আসছে সিডনি শেরিডান।
কেপটাউন থেকে ছয় দিন আগে রওনা হয়ে গেছে বুমেরাং। টেলিগ্রাম মেসেজটা পেয়ে ইচ্ছে হল এক্ষুনি ছুটে যাই কুলি পীক-এ, দিগন্তরেখায় চোখ বুলিয়ে দেখি বুমেরাং আসছে কিনা। কিন্তু নিজেকে শান্ত করলাম আমি, টেলিগ্রামটা রাফেলাকে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফ্রবিশার স্ট্রীটে চলে এলাম।
ঢ্যাঙা গোখলে রামাদীন তার ট্রাভেল এজেন্সির দরজা মাত্র খুলছে, মা এডির দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাবার সময় দেখতে পেলাম। কেনাকাটার একটা তালিকা সহ রাফেলাকে দোকানে ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে এগোচ্ছি আমি। জলকুমারীর ইনশিউরেন্সের টাকা বীমা কোম্পানিতে জমা দেয়নি বলে খুন করতে গিয়েও করিনি রামাদীনকে, এবং সেই থেকে ওর সঙ্গে দেখা নেই আমার।
ডেস্কের পেছনে বসে আছে ও। পরনে হাঙ্গরের চামড়ার স্যুট, নেকটাইয়ের গায়ে নারকেল গাছের সারি, সৈকত এবং দ্বীপবাসিনী এক যুবতীর নকশা ছাপা। ধূর্ত একটা হাসি লেপ্টে রয়েছে ঢ্যাঙার ঠোঁটে, যখন একা থাকে আপনমনে এই হাসিটাই হাসে সে। মাথা নিচু করে একটা পেপার-ওয়েট নাড়াচাড়া করছে, লাল পাথরটার গায়ে সাদা হরফে লেখা রয়েছে-ভারত মহাসাগরের মুক্তো সেন্ট মেরীতে স্বাগতম।
পায়ের আওয়াজ পেয়ে হাসিভরা মুখটা তুলল সে, কিন্তু আমাকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে অকস্মাৎ চেহারাটা রক্তশূন্য হয়ে গেল তার, ঝুলে পড়ল মুখটা। আতঙ্কিত একটা চিৎকার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, পায়ের ধাক্কায় ঠকাঠক নেচে চার হাত দূরে সরে গেল চেয়ারটা। আধপাক ঘুরেই পেছনের দরজার দিকে ছুটল সে। কিন্তু ততক্ষণে আমি ওর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছি। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। পিছু হটছে, করুণ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ছে। ঠোঁট দুটো নড়ছে দ্রুত, ব-ব-ব-ব শব্দ বেরিয়ে আসছে শুধু। হাঁটুর পেছনে চেয়ারটা ঠেকল, ধপ করে বসে পড়ল তাতে। এতক্ষণে মৃদু হাসলাম আমি। অনুভব করছি, স্বস্তিতে এখন ও জ্ঞান হারাতে পারে।
কেমন আছ, মিস্টার কবিরাজ?
উত্তর দিতে চেষ্টা করল ঢ্যাঙা রামাদীন, কিন্তু গলা থেকে–ছাড়া আর কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। তবে প্রচণ্ড বেগে মাথা নাড়তে দেখে বুঝলাম খুব ভাল আছে সে।
তোমার কাছে একটু সাহায্য চাইতে এসেছি আমি।
জান দিয়ে দেব, হঠাৎ কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল ঢ্যাঙা রামাদীন, ফ্রবিশার স্ট্রীটের শেষ মাথা পর্যন্ত যে-কেউ শুনতে পাবে তার এই চিৎকার। শুধু মুখ ফুটে উচ্চারণ করুন, এক্ষুনি করে দেব আপনার সব কাজ, স্যার, মিস্টার রানা।
ধীরে ধীরে শান্ত এবং সুস্থ হয়ে উঠছে রামাদীন, কান পেতে শুনছে তিন বাক্স বিস্ফোরকের জন্যে আমার অনুরোধ। আমি থামার আগেই মাথা নাড়তে শুরু করল সে, বোঝাতে চাইছে আমার এই অনুরোধ রক্ষা করা তার সাধ্যের বাইরে। কোটরাগত চোখ দুটো গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, টুপ টুপ করে ঝরে পড়তে বাকি শুধু। জিভ আর টাকরা সহযোগে হতাশাব্যঞ্জক বিচিত্র শব্দ উৎপাদন করে চলেছে সে।
তার এসব ভাবভঙ্গি দেখেও না দেখার ভান করে আমি বললাম, হাতে একেবারেই সময় নেই। বড়জোর কাল দুপুর পর্যন্ত সময় দিতে পারি তোমাকে। ওই সময়ের মধ্যে তিন বাক্স ওই জিনিস চাই আমার। যদি দিতে না পার, তুমি আর আমি ইনশিউরেন্স প্রিমিয়ামের বিষয়টা নিয়ে আবার আলোচনায় বসব…
দশটা আঙুল খাড়া করে হাত দুটো নেতিবাচক ভঙ্গিতে নাড়ছিল রামাদীন, আমার কথা শেষ হবার আগেই হাত দুটো কোলের ওপর পড়ে স্থির হয়ে গেল। চেহারায় বুদ্ধি এবং সদিচ্ছার ভাব ফুটে উঠল আবার।
তার কোন প্রয়োজন নেই, স্যার, মিস্টার রানা। আপনি যা চাইছেন তা বোধহয় আমি জোগাড় করে দিতে পারব-কিন্তু, ভয় করছি, বড় বেশি দাম পড়ে যাবে জিনিসগুলোর।
কত?
এক একটা কেস তিনশো ডলারের কম তো নয়ই, আমাকে আঁতকে উঠতে না দেখে সম্ভবত ডাবল দামটা কম চাওয়া হয়ে। গেছে, তাই দ্রুত সংশোধন করে নিল নিজেকে, বলল, আন্দাজে বলছি। পাঁচশো ডলারও হতে পারে।
লিখে রেখো। ধারে কিনতে চাইছি আমি।
স্যার, মিস্টার রানা! কান্না-করুণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ঢ্যাঙা রামাদীন। আমাকে বাঁচতে দিন, প্লীজ! কেউ ধার চাইলে আমি লজ্জায় মরে যাই…।
চুপ করে থাকলাম আমি। কিন্তু পরিবর্তে ভুরু কুঁচকে চোখ দুটো পাকালাম, দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল দুটো উঁচু করলাম এবং গভীর ভাবে বাতাস টেনে ফোলাতে শুরু করলাম বুকটা।
ঠিক আছে, ঠিক আছে! ব্যগ্র ব্যস্ততার সঙ্গে দ্রুত বলল রামাদীন। ওসবের কোন দরকার নেই, স্যার, মিস্টার রানা। আপনি আমার সম্মানিত খদ্দের। আপনাকে ধার দেব না তো কাকে দেব? যখন যা দরকার হবে মুখ ফুটে বলবেন শুধু তাহলেই পেয়ে যাবেন। একটু বিরতি নিয়ে মনে মনে বোধহয় যাচাই করল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলে ফেলছে কিনা, তারপর একটু হেসে বলল, তাহলে সেই কথাই রইল–আগামীকাল আপনি মালটা ডেলিভারি নেবেন, আর পরশু দিন দাম চুকিয়ে দেবেন।
কে বলেছে পরশু দিন টাকা দেব?
বলেননি? বিস্মিত দেখাল রামাদীনকে। তাহলে বোধহয় শুনতে ভুল হয়েছে আমার। ঠিক আছে, তার পরদিন…
এমাসের শেষ তারিখে পাবে, জানালাম ওকে। তার আগে চাইলে এক পয়সাও পাবে না।
বেশ তো, তাই হবে। না হয় আরও একমাস পরে দেবেন। আপনি তো আর টাকা মেরে দেবার মানুষ নন…।
চমৎকার! লোক তুমি ভালই, রামাদীন। শুধু পেচ্ছাব করে তাতে গড়াগড়ি খাবার একটা বদভ্যাস আছে, এই যা। যাই হোক, অনুরোধ রক্ষার জন্যে ধন্যাবাদ।
আপনার কাজ করে আনন্দ পাই, স্যার, মিস্টার রানা, আশ্বস্ত করল আমাকে ও। দারুণ আনন্দ পাই।
আর মাত্র একটা অনুরোধ, রামাদীন, বললাম ওকে। মনে মনে আঁতকে উঠল ও, টের পেলাম চেহারা দেখে, কিন্তু এক সেকেণ্ডের মধ্যেই অসম সাহসের সঙ্গে মুখে হাসি টানল।
আপনার অনুরোধে ঢেঁকি পর্যন্ত গিলতে পারি, স্যার, মিস্টার রানা।
অদূর ভবিষ্যতে সুইটজারল্যাণ্ডের জুরিখে একটা কার্গো পাঠাতে চাই আমি। আমাকে যেন কাস্টমসের ঝামেলায় পড়তে না হয়। কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ?
পানির মত, স্যার…
লাশ পাঠাবার অভিজ্ঞতা আছে তোমার? জানতে চাইলাম।
চোখ কপালে উঠে গেল রামাদীনের। স্যার, ঠিক কি বলতে চাইছেন…
দ্বীপে বেড়াতে এসে কোন টুরিস্ট যদি, ধরো, হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল, তার লাশটা ফেরত পাঠানো হয় কিনা? যদি হয়, কে পাঠায়?
আমি, একগাল হেসে বলল রামাদীন। কার্গো আনা-নেয়ার যাবতীয় বেসরকারী কাজ এই অধমকেই করতে হয়-মড়াকে মানুষ নয়, কার্গো হিসেবেই গণ্য করি আমি।
গুড! তাহলে কিভাবে কি করতে হয় সবই জানা আছে তোমার। একটা কাঠের তৈরি কফিনের ব্যবস্থা করে রাখ আমার জন্যে, ওটা কবে পাঠাতে হবে পরে তোমাকে জানাব আমি।
স্যার, মিস্টার রানা, আমি কি জানতে পারি ঠিক কি জিনিস রফতানি করতে চান আপনি?
তোমার লাশ নয় সেটা।
এটুকু জেনেই আমি সন্তুষ্ট, গম্ভীরভাবে বলল রামাদীন।
গাড়ি চালিয়ে দুর্গে চলে এলাম আমি। প্রেসিডেন্টের সেক্রিটারির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, মাননীয় প্রেসিডেন্ট বৈঠকে বসেছেন, তবে আমি যদি দুপুর একটায় তার অফিসে লাঞ্চ খেতে আসি তাহলে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে।
আমন্ত্রণটা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সময়টা কাটাবার জন্যে। কুলি পীক-এ উঠলাম যতদূর গাড়ি ওঠে, তারপর পায়ে হেঁটে পুরানো লুকআউট এবং সিগন্যাল স্টেশনের ধ্বংসাবশেষের দিকে এগোলাম। প্যারাপেটে বসে চুরুট ধরালাম একটা, দিগন্ত বিস্তৃত মহাসাগর আর সবুজ দ্বীপমালিকা দেখছি। এই সুযোগে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আর কর্ম পদ্ধতিগুলো খুঁটিয়ে আরেকবার বিশ্লেষণ করে নিচ্ছি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি আমি, জীবনের কাছ থেকে আপাতত তিনটে জিনিস চাওয়ার আছে আমার। দুনাম্বার জলকুমারী, রাফেলা এবং দ্বীপবাসীদের ভালবাসা। দ্বীপবাসীরা এমনিতেই যথেষ্ট ভালবাসে আমাকে, কিন্তু সেই ভালবাসা যদি হারাতে না চাই তাহলে দ্বীপের একটা উপকার করতে হবে আমাকে এবং বড় ধরনের একটা মহত্ত্বের পরিচয় দিতে হবে। দুনাম্বার জলকুমারী পেতে হলে প্রচুর নগদ টাকার দরকার হবে আমার। আর রাফেলা বার্ডকে পেতে হলে…এইখানে এসে হোঁচট খেল আমার চিন্তা। অনেকক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটালাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গড়াবে তা অনুমান করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলাম আমি। সাহসে বুক বাঁধো, রানা, নিজেকে পরামর্শ দিয়ে ফেলে দিলাম চুরুটটা। ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম।
গাড়ি নিয়ে দুর্গে ফিরে আসতেই সেক্রেটারি আমাকে জানাল মাননীয় প্রেসিডেন্ট আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন প্রেসিডেন্ট, অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে রিসেপশনে বেরিয়ে এসেছেন তিনি, আমার কাঁধে একটা হাত তুলে দেবার জন্যে পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে নাগাল পাবার চেষ্টা করছেন। তাকে সম্মান দেখিয়ে একদিকের কাঁধ যথাসম্ভব নিচু আর কাত করে রাখলাম আমি। তিনি আমাকে তার অফিসে নিয়ে এলেন।
রুচিসম্মতভাবে সাজানো অফিস কামরাটা বিশাল একটা হলরুমের মত। সিলিং থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি, দেয়ালে হাতির দাঁতের মোটা ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো ধোঁয়াটে তৈলচিত্র এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য। কাঁচের ডিম্বাকৃতি জানালাগুলো মেঝে থেকে উঠে সিলিং ছুঁয়েছে, সামনে দাঁড়ালে বন্দরটা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। কামরার মেঝেটা ইরানী কার্পেটে মোড়া।
জানালার সামনে ওক কাঠের কনফারেন্স টেবিলে সাজানো হল রাজকীয় লাঞ্চ। খেয়ে নয়, খাইয়ে তৃপ্তি পাবার দলে পড়েন। মাননীয় প্রেসিডেন্ট-সুতরাং আমার কোন প্রতিবাদে কান না দিয়ে অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে গেলেন তিনি। তিনজনের খাবার একা খেয়ে যখন শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে, তখন সবিনয়ে ক্ষমা চাইলাম আমি।
স্নেহ মাখা হাসির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আমাকে রেহাই দিলেন। বললেন, এবার, লক্ষ্মী ছেলে, বল দেখি, তোমার জন্যে কি করতে পারি আমি। বললাম।
.
বাড়ি ফিরে একটা চিরকুট পেলাম রাফেলার, বেগম রডরিকের সঙ্গে দেখা করতে গেছে সে। ঠাণ্ডা একটা বিয়ার নিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসলাম আমি। প্রেসিডেন্ট পিডলের সঙ্গে আমার আলোচনাটা আদ্যোপান্ত স্মরণ করলাম আরেকবার।
কোথাও কোন খুঁত নেই, ভাবলাম আমি। সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির কথা মনে রেখে সমস্ত ফুটো বন্ধ করতে পেরেছি আমি-শুধু একটা ছাড়া, গা বাঁচাবার জন্যে দরকার হলে ওটা ব্যবহার করব আমি।
.
মেইন ল্যাণ্ড থেকে রামাদীনস ট্রাভেল এজিন্সির ঠিকানায় বেলা। দশটার প্লেনে তিনটে কাঠের বাক্স এসে পৌঁছুল, সেগুলোর গায়ে রঙ দিয়ে লেখা-টিনজাত মাছ। নরওয়ের পণ্য।
টার্টল বে-তে ডেলিভারি নিলাম বাক্সগুলো। পিকআপের পেছনে তুলে ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে রাখলাম।
মাসের শেষ তারিখ পর্যন্ত, তাহলে, বিদায় নেবার আগে স্মরণ করিয়ে দিল আমাকে ঢ্যাঙা রামাদীন, স্যার, মিস্টার রানা। আপনাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না, আমিই ঠিক সময়ে এসে হাজির হব।
কাবলিওয়ালার মত? না, তার দরকার নেই। টাকাটা আমিই তোমাকে দিয়ে আসব-সময় হলে।
ঢোক গিলে কি যেন বলতে গিয়েও বলা উচিত হবে না ভেবে নিঃশব্দে বিদায় নিল রামাদীন।
প্রয়োজনীয় সব জিনিস ইতিমধ্যে প্যাক করে ফেলেছে রাফেলা। আমার একটা পুরানো শার্ট আর রঙ চটা জিনস পরেছে ও, ঢোলা আর হাস্যকর দেখাচ্ছে। প্যাক করা জিনিসপত্রের বাক্সগুলো গাড়িতে তুলতে সাহায্য করলাম ওকে আমি। তারপর উঠে বসলাম পিকআপে।
এপথে আবার ধনী হয়ে ফিরে আসব আমরা, ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে আশ্বস্ত করলাম রাফেলাকে।
নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে পাইনগাছের নিচে মেইন রোডে বেরিয়ে এলাম আমরা, তারপর বাক নিয়ে উঠতে শুরু করলাম পাহাড় সারির দিকে।
পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচানো পথ ধরে শহর আর বন্দরের মাথায় উঠে এসেছি, এই সময় প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, গড ড্যাম ইট! সেই সঙ্গে অকস্মাৎ ব্রেক কষলাম। রাস্তার সঙ্গে প্রচণ্ড ঘষা খেয়ে পিছলে গেল গাড়ির চাকা, পেছনের পাইনঅ্যাপলের ট্রাকটা সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে দ্রুত নেমে পড়ছে রাস্তা থেকে। ঝড়ের বেগে পাশ কাটিয়ে চলে গেল ট্রাকটা, জানালা দিয়ে গলা বের করা ড্রাইভারের অগ্নিমূর্তি দেখতে পেলাম পলকের জন্যে।
ড্যাশবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাফেলা, নিজেকে সিধে করে নেয়ার সময় চেঁচিয়ে উঠল সে, কি, কি হয়েছে?
দিনটা মেঘমুক্ত উজ্জ্বল-বাতাস এত স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার যে। ছবির মতো লাগছে আশ্চর্য সুন্দর সাদা আর নীল ইয়টটাকে। গ্র্যাণ্ড হারবারের প্রবেশ মুখে মেইল শিপ এবং প্রমোদতরীর জন্যে নির্ধারিত এলাকায় নোঙর ফেলে বসে আছে ওটা।
ইয়টের গায়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে রঙচঙে অসংখ্য সিগন্যাল ফ্ল্যাগ। সাদা স্যুট পরা ক্রুরা রেইল ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তীরের দিকে। পানি কেটে ইয়টের দিকে ছুটছে হারবার টেণ্ডার, বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হারবার মাস্টার, কাস্টমস ইন্সপেক্টর এবং ডাক্তার ডানিয়েলকে।
বুমেরাং? জানতে চাইল রাফেলা।
বুমেরাং এবং সিডনি শেরিডান, জানালাম ওকে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত নিচে নামছি আবার।
কি করবে তুমি এখন? জানতে চাইল রাফেলা।
আর যাই করি, ওরা যখন তীরে উঠবে আমি তখন সেন্ট মেরীতে থাকছি না।
পাহাড় থেকে নেমে প্রথম বাসস্টপের কাছে গাড়ি দাঁড় করালাম আমি। রাফেলাকে গাড়িতে রেখে কনফেকশনারি অ্যাণ্ড জেনারেল স্টোরে গিয়ে উঠলাম। ব্যবসাটা রডরিকের এক মামার। আমাকে দেখে কোন প্রশ্ন করল না সে, ঘাড় নেড়ে ভেতরের কামরায় যাবার অনুমতি দিল। শুধু ফোন করার প্রয়োজন হলেই এখানে আসি আমি।
রডরিকের নিজের ফোন নেই, কিন্তু পাশের বাড়িতে আছে। আমার কণ্ঠস্বর শুনে রডরিককে ডেকে আনল তারা।
রডরিক, ওকে বললাম আমি, মেইল শিপ মুরিংয়ে ওই ভাসমান ব্রথেলটা আমাদের জন্যে কোন সুখবর বয়ে নিয়ে আসেনি।
আমি কি বলতে চাইছি তা বুঝতে এক সেকেণ্ডের বেশি লাগল না রডরিকের। সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইল সে, বলে দাও কি করতে হবে।
ছুট লাগাও। পানির ক্যানগুলো স্ট্যাম্প নেট দিয়ে ঢেকে ফেল, যেন মাছ ধরতে যাচ্ছ। সাগরে বেরিয়ে এসে ঘুরপথে চলে এসো টার্টল বে-তে। সৈকত থেকে মালপত্তর তুলব আমরা হোয়েলবোটে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে রওনা দেব গানফায়ার রীফের দিকে।
দুঘন্টার মধ্যে বে-তে পৌঁছাচ্ছি, বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সে।
দুঘন্টা নয়, এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল রডরিক। ওর এই সময় জ্ঞানের জন্যে ভালবাসি ওকে আমি। সময় উল্লেখ করে আসবে বলে যদি কথা দেয়, ওর কথার ওপর সারা জীবনের সঞ্চয় বাজি ধরা যায়।
সূর্য ডোবার পর অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। হোয়েলবোট নিয়ে যখন রওনা দিলাম তখন একশো গজ দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। টার্টল বে থেকে বেরিয়ে দ্বীপ থেকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে এসেছি, এই সময় চাঁদ উঠল আকাশে।
তারপুলিনের নিচে রাখা একটা জেলিগনাইটের বাক্সের ওপর বসে রাফেলা আর আমি বুমেরাংয়ের উদয় সম্পর্কে আলোচনা করছি।
সিডনি শেরিডান কি করবে এখন? জানতে চাইছে রাফেলা।
পকেট ভর্তি টাকা দিয়ে তার ছেলেছোকরাদেরকে তথ্য সংগ্রহের জন্যে পাঠাবে, বললাম আমি। দোকান এবং বারগুলোয় ঢুকে পশ্ন করবে ওরা-কেউ মাসুদ রানাকে দেখেছ?
উত্তরে কি বলবে সবাই?
উত্তর দেবার জন্যে লাইন দেবে দ্বীপবাসীরা, বললাম আমি। প্রথমে ওরা দুঃখের সঙ্গে জলকুমারীর দুর্ভাগ্য বর্ণনা করবে। তারপর বলবে, বেচারা মাসুদ রানা তার ক্রু রডরিকের হোয়েলবোট ভাড়া নিয়ে সী-শেল খোঁজার জন্যে ডাইভ দিয়ে বেড়ায় এখন। এর মধ্যে কেউ একজন ওদেরকে ঢ্যাঙা রামাদীনের কাছে যেতে বলবে আরও তথ্যের জন্যে। এবং ঢ্যাঙা রামাদীনকে ওরা যদি যথেষ্ট সালাম দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারে, গড় গড় করে বলে দেবে সে।
এরপর কি করবে সিডনি শেরিডান?
সেভার্নে ডুবে আমি মারা যাইনি বুঝতে পেরে হার্টে একটু ব্যথা অনুভব করতে পারে সে। ব্যথাটা কমলে টার্টল বে-তে আমার আস্তানা সার্চ করার জন্যে লোক পাঠাবে। ওখানে মস্ত একটা শূন্যতা ছাড়া কিছুই পাবে না সে। এরপর প্রিয়তমা লোরনা পেজ তাকে পথ দেখিয়ে বিগ গাল আইল্যাণ্ডের জলসীমায় নিয়ে। যাবে, মুঘল সম্রাটদের ব্যাঘ-সিংহাসন উদ্ধারের আশায়। ওখানে দুটো দিন কাটবে ওদের। তারপর বুঝতে পারবে ভোরের আলোর বেলটা ছাড়া ওখানে কিছু ছিল না এবং নেই।
তারপর?
তারপর? তারপর সম্ভবত উম্মাদ হয়ে উঠবে সিডনি। সম্ভবত প্রিয়তমাকে কিছু নির্যাতনও সইতে হতে পারে। এরপর ঠিক কি ঘটবে, আমি জানি না। শুধু জানি, চোখের আড়ালে থেকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কর্নেল গুডচাইল্ডের শখের ধন-সম্পদ উদ্ধার করতে হবে আমাদেরকে।
.
পরদিন স্রোতের মতিগতি সুবিধের না হওয়ায় সকালের শেষ। ভাগের আগে চ্যানেলে ঢুকতে পারা গেল না। এই সময়টুকু হাতে পেয়ে সুবিধেই হল, প্রস্তুতিপর্বের কিছু কাজ বাকি ছিল, সেগুলো সেরে নিতে পারলাম আমরা।
জেলিগনাইটের বাক্স খুলে দশটা হলুদ স্টিক বের করে নিলাম আমি। বাক্সটা বন্ধ করে বাকি দুটোর সঙ্গে, ক্যাম্পের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে, বেলেমাটির নিচে পুঁতে রাখলাম। এরপর রডরিককে বিস্ফোরক সরঞ্জামগুলো সাজিয়ে এবং চেক করে নিতে বললাম।
এটা-সেটা দিয়ে হাতে তৈরি একটা ব্যবস্থা, কিন্তু এর সাহায্যে অনেকবার বিস্ফোরণ ঘটাতে সফল হয়েছি আমরা। সরঞ্জাম বলতে সাধারণ একটা সুইচবক্সের ভেতর নাইনভোল্টের দুটো ট্রানজিস্টার ব্যাটারি, চার রীল হালকা ইনসুলেটেড কপার অয়্যার এবং চুরুটের একটা বাক্স ভর্তি ডিটোনেটর। প্রতিটি সিলভার টিউব যত এবং সতর্কতার সঙ্গে তুলো দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। বাক্সে বাছাই করা কিছু পেন্সিল আকৃতির টাইম ডিলেড ডিটোনেটরও রয়েছে।
এগুলো নিয়ে কাজ করার সময় রাফেলা আর ল্যাম্পনিকে সরিয়ে দিলাম আমরা। ইলেকট্রিক ডিটোনেটরগুলো হাতে তৈরি টার্মিনালে বেঁধে আটকে নিলাম অত্যন্ত সাবধানে।
শক্তিশালী বিস্ফোরক ব্যবহার করার নিয়মটা পানির মত সহজ, কিন্তু একজন বুদ্ধিমান লোক যখন জিনিসটা ব্যবহার করতে যায় তখন তার স্নায়ুর ওপর হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করে। এমন কি এক নাম্বারের একটা গাধাও তারের সংযোগ ঘটিয়ে বোতামে চাপ দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে, কিন্তু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এর কাছ থেকে ষোলো আনা কাজ নিপুণভাবে আদায় করার কৌশল রপ্ত করা অত সহজ নয়। নিখুঁত বিস্ফোরণ ঘটানো সাংঘাতিক কঠিন কাজ, তাই এটা একটা শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
আধ-বাক্স জেলিগনাইটের বিস্ফোরণ হজম করে মাঝারী আকারের একটা গাছকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি। গাছটা তার সব পাতা আর উল্টোদিকের কিছু ছাল হারিয়েছিল শুধু। কিন্তু মাত্র একটা স্টিকের অর্ধেকটা দিয়ে ওই গাছটাকেই আমি রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ভঙ্গিতে ধরাশায়ী করতে পারি, তাতে যানবাহন চলাচলের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে রাস্তাটা। শুধু তাই নয়, গাছটা থেকে একটা পাতাও খসবে না। ঠাট্টা বা গর্ব করছি না, এ ব্যাপারে নিজেকে আমি একজন শিল্পী বলে মনে করি। এ ব্যাপারে যতটুকু জানি আমি, তার সবটুকু শিখিয়েছি রডরিককে। বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর ওর দুর্বলতা জন্মগত, কিন্তু কায়দা কানুন যতই শেখাই, শিল্পী ও কোনদিনও হতে পারবে না। গোটা ব্যাপারটাকে হালকা ভাবে নেয় ও, মজার একটা বিষয় বলে মনে করে। ডিটোনেটর নিয়ে কাজ করার সময় আনন্দে প্রলাপ বকতে শুরু করে দেয়।
দুপুরের খানিক আগে পুলে ঢুকে পজিশন নিলাম আমরা। পানিতে আমি একা নামলাম, সঙ্গে নিলাম শুধু একটা নেমরড এয়ার স্পিয়ার গান। স্পিয়ার গানের মাথার দিকটা আমার নিজের ডিজাইনে তৈরি। শেষ প্রান্তটা সূচের মত ছুঁচালো, এবং প্রথম ছয়। ইঞ্চি সরু ইস্পাতের কাটায় ভর্তি। তীক্ষ্ণ-মুখো মোট চব্বিশটা খুদে কাটা রয়েছে ওখানে, ওগুলোর পেছনে ক্রস-চিত্রে ভঙ্গিতে আটকানো হয়েছে একটা চার ইঞ্চি লম্বা ইস্পাতের রড, যাতে আমি যখন স্পিয়ার গানের অপর প্রান্তটা ধরে থাকব তখন যেন আহত প্রাণীটা পিছলে এসে আমাকে আঘাত করতে না পারে। গানের সঙ্গে রয়েছে পাঁচশো পাউণ্ড টেস্টের নীল নাইলনের লাইন, এই লাইনের একটা বিশ ফুট লম্বা লুপ রয়েছে ব্যারেলের নিচে।
ফিন পরা পা দিয়ে প্যাডেল করে নেমে এলাম বেঢপ ভাবে। ফুলে থাকা ভোরের আলোর খোলের কাছে। গানপোর্টের পাশে এক জায়গায় দাঁড়ালাম আমি, চোখে অন্ধকার সইয়ে নেবার জন্যে। পাতা দুটো বুজে থাকলাম কয়েক সেকেণ্ড।
চোখ খুলে সাবধানে উকি দিয়ে তাকালাম চারকোণা অন্ধকার গহ্বরটার ভেতর, আমার সামনে বাড়িয়ে ধরেছি স্পিয়ার গানের ব্যারেলটা।
মস্ত চাকার মত কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে গানপোর্টের ভেতর মোরে ঈলটা-কালো, চকচকে আর পিচ্ছিল দেখাচ্ছে তাকে। আমার সাড়া পেয়ে নড়ে উঠল সে, পঁাচ ছাড়াচ্ছে শরীরের। হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে পিছিয়ে যাচ্ছে, ভীতিকর অসমান হলুদ দাঁতগুলো বের করে ভয় দেখাচ্ছে আমাকে। তার চোখ দুটো কালো আর উজ্জ্বল, অন্ধকারে বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বল করছে।
সাপের মত ঈল মাছটা আমার উরুর সমান চওড়া, লম্বায় সাত ফুটের কম না। দাঁত বের করে আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে যখন, তার ডরসাল ফিনের ঢেউখেলানো ঝুঁটি শক্ত আর খাড়া হয়ে উঠছে প্রচণ্ড রাগে।
ইতিমধ্যে গানপোর্টের পাশ থেকে বেরিয়ে এসে চারকোণা মুখের সামনে দাঁড়িয়েছি আমি। সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্যস্থির করার চেষ্টা করছি, কিন্তু মাথাটা আরেকটু তুলে একদিকে সামান্য একটু ঘোরানো পর্যন্ত বারবার ঢোক গিলে অপেক্ষা করছি আমি। গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে আমার। মাত্র একটা শট ছুঁড়তে পারব আমি, সেটা যদি জায়গা মতো লেগে ওটাকে কাবু করতে না পারে, এক নিমেষে উড়ে চলে আসবে আমার দিকে। ছোবল মেরে ডিঙি নৌকার কাঠের কিনারা দাঁত দিয়ে কামড়ে ভেঙে ফেলতে দেখেছি আমি আহত একটা মোরে ঈলকে। ওর ওই ধারাল দাঁত রাবার স্যুট আর মাংস ছিঁড়ে অনায়াসে পৌঁছে যাবে হাড়ের কাছে।
মন্থর ছন্দে দুলছে মাছটা, ফণা তোলা কেউটের মত নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে আমার হাবভাব। লক্ষ্যভেদ করার জন্যে দূরত্বটা আরও কমিয়ে আনতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু একবার যখন ওর চোখে পড়ে গেছি, ওর দিকে এগোবার চেষ্টা করা স্রেফ বোকামি হবে এখন।
আরও কয়েক সেকেণ্ড পর প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। আক্রমণের দ্বিতীয় লক্ষণ প্রকাশ পেতে দেখলাম ওর মধ্যে। গলাটা অকস্মাৎ ফুলিয়ে মাথাটা সামান্য একটু ঘোরাল ও, ফলে মুখের একটা পাশ দেখতে পেলাম এতক্ষণে আমি।
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে, তার কারণ এর আগে একবার মাত্র খেলাচ্ছলে অস্ত্রটা ব্যবহার করেছি আমি। ট্রিগার টেনে ধরতেই প্রচণ্ড হিস করে উঠল গ্যাস, সশব্দে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে গেল প্লাঞ্জারটা, ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে দিল স্পিয়ারটাকে। লম্বা একটা রেখা তৈরি করে ছুটছে স্পিয়ার, চাবুকের মত দুলছে পেছনে লাইনটা।
মাছটার খুলির একটু পেছনে কান আকৃতির কালো একটা। দাগের ওপর লক্ষ্য স্থির করেছি, লক্ষ্যভেদ করলাম দুই ইঞ্চি ডান দিক ঘেঁষে, দেড় ইঞ্চি ওপরে। কেউ যেন বোতামে চাপ দিয়ে ইলেকট্রিক চরকিটাকে ঘুরিয়ে দিল, বিদ্যুৎগতিতে কয়েকবার পাক খেল মোরে ঈল। মোচড় খেয়ে লম্বা শরীরটা কয়েক জায়গায় গোল রিঙ-এর মত কুণ্ডলী পাকিয়ে গেল, রিঙগুলো চোখের পলকে ছুটোছুটি করছে গোটা গানপোর্ট জুড়ে। গানটা ফেলে ফিন দিয়ে পেড়াল মেরে সামনে এগোলাম দ্রুত। চঞ্চলভাবে আঁকি। খাচ্ছে স্পিয়ারের হাতলটা, কয়েকবার চেষ্টা করে সেটাকে মুঠোয় ধরতে পারলাম আমি। কাঁটা বসানো স্পিয়ারের মাথার সঙ্গে মোটা চামড়া আর রাবারের মত পেশী আটকে গেছে-হাতল ধরে। পিছিয়ে আসছি আমি, টেনে বের করে আনছি ওকে ওর আশ্রয় থেকে।
নিঃশব্দ আক্রোশে মুখ হাঁ করে রয়েছে ঈলটা, রিঙ-এর জট খুলে গেল, প্রচণ্ড আক্ষেপে মোচড় খাচ্ছে শরীরটা ঝড়ে পড়া একটা যুদ্ধ জাহাজের মত।
মাথাটা সরিয়ে নিতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই প্রচণ্ড একটা ঝাপটা খেলাম লেজের, ধাক্কা লেগে মুখ থেকে সরে গেল। মাস্কটা। নাক এবং চোখে পানি ঢুকে গেছে। কয়েক সেকেণ্ড। কিছুই দেখতে পেলাম না। মাথা ঝাঁকাচ্ছি। ঈলটা প্রচণ্ড শক্তিতে। আছাড় খাচ্ছে এলোপাতাড়ি ভাবে। স্পিয়ারের হাতলটা ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইছে মুঠো থেকে। এক হাতে মাস্কটা আবার জায়গা মত বসিয়ে নিয়ে ওপর দিকে উঠে আসতে চেষ্টা করছি আমি। কোন বাধাই পাচ্ছি না, আমার সঙ্গে সঙ্গে স্পিয়ারের কাঁটাবহুল মাথায় আটকে থাকা ঈলটা দিব্যি উঠে আসছে। দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে আসছে আমার। এই সময় দেখলাম ঈলটা অদ্ভুত এক মোচড় দিয়ে পেছন দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে তার মাথা, ভীতিকর হ করা মুখের ভেতর স্পিয়ারের ধাতব অংশটা নিয়ে চোয়াল দুটো বন্ধ করছে। ইস্পাতের গায়ে দাঁত ঘষা খাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। আমি। পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে ইস্পাতের রডটা, আবার খপ করে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে নিচ্ছে সেটা। কামড়ে ধরা জায়গাগুলোর ছাল উঠে গেছে, উজ্জ্বল রূপালী দাগ ফুটে উঠেছে।
আমার শিকারটা উঁচু করে ধরে পানির ওপর ভেসে উঠলাম আমি। সাপের মত সামুদ্রিক দানবটাকে পানির ওপর মোচড় খেতে আর আড়মোড়া ভাঙতে দেখে আতঙ্কে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল রাফেলার গলা থেকে। কিন্তু আনন্দে আর আহ্লাদে আটখানা হল রডরিক।
বাপজানের কাছে চলে এসো, লোভে চকচক করে উঠল রডরিকের চোখ দুটো, ঝুঁকে পড়ে স্পিয়ারটা ধরে হোয়েলবোটে তুলে নিল ঈলটাকে ও। মুখের মাংস ভাঁজ খেয়ে উল্টে যাচ্ছে, বুলডগের মত কুৎসিত দেখাচ্ছে চেহারাটা-ওর সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য এই মোরে ঈল। গানের সঙ্গে বাইন মাছটার ঘাড় চেপে রেখে বেইট নাইফ দিয়ে নিপুণভাবে বিশাল দানবটার ধড় থেকে মুণ্ডটা আলাদা করে ফেলল ও, ঝপাৎ করে পানিতে পড়ল সেটা।
মিস রাফেলা, ম্যাডাম, অত্যন্ত সম্মান দেখিয়ে বলল রডরিক, আপনিই প্রথম এ স্বাদ গ্রহণ করবেন। জীবনে ভুলতে পারবেন না।
মাগো! শিউরে উঠল রাফেলা। রক্তাক্ত বীভৎস প্রাণীটার কাছ থেকে আরও একটু পিছিয়ে গেল সে।
আর দেরি নয়, জেলিগনাইট নিয়ে এসো, তাড়া দিলাম আমি।
ক্যারি-নেটটা ধরিয়ে দিল আমার হাতে ল্যাম্পনি। ইনসুলেটেড রীল হাতে নিয়ে পানিতে নামল রাফেলা, নিচে নামার সময় তার ছাড়ছে ও।
সোজা গানপোর্টের কাছে নেমে এলাম আমি। ভেতরে ঢুকে জায়গাটা আরেকবার পরীক্ষা করে নিলাম। পেছনের প্রবাল। টুকরোর স্কুপের সঙ্গে শক্তভাবে আটকে গেছে কামানের ব্রীচ। বিস্ফোরণ ঘটাবার জন্যে দুটো জায়গা বেছে নিলাম আমি। ধাক্কা খাইয়ে একপাশে সরিয়ে দিতে চাই কামানটাকে, চাই প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ির মত ঘা মেরে প্রবালের সঙ্গে জমাট বেঁধে আটকে যাওয়া একটা প্ল্যাঙ্ক ভেঙে ফেলুক। একই সঙ্গে প্রবাল জঞ্জালের। প্রাচীরটা ভাঙবে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ, গানডেকে ঢোকার পথটা। উন্মুক্ত হয়ে যাবে তাতে।
জেলিগনাইটের টুকরো দুটো দুজায়গায় শক্তভাবে বেঁধে দিলাম তার দিয়ে। রাফেলার কাছ থেকে লাইনের শেষ প্রান্ত নিয়ে সাইড কাটার দিয়ে চেঁছে কপার অয়্যার বের করলাম, সেটা আটকে দিলাম টার্মিনালের সঙ্গে।
সব ঠিক আছে কিনা খুঁটিয়ে আরেকবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে এলাম গানপোর্ট থেকে খোলের ওপর। পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে রাফেলা, কোলের ওপর পড়ে রয়েছে রীলটা। ফেলে রাখা স্পিয়ার গানটা তুলে নিয়ে সিগন্যাল দিলাম ওকে। উঠতে শুরু করলাম আমরা।
হোয়েলবোটে উঠে এসে দেখি একটা খেলনার মত ব্যাটারি সুইচবক্স নিয়ে গলুইয়ে বসে আছে রডরিক। ইতিমধ্যে তার সংযোগের কাজও সেরে ফেলেছে ও। এখন আরও কদর্য। দেখাচ্ছে ওকে, তার মানে বিস্ফোরণ ঘটাবার এই সুযোগটাকে ঈল মাছ খেতে পাওয়ার চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক বলে মনে করছে ও। এখন যদি সুইচবক্স ছেড়ে উঠে আসতে বলি ওকে, কোন সন্দেহ নেই, আমার সঙ্গে মারামারি বাধিয়ে দিতেও দ্বিধা করবে না ও।
দিই ফাটিয়ে, মাসুদ?
দাও, মৃদু কণ্ঠে বললাম ওকে। কিন্তু যা ভেবেছি, তাই। একচুল নড়ছে না রডরিক, মুখে অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুইচবক্সের বোতামটার দিকে। তারপর বোতামটার গায়ে একটা কালো মোটা আঙুলের ডগা ছোয়াল সে। আঙুলটা আলতোভাবে বোতামের গায়ে বুলাচ্ছে। তার এই আদরের ঘটা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, এবং বিরক্তি প্রকাশ করে কোন লাভ নেই জেনে চুপ করে আছি, অপচয় হতে দিচ্ছি কয়েকটা মূল্যবান সেকেণ্ড।
শেষ পর্যন্ত ঝোকটা সামলাতে পারল না রডরিক, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল বোতামটা।
অকস্মাৎ মাথাচাড়া দিয়ে কেঁপে উঠল পুলের পানি, ধাক্কা খেয়ে দুলে উঠল হোয়েলবোট। কিছুক্ষণ পর রাশ রাশ বুদবুদ ভেসে উঠল পানির ওপর। স্যুটের ট্রাউজারটাও এবার পরে নাও, রাফেলা, ওকে বললাম আমি।
কেন? তর্ক জুড়ে দিল ও। তোমার কি ধারণা বিস্ফোরণের ফলে পানি গরম হয়ে গেছে?
দস্তানা এবং জুতোও পরতে হবে, রাবারের ফুল প্যান্টটা নিজের পায়ে গলিয়ে নিয়ে আবার বললাম ওকে। খোলটা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, এবারের ডাইভেই ভেতরে ঢুকব আমরা। চোখা কিছুর সঙ্গে ঘষা লাগতে পারে, তাই সাবধান হবার দরকার আছে।
তর্ক করার পুরোপুরি ইচ্ছে থাকলেও হাতে কোন যুক্তি নেই দেখে অবশেষে আমার কথা মেনে নিল রাফেলা। সামনে একরাশ কাজের বোঝা দেখতে পাচ্ছি আমি-ওকে ট্রেনিং দিয়ে আমার ঘর করার উপযুক্ত করে তুলতে বেশ সময় লাগবে, ভাবলাম।
আণ্ডারওয়াটার টর্চ জেনি বার আর হালকা নাইলনের এক কয়েল লাইন চেয়ে নিলাম ল্যাম্পনির কাছ থেকে। ওদিকে টাইট রাবার প্যান্টটা টানাটানি করে ওপরে তুলতে হিমশিম খাচ্ছে রাফেলা। শেষপর্যন্ত হার মানল ও, অসহায়ভাবে তাকাল ল্যাম্পনির দিকে। বিশ্বস্ত ক্রীতদাসের মত এগিয়ে এসে ওকে সাহায্য করছে ল্যাম্পনি। কাজটা শেষ হতেই বোতাম আটকে নিল রাফেলা, আমার দিকে ফিরে বলল, রেডি।
পানিতে নেমে অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছি, এই সময় ঝাপসা নীল গভীরে চিৎ হয়ে ভেসে থাকা প্রথম মরা মাছের দেখা পেলাম আমরা। বিস্ফোরণে কয়েক হাজার মাছ হয় মারা গেছে, নয়ত অবশ অচেতন হয়ে গেছে, এদের মধ্যে রয়েছে কড়ে আঙুলের সমান চুনো থেকে শুরু করে দুই হাত লম্বা ডোরাকাটা স্ন্যাপার আর রীফ-ব্যাস। হত্যাযজ্ঞের নমুনা দেখে বিষাদে ভরে উঠল। মনটা, কিন্তু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে যত মাছ মেরেছি তা একটা ব্লুফিন টানির একদিনের খোরাকও নয়।
ঝক ঝক মরা মাছের ভেতর দিয়ে নামছি আমরা, অন্ধকার রাতের আকাশে নিষ্প্রভ তারার মত চারদিকে হঠাৎ জ্বলে উঠছে মাছদের চোখ। পুলের তলাটা বালু-কণা আর অন্যান্য জঞ্জালের। গুড়োয় ঘোলা দেখাচ্ছে। বাঁশঝাড়ের মাথার এক জায়গায় গভীর একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে বিস্ফোরণের ফলে, সেটার ভেতর দিয়ে নামছি আমরা।
নজর বুলিয়েই বুঝলাম যা চেয়েছিলাম তাই ঘটেছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় খোল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে কামানটা, গানপোর্টের প্রাচীন চোয়াল থেকে পোকায় খাওয়া দাঁতটা সম্পূর্ণ উপড়ে নিয়েছে। ছিটকে এসে কামানটা পুলের মেঝেতে পড়েছে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা প্রবাল জঞ্জালের মাঝখানে।
গানপোর্টের ওপরের ঠোঁট ভেঙে যাওয়ায় গর্তটা আরও বড় হয়েছে, একজন মানুষ ওখানে এখন সিধে হয়ে দাঁড়াতে পারবে। গর্তটার ওদিকে টর্চের আলো ফেললাম, কিন্তু ভাসমান জঞ্জালের গুড়ো আর বালুকণা ভর্তি ঘোলা পানিতে দৃষ্টি চলে। এই ময়লা থিতিয়ে পড়তে আরও সময় নেবে। কিন্তু অতক্ষণ ধৈর্য ধরতে রাজি নই আমি। খোলের মাথায় বসে সময় আর এয়ার রিজার্ভের হিসেব মেলাচ্ছি। এর আগে দুবার ডাইভ দেয়ায় এবার ডিকমপ্রেশনের জন্যে অতিরিক্ত সময় দিতে হবে আমাদেরকে, সেকথা মনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, হাতে আমাদের এখনও নিরাপদ সতেরো মিনিট সময় রয়েছে। রিস্টওয়াচের সুইভেল রিঙটা সেট করে ভোরের আলোর ভেতরে ঢোকার প্রস্তুতি নিলাম আমি।
রাফেলাকে জায়গা ছেড়ে নড়তে নিষেধ করে নাইলন লাইনের শেষ প্রান্তটা বাধলাম ছিটকে পড়া কামানের সঙ্গে, তারপর পেছনে লাইন ছাড়তে ছাড়তে আবার উঠে এলাম গানপোর্টের খোলা মুখের কাছে। নিষেধ মানেনি রাফেলা, গানপোর্টের ভেতর দিয়ে ঢুকে খোলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে ও। রেগেমেগে হাত নেড়ে বেরিয়ে আসতে বলছি ওকে, কিন্তু জেদের বশে পাল্টা হাত নেড়ে পরিষ্কার জানাচ্ছে, আমার কথা শুনতে রাজি নয় ও। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে কারাতের একটা মারের ভঙ্গি দেখিয়ে হুমকি দিতে হল ওকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে এল বটে, কিন্তু স্লেটে লিখতে ভুলল না–এই অন্যায়ের বিচার করবে রডরিক।
সাবধানে গানপোর্টের ভেতর ঢুকছি আমি, ঘোলা পানিতে তিন ফুটের বেশি দৃষ্টি যাচ্ছে না। বিস্ফোরণের ফলে কামানের পেছন দিকে যে বাধাটা ছিল সেটার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। একটা ফাঁক দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে হলে আরও বড় করতে হবে ওটাকে। জেনি বার-এর সাহায্যে ধ্বংসস্তুপের বড় কয়েকটা টুকরো সরাবার পর দেখলাম ভারি গান ক্যারেজটাই আসলে প্রধান বাধা তৈরি করছে।
সদ্য বিস্ফোরণে ধসে পড়া স্থূপে কাজ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক, জানার কোন উপায়ই নেই কিসের ওপর স্থির হয়ে আছে গোটা ব্যাপারটা, আঙুলের একটু ছোয়া বা পানির একটু ধাক্কায় হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর নেমে আসবে কিনা।
কাজ করছি ধীর-স্থির ভাবে, আমার শিড়দাঁড়ার নিচের দিকের। শেষ গিটে তালু দিয়ে বারবার অসহিষ্ণু চাপ দিচ্ছে রাফেলা, কিন্তু গ্রাহ্য করছি না। একবার টুকরো কয়েকটা প্ল্যাঙ্ক নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি, রাফেলা দ্রুত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার স্লেটে লিখল-আকারে ছোট আমি! ছোট শব্দটার নিচে দুটো রেখা টেনেছে ও, যাতে জোড়া বিস্ময়বোধক চিহ্নটা আমার নজর এড়িয়ে না যায়। উত্তরে আবার কারাতের কোপ দেখালাম ওকে। পরিষ্কার দেখলাম মাস্কের ভেতর মুখ ভেঙচাচ্ছে ও।
এর মধ্যে জায়গাটা মোটামুটি পরিষ্কার করে ফেলেছি, ঢোকার পথে এখন একমাত্র বাধা ভারী গান ক্যারেজটা, গান ডেকের প্রবেশপথে আড়াআড়ি ভাবে একটু কাত হয়ে ঝুলছে সেটা। এর বিরুদ্ধে জেনি বারটার করার কিছুই নেই। হয় আমাকে ফিরে গিয়ে জেলিগনাইট নিয়ে আসতে হয় আগামীকাল, নয়ত একটা ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারি এখনই একবার।
রিস্টওয়াচে চোখ রেখে জানলাম বারো মিনিট খরচ করে ফেলেছি এরই মধ্যে। তাছাড়া, এবারে নিচে নেমে অন্যান্য বারের তুলনায় কিছু বেশি বাতাস টানছি আমি। তবু ঠিক করলাম এখনই একটা চেষ্টা করে দেখব।
টর্চ আর জেনি বার রাফেলাকে দিয়ে আবার ঢুকলাম গানপোর্টে। গান ক্যারেজের ওপরের প্রান্তের নিচে কাঁধ ঠেকালাম, পা নেড়ে চেড়ে খুঁজে নিলাম শক্ত একটা জায়গা। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, তারপর চাপ দিতে শুরু করলাম কাঁধ দিয়ে।
ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছি, আমার পা আর পিঠের পেশী লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে। মুখ আর গলায় রক্ত উঠে এসে গরম করে তুলেছে চামড়া, অনুভব করছি, কোটর ছেড়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্যে তৈরি হয়ে গেছে চোখ দুটো। একচুল নড়ছে না গান ক্যারেজটা। নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বুক ভরে নিলাম বাতাসে, আবার চেষ্টা করলাম, এবার টিম্বার বীমে আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে চাপ দিলাম।
কাঁধে প্রচণ্ড চাপ, তারপরই ঢিল অনুভব করলাম। কাজ হয়েছে। ভারসাম্য হারিয়ে পেছন দিকে ডিগবাজি খেলাম আমি, হুড়মুড় করে সশব্দে নেমে আসছে আমার ওপর প্রবাল জঞ্জাল।
পতনের শব্দ থামল এক সময়। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ঘিরে রেখেছে আমাকে। প্রবাল গুড়ো আর পচা কাঠের ঘন কাদার ঘোলা পানিতে আলো ঢুকতে পারছে না। নড়তে চেষ্টা করলাম আমি, সঙ্গে সঙ্গে পায়ের আঙুল থেকে মাথার খুলি পর্যন্ত হিম হয়ে গেল ভয়ে। কিসে যেন আটকে গেছে আমার একটা পা, নড়াতে পারছি না। উন্মত্তের মত ছুঁড়তে চেষ্টা করছি পা-টা। আতঙ্কে ভোতা হয়ে গেছে আমার অনুভূতি, ছয়বার পা ছোড়ার পর আবিষ্কার করলাম এর আগেই কপাল গুণে মুক্ত হয়ে গেছে পাটা। গান ক্যারেজটা সিকি ইঞ্চির জন্যে ছুঁতে পারেনি আমার পা, পড়েছে আমার রাবার সুইমিং ফিনের ওপর। জুতো থেকে টেনে বের করে নিলাম পা, অন্ধকারে পথ হাতড়ে ফাঁকটা দিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে।
খবরের জন্যে ব্যগ্রভাবে অপেক্ষা করছে রাফেলা। স্লেটে লিখলাম-পথ হয়েছে!! শব্দ দুটোর নিচে দুটো রেখা টানলাম। গানপোর্টের দিকে হাত তুলল ও, ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইছে। রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। আরও দুমিনিট আছে হাতে। মাথা কাত করে সায় দিলাম, ওকে পেছনে নিয়ে এগোলাম আবার গানপোর্টের দিকে।
টর্চের আলোতেও আঠারো ইঞ্চির বেশি দেখতে পাচ্ছি না। তবে সদ্য তৈরি ফাঁকটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। বেশ বড়ই হয়েছে সেটা, এয়ার বটল বা ব্রিদিং হোস কোথাও আটকাল না, সহজভাবে ঢুকতে পারলাম।
ভোরের আলোর ডেক আর কম্প্যানিয়নওয়ের গোলক ধাঁধায় পথ হারাতে চাই না, তাই পেছনে নাইলন লাইন ছেড়ে এগোচ্ছি আমি। লাইন ছুঁয়ে আমাকে অনুসরণ করছে রাফেলা, আমার পায়ের আঙুলে, গোড়ালিতে ওর হাতের স্পর্শ পাচ্ছি।
গান ক্যারেজের ওদিকে পানির ঘোলাটে ভাব একটু কম। ফাঁকটা গলে গান ডেকের নিচু, চওড়া একটা চেম্বারে এসে। পৌঁছুলাম আমরা। রহস্যময় আর ভৌতিক লাগছে পরিবেশটা, আমাদের চারদিকে বেঢপ আকৃতির কি সব দেখতে পাচ্ছি। কোনটা চিনতে পারছি, বেশির ভাগই চেনা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় গান ক্যারেজটা দেখতে পেলাম আমি। বাক এবং কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অথবা স্তুপ হয়ে রয়েছে ক্যানন বলগুলো। আর সব জিনিস অনেকদিন পানিতে ভিজে তাদের চেহারা বদলে নিয়েছে, চেনা যাচ্ছে না।
ধীর গতিতে এগোচ্ছি সামনে, আমাদের ফিনের ঝাপটায় আবর্জনা আর কাদার ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে পানিতে। এখানেও আমাদের সামনে ভাসতে দেখছি মরা মাছ। তবে কিছু লাল রীফ ক্রেফিশ চোখে পড়ছে, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রকাণ্ড মাকড়সার মত হামাগুড়ি দিয়ে জাহাজের নিচের দিকে ভেসে যাচ্ছে।
আমাদের মাথার ওপর ডেকের গায়ে টর্চের আলো ফেললাম। আমি, লোয়ার ডেক আর হোল্ডগুলোয় ঢোকার পথ খুঁজছি। জাহাজটা উল্টে থাকায় এর যে ড্রয়িংটা দেখেছি আমি সেটার সঙ্গে মিলিয়ে পথ খুঁজে নিতে একটু বেশি সময় লাগছে আমার।
ভেতরে ঢোকার মুখ থেকে পনেরো ফুট এগিয়ে ফোক্যাসলের মইটা দেখতে পেলাম আমি, আরেকটা চৌকো গর্ত দেখতে পাচ্ছি মাথার ওপর। ফাঁকটা গলে উঠে আসছি, বুদ বুদগুলো রূপালী, তরল পারদের মত বাল্কহেড আর ডেকিং ঘেঁষে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। পচে ঘন কাদা হয়ে আছে মইটা, ছোঁয়া লাগতে না লাগতে খসে পড়ছে, লোয়ার ডেকে যাবার সময় আমার মাথার চারপাশে স্থিরভাবে ভাসছে টুকরোগুলো।
সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে এগোচ্ছি আমরা, দুদিকে সার সার দরজা দেখা যাচ্ছে। দরজাগুলো দিয়ে ভেতরে ঢোকার অদম্য ইচ্ছা জাগছে আমার। এগুলো সম্ভবত অফিসার্স মেস এবং প্যাসেঞ্জার কেবিন। ভেতরে ঢুকে চমকপ্রদ অনেক কিছু আবিষ্কার করার ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রেখে লম্বা ডেকের শেষ প্রান্তে একটা বড় বাল্কহেডের সামনে এসে থামলাম। এটা সম্ভবত ফরওয়ার্ড হোল্ডের বাইরের দেয়াল, ডেক ভেদ করে নেমে গেছে জাহাজের পেটের কাছে।
যতটুকু এগিয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে টর্চের আলো ফেলে রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। নিরাপদ সময়ের পরও চার মিনিট পার করে দিয়েছি বুঝতে পেরে অন্যায় একটা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম, প্রতিটি সেকেণ্ড আমাদেরকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এয়ার বটল খালি হয়ে যাবার ভীতিকর বিপদের দিকে। শুধু তাই নয়, এর ফলে ডি-কমপ্রেশনের জন্যে বিরতিগুলো সম্পূর্ণ করতেও পারব না, ফলে রক্তে বুদ বুদ সৃষ্টি হওয়ার ভয়াবহ ঝুঁকিয়ে নিতে হবে আমাদেরকে।
খপ করে রাফেলার একটা হাত ধরলাম আমি, রিস্টওয়াচ দেখিয়ে বিপদের সিগন্যাল দিলাম ওকে। সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বটা বুঝল ও, দ্রুত অনুসরণ করল আমাকে। খোলের ভেতর দিয়ে গাইডিং লাইন ধরে গানপোর্টের দিকে ফিরে আসছি আমরা। এরই মধ্যে ডিমাণ্ড ভালভের আড়ষ্টতা অনুভব করছি, বটল খালি হয়ে আসায় বাতাস যোগান দিতে ইতস্তত করছে।
বাইরে বেরিয়ে এসে ওপরে তাকাবার আগে প্রথমে আমার পাশে রাফেলা এসে পৌঁছেছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে জেনে নিলাম। তারপর মুখ তুলে ওপর দিকে তাকিয়েই ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার বুক। আতঙ্কে গলায় বাতাস আটকে গেল, আমার তলপেটের ভেতর কেউ যেন গরম তেল ঢেলে দিয়েছে।
<