মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল রানা। মিস্টার। থাইগন লোবাং, মিস নন্দিনী অপরূপা-আমার একজন বন্ধু।

আই অ্যাম অনারড, বললেন লোবাং, চেয়ার ছেড়ে মাথাটা সামান্য নোয়ালেন।

নন্দিনী বসা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল ওরা। হেড ওয়েটারকে। ডেকে তার জন্য অর্ডার দিল রানা। এরই ফাঁকে ওদের দুজনের। জন্য কফি পরিবেশন শুরু হলো। নিজের চেয়ারে বসে হেলান দিল রানা, কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে নন্দিনীকে।

খাকি সাফারি সুট পরেছে সে, রাশি রাশি কালো রেশমি চুল বেণী করেনি আজ। শেষবার যেমন দেখেছিল, চব্বিশ ঘণ্টাও পেরোয়নি, এখন তারচেয়েও সুন্দর লাগছে তাকে।

গলায় আস্ত মাছ আটকানো বিড়ালের মত লাগছে তোমাকে, সম্ভব, আরেক দফা সংক্রামক হাসির সঙ্গে বলল নন্দিনী। তারপর কিউরেটরের দিকে ফিরল। সম্ভবের সঙ্গে হংকঙে পরিচয় হয় আমার, মিস্টার লোবাং। কিছু ফিল্ড ওঅর্ক করার জন্যে পেগানের পথে রয়েছি আমি, কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগছে-ও যে মায়ানমারে আসবে, এ-কথা ভুলেও আমাকে জানায়নি। কাঁধ ঝাঁকাল সে। ওর বোধহয় জানা নেই যে দুনিয়াটা বেশি বড় নয়।

খুবই ছোট, বললেন লোবাং, প্রথমে রানার দিকে ফিরে হাসলেন, তারপর নন্দিনীর দিকে। তবে আপনাদের জন্যে সারপ্রাইজটা নিশ্চয়ই খুব মধুর।

তা আর বলতে। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল রানা। হাসির আড়ালে উদ্বেগ লুকাচ্ছে। নিজের আশপাশে নন্দিনীকে চায় না ও। তার উপস্থিতি ওর জন্য নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করবে।

বিশেষ করে জটিল আর বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে থাকার সময় কোন মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতে নেই। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে রানার জানা আছে, শত্রুপক্ষ ব্যাপারটাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে প্রলুব্ধ হয়। বছরখানেক আগে এরকম একটা মেয়ের সঙ্গ এড়াতে পারেনি ও। তার পরিণতি মোটেও শুভ হয়নি। হঠাৎ যখন গোলাগুলি শুরু হলো, তার কথা মনেই ছিল না রানার। পরিবেশ শান্ত হতে দেখা গেল মেয়েটা আহত হয়েছে। ফলে ইনটেনসিভ কেয়ারে মাসখানেক থাকতে বাধ্য হলো সে। রানা একই বোকামির পুনরাবৃত্তি চায় না।

তবে, সম্ভব, বলল নন্দিনী, রানার আগ্রহের অভাব দেখে পরোক্ষভাবে প্রতিবাদ করছে, ব্যাপারটা আবার অত বড় সারপ্রাইজ নয়ও। সবাই জানে ইয়াঙ্গুনে প্রথম শ্রেণীর হোটেল খুবই কম…

কে বলল? তাজমহল আছে, ইরাবতী ইন্টারন্যাশনাল আছে…

ওগুলো আমার পথে পড়ে না, হেসে উঠে বলল নন্দিনী। শেরাটন থেকে শয়ে ডাগন প্যাগোডা একদম কাছে, হেঁটে গেলে। তিন মিনিটে পৌঁছে যাব। আউটডোর মার্কেটও কাছে। তবে জানি না এখানে বসে কী কারণে আমি একের পর এক অজুহাত তৈরি করছি। প্রথমবার যখন দেখা হলো তখনই তোমাকে জানিয়েছি, মায়ানমারে আসছি আমি। কিন্তু আমাকে কেউ জানায়নি যে তুমিও এখানে আসছ।

আমাকে এবার যেতে হয়, হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে বললেন থাইগন লোবাং। দুই তরুণ-তরুণীর মান-অভিমানের পালা শুরু হয়েছে, কাজেই বুঝতে পারছেন তাঁর উপস্থিতি বেমানান হয়ে পড়েছে। মিস্টার সম্ভব, আপনার সান্নিধ্যে ভারি আনন্দময় একটা সন্ধ্যা কাটালাম। আন্তরিক ধন্যবাদ। আবার যদি মিউজিয়াম। ভিজিট করেন, আমার সঙ্গে দেখা না করলে হতাশ হব।

মনে থাকবে, আশ্বস্ত করল রানা। আমার বেড়ানোটা। স্মরণীয় করে রাখতে সাহায্য করেছেন আপনি। আপনার মত। জ্ঞানী মানুষের দেখা খুব কমই পাই আজকাল।

ওদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দ্রুত বিদায় নিলেন থাইগন লোবাং।

সত্যি আমি দুঃখিত, নিজের প্লেটের দিকে চোখ রেখে বলল। নন্দিনী, যেন বাচ্চা মেয়ের মত অভিমানে ঠোঁট ফোলাবে। তুমি এরকম রেগে যাবে জানলে…

আমি রাগিনি, প্রতিবাদ করল রানা। আমি…অবাক হয়েছি, খুশি হয়েছি, একটু ঘাবড়েও গেছি। এবার বলো, আমার এই সততা, এই সরল স্বীকারোক্তি কেমন লাগছে তোমার। নন্দিনীর হাতটা ধরল ও, চাপ দিল মৃদু, আড়ষ্ট ভাবটুকু আড়াল করতে চাইছে।

না, ইয়াঙ্গুন শেরাটনে নন্দিনীর আগমন মোটেও অবাক করার মত কিছু নয়। বরং ইয়াঙ্গুনে রানার উপস্থিতিই খানিকটা অপ্রত্যাশিত।

তুমি আমাকে বলোনি কেন এখানে আসছ? জানতে চাইল নন্দিনী, অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে প্লেট থেকে মুখ তুলে তাকাল।

আমাদের শেডিউল বদলে নতুন করে সাজানো সম্ভব বলে মনে হয়নি, তাই, মিথ্যেকথা বলল রানা। কাজেই মুখ বুজে ছিলাম আমি। কে জানত সময়ের আগেই চলে আসবে তুমি…

তুমি নেই, হংকং আর ভালো লাগে কী করে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নন্দিনী। আমার কী করেছ, তুমি বোধহয় জানোও না!

কী করেছি?

তুমি বোধহয় খুব নিষ্ঠুর মানুষ, তা না হলে এ-প্রশ্ন করতে না!

আশ্চর্য তো!

সত্যি জানো না? শিরদাঁড়া একটু খাড়া করে সরাসরি রানার চোখে তাকাল নন্দিনী। জানো না, নিজের কত বড় সর্বনাশ করে ফেলেছি আমি?

একবার নিজেকে দুষছ, আরেকবার আমাকে। কাঁধ ঝাঁকাল রানা। কী করে জানব, বলো? আমি কি অন্তর্যামী?

তুমি কে? তোমাকে আমি চিনি? মাথা নাড়ল নন্দিনী। কিছুই জানলাম না, অথচ পাগল হয়ে সব দিয়ে বসলাম।

এটাকে তুমি নিজের সর্বনাশ বলছ?

বলছি। কিন্তু আমাকে নিয়ে মূল সমস্যা হলো, হেসে ফেলল নন্দিনী, নিজের ওই সর্বনাশ আমি আবার করব। বারবার করব। যতবার দেখা হবে। যেখানে দেখা হবে।

কোন মেয়ের এরকম আত্মসমর্পণ কার না ভালো লাগে।

ব্যাপারটা আরও উপভোগ্য হয়ে উঠল এক ঘণ্টা পর, নন্দিনীর হোটেল স্যুইটে। নিষ্প্রভ নীল আলো গায়ে মেখে আনন্দে অবগাহন।

নন্দিনীর ফর্সা ত্বকে একটা উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে। রিবন-এর দিকে হাত বাড়াল রানা, ওটা ধরে টান দিলেই খুলে যাবে নাইটগাউন।

 কিন্তু সরে গেল নন্দিনী, ঠোঁটে দুষ্টামি ভরা হাসি, রানাকে নিয়ে যেন খেলছে। তুমি অদ্ভুত, আশ্চর্য একজন মানুষ, সম্ভব। খুবই…খুবই…কী বলব? খুবই রহস্যময়।

সেটা কি তোমার জন্যে উত্তেজক?

মাথা ঝাঁকাল অর্ধনগ্ন নারী। হ্যাঁ। ব্যাপারটা…ব্যাপারটা আমার ভেতর যেন একটা চাবি ঘোরায়। আমি যেন অন হয়ে। যাই। ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। বিচ্ছিরি, না?

মাথা নাড়ল রানা। তোমার ভালো লাগলে বিচ্ছিরি হতে যাবে। কেন।

না, মানে, মেয়েরা নিজেদের এই সব অনুভূতির কথা মুখ ফুটে বলে না। সত্যি তুমি কিছু মনে করছ না?

না, করছি না, সত্যি কথাই বলল রানা। আমার ভালো লাগছে, কারণ তুমি আর দশজনের মত নও। ছেলে হোক আর। মেয়ে, এরকম ঘনিষ্ঠ সময়ে সে তার অনুভূতির কথা কেন বলবে না।

হঠাৎ রানার বুকে চলে এল নন্দিনী। তার আলিঙ্গন হয়ে উঠল খামচি, চুম্বনকে বলতে হবে কামড়।

তাকে নির্যাতন করার সুযোগ দিচ্ছে রানা। কারণ জানে একটু পর সে নির্যাতিতা হবে।

.

তারপর কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। হাতঘড়িতে এখন রাত ১২:১৫।

নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে অন্ধকারেই কাপড় পরতে শুরু করল রানা। কাজ আছে ওর, যে কাজ ফেলে রাখা যায় না। থাইগন লোবাং বলেছেন, রাত একটার পর মিউজিয়ামে গার্ড থাকে না বললেই চলে। নন্দিনীর ঘুম না ভাঙিয়ে ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করার জন্য নিজের স্যুইটে ফিরে এল রানা, যতটা সম্ভব বদলে চেহারায় বার্মিজ বৈশিষ্ট্যও আনতে হবে। ইকুইপমেন্টের মধ্যে ধুতরার ফল মেশানো এক প্যাকেট সিগারেটও আছে। সার্ভিস এন্ট্রান্সটা আগেই দেখে রেখেছিল, হোটেলের বাইরে বেরুবার সময় কারও চোখে ধরা পড়ল না।

স্ট্রিট ল্যাম্পের নীচে ঝক ঝক পতঙ্গ আলোড়িত মেঘ তৈরি করেছে। মালা স্ট্রিট ধরে নিজের গন্তব্যে যাবার পথে ওর চুলের সঙ্গে জড়িয়ে গেল কিছু পোকা।

ফুটপাথে প্রচুর লোকজন শুয়ে আছে। এটা-সেটা নিয়ে গোলযোগ লেগেই আছে। এতরাতে বিদেশী একজন লোককে দেখামাত্র চুপ করে যাচ্ছে তারা। মালা রোড থেকে উত্তরে রওনা হলো রানা। এদিকের রাস্তায় কোথাও আলো আছে, কোথাও নেই। একে একে পেরিয়ে এল মার্চেন্ট, ডালহৌসি, বগিওক, ডাবল প্যাগোডা আর ড্রাগন স্ট্রিট। প্রতিটি রাস্তায় ছায়ার ভিতর থেমেছে ও, পিছনে তাকিয়ে দেখেছে কেউ পিছু নিয়ে আসছে কিনা।

বিশ কি বাইশ মিনিট হনহন করে হেঁটে শয়ে দাগুন প্যাগোডা রোড আর পেয়ারে স্ট্রিটের মোড়ে পৌছাল রানা। দম। নেওয়ার জন্য এখানে একটু থামল রানা, পিছন দিকটা আরেকবার ভালো করে দেখে নিশ্চিত হতে চাইল কেউ ওর পিছু নিয়ে আসেনি। তারপর পেয়ারে স্ট্রিট ধরে নিঃশব্দ পায়ে মিনিস্ট্রি অভ কালচার-এর সামনে চলে এল।

বিশাল আয়তনের দালানটাকে পাশ কাটাবার সময় আশপাশে। কোন পাহারা বা লোকজন চোখে পড়ল না। তবে সামনের দরজা। ভিতর থেকে বন্ধ দেখা গেল।

কিছুদূর এগিয়ে গাঢ় ছায়ায় দাঁড়াল রানা। ফেলে আসা পথে কিছুই নড়ছে না। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে আবার দালানটার দিকে এগোল ও। সদর দরজার সামনে থেকে কবাটে ঠেলা দিতে। একচুল নড়ল না সেটা, একবার চোখ বুলাতেই বোঝা গেল, দরজার কবাটে কোন কী হোল নেই। তারমানে ভিতর দিক থেকে। বোল্ট আর তালা লাগানো হয়েছে।

এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নয় রানা, বিশেষ করে এই। তথ্য জানার পর যে তো ওয়ানের ডেথ সুটে মাইক্রোফিল্মটা। লুকানো আছে।

সাবধানে দালানটার পিছন দিকে চলে এল রানা। এটা সরু একটা কাঁচা গলি, পায়ের নীচে ঢাকা নর্দমা, আবর্জনার স্তুপে পা। ফেলে এগোতে হচ্ছে।

মন্ত্রণালয় বা আশপাশের অন্যান্য দালান নিস্তব্ধ হয়ে আছে। পকেট ফ্ল্যাশলাইট বের করে সরু অথচ শক্তিশালী আলো ফেলল রানা, কালচারাল ইনস্টিটিউটের ভিত বরাবর বেশ খানিক দূর আলোকিত হয়ে উঠল। মাত্র দুসেকেন্ড জ্বলল ওটা, তারমধ্যেই অনেক কিছু দেখে নিয়েছে রানা।

নিচু একটা পাঁচিল টপকালেই ইন্সটিটিউটের পিছনের উঠানে নামা যায়। তারপর সামনে পড়বে এক সারিতে কয়েকটা জানালা। ওগুলো বেমেন্টের জানালা, প্রতিটি লোহার জাল দিয়ে মোড়া।

পাঁচিল টপকাতে কোন সমস্যা হলো না। চারটে জানালা, প্রথমটার সামনে থেমে লোহার জাল পরীক্ষা করল।

পাতলা জাল, পকেট নাইফ কাজে লাগিয়ে কাঠের ফ্রেম থেকে ওটাকে খুলে ফেলতে তিন মিনিটের বেশি সময় লাগল না। অন্ধকারে হাতড়ে উইন্ডো ল্যাচ খুঁজছে রানা। নেই।

জানালাটা ভিতর থেকে বন্ধ করা। তারমানে ভিতরে ঢুকতে হলে কাঁচ ভাঙতে হবে।

মিউজিয়ামটা আরও তিন ফ্লোর উপরে, হাতে রুমাল জড়াবার সময় রানা ভাবছে, সেখানে পৌছাবার আগে আরও কত রকমের বাধার সামনে পড়তে হয় কে জানে।

দম আটকে কাঁচে ঘুসি মারল রানা। লিনেন রুমাল ব্যথা পেতে দেয়নি, আওয়াজও খানিকটা দমিয়ে রাখল। মৃদু ঝন ঝন শব্দে ভেঙে গেল কাঁচটা।

ভিতরে হাত গলাতেই ল্যাচ বা ছিটকিনি পেয়ে গেল রানা। সেটা সাবধানে নামাল ও, খেয়াল রাখছে ভাঙা কাঁচ লেগে হাত না কেটে যায়। বহু বছর এই জানালা খোলা হয় না, তাই উপরে উঠে যাবার সময় ক্যাচক্যাচ করে উঠল।

জানালা দিয়ে গলে ভিতরে ঢুকল, তারপর ধীরে ধীরে সিধে হয়ে দাঁড়াল রানা। অন্ধকার এখনও গাঢ় আর দুর্ভেদ্য। জানালাটা ধরে সাবধানে নামাল ও, যাতে কোন শব্দ না হয়। তারপর ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালল।

কিউরেটর ভদ্রলোক মিউজিয়ামের বাইরে টহল গার্ড থাকবে কিনা রানাকে বলেননি। যদি থাকে তা হলে তাদের চোখে ধরা পড়বে যে জানালাটা ভাঙা হয়েছে।

গুমোট, ভ্যাপসা একটা গন্ধ পাচ্ছে রানা। টর্চের আলোয় দেখল, এটা একটা স্টোররুম। মৃৎশিল্প, চিনামাটির কাজ, শ্বেতপাথরের সিংহ, অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি দেখা যাচ্ছে-তবে সবই। ভাঙা।

এ-সবের মাঝখানে হিনথা গঙ-ও রয়েছে-পৌরাণিক সেই পাখি, উঠে আসছে সমুদ্র থেকে।

কাঠের স্ট্যাচুর পিছনে সিলিং ছুঁয়েছে একটা র‍্যাক, তাতে সাজানো রয়েছে প্রাচীন মৃৎশিল্পের অসংখ্য নিদর্শন।

আর্কিওলজিক্যাল আবর্জনার ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এগোচ্ছে রানা। সামনে একটা দরজা পড়ল, স্টোররুম থেকে বেরুবার পথ।

কিন্তু সেটা বাইরে থেকে বন্ধ।

সিসেম খুল যা বললেই দরজা খুলে যাবে, এরকম কিছু আশা করেনি রানা। তবে এ-ধরনের বাধা ওর কাজটাকে আরও জটিল করে তুলছে, বিশেষ করে ও যেখানে কোন শব্দ করতে চাইছে না। যাই হোক, সম্ভাব্য বাধার কথা মনে রেখে তৈরি হয়েই এসেছে ও।

ব্রেস্ট পকেট থেকে লম্বা, চৌকো একটুকরো অ্যাসিটেইট বের করল রানা। জিনিসটা কাগজের মত পাতলা। এটা সিঁধেল চোরদের অতি পুরানো একটা কৌশল, রানা এখন দ্রুত কাজে লাগাচ্ছে। দরজার ফাঁকে প্লাস্টিকের টুকরোটা ঢুকিয়ে নীচের দিকে, তালার দিকে, ধীরে ধীরে নামিয়ে আনছে ও। তালাটাকে পাশ কাটিয়ে আরও নামল ওটা।

তার মানে প্রথমবারে কাজ হয়নি। তবে এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বে না রানা।

আকেরবার চৌকো অ্যাসিটেইট দরজার ফ্রেম আর দরজার কবাটের মাঝখানে ঢোকাল রানা, অনুভব করল মরচে ধরা ধাতব তালায় লাগল ওটা; তারপর, আগের বারের চেয়ে একটু বেশি জোরে চাপ দিল নীচের দিকে। পুরস্কার হিসাবে কপালে জুটল মৃদু ক্লিক।

তারপর ডোরনব ধরে মোচড় দিল রানা, আরেকটা ক্লিক করে সেতাও সবটুকু ঘুরে গেল। নিঃশব্দ পায়ে, সতর্ক চোখে, কান খাড়া করে স্টোররুম থেকে বেরিয়ে এল ও।

চওড়া একটা করিডর এটা, সিলিঙের ঠিক নীচেই কয়েক সারি গরম আর ঠাণ্ডা পানির পাইপ দেখা যাচ্ছে, সমান্তরাল এগিয়ে বেযমেন্ট স্টোরেজ রুমের দিকে চলে গেছে। দরজাটা সাবধানে বন্ধ করে ডান দিকে এগোল রানা। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে।

পঞ্চাশ ফুট পর হঠাৎ করে শেষ হয়েছে হলওয়ে। এখানে বোমেন্ট করিডরে এসে মিলিত হয়েছে পুরানো, প্রতিবাদমুখর কাঠের সিঁড়ি। এক হাতে রেইলিং ধরে প্রতিবার একটা করে ধাপ টপকাচ্ছে রানা, গলাটা বকের মত উঁচু করে দেখতে চেষ্টা করছে। ল্যান্ডিঙের মাথায় ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করছে কিনা।

কেউ নেই। ইঁদুরের চেয়ে বড় আর কিছু না দেখে দোতলা পার হয়ে এল রানা, অন্ধকারে ওটা ওকে পাশ কাটাবার সময় চোখ থেকে লালচে আভা বেরুতে দেখা গেল।

আরেক প্রস্থ সিঁড়ি পেরোল রানা, এখন আগের চেয়েও সতর্ক। এবারও কেউ ওকে বাধা দিচ্ছে না। কয়েক মুহূর্ত পর একটা ল্যান্ডিঙে পৌছাল রানা। এখান থেকেই চারতলার ফ্লোরে যাওয়া। যায়। কালচারাল ইন্সটিটিউট আর ন্যাশনাল মিউজিয়ামটা এই ফ্লোরেই।

মিউজিয়ামে হান সাম্রাজ্যের প্রদর্শনী চলছে।

মেটাল সেফটি ডোরটা আধুনিক, তবে তালা দেওয়া নয়। বার-এ চাপ দিতেই কাঁপতে কাঁপতে ভারী দরজা সামান্য খুলে। গেল, কোন রকমে ভিতরে ঢুকতে পারল রানা। ল্যান্ডিঙে কংক্রিট। ছিল, তার বদলে পায়ের নীচে প্রথমে কাঠ মোড়া মেঝে দেখা গেল, তারপরই মার্বেল।

নিঃশব্দে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা, ক্ষীণ আলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে চোখ দুটোকে। সামনে, উপর দিকে, রাজকীয় আলখেল্লা ঝুলছে, শিরস্ত্রাণসহ; পথ নির্দেশ পেতে সাহায্য করল রানাকে।

ওই গ্যালারি পার হয়ে হল-এ যেতে হবে রানাকে। ভ্রাম্যমাণ। প্রদর্শনী ওই হলেই দেখানো হচ্ছে। প্রচুর মিউজিয়াম কেস রয়েছে, আড়াল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু প্রদর্শনী বা তু ওয়ানের ডেথ সুটের এত কাছাকাছি এসে কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইছে না রানা। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার, অবিশ্বাস্যই বলতে হবে, এখন পর্যন্ত কোন গার্ডই ওর চোখে পড়েনি। কিন্তু এতক্ষণ তাদেরকে। দেখেনি বলে এটা ধরে নেওয়া বোকামি হবে এখানেও তারা নেই।

কাজেই এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হেঁটে গেলেই চলবে না। রানাকে এগোতে হবে যথাসম্ভব সাবধানে আর সময় নিয়ে।

জায়গাটা স্টোররুমের মত অন্ধকার নয়। করিডরের। উল্টোদিকের দেয়ালে খানিক পর পর একটা করে লো-ওয়াটের বালব জ্বলছে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে রানা এই মুহূর্তে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি। রোলেক্সের আলো জ্বেলে সময় দেখল ও-১:০৯। সময়ের চেয়ে যেহেতু পিছিয়ে নেই, তাই অপেক্ষা করতেও আপত্তি নেই।

তিন মিনিট পর, অবশেষে, পা বাড়াল রানা। কিছুই ঘটল না, মান্দালয় গ্যালারির প্রবেশ পথে পৌঁছে গেল। কিন্তু ওখানে থামতে থামতে ছলকে উঠল বুকের রক্ত। পরমুহূর্তে লাফ দিয়ে সরে এল।

পায়ের আওয়াজ!

কোত্থেকে আসছে বোঝার জন্য কান পাততে হলো রানাকে। সন্দেহ হলো, হল-এর শেষ মাথার দিকে হাঁটছে কেউ।

দ্রুত সরে এসে একটা মিউজিয়াম কেসের আড়ালে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে রানা। আওয়াজটা বাড়ছে-মার্বেলের সঙ্গে লেদারের ঘর্ষণ-ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওর দিকে, নিয়মিত একটা ছন্দে।

কান পেতে শুনছে রানা, আওয়াজটা অস্থির বলে মনে হচ্ছে। তারমানে এখনও কিছু সন্দেহ করেনি সে।

লোকটা রোগা; সরু মুখ, প্রায় ছফুট লম্বা, বয়স হবে ত্রিশবত্রিশ। কঁচ আর কাঠের তৈরি কেসগুলোর মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসছে সে-এটাকে একটা প্যাসেজই বলা উচিত, দুপাশে আরও একটা করে, একই মাপের কেস।

উঁকি দিয়ে তাকিয়ে ছিল রানা, লোকটা পনেরো ফুট দূরে থাকতে পুরোপুরি আড়ালে সরে এল। ইতিমধ্যে হিপ-এ পরা হোলস্টারটা দেখা হয়ে গেছে ওর, গোল আকৃতির বাঁটের শেষ প্রান্ত দেখে কোন্ট .৩৮ পিস্তলটাও চিনতে পেরেছে।

ওটা একটা পুলিশ পজিটিভ স্পেশাল, এমন একটা হ্যান্ডগান যার ডাবল-অ্যাকশন মেকানিজমের কারণে হাঁটার ছন্দে এতটুকু বিঘ্ন সৃষ্টি না করে ছয় রাউন্ড গুলি করতে পারবে গার্ড, হ্যামার ম্যানুয়ালি কক করারও দরকার হবে না।

রানা ধারণা করল, গোটা মিউজিয়ামে এত রাতে খুব বেশি হলে ছয় থেকে আটজন গার্ড আছে। এত বড় একটা জায়গার তুলনায় কমই বলতে হবে। তবে সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে প্রহরীদের অস্ত্র। পিস্তল ছাড়াও তাদের কাঁধে একটা করে অটোমেটিক কারবাইন ঝুলতে দেখেছে রানা, দেখেছে কোমরে গোঁজা বড় আকৃতির ছোরা।

গার্ড গ্যালারি থেকে না বেরুনো পর্যন্ত ছায়ায় অপেক্ষা করল রানা। পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাবার পরও বেশ কয়েক মুহূর্ত নড়ল না। তারপর ধীরে ধীরে সরু প্যাসেজটায় ঢুকে হল-এর দিকে পা বাড়াল।

সামনে মার্বেল পাথরের একটা খিলান পড়ল। তার পাশে কোন রকমে খাড়া করা একটা টিকিট স্ট্যান্ড, আর তারপরই, অবশেষে…

হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে উঠল রানা। সাদা একজোড়া। মূর্তি! তারপর পরিষ্কার হলো, সারা গায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধেছে-এটা। ওদের ছদ্মবেশ!

কুত্তার বাচ্চা! দাঁতে দাঁত চেপে গালি দিল রানা। সেই সঙ্গে। স্যাঁৎ করে পিছিয়ে এল।

সেই সিআইএ বক্সার আর বিআইবি বাচাল-সাদা কোট আর। লাল টাই-ওকে হারিয়ে দিয়ে ওর আগে পৌঁছে গেছে এখানে!

কঠোর পরিশ্রম করছে লোক দুজন। একটা মিউজিয়াম কেসের মাথা থেকে ভারী কাঁচের ঢাকনিটা সরাবার চেষ্টা করছে। রানা জানে, ওই কেসটাতেই রয়েছে তো ওয়ানের ডেথ সুট-জেড পাথর, সোনার পাত আর সোনার তার দিয়ে তৈরি।

কেসটার কয়েক ফুট দূরে, মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে দুজন গার্ড। পড়ে থাকার ভঙ্গিটাই বলে দিচ্ছে জ্ঞান নেই ওদের।

রানার চিন্তা-ভাবনায় একটা পরিবর্তন আসছে। সিআইএ আর বিআইবি-কে নিয়ে এখন তেমন উদ্বিগ্ন নয় ও। ভাবছে, খাটনির কাজগুলো করছে করুক ওরা। সঙ্গে পিস্তল আছে, কাজেই চিন্তার কিছু নেই।

সন্দেহ নেই এইমাত্র এখানে পৌঁছেছে ওরা, কারণ শেষ যে গার্ডটাকে দেখেছে ও সে এদিক থেকেই গেছে।

এই মুহূর্তে নিঃশব্দে কাজ করছে ওরা। কাছাকাছি থাকায় রানা শুধু ওদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। কাঁচের ঢাকনিটা খুব ভোগাচ্ছে ওদেরকে। ছোট আকৃতির অনেকগুলো টুল-এর সাহায্যে পালিশ করা কাঠের বেইস বা ভিত থেকে ওটাকে আলাদা করতে ঘেমে নেয়ে উঠছে ওরা। কাঠের ভিতটা এক ধরনের প্লাটফর্ম, যেটার গায়ে ফিউনেরারির আর্মার বিছিয়ে রাখা হয়েছে।

ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল রানা, দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে গোটা মান্দালয় গ্যালারি দেখে নিল। কিছুই নড়ছে না। আবার যখন ঘাড় সোজা করল, দেখল লোক দুজন ঢাকনিটার একটা দিক খুলতে পেরেছে।

ধীরে ধীরে, সাবধানে, সাদা সুটকে ফিসফিস করতে শুনল রানা।

তার সঙ্গী মাথা ঝাঁকাল, কাঁচের পাশ দিয়ে নীচে একটা স্কুড্রাইভার ঢুকিয়ে চাপ দিল। কাঠ ককাচ্ছে, কাচের ঢাকনি ঝকি খেয়ে আগুপিছু করছে, তারপর হঠাৎ কেসের ভিত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেরিয়ে এল।

সাবধান! আবার বিড়বিড় করল সাদা সুট। ঢাকনির একটা। প্রান্ত ধরে আছে সে, এবার সাদা টাই অপরপ্রান্তটা ধরল। দুজন মিলে ধরাধরি করে স্বচ্ছ ঢাকনিটা মিউজিয়াম কেসের উপর থেকে তুলল, ডেথ সুট থেকে উঁচু করল আরও ফুট খানেক। তারপর। ধীরে ধীরে একপাশে সরাল ওটাকে, বেরিয়াল আর্মারকে ছাড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত থামল না।

এবার নামাও, সাদা কোট বলল, ঢাকনিটা মার্বেল মেঝেতে। নামাতে সাহায্য করছে। এক মুহূর্ত পরই আর্মারটা হাতড়াতে শুরু করল সে, একের পর এক সেকশনগুলো তুলে মাইক্রেফিল্মটা। খুঁজছে।

নাক গলাবার কোন কারণ দেখছে না রানা। আগে জিনিসটা। পাক ওরা, তারপর ছিনিয়ে নিতে কতক্ষণ।

ডেথ সুটে মাইক্রোফিল্মটা যদি থাকেও, নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবে লুকানো আছে, যত্ন করে আর সময় নিয়ে খুঁজতে হবে। কিন্তু তার সুযোগ পাওয়া গেল না, কারণ মান্দালয় গ্যালারির অপর প্রান্ত থেকে জোরাল প্রতিধ্বনি ভেসে এল-সন্দেহ নেই কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ ওগুলোর উৎস।

মাথা নিচু করে পিছিয়ে এল রানা, গার্ডরা ওকে যাতে দেখতে পায়। ওদিকে সাদা সুট আর ভাঙা আঙুল ক্ষিপ্র বেগে আবার জায়গা মত বসাচ্ছে কাঁচের ঢাকনিটা। কাজটা শেষ হতেই পাশের। একটা ডিসপ্লের পিছনে গা ঢাকা দিল তারা।

পায়ের আওয়াজ জোরাল হচ্ছে, তবে ছন্দে একটা। অনিশ্চয়তার সুর; যেন হান প্রদর্শনীতে ফেরার পথে লোকগুলোর মনে কোন কারণে সন্দেহ জেগেছে। হয়তো দুজন গার্ডের অনুপস্থিতিটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছে না। ফিরে আসার কারণ যাই হোক, ব্যস্ততার মধ্যে উদ্বেগ টের পাওয়া যাচ্ছে।

খিলান আর টিকিট কাউন্টার-এর কাছাকাছি চলে এসেছে। তারা। কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। তারপর থমকে দাঁড়াল। রানার কাছ থেকে ছয় ফুট দূরেও নয়। একজোড়া হাত একযোগে পুলিশ পজিটিভ স্পেশাল ছুঁতে যাচ্ছে।

তারপরই অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা গার্ড দুজনকে দেখতে পেল তারা। একজনকে খানিক আগে দেখেছে রানা-মুখটা সরু, প্রায় ছফুট লম্বা। সে-ই অজ্ঞান সঙ্গীদের দিকে ছুটে এল। দ্বিতীয় গার্ড পিস্তল বের করে অন্ধকার এগজিবিট হলে পা রাখল।

এখন যদি রানা কিছু না করে, অপরাধ যে লাভজনক তার জ্যান্ত প্রমাণ হয়ে থাকবে সাদা কোট আর সাদা টাই। সেটা ঘটতে দিতে চায় না ও। এমন কিছু করতে হবে যাতে নিজের উপস্থিতি গোপন রেখে ওদের পালানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়।

পকেটে হাত ভরে এক মুঠো কিয়াত বের করল রানা। সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া ব্রিটিশ আর আমেরিকা কোথায় লুকিয়েছে জানে ও। কয়েনগুলো ছুঁড়ে দিল সেদিকে।

নিস্তব্ধতার ভিতর মার্বেল পাথরের মেঝেতে ঝনঝন শব্দ তুলে গড়িয়ে গেল ওগুলো। গার্ড দুজনের গলা থেকে একযোগে আঁতকে ওঠার আওয়াজ বেরুল। পরমুহূর্তে চিৎকার জুড়ে দিল, অন্যান্য সঙ্গীদের সাবধান করছে।

গার্ডদের চিৎকার শুনে সিআইএ আর বিআইবি ভয়ানক নার্ভাস হয়ে পড়ল। প্রথমে ভাঙা আঙুল, তার পিছু নিয়ে সাদা কোট আড়াল থেকে বেরিয়ে খিচে দৌড় দিল-গ্যালারির শেষ মাথার দিকে যাচ্ছে।

কিন্তু ইউনিফর্ম পরা দুই গার্ড এত সহজে চোরদের পালাতে দেবে না, পিছু নিয়ে তারাও ছুটছে।

একটা গুলি করল তাদের একজন। দেখাদেখি দ্বিতীয় লোকটাও। প্রথম গার্ড আরেকবার টার্গেট প্র্যাকটিস করল। তার। এই দ্বিতীয় বুলেটটাই লাগল ভাঙা আঙুলকে।

লোকটা প্রথমে খোঁড়াল। তারপর দেখা গেল পা দুটো তার ভার বইতে একদমই রাজি নয়। ব্যথায় ঘড়ঘড় করে তরল একটা। আওয়াজ করল মুখ দিয়ে, তারপর কাশল, কাশির সঙ্গে হড়হড় করে বেরিয়ে এল তাজা রক্ত, পর মুহূর্তে ঢলে পড়ল মেঝেতে।

মৃত্যু যন্ত্রণায় মেঝেতে ছটফট করছে সে, সেটা দেখার জন্য ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার বান্দা সাদা কোট নয়। হাজার হোক বেনিয়ার জাত; নিজের লাভ ভালোই বোঝে। সরু করিডরে বেরিয়ে পড়ল সে, থাইগন লোবাঙের খোজে কাল যে করিডরে পা পড়েছিল রানার।

তবে গার্ড দুজন একজন চোরকে ফেলে দিয়ে সন্তুষ্ট নয়। নিজেদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সাদা কোটকে ধাওয়া করল। তারা। আরও দুটো গুলির আওয়াজ শুনল রানা।

তিনটে পড়ে থাকা দেহ ছাড়া হল আবার খালি হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে শুধু ভাঙা আঙুলের অবস্থাই করুণ।

ফার্স্ট এইড দেবার মত সময় বা ইচ্ছে, কোনটাই নেই রানার। তা ছাড়া, অনেক দেরিও হয়ে গেছে। ভাঙা আঙুলের। কপাল অবশেষে সত্যি পুড়েছে।

আবারও গুলির আওয়াজ শুনল রানা, তবে আরও দূরে, কাজেই ইতস্তত না করে মিউজিয়াম কেসটার দিকে এগোল ও। সময় কম, দ্রুত শেষ করতে হবে কাজ। মেঝেতে পড়ে থাকা গার্ড দুজন যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান ফিরে পেতে পারে। যে-দুজন বিআইবি-র পিছু নিয়েছে, এখুনি আবার গ্যালারিতে ফিরে আসার কথা তাদের। এমনকী গার্ডদের তৃতীয় জোড়া, যারা মিউজিয়ামের অন্য কোথাও ডিউটি দিচ্ছে, সঙ্গীদের বিপদে সাহায্য করতে চলে এলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

রানার ইচ্ছে নয় ক্রস ফায়ারে মারা পড়ে।

এতক্ষণে মিউজিয়ামের চারদিকে অ্যালার্ম বেজে উঠল। রানা তাড়াহুড়ো করছে ঠিকই, কিন্তু আরেক জোড়া হাতের সাহায্য ছাড়া কঁচের ঢাকনিটা ভালো করে ধরতেই পারছে না। অনেক কষ্টে একটা প্রান্তের দুই কোণ ধরে উঁচু করল, তারপর বার কয়েক সামনের দিকে ঠেলে আর পিছনদিকে টেনে আসা-যাওয়ার পথটা যথাসম্ভব সাবলীল করে নিল, সবশেষে নিচু করল মেঝের দিকে। কঁচটা যদি ভাঙে, ছুটে এসে মৌমাছির মত ঘেঁকে ধরবে ওকে গার্ডরা। কাজেই সময় দ্রুত ফুরিয়ে এলেও অত্যন্ত সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে ওকে।

কাঠের প্ল্যাটফর্মের পাশে ঢালু করে রাখল রানা ঢাকনিটাকে, ঠেক দেওয়ার ভঙ্গিতে; তারপর কাজ শুরু করল।

যতটুকু ভেবেছিল জেড আর্মার তারচেয়েও বেশি ভারী। প্রতিবার বেরিয়াল সুটের শুধু একটা অংশ মাত্র তোলা সম্ভব। প্রথমে ডান পা ধরে তুলল রানা, তারপর বাম পা। এভাবে হাত দুটোও। সবশেষে মাথাটা উঁচু করল, ধড়টা সামনে ঠেলে বাঁকা করল। জেড অর্ধচন্দ্র আর চাকতিটাও নাড়াচাড়া করল ও, তোউ ওয়ান-এর ফিউনারারি সুটের পাশে সাজানো রয়েছে।

কিন্তু মাইক্রোফিল্মের রোলটা কোথাও পাচ্ছে না।

অন্য কেউ হলে আর কিছু দেখার নেই ভেবে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যেত। কিন্তু মাসুদ রানার কাজের পদ্ধতি আলাদা।

ঠিক আছে, ভাবল ও, জিনিসটা কোথায় লুকানো হয়েছে? আরে, মাথা ঘামাও! আর কোথায় লুকানো সম্ভব?

জেড পাথর পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লেগে আছে সোনার তারের সাহায্যে। সুটটা ফাপা হলেও, তার ভেঙে ভিতরে ফিল্ম ঢুকিয়ে রাখার মত উদ্ভট চিন্তা চৌ মিন বা তার অনুগত কোন লোকের মাথায় আসবে না। সুটের এ-ধরনের ক্ষতি কারও না। কারও চোখে পড়তই, হয়তো আর্মারটা বেইজিং থেকে রওনা। হবার আগেই। সুটের ভিতর, ফাপা জায়গাটায়, আঙুল বুলাল রানা। কিছু নেই। কয়েকটা পাথর নাকের ব্রিজ তৈরি করেছে, ব্রিজের ভিতর আঙুল ঢুকিয়েও কিছু পেল না।

লাইনিংটা দেখা দরকার, ভাবল রানা।

মেরুন রঙের ফেল্ট শয্যায় বিছিয়ে রাখা হয়েছে ডেথ। সুটটাকে, ফলে জেডের নীল-সবুজ রঙটা ভালোভাবে ফুটেছে। ফেল্ট-এর একটা প্রান্ত ধরে টানতে শুরু করল রানা। নগ্ন, অসমাপ্ত সারফেসের সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকানো জিনিসটা। প্লাটফর্মের পাশগুলো পালিশ করা ঝকঝকে, কিন্তু মেঝেটা কাঁচা কাঠ। রানা আশা করছে, ফেল্টের নীচে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে রোলটা। লুকাবার পর জায়গাটার উপর আঠা লাগানো ফেল্ট ফেলা হয়েছে।

ওর দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, কাজটা শেষ করতে পারল না।

<

Super User