ্ছি।

নাগালের মধ্যে এসেই স্টীল স্পিয়ারের এক্সপ্লোসিভ হেডের ডগাটা ওর ঢেউখেলানো নীল খুলিতে চেপে ধরলাম শক্ত করে, ঠাণ্ডা এবং ভীতিকর হলুদ দুই চোখের ঠিক মাঝখানে। স্পিয়ারের হাতলে স্পিঙ বসানো ট্রিগারে আঙুল পেঁচিয়ে রেখেছি আগেই, এখন সেটা টেনে দিলাম শুধু।

কড়াক শব্দে কানের পর্দা কেঁপে উঠল আমার, মুঠোর ভেতর জোর একটা ঝাঁকি খেল স্পিয়ারটা। চমকে ওঠা বন্য ঘোড়ার মত পেছন দিকে লাফ দিল হাঙ্গরটা। ভাগ্য ভাল যে বিশাল শরীরের। সঙ্গে হালকাভাবে মৃদু একটু ধাক্কা খেলাম আমি, তবু তাতেই ছিটকে পড়লাম দূরে, ডিগবাজি খেলাম পর পর গোটা তিনেক। তাল সামলে নিতে আগের বারের চেয়ে এবার কম সময় লাগল আমার। তাকিয়ে দেখি, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে বড়লাট। বিধ্বস্ত ব্রন থেকে আক্ষেপের ঢেউ এসে মসৃণ চামড়ার নিচের পেশীগুলোকে মোচড় খাওয়াচ্ছে। গুটিয়ে যাচ্ছে তাল তাল মাংস, ফুলে ফেঁপে উঁচু ঢিপির মত আকার নিচ্ছে, পর মুহূর্তে থরথর করে কেঁপে উঠে সমান হয়ে যাচ্ছে শরীরের সঙ্গে। সেই সঙ্গে গোটা শরীর দুমড়ে মুচড়ে, বেঁকেচুরে যাচ্ছে।

দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করেছে এবার সে, ডাইভ দিয়ে নেমে। যাচ্ছে নিচের দিকে, বন বন করে ঘুরছে লম্বা শরীরটা। তীরবেগে। সোজা ছুটে গিয়ে পুলের পাথুরে মেঝেতে ধাক্কা খেল সংঘর্ষে প্রচণ্ডভাবে থেঁতলে গেল মুখটা। ড্রপ খেল, ঝুঁকির সঙ্গে উঠে এল খানিকটা, তারপর অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে কাত হতে শুরু করল।

লেজের ওপর ভর দিয়ে রয়েছে হাঙ্গরটা এখন। একটা মস্ত স্তম্ভ যেন। স্তম্ভটা ছোট ছোট লাফ দিয়ে দ্রুত এবং ঘন ঘন জায়গা বদল করে যাচ্ছে অবিরাম।

সসম্মান দূরত্ব রেখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। স্কু খুলে বিস্ফোরিত হেডটা ফেলে দিয়ে তার জায়গায় তাজা হেড ফিট করে নিয়েছি স্পিয়ারে।

হোয়াইট ডেথের দুই চোয়ালের মাঝখানে রাফেলার জোড়া এয়ার বটল দুটো আটকে রয়েছে এখনও। ওটা আমি হারাতে পারি না। দৃষ্টি দিয়ে এখনও ওর অনিশ্চিত, চঞ্চল গতি অনুসরণ করে যাচ্ছি আমি। অবশেষে এক জায়গায় স্থির হল ও। নাক ঠেকে আছে পুলের শক্ত মেঝেতে, খাড়া হয়ে ভাসছে চওড়া লেজের সাহায্যে। ধীর, সতর্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছি ওর দিকে আমি। ওর খুলিতে আরেকবার ঠেকালাম স্পিয়ারের ডগাটা।

কড়াক করে শব্দ হতেই লাফ দিয়ে পিছিয়ে এলাম আমি, ভয়ে ঢোক গিললাম একবার। কিন্তু হাঙ্গরটা নিজে থেকে নড়ছে না আর বিস্ফোরণের ধাক্কায় একবার শুধু ঝাঁকি খেয়েছে শরীরটা। কিন্তু এরপর সেটা আর খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে না। মন্থর গতিতে ঘুরছে, আর কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে পুলের মেঝেতে। এগিয়ে গিয়ে দুহাত দিয়ে স্কুবাটা ধরে টান মারলাম। কর্কশ কয়েকটা ধাতব শব্দ করে গহ্বর থেকে বেরিয়ে এল সেটা।

সঙ্গে সঙ্গে সেটটা পরীক্ষা করলাম আমি। এয়ার হোসগুলো ফুটো হয়ে গেছে কয়েক জায়গায়, গভীর কামড়ের দাগ ছাড়া তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বটল জোড়ার।

রাফেলা, রাফেলা-ওর নাম জপছি মনে মনে, দ্রুত উঠছি বাঁশঝাড়ের মাথার দিকে।

ওপর থেকে কোন বুদবুদ দেখতে পাচ্ছি না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। বাঁশঝাড়ের মাথার গর্ত দিয়ে নামার সময় দেখতে। পাচ্ছি রাফেলাকে। শেষ স্কুবা সেটটাও খালি হয়ে গেছে ওর, খুলে ফেলে দিয়েছে সেটা ও। বাতাস নেই, বাতাস নিচ্ছে না-ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে রাফেলা।

একটু একটু করে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবার মত এই রকম বিপদেও মাথা ঠিক রেখেছে ও, পানির ওপর উঠে যাবার আত্মহত্যাপ্রবণ চেষ্টা করছে না। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ও। মারা যাচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাস হারায়নি আমার ওপর।

<

Super User