রানা লন্ডনে এসেছে বিএসএস চীফ মারভিন লংফেলোর জরুরী আহবানে। তিনি নাকি ভয়ানক এক সঙ্কটে পড়েছেন, চাকরি যায় যায় অবস্থা। শুধু তিনি নন, ব্রিটেনও নাকি খুব বড় একটা বিপদে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। সরাসরি রানার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি, কারণ রানা পেশোয়ার থেকে ইসলামাবাদে চলে গিয়েছিল। বিএসএস চীফ বিসিআই হেডকোয়ার্টার ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করেন,  কথা বলেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের সঙ্গে। বহুকাল আগে রয়্যাল নেভীতে দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন, সম্পর্কটা বন্ধুত্বের, কাজেই রাখ-ঢাক না করে নিজের ও ব্রিটেনের বিপদের কথা খুলেই বলেছেন। রাহাত খান জরুরী বার্তা পাঠিয়ে সব কিছুই অবহিত করছেন রানাকে, সেই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছেন প্রয়োজন অনুসারে মারভিন লংফেলোকে রানার সাহায্য করতে হবে।

হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে কাস্টমসের ঝামেলা সারল রানা। টার্মিনাল ভবনে ঢুকতেই দেখা হলো বিএসএস-এর একজন এজেন্টের সঙ্গে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ঢোকার পাস পাওয়া গেল তার কাছ থেকে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিল্ডিংটা হোয়াইট হলে। রানা এজেন্সির লন্ডন শাখা আগেই খবর পেয়েছিল, তারা রানার প্রিয় বাহন অ্যাসটন মার্টিন গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছে এয়ারপোর্টে। গাড়ি নিয়ে বিল্ডিংটার পিছনের রাস্তায় পৌঁছুল রানা, পাস দেখিয়ে সিকিউরিটি

গেট পেরল, পার্ক করল মারভিন লংফেলোর রোলস রয়েসের পিছনে।

রানাকে বাদ দিয়েই শুরু হয়ে গেছে মীটিং। ভেতরে খুব হৈ চৈ। স্টাফ অফিসাররা হুকুম করছেন, রিপোর্ট সংগ্রহ করছেন। দেয়াল জোড়া ভিডিও ক্রীনে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ চীন সাগরে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে রয়্যাল নেভীর জাহাজ বহর। একটা মনিটরে দেখা যাচ্ছে আগের সেই ভিডিও, খাইবার পাসের চোরা বাজার থেকে লাল একটা চৌকো বাক্স কিনছে খায়রুল কবির। কামরার ভেতর পদক আর মেডেলের ছড়াছড়ি, দেখে রানা আশ্চর্য হলো না। উপস্থিত প্রায় সবাইকেই চিনতে পারল ও–ফাৰ্ট সী লর্ড, অ্যাডমিরাল রবিনহুড, মারভিন লংফেলোবিল হ্যামারহেড।

যে-কোন কারণেই হোক, অ্যাডমিরাল রবিনহুড সাংঘাতিক খেপে আছেন বলে মনে হলো। আক্ষরিক অর্থেই থরথর করে কাঁপছেন তিনি। মারভিন লংফেলোকে অস্বাভাবিক গম্ভীর লাগছে।

অ্যাডমিরাল রবিনহুড চিৎকার করে কথা বলছেন, আপনি রয়্যাল নেভীর বিরদ্ধে, চীনা এয়ার ফোর্সের পক্ষে কথা বলছেন! এ কিভাবে সম্ভব? তার চেহারা লাল হয়ে আছে রাগে।

এ আপনার ভিত্তিহীন অভিযোগ! প্রতিবাদ করলেন মারভিন লংফেলো।

ওরা আমাদের একটা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে, অথচ আপনি একটা জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন চাইছেন? আপনার কাছ থেকে এ-ধরনের কাপুরুষতা…

আমার সঙ্গে একমত না হতে চান, না হন, কিন্তু ওই কাপুরুষতা শব্দটা আবার যদি ব্যবহার করেন, আপনাকে আমি একপাশে সরে দাঁড়াতে বলব, অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বললেন মারভিন লংফেলো।

বোবা হয়ে থাকা বিল হ্যামারহেডের দিকে তাকাল রানা, এই সময় কামরায় ঢুকলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। চেহারাই বলে দিল, মারভিন লংফেলোর শেষ কথাটা শুনে ফেলেছেন। কি ব্যাপার? জানতে চাইলেন তিনি। মি. লংফেলো, কথা শুনে মনে হচ্ছে। আপনি অ্যাডমিরাল রবিনহুডকে চ্যালেঞ্জ করছেন…পাঞ্জা লড়ার?

হ্যাঁ, অবশ্যই, চ্যালেঞ্জই করছি।

এটা ছোটখাট বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার সময় নয়, কারণ ব্রিটেন একটা জাতীয় সঙ্কট মোকাবিলা করছে! ঘোষণা করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। দশ মিনিটের মাথায় শুরু হতে যাচ্ছে ইমার্জেসী কেবিনেট মীটিং। আপনারা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা দিন আমাকে।

ফাস্ট সী লর্ড বললেন, অ্যাডমিরাল শেলওয়ানের সঙ্গে এখন তিনটে ফ্রিগেট রয়েছে, কালকের মধ্যে আরও তিনটে পৌছে যাবে।

কাল ওখানে আমাদের পঞ্চাশটা ফ্রিগেট পৌঁছুলেও কোন লাভ নেই, বললেন মারভিন লংফেলো। কারণ, আমাদের জাহাজ-গুলোর কাছ থেকে চীনাদের বৃহত্তম এয়ার ফোর্স বেস মাত্ৰ দশ মিনিটের পথ। আমি বলতে চাইছি, অত কাছাকাছি আমাদের জাহাজ বহরকে চীন থাকতে দেবে না। ভেবে দেখুন, আমরা কি ইংলিশ চ্যানেলে চীনাদের জাহাজ বহরকে থাকতে দেব?

হাত ছুড়ে অ্যাডমিরাল রবিনহুড বললেন, তারমানে আপনি বলতে চাইছেন ওরা আমাদের জাহাজ ডুবিয়ে দিলেও আমরা সেটা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেব?

আরে ধ্যাত, তার দিকে কটমট করে তাকালেন মারভিন লংফেলো। তা কেন…

প্লীজ! গলা চড়ালেন মন্ত্রী। মি. লাংফেলো, আপনি আসলে ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বলুন তো।

বিএসএস চীফকে কথা বলতে না দিয়ে অ্যাডমিরাল বললেন, উনি বলতে চাইছেন চীনা পাইলটরা কোন ভুল করেনি, আমাদের জাহাজই নাকি কোর্স ছেড়ে চীনা উপকূলের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। লেটেস্ট স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম যাই বলুক!

আমি বলতে চাইছি, লংফেলো বললেন, জিপিএস সিস্টেমে কারিগরি ফলানো হয়ে থাকতে পারে। আমার ধারণা ছিল তা সম্ভব নয়, মন্তব্য করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

বিল! ডাক দিলেন বিএসএস চীফ।

ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের চীফ অব স্টাফ, রানার পুরানো বন্ধু, মারভিন লংফেলোর সাহায্যে এগিয়ে এলেন। আপনি তো জানেনই, স্যার, সমুদ্রের জাহাজ ও আকাশের প্লেন, গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইট সিস্টেম অর্থাৎ জিপিএস-এর ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিরক্ষা দফতরের একটা স্যাটেলাইট নেটওঅর্ক বিরতিহীনভাবে টাইম সিগনাল ব্রডকাস্ট করে, ল্যান্ড বেসড অ্যাটমিক ব্লক থেকে সংগ্রহ করার মাধ্যমে।

এ-সব আমার জানা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বললেন। এবং আমার হাতে সময় আছে আর মাত্র পাঁচ মিনিট।

সামান্য বিব্রত হ্যামারহেড আরও দ্রুত কথা বলছেন, এই সিগনালগুলো এনকোডেড, কাজেই রিসিভার জানে কোন স্যাটেলাইট কি সিগনাল ব্রডকাস্ট করছে। অ্যাটমিক রূক সিগনাল এনকোডিং সিস্টেম, আমেরিকানরা যেটাকে এসিএসইএস বা

অ্যাকসেস বলে–অত্যন্ত সতর্ক প্রহরায় রাখা মার্কিন সরকারের একটা গোপন ডিভাইস।

হ্যামারহেড কথা বলছেন, এই সময় একজন স্টাফ অফিসার একগাদা খবরের কাগজ নিয়ে ঝড়ের বেগে কামরায় ঢুকলেন। কাগজগুলো সবাইকে তিনি বিলি করছেন। হাতে পাওয়া একটা কাগজের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

ওদিকে হ্যামারহেড আবার তার কথা শুরু করেছেন, গোটা দুনিয়ায় সব মিলিয়ে মাত্র বাইশটা অ্যাকসেস ডিভাইস আছে।

মাই গড! , আঁতকে উঠলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। এ কী দেখছি! নিজের কাগজটা মারভিন লংফেলোর সামনে মেলে ধরলেন তিনি। এক্সকিউজ মি, মি. লংফেলো। দৈনিক আগাম খবর-এর সর্বশেষ।সংস্করণটা একবার দেখুন।

আগাম খবর-এর হেডলাইনটা যেন চিৎকার করছে।

লাশগুলো উদ্ধার করেছে একটা ভিয়েতনামী জেলে নৌকা। খবরটা পড়ছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। কেউ কেউ সতেরো বছরের কিশোর মাত্র।

পড়ছেন অ্যাডমিরালও, বুলেটগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, চীনাদের মিগগুলো এই বুলেটই ব্যবহার করে।

চীফ অভ স্টাফ বিল হ্যামারহেডের দিকে তাকিয়ে বিদ্ৰুপাত্নক সুরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বললেন, আবার শুরু করুন, মি.হ্যামারহেড।

এর আগে বলেছি বাইশটা অ্যাকসেস ডিভাইস আছে। আসলে তেইশটা ছিল। ধারণা করা হয় একটা ইউএস ট্রান্সপোর্ট পুেন বিধ্বস্ত হবার সময় ওটা হারিয়ে গেছে…

খবরের কাগজের উত্তেজক শিরোনাম দেখতে ব্যস্ত সবাই, বিল হ্যামারহেড শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারছেন না, লক্ষ্য করে একটা মনিটরের সামনে এসে দাঁড়াল রানা–ওটায় খায়রুল কবিরের ভিডিও টেপ চালু রয়েছে। বোতামে চাপ দিল ও, ফ্রেমটা স্থির হয়ে গেল, তাতে দেখা যাচ্ছে লাল বাক্সটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কবির। ওটাই হলো হারানো অ্যাকসেস, গলা চড়িয়ে বলল রানা, সবাই যাতে মনোযোগ দেয়। যার হাতে ওটা রয়েছে তার মত টেকনিকালি সফিসটিকেটেড হলে যে কেউ একটা সাধারণ স্যাটেলাইটকে দিয়ে জিপিএস স্যাটেলাইটের কাজ করাতে পারবে, অর্থাৎ তার পক্ষে যে-কোন জাহাজকে নির্দিষ্ট কোর্স থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

রানার নাকের সামনে নাক নিয়ে এসে অ্যাডমিরাল রবিনহুড তীক্ষ কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কিন্তু আপনি কে, স্যার?

আমি ব্লাক নাইট, অ্যাডমিরাল, জবাব দিল রানা। চিনতে পারছেন না? ব্ল্যাক নাইট, যে আপনার নাম পাল্টাবার সুপারিশ করেছিল।

হোয়াট! কোন সূত্র নেই, কাজেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বিস্মিত।

লংফেলোর দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল। আমি ডিটেলস জানতে চাই। উনি শ্বেতাঙ্গ নন। তাহলে?

অশ্বেতাঙ্গ বহু লোক রয়্যাল নেভীতে আছে, জবাব দিলেন বিএসএস চীফ, ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসে থাকবে না কেন? উনি মাসুদ রানা, আমাদের অনারারি অ্যাডভাইজার। হ্যামারহেডের দিকে ফিরলেন তিনি। বিল, তোমার কথা শেষ করো।

এফএমজিএন স্যাটেলাইটের কথা আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। ওগুলো নিউজ স্যাটেলাইট, এখনও ব্ৰডকাষ্ট করার অনুমতি পায়নি। ওই রাতে ওদের একটা স্যাটেলাইট চীনের ওপর ছিল, সেটা থেকে একটা সিগনালও পাঠানো হয়।

তারমানে কি ওই সিগনাল জাহাজটাকে কোর্স থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়? জিজ্ঞেস করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

মি. লংফেলো তা বলতে পারেন না, চ্যালেঞ্জের সুরে প্রশ্ন করলেন অ্যাডমিরাল, পারেন কি?

পারি না, বললেন লংফেলো। আমরা শুধু জানি যে তা সম্ভব। রানার দিকে তাকালেন তিনি, মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল রানা।

অর্থাৎ কোন প্রমাণই নেই, অ্যাডমিরাল গলা চড়ালেন। কিন্তু আমাদের জাহাজ বহর যখন নটিংহামকে খুঁজে পাবে, প্রমাণের কোন অভাব হবে না। শুধু বিএসএস চীফ মি. লংফেলো বলছেন বহর পাঠানো উচিত হবে না। উনি চাইছেন হাতে হ্যাট নিয়ে চীনাদের কাছে যাই আমরা, জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন-এর জন্যে অনুরোধ করি। এরচেয়ে অদ্ভুত কথা আর কি হতে পারে!

কথাটা কি সত্যি? লংফেলোর দিকে তাকালেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

হ্যাঁ, এটাই আমার সুপারিশ। তবে মাথা নত করে যাবার কথা আমি বলিনি,  জবাব দিলেন বিএসএস চীফ।

মি. লংফেলো, মাথা নাড়ছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। না এ অসম্ভব। সব কটা জাতীয় দৈনিক প্রতিশোধ নিতে বলছে। যৌথ তদন্তের কথা বললে মিডিয়া আমাদের কল্লা চাইবে।

আমি বরং মিডিয়ার মুখোমুখি হব, বলব জাহান্নামে যাও; কিন্তু মিডিয়ার ভয়ে দেশটাকে বিপদের মধ্যে ফেলতে পারব না।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর চোখ জোড়া কুচকে উঠল। আমার সঙ্গে  এদিকে একটু আসুন, প্লীজ, মি. লংফেলো।

লংফেলোকে নিয়ে এক পাশে সরে গেলেন তিনি।

আরেক পাশে সরে এল রানা, বিল হ্যামারহেডের সঙ্গে। বস ঠিক কথাই বলছেন, তবে এবার তিনি বোধহয় অধিকারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন, ফিসফিস করলেন হ্যামারহেড। ওরা না তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।

বাজি ধরে বলতে পারি ব্যাপারটা অত দূর গড়াবে না, মন্তব্য করল রানা।

আপনার গাড়ির চাবিটা আমাকে দেবেন?

উহু, গাড়ি বাজি ধরতে রাজি নই আমি।

না, না–চাবি চাইছি আর কাউকে  দিয়ে গাড়িটা রানা।এজেন্সিতে পাঠাব, তাই। আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা শেষ করে ঘুরলেন মারাভন। লংফেলো, ঠোঁট জোড়া পরস্পরের সঙ্গে চেপে আছে, অ্যাডমিরালকে পাশ কাটালেন, তারপর পাশ কাটালেন রানা ও হ্যামারহেডকে। রানা ও হ্যামারহেড দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর তার পিছু নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এল।

রোলস-রয়েসের জাম্প সীটে বসল রানা, মারভিন লংফেলো আর বিল হ্যামারহেডের দিকে মুখ করে। শোফার গাড়ি ছাড়ার পরও বিএসএস চীফ কথা বলছেন না, তবে তাকে শান্ত ও ঠাণ্ডা দেখাচ্ছে। বিপদ যত গুরুতরই হোক, বিচলিত হতে জানেন না। ঠিক পথে আছেন, এই বিশ্বাস তাঁকে শক্তি ও সাহস যোগাচ্ছে।

ক্রিস্টাল ডিক্যান্টার থেকে দুটো গ্লাসে স্কচ ঢাললেন হ্যামারহেড, মারভিন লংফেলো একটা বোতামে চাপ দিলেন। রানার পাশে একটা প্যানেল সরে গেল, বেরিয়ে পড়ল একটা সফিসটিকেটেড কমিউনিকেশন বোর্ড। আরেকটা বোতামে চাপ দিলেন তিনি, এবার রানার মাথার পিছন থেকে প্রাইভেসী প্যানেল সরে গেল, দেখা গেল শোফারের পাশে বসে রয়েছে। সূর্যমুখীর সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিএসএস চীফের প্রাইভেট সেক্রেটারি জুলিয়া পার্কার। জুলিয়া জেমস বন্ডের প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিল, বন্ড অ্যাক্সিডেন্ট করে ছুটিতে থাকায় নতুন দায়িত্ব পেয়েছে। তার সঙ্গে টেলিফোন আর ল্যাপটপ কমপিউটর রয়েছে। গাড়িতে বিএসএস

চীফের মোবাইল অফিস শুধু নয়, মোবাইল আউটার অফিসও আছে।

ইভনিং, রানা জুলিয়া বলল। রোদ লেগে তার লালচে চুল চকচক করছে।

ইভনিং, জুলিয়া বলে হাসল রানা।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে মারভিন লংফেলো বললেন, জুলিয়া, দৈনিক এক্সপ্রেসে একটা খবর পাঠাও। বলো, সরকার আমাকে বরখাস্ত করতে চায়, কিন্তু সবার নামে আমার কাছে ফাইল থাকায় ভয় পাচ্ছে।

এরপর রানা ও হ্যামারহেডের দিকে তাকালেন তিনি, বললেন,। খবরটা ছাপা হলে দিন দুই সময় পাওয়া যাবে। কার চাকরি গেল বা থাকল সেটার কোন গুরুত্ব নেই, এই দুদিনে ব্রিটেন এমন একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে যে যুদ্ধে জেতার কোনই সম্ভাবনা নেই আমাদের। ওদের ধারণা ওঁরা ঠিক পথে আছেন। তাছাড়া, ওদের হাতে প্রমাণও প্রচুর। আমাদের হাতে কিছুই নেই। শুধু দুতিনটে জিনিস মিলছে না।

আমার যদি কিছু করার থাকে… ভদ্রতাবশত শুরু করল রানা।

তোমার চীফের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, রানা, মারভিন লংফেলো বললেন। তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন।

কিসের অনুমতি? জানতে চাইল রানা।

পকেট থেকে একটা কমপিউটর প্রিন্টআউট বের করে রানার হাতে ধরিয়ে দিলেন বিএসএস চীফ। এটা দেখো। তিনি বলেছেন, আমাকে তুমি সাহায্য করবে।

প্রিন্টআউটে চোখ বুলিয়ে মাথা ঝাকাল রানা। বেশ। কি করতে হবে আমাকে?

আমরা হিথরোয় যাচ্ছি, রানা, বললেন লংফেলো। তোমাকে একটা প্লেন ধরতে হবে।

শুনে রোমাঞ্চিত হলো রানা। কোথায় যাচ্ছি, মি. লংফেলো? বেইজিং? নাকি হঙকঙ?

না। হামবুর্গে। আমার ধারণা ম্যাডক ফাউলারের স্ত্রীকে তুমি চেনো।

ভুরু কোঁচকাল রানা। হ্যাঁ। এক সময় তাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবেই চিনতাম। তখন তার পরিচয় ছিল পামেলা ক্যাম্পবেল। কিন্তু সে খবর খুব কম লোকই জানে।

চোখ ঘুরিয়ে জুলিয়ার দিকে তাকাল রানা, সে ঠোঁট টিপে হাসছে। উল্টোটাই বরং সত্যি, রানা। আমরা এসপিওনাজে আছি, ভুলে যেয়ো না।

লংফেলো বললেন, ওখানে হ্যামারহেড যখন স্যাটেলাইটের কথা বলছিল, তুমি আমার দিকে তাকিয়েছিলে–কেন, রানা?

উনি ফাউলার মিডিয়া গ্রুপ নেটওঅর্ক এর স্যাটেলাইট সম্পর্কে বলছিলেন, কাজেই আমার মনে পড়ে যায় দৈনিক আগাম  খবরের মালিকও ফাউলার।

ঠিক তাই, রানাও একই লাইনে চিন্তা করছে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন বিএসএস চীফ। আমাদের কোন এজেন্টকে না ডেকে তোমার সাহায্য চাওয়ার কারণটা হলো রানা, এর সঙ্গে খায়রুল কবির জড়িত। সে তোমার স্বদেশী হওয়ায় তার মন-মানসিকতা তুমিই ভাল বুঝবে। বিপদের জড় প্রথম সুযোগেই উপড়ে ফেলতে চাই আমি। তবে মনে রাখবে, প্রথম প্রায়োরিটি খায়রুল কবির নয়। তোমার কাজ হবে নটিংহাম ডোবার জন্যে চীনারা দায়ী নয়, এটা প্রমাণ করা। বিল।

বিল হ্যামারহেড তৈরি হয়েই ছিলেন, মোটা একটা ফাইল ধরিয়ে দিলেন রানার হাতে। ম্যাডক ফাউলারের ডোশিয়ে। তার সম্পর্কে যা কিছু জানার সব আপনি এতে পাবেন।

হিথরোর পথে মটরওয়েতে উঠে এল রোলস-রয়েস। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌছে যাবে ওরা।

রানা জানতে চাইল, আপনার ধারণা এর সঙ্গে ফাউলার জড়িত।

এশিয়া থেকে এফএমজিএন স্যাটেলাইট অজ্ঞাত একটা সিগনাল পাঠাবার ঠিক আগে এফএমজিএন-এর হামবুর্গ ব্রডকাস্ট সেন্টার থেকেও আরেকটা অজ্ঞাত সিগনাল পাঠানো হয়েছে, জবাব দিলেন হ্যামারহেড। ওই সেন্টার এখনও খোলা হয়নি, খোলা হবে আজ রাতে। ফাউলার সেখানে বিরাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

রানার হাতে একটা এনভেলাপ ধরিয়ে দিল জুলিয়া। তোমার টিকেট, কাভার স্টোরি আর কার রিজার্ভেশন, বলল সে। এখানে সই করো, প্লীজ।

এনভেলাপটা নিচ্ছপ রানা। লংফেলো বললেন, ফাউলার স্যাটেলাইটের মালিক কবিরকে তুমি এমন একটা ডিভাইস কিনতে দেখেছ যেটা শুধু স্যাটেলাইটের কাজে ব্যবহার করা যায়। তোমাকে দেখতে হবে দুটোর মধ্যে যোগাযোগ আছে কিনা। ফাউলারকে একটু খোচাও। তার স্ত্রী…

জানি না আমার কথা পামেলার মনে আছে কিনা।

মনে করিয়ে দেয়া যায়, ফিসফিস করল জুলিয়া। তোমার মত হ্যান্ডসাম পুরুষ একটা মেয়ের কাছ থেকে যে-কোন তথ্য আদায় করতে পারবে।

কই, তোমার কাছ থেকে তো পারি না, রানাও পাল্টা ফিসফিস করল।

মিষ্টি হেসে মাঝখানের পার্টিশনটা টেনে দিল জুলিয়া। রানার দিকে ঝুকে বিএসএস চীফ বললেন, ফাইলটা পড়ার পর মনে হবে স্রেফ বড় একটা পার্টিতে যাচ্ছ তুমি। কিন্তু আমার যদি ভুল না হয়, তুমি ভয়ানক এক বিপদের মধ্যে থাকবে।

ইতিমধ্যে হিথরো এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে টারমাকে ঢুকে পড়েছে রোলস-রয়েস। একটা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ সেভেন-ফাইভ-সেভেন আকাশে ওঠার জন্যে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। গ্রাউন্ড ক্ররা এয়ারক্রাফটের দিকে মই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল রোলস-রয়েস।

সাবধানে থাকবে, রানা, রানা গাড়ি থেকে নামার আগে মারভিন লংফেলো বললেন। তোমাকে আমি শ্ৰদ্ধেয় বন্ধুর কাছ থেকে ধার হিসেবে পেয়েছি, বহাল তবিয়তে ফিরিয়ে দিতে না পারলে মুখ দেখাতে পারব না।

সেভেন-ফাইভ-সেভেন বিকেলে ল্যান্ড করল হামবুর্গে। টার্মিনাল ভবনটা অত্যাধুনিক, ছাদ দেখে মনে। হয় কোন প্লেনের বিশাল একটা ডানা। ভেতরে অসংখ্য দোকান আর রেস্তোরা আছে।

হামবুর্গ শহরে একাধিক খাল থাকায় প্রায়ই ভেনিস আর আমস্টারডামের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বারোশো বছরের পুরানো শহর, স্বভাবতই সমদ্ধ একটা ইতিহাস আছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের  পর শহরটাকে নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। পার্কগুলো বিশাল, বহুতল ভবনগুলো আক্ষরিক অর্থেই আকাশ ছোয়া, চারদিকে ছড়িয়ে আছে নামকরা সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান।  হামবুর্গ জার্মানীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, সবচেয়ে সবুজ বলেও দাবি করা হয়। সারফেস এরিয়ার পঞ্চাশ ভাগ জুড়ে রয়েছে পানি, খেত-খামার, বনভূমি ও এক  হাজার চারশো বাগান আর পার্ক।

হামবুর্গে আগেও কয়েকবার এসেছে রানা, শহরের সব কিছু চেনে। এক বাংলাদেশীর রেন্ট-আ-কার কোম্পানী পক্ষীরাজ-এ চলে এল ও, সুন্দরী এক বঙ্গ ললনাকে বলল, আমার অফিস একটা কার রিজার্ভ করেছে। জুলিয়ার দেয়া রিজার্ভেশন নম্বরটা জানাল ও। এক মিনিট, বলে কাউন্টার থেকে সরে গেল মেয়েটা। পক্ষীরাজ হামবুর্গে বিসিআই-এর একটা কাভার, জানে রানা। ভাবছে কি গাড়ি দেয়া হবে ওকে। বিসিআই এর টেকনিকাল ব্রাঞ্চ ইউরোপে একটা জাগুয়ার এক্সকেএইট-এর ওপর কারিগরি ফলাচ্ছে বলে গুজব শুনেছে ও, শোনার পর থেকে খুব ইচ্ছে  একবার চালিয়ে দেখে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সুযোগ পায়নি।

এম. আরনাইনের ট্রেনিং ভূমিকা পালন করল, বেমানান কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখার জন্যে সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চারদিকে দৃষ্টি বোলাল রানা। কামরার চারদিকটা দেখা শেষ করেছে, চোখ পড়ল নিউজস্ট্যান্ডে ঝুলন্ত আগাম খবর-এর ওপর। হেডলাইন দাবি করছে–চীন ব্রিটিশ জাহাজ বহরকে সাবধান করে দিয়েছে।

এখানে আপনাকে সই করতে হবে, মি. রানা, প্লীজ। পিছন থেকে বলল কেউ, গলাটা রানা সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। ঘুরে তাকাতেই পক্ষীরাজের লাল জ্যাকেট পরা সলিল সেনকে চিনতে পারল ও। পরস্পরের বন্ধু ওরা, সলিলও বিসিআই এজেন্ট। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। হেসে উঠে দুজনের কাভারই ফাটিয়ে দিতে যাচ্ছিল রানা, শেষ মুহুর্তে কোনমতে সামলে নিল নিজেকে। কাউন্টার থেকে বীমা কোম্পানীর একটা ফর্ম তুলে নিয়ে রানার সামনে রাখল সলিল, আপনার নতুন গাড়ির জন্যে এই ফর্মটা পূরণ করতে হবে, মি. রানা।

লাইনে দাঁড়ানো কয়েকজন লোক ওদের কথা শুনছে, ফর্মটা পূরণ করার পর নিচু গলায় কথা বলল রানা, আর কোন রকম প্রটেকশন দরকার আছে আমার?

আছে, দোস্ত, বলে কাউন্টারের পিছনের একটা দরজা খুলে নিঃশব্দে ইঙ্গিত করল সলিল। ঘুরে কাউন্টারের ভেতর দিকে ঢুকল রানা, তারপর সলিলের পিছু নিল। দরজা টপকে বিশাল এক গ্যারেজে ঢুকল ওরা। ভেতরে কোথাও কোন গাড়ি নেই, তবে কাঠের কয়েকটা প্রকাণ্ড বাক্স দেখা গেল, একেকটা মাঝারি আকৃতির ঘরের মত, তাতে লেখা পক্ষীরাজ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি। সলিল বলল, আমি এখানে আছি বলেই দায়িত্বটা বস আমাকে দিয়েছেন।

তুই কি আমাকে ব্রিফ করবি? রানার গলায় অবিশ্বাস।

মাথা নাড়ল সলিল। না। বলতে পারিস তোকে আমি যুদ্ধের জন্যে সাজিয়ে দেব। প্ৰথমে তোর গাড়ি প্রসঙ্গে অাস যাক।

একটা রশি ধরে টান দিল সলিল, প্রথম বাক্সটার সামনের অংশ একপাশে সরে গেল, ভেতরে দেখা গেল খাচায় বন্দী মস্ত একটা জাগুয়ার। জানোয়ারটা বিকট শব্দে রানার উদ্দেশে খেকিয়ে উঠল, শুনে ওর অ্যার পানি শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো।

হা-হা করে হেসে উঠল সলিল। রঙ অ্যাসাইনমেন্ট। সরি, দোস্ত।

ঢিল পড়ল রানার পেশীতে, ও-ও হাসল।

দ্বিতীয় বাক্সটার দিকে এগোল সলিল। কিন্তু রানা দেরি করছে, তাকিয়ে আছে এখনও জাগুয়ারের দিকে। ওর তীক্ষ দৃষ্টির সামনে শান্ত হয়ে গেল জানোয়ারটা।

বন্ধুকে পেয়ে বক বক করছে সলিল, প্র্যাকটিকাল জোক থেকে অঢেল মজা পেয়েছে। রানাকে চমকে দেয়া অত্যন্ত কঠিন, তবে সফল হলো প্রতিবারই। স্মরণীয় হয় ঘটনাটা। আয়, আরেকবার। চেষ্টা করি, বলল সে, তারপর দ্বিতীয় বাক্সটার। সামনে দাঁড়িয়ে আরেক প্রস্থ রশি ধরে টান দিল। বাক্সটার চারটে দিকই খসে পড়ল মেঝেতে, উন্মোচিত হলো নতুন মুদ্রার মত চকচকে ঝকঝকে একটা গাড়ি।

আনকোরা নতুন বিএমডব্লিউ সাতশো পঞ্চাশ। যা যা থাকার তা তো আছেই, আরও আছে মেশিন গান, রকেট….

সিডি প্লেয়ার আছে? বাধা দিয়ে জানতে চাইল রানা।

সলিল বলে যাচ্ছে, রানার কথা যেন শুনতেই পায়নি, জিপিএস ট্রাকিং ও…. গাড়ির দরজাটা খুলল রানা।….বিশেষ করে এটার জন্যে আমি খুবই গর্বিত।

ইংরেজিতে কথা বলছে, তবে বাচনভঙ্গি জার্মান, বেরিয়ে এল গোপন স্পীকার থেকে, ওয়েলকাম টু বিএমডব্লিউস নিউ ভয়েস অ্যাসিসটেড নেভিগেশন সিস্টেম।

রানা দরজা বন্ধ করতে আওয়াজটা থেমে গেল। সিলভার কালার গাড়িটা খুবই পছন্দ হলো ওর। পালিশ করা কাঠের একটা ছোট বাক্স খুলল সলিল। ভেতরে ভেলভেটের ওপর শুয়ে রয়েছে নতুন একটা ওয়ালথার পি নাইনটি নাইন হ্যান্ডগান। সলিল বলল, এটা একটা হ্যামারলেস পিস্তল, সিঙ্গেল ও ডাবল-অ্যাকশন, জার্মান পুলিস ব্যবহার করে।

হাতে নিয়ে জিনিসটা পরীক্ষা করল রানা।

ফ্রেম ও অন্যান্য পার্টস হাই কোয়ালিটি পলিমার দিয়ে তৈরি। ম্যাগাজিনে ষোলোটা বুলেট ধরে, চেম্বারে অতিরিক্ত একটা রাউন্ড থাকে। রানার হাতে একটা সেল ফোন ধরিয়ে দিল সলিল। এবার এটার কথা বলি। কালো রঙের ফোন, এরিকসন মডেল। বৈশিষ্ট্য হলো ইনফ্রারেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার আছে, আছে টোয়েনটি-থাউজ্যান্ড-ভোস্ট সিকিউরিটি সিস্টেম, বিচ্ছিন্ন করা যায় এমন অ্যান্টেনা, ভিডিও ক্যামেরা ও স্টান-গান। এটা আবার তোর নতুন গাড়ির রিমোট কন্ট্রোলও। সেল ফোনের একটা বোতামে চাপ দিল সে, একটা বইয়ের মত খুলে গেল ওটা। দুবার চাপ দিবি, বলে নিজেই দুবার চাপ দিল। ওদের পিছনে বিএমডব্লিউ স্টার্ট নিল। চালু এঞ্জিন নির্দেশ পাবার জন্যে অপেক্ষা করছে।

এরপর অত্যন্ত সাবধানে টাচ স্ক্রীনের ওপর আঙুল বুলাল সলিল। এই প্যাডে যেভাবে তুই আঙুল বুলাবি সেভাবে মুভ করবে গাড়ি। আঙুল বুলিয়ে দেখাচ্ছে সে। রিভার্সে চলে গিয়ে ধীরে ধীরে পিছু হটছে বিএমডব্লিউ। আঙুলটা উল্টোদিকে সরাল সলিল। গিয়ার বদলে গেল, কয়েকবার মৃদু ঝাকি খেয়ে সামনে বাড়ল গাড়ি। স্ক্রীন থেকে আঙুল তুলে নিল সে, সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল কার। বাইরে থেকে গাড়িটা ড্রাইভ করা অত্যন্ত কঠিন, তবে চর্চা করলে…

দেখা যাক আমার ছোয়ায় কেমন সাড়া দেয়, বলল রানা। চাকার সঙ্গে পাকা মেঝে ঘষা খাওয়ায় কর্কশ আওয়াজ হলো। সবেগে পিছন দিকে ছুটল বিএমডব্লিউ, একটা বাক্সকে ঘিরে বৃত্ত তৈরি করল, তারপর লাটিমের মত একটা পাক খেয়ে সলিল আর রানার দিকে ছুটে এল। হঠাৎ থামল গাড়িটা, ওদের হাঁটু থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।

সুইচ টিপে এঞ্জিন বন্ধ করল রানা, ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। সলিলের চেহারা সাদা হয়ে গেছে।

ফাউলার মিডিয়া গ্রুপ নেটওঅর্ক কমপ্লেক্সের সামনে সার্চলাইটের উজ্জ্বল আলো ছুটোছুটি করছে। সুদৃশ্য ভবনের চত্বরে বাকা চাঁদের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়েছে একদল ভ্যালিট। দামী গাড়ির লাইন ধীরগতিতে এগোচ্ছে। অভিজাত, ধনী ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা আমন্ত্রণ পেয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন মিডিয়া প্রফেশনাল, ডিপ্লোম্যাট, ব্যবসায়ী, আর্টিস্ট, কলাম লেখক, এমন কি রক স্টারও এফএমজিএন হামবুর্গে তাদের নতুন হেডকোয়ার্টার খুলতে যাচ্ছে।

একজন ভ্যালিটের সামনে নিজের বিএমডব্লিউটা দাঁড় করাল রানা। ভ্যালিট দরজা খুলে দিল। নিচে নেমে জার্মান ভাষায় তাকে  রানা বলল, ওকে তোমার ওপর মাতব্বরি করার সুযোগ দিয়ো না।

হতভম্ব ভ্যালিট গাড়িতে উঠে প্রস্তুতি নিচ্ছে, গ্যারেজে নিয়ে যাবে। গাড়ির নারীকণ্ঠ বলে উঠল, সিটবেস্ট বাঁধুন, হুজুর।

বিল্ডিঙের ভেতর জমে উঠেছে পার্টি। হালকা বাদামী রঙের স্যুট পরেছে রানা, দরজায় দাঁড়ানো একটা মেয়ের হাতে ইনভিটেশন-কার্ডটা ধরিয়ে দিল। কার্ডে চোখ বুলিয়ে মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা। ওয়েলকাম, মি. রানা। এদিক আসুন, প্লীজ। পথ দেখিয়ে রানাকে মেইন হলরামে নিয়ে এল সে। নানা রকম ব্যানার দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘরটাকে। বাম দিকের ব্যানারে আগাম খবর-এর লোগো দেখা যাচ্ছে, ডান দিকের ব্যানারে এফএমজিএন-এর লোগো। দুটোতেই ম্যাডক ফাউলারের ছবি আছে। তারপর রানা যেদিকেই তাকাল, লক্ষ্য করল কোন না কোনভাবে ফাউলারের ছবিই শুধু প্রদর্শিত হচ্ছে।

বিশাল বিল্ডিংটা ধাতব সেতুর সাহায্যে আরও দুটো বিল্ডিঙের সঙ্গে যুক্ত। ডিজাইন বা নকশার মধ্যে অন্তপ্রচারের একটা ভাব স্পষ্ট। ফাউলারের টাকা আছে, সে তা উপভোগ ও প্রচার করতে ভালবাসে।

মেয়েটা ওকে আরেক লোকের হাতে ছেড়ে দিল। লোকটার পরনে জ্যাকেট, দেখে মনে হলো পাবলিক রিলেশন্স অফিসার। এক সুন্দরী চীনা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল সে। চীনা হলেও জাপানী পুতুলের মত নিখুঁত মেয়েটা। অপরূপ সুন্দরী। দীর্ঘ, রূপোলি রঙের একটা ড্রেস পরেছে। তাকাবার পর রানা তার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। এবার মেয়েটাও তাকাল। সে-ও চোখের পাতা ফেলছে না।

লোকটা বলল, হামবুর্গে স্বাগতম, মি. রানা। আগেই রানার কার্ডের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়েছে সে। আমি জ্যাক ফনটন, এখানকার পিআরও। রানার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল সে। হাতে সামান্য ব্যথা পেয়ে রানার ধারণা হলো, লোকটা শুধু পাবলিক রিলেশন্স অফিসার নয়, সম্ভবত বডিগার্ডও। ফনটন তখনও বলছে, ধারণা করছি এরই মধ্যে আপনাদের পরিচয় হয়েছে, আপনারা

যেহেতু পরস্পরের প্রতিদ্বন্দী।

না, সে আনন্দ থেকে এখনও আমি বঞ্চিত, বলল রানা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসি ফোটাল চোখে। আমি মাসুদ রানা।

হ্যান্ডশেক করল ওরা। মেয়েটা বলল, আমি লীনা ওয়াং। খুশি হব লীনা বলে ডাকলে। ব্যাংক অভ হঙকঙে আছি। আপনি…?

ব্যাংক অভ ইংল্যান্ডে, জবাব দিল রানা। কাভারটাকে নিরাপদই বলা যায়, কারণ সম্প্রতি ফাইন্যান্স সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে ও। টাকা-পয়সা সংক্রান্ত যে-কোন আলোচনায় উতরে যেতে পারবে। মেয়েটাকে এতক্ষণে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে ও। আকারে একটু ছোটখাট হলেও, হাবভাবে কর্তৃত্ব। আর অাত্নবিশ্বাস যথেষ্ট। ছাব্বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে বয়েস। ব্যাংকার হিসেবে ঠিক যেন মানায় না, বড়বেশি সুন্দর আর সেক্সি। মেয়েটার মধ্যে বিপজ্জনক কি যেন একটা আছে বলে সন্দেহ হলো ওর। তবে অস্বস্তির সঙ্গে কৌতূহলও বাড়ল।

রানাকে খুঁটিয়ে দেখে লীনাও সিদ্ধান্তে পৌঁছুল, এই লোক ব্যাংকার হতে পারে না। চোখ দুটো কালো আর মায়াময়, কিন্তু তা সত্ত্বেও নিৰ্ভর বা কঠিন এমন একটা কিছু আছে ওখানে, যে ভয়ের একটা ভাব জাগে মনে। এতটা সুঠাম স্বাস্থ্য, দাঁড়াবার ঋজু ভঙ্গি, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি কোন ব্যাংকারের হতে পারে না। এই লোক নিষ্ঠুর বলে চিৎকার করছে ডান ভুরুর কাছে কাটা দাগটা। তাছাড়া বড় বেশি নির্লিপ্ত আর ঠাণ্ডা। লোকটা সম্ভবত গোয়েন্দা টাইপের কিছু হবে, ধারণা করল সে। তারপর ভাবল, নাকি আমারই মত ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট?

চলুন, আপনাদেরকে মি. ফাউলারের কাছে নিয়ে যাই, বলল ফনটন। উনি আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে এগোল ওরা। লাল জ্যাকেট পরা আরও বেশ কয়েকজন অফিসারকে দেখতে পেল রানা, ধারণা করল লোক গুলো আসলে সিকিউরিটি গার্ড।

ব্যাপারটা দারুণ না? প্রথমে সব কিছু আলাদা ছিল–ফ্রন্ট অফিস বিল্ডিং ছিল আমাদের পিছনে, বাম দিকে ছিল নিউজপেপার প্ল্যান্ট, আর ডান দিকে ছিল স্যাটেলাইট নেটওঅর্ক। এখন সব এক করা হয়েছে, একই ছাদের নিচে।

হোক একই ছাদ, আমার কাছে বিশাল এক তাঁবুর মত লাগছে, মন্তব্য করল রানা।

যদি তাঁবু হয়ও, হেসে উঠে বলল ফনটন, এই তাঁবুর বৈশিষ্ট্যই হলো পুরস্কার পাওয়া।

এক ও দুতলার মাঝখানের একটা স্তরে ফাউলারকে পেল। ওরা, অতিথিরা ঘিরে রেখেছে। সবুজ ও সোনালি রঙের কাজ করা সিস্কের একটা ঢোলা আলখেল্লা পরে আছে সে, ডিজাহনটা সম্ভবত জাপানীদের কাছ থেকে ধার করা। লোকটা হাসিখুশি চেহারায় ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্য আছে, দেখে বোঝার উপায় নেই ব্রিটিশ নাবিকদের খুন করার জন্যে সে দায়ী হতে পারে। মি. ফাউলার, সবিনয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল ফনটন। ইনি মি. মাসুদ রানা, আর ইনি মিস লীনা ওয়াং।

ওদের দিকে ফিরে আন্তরিক হাসি হেসে ফাউলার বলল, ও, হ্যাঁ, আপনারা নতুন ব্যাংকার! অতিথিদের দিকে ফিরে সকৌতুকে চোখ মটকাল। ব্যাংক প্রসঙ্গে বলতে হয়, সংখ্যায় কয়েকশো হবে–আমি ওগুলোর মালিক। গ্রুপের সবাই হেসে উঠল, তবে সুরটা আড়ষ্ট। রানার দিকে আবার ফিরে জানতে চাইল, আপনারা

কি একসঙ্গে এসেছেন? হাত বাড়াল ওর দিকে।

আসতে পারলে খুশি হতাম, জবাব দিল রানা। ওঁর সঙ্গে আমার নিচে দেখা হয়েছে। ফাউলারের হাতে কঠিন একটা চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল ও।

বলুন তো, মি. রানা। সঙ্কট শুরু হবার পর বাজারের প্রতিক্রিয়া কি?

কারেন্সি মান হারালেও আপনার স্টক বাড়ছে।

ওদের সঙ্গে যোগ দিল আমেরিকান একটা মেয়ে। শ্বাসরুদ্ধকর দেহ-সৌষ্ঠব, তবে উজ্জ্বল হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে বিষগ্নতা। গাঢ় খয়েরী রঙের চুল কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। মায়াভরা হরিণীর চোখ, তা-ও খয়েরী। লো-কাট কালো ড্রেস পরেছে, লীনা ওয়াঙের মতই দৃষ্টি কাড়ে। উন্মুক্ত গলায় হীরে বসানো নেকলেসটা আলোর দ্রুতি ছড়াচ্ছে। মেয়েটার বয়েস হবে আঠাশ কি উনত্রিশ। স্মিত হেসে বাউ করল ফনটন, দল থেকে বেরিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেল।

ওহ, ডার্লিং, আমেরিকান মেয়েটিকে বলল ফাউলার। এসো, আমার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি ব্যাংক অব হঙকঙের মিস লীনা ওয়াং…. মেয়েটার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল লীনা। ফাউলার রানার দিকে ফিরল, কিন্তু ওর সঙ্গে সে নিজের স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগেই ঠাস করে জোরাল একটা শব্দ হলো।

আশপাশে উপস্থিত সবাই আওয়াজটা শুনে থেমে গেছে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল এদিকে। চোখে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা নিয়ে রানার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পামেলা ফাউলার। আর রানা, সামান্য বিব্রত, একটা হাত তুলে নিজের বাম গালটা হালকাভাবে স্পর্শ করল।

আমার স্ত্রীকে আপনি আগে থেকেই চেনেন, মি. রানা? জানতে চাইল ফাউলার, হতভম্ব দেখাচ্ছে তাকে। ব্যাখ্যা চাওয়ার ভঙ্গিতে ঘন ঘন দুজনের দিকে তাকাচ্ছে।

চিন্তা কোরো না, ডার্লিং, বলল পামেলা। তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবার আগেই মাসুদ রানা আমার কাছে প্রাচীন ইতিহাস হয়ে গেছে। লীনার দিকে ফিরল সে। তোমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওকে চড় মারায় সত্যি আমি দুঃখিত, তবে তুমি যদি ওর সঙ্গে দশ মিনিটের বেশি মিশে থাকো, কারণটা ঠিকই বুঝে নিতে পারবে।

আসলে, দশ মিনিটও হয়নি ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার,বলল লীনা, রানা সম্পর্কে তার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল।

তাহলে চলো, তোমাকে কিছু গল্প শোনাই। পুরুষদের দিকে ফিরল পামেলা। নাকে পাফ বুলিয়ে আসি। লীনার হাত ধরে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল সে।

রানাকে তীক্ষ চোখে দেখছে ফাউলার। আমার স্ত্রী খুব মেজাজী মহিলা।

হাতে জোরও খুব, জবাব দিল রানা।

চার্লস রাইডার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

চার্লস রাইডার ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। এখন তিনি আগের চেয়ে ভাল আছেন, মিথ্যে কথা বলল রানা। উনি আপনাকে গুজবে কান দিতে বারণ করেছেন।

গুজব?

অর্থহীন। ভিত্তিহীন। একদম কান দেবেন না।

আমি কৌতুহলী।

ইয়ে, মানে, লোকে বলছে যে, স্নান সুরে শুরু করল রানা, লন্ডন থেকে হামবুর্গে আর হঙকঙ থেকে ইন্দোনেশিয়ায় সরে আসার জন্যে আপনি যে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করছেন তা নাকি ব্যবসার খাতিরে নয়। এর আসল কারণ চীনাদের আপনি। ঘৃণা করেন তারা হঙকঙ ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে, আর ব্রিটিশদের ঘৃণা

করেন তারা ফিরিয়ে দিচ্ছে বলে।

উদ্ভট।

তারপর লোকে বলাবলি করছে আপনার স্যাটেলাইট সিস্টেম এত লোকসান দিচ্ছে যে নিউজ বিজনেস থেকে আপনাকে বোধহয় সরে আসতে হবে। এ-ও শোনা যাচ্ছে যে আপনি স্যাটেলাইট নেভিগেশন থেকে কিছু আয় করা যায় কিনা ভেবে দেখছেন।

নেভিগেশন! ফাউলারের সারা শরীরে রক্ত যেন ছলকাতে শুরু করল। এই লোক এ-সব কি বলছে?

অর্থহীন গুজব, আগেই বলেছি,বলল রানা।        নেভিগেশনে টাকা নেই। কি, আছে?

আমার তা জানার কথা নয়, ফাউলার বলল। আর কোন গুজব. মি. রানা?

এটা সবচেয়ে বিদঘুটে…লন্ডন ছাড়ার পিছনে আসল কারণ নাকি আপনি একজন ব্যারন হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা আপনাকে এমন কি স্যার ফাউলার বানাতেও রাজি নয়।

রানার দিকে তাকিয়ে থাকল ফাউলার। অনুভব করল চোয়ালের পেশী ব্যথা করছে। এই লোক কি মনে করে নিজেকে?

এ-সব বাজে প্রসঙ্গ থাক, বলল রানা। আপনি বরং আপনার স্যাটেলাইট প্রসঙ্গে বলুন। দুনিয়া জুড়ে কোথায় না আপনি পজিশন নিয়েছেন। কিভাবে সম্ভব হলো জানার খুব আগ্রহ আমার।

চেহারা দেখে বোঝা না গেলেও চিন্তিত হয়ে পড়ছে ফাউলার। স্যাটেলাইট সম্পর্কে নতুন করে কি বলার আছে। ওগুলো ইনফরমেশন সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

কিংবা ডিজইনফর্মেশন। আচ্ছা আপনি যদি কোন সরকারকে বা কোন দেশের জনগণকে, বা ধরন একটা জাহাজকে দিকভ্রান্ত করতে চান? প্রশ্নটা করার সময় রানার চেহারায় শিশুসুলভ সরলতা ছাড়া আর কিছু থাকল না।

ইন্টারেস্টিং, মি. রানা, দুসারি দাতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে বলল ফাউলার। অতিথিদের সামনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। একজন ব্যাংকারের এমন রঙচঙে, কল্পনাশক্তি আশা করা যায় না। আপনাকে বোধহয় একটা উপন্যাস লেখার জন্যে ভাড়া করা উচিত আমার।

তাহলেই হয়েছে! সত্যি যদি লিখতে বলেন, মনে হবে সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি।

ভুরু কোচকাল ফাউলার। কতটুকু কি জানে এই লোক?

কোথেকে যেন ওদের পাশে উদয় হলো ফনটন, দুজনের উত্তেজনা আঁচ করতে পেরেছে। ঝকমকে হাসি হেসে বলল, আপনাকে সরিয়ে নিতে হচ্ছে বলে দুঃখিত মি. ফাউলার। একবার ওপরতলায় উঠতে হবে।

রানার সামনে থেকে ফাউলারকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফনটন, কিন্তু মিডিয়া সম্রাট নতুন প্রতিপক্ষের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ভাবছে, এই লোক এত সাহস কোথেকে পায় যে আমাকে অপমান করে? লীনা ওয়াংকে নিয়ে ফিরে আসছিল পামেলা, দেখতে পেয়ে তাকেও ডাকল ফনটন, ভালই হলো আপনিও এসে গেছেন, মিসেস ফাউলার। আপনাদের দুজনকেই একবার ওপরতলায় যেতে হবে….

ফনটন আর স্ত্রীর সঙ্গে যাবার সময় রানাকে ফাউলার বলল, মার্ক টোয়েনের কথাটা কখনও ভুলবেন না, মি. রানা। উনি বলেছিলেন, যে লোক ব্যারেল ব্যারেল কালি কেনে তার সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই।

স্বামী ও রানার সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে, বুঝতে পেরে নার্ভাস ভঙ্গিতে দুজনের দিকে তাকাল পামেলা। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ফাউলার, একটু জোরেই। রানার পাশে এসে দাঁড়াল লীনা।

আমাদের ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়নি তো, মি. রানা? লীনার গলায় কৌতুক।

সঞ্চয় বরং বেড়েছে, জবাব দিল রানা। লেডিস রূমে খুব গল্প হলো, কি বলেন?

আমি বিহবল।

আমিও হতে চাই।

নাহ, সে কি বলার মত কথা?

ইংরেজি আপনি খুব ভালই বলেন। শিখলেন কোথেকে? বাচনভঙ্গিতে কোন এলাকার টান বলুন তো, উত্তর চীন?

আমেরিকায় লেখাপড়া শিখেছি না! উত্তর চীন নয়, সাংহাই।

আর কি ভাষা জানেন আপনি?

অনেক, মি. রানা। ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রাশিয়ান, ইটালিয়ান, জাপানী, আঞ্চলিক কয়েকটা চীনা ভাষা। কেন?

আপনার সঙ্গে। আমার অনেক মিল। ও-সব ভাষা আমিও জানি। পেশাও এক। সত্যি কি এক?

আমার কোন সন্দেহ নেই, বলে হাসল লীনা। শুধু পেশাই বা বলি কেন, বোধহয় উদ্দেশ্যও এক।

এই সময় ছোটখাট স্টেডিয়াম তুল্য হলরূমের আলে নিস্তেজ হয়ে এল, স্পটলাইটের আলো ফেলা হলো মাথার। ওপর ঝুলন্ত সবচেয়ে উঁচু ব্রিজটার ওপর। ওখানে স্ত্রীকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যাডক ফাউলার। নিচের অতিথিদের উদ্দেশে হাত নাড়ল সে। বিল্ডিঙে উপস্থিত প্রায় সবাই আনন্দে মুখর হয়ে উঠল। স্বামী স্ত্রী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, তবে নিচে থেকে তা শুনতে পাবার কথা নয়।

ওই লোক, মাসুদ রানা, ফাউলার বলল, তুমি তাকে ব্যাংকার হিসেবে চিনতে?

হ্যাঁ। পলকের জন্যে ইতস্তত করায় স্বামীর মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলল পামেলা।

কেউ মিথ্যে কথা বললে আমি ধরে ফেলি, ডার্লিং। ওকে তুমি চড় মারলে কেন?

ওটা ওর পাওনা ছিল।

এখন আমার কাছ থেকেও পাবে, তবে আরও কঠিন শাস্তি।

ব্রিজে একটা মাইক্রোফোন সেট করা হয়েছে, ফাউলারকে সেদিকে এগোবার জন্যে ইঙ্গিত করল ফনটন। পামেলা পিছিয়ে। এল, স্পটলাইটে একা রয়ে গেল ফাউলার।

উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে আবার হাসিখুশি আর অাত্নবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে ফাউলার। তার কর্তৃত্বপূর্ণ ভরাট কণ্ঠস্বর বিল্ডিঙের ভেতর গমগম করতে লাগল, শ্রোতাদের সম্মোহিত করে ফেলছে। কথাটা মনে পুলক জাগায়, আপনারা হয়তো শুনেছেন ভবিষ্যতে পা ফেলার সেতু। কিন্তু না, এ শুধু আমার একটা শ্লোগান নয়। এ এক অতি বাস্তব সত্য। আমি সেই সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আছি! আমার ডান দিকে সারাদিনে চব্বিশ ঘণ্টা চালু থাকছে প্রিন্টিং মেশিনগুলো, ছাপা হচ্ছে দুনিয়ার প্রথম গ্লোবাল নিউজপেপার। বাম দিকে দুনিয়ার বৃহত্তম গ্লোবাল স্যাটেলাইট নেটওঅর্ক সেন্টারকে জায়গা ছেড়ে দিতে যাচ্ছি আমরা। আমি আপনাদেরকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, অষ্টাদশ শতকের টেকনলজির চরম উৎকর্ষ দেখুন, তারপর আমার সঙ্গে পা ফেলুন ভবিষ্যতের সেতুতে, দেখুন ভবিষ্যৎ আমাদের জন্যে কি উপহার নিয়ে অপেক্ষা করছে…

তুমুল করতালি শুরু হলো। তারপর অতিথিদের একটা মিছিল ঝুল-বারান্দায় জড়ো হলো, ওখান থেকে প্রেস সেকশনটা দেখা যায়। নিচে এক সারিতে অনেকগুলো পাচতলা সমান উঁচু নিউজপেপার প্রিন্টিং প্রেস। ভিড় ঠেলে সামনে চলে এল রানা ও লীনা, নিচে চোখ বুলাল। রানার মন খুত খুঁত করছে, লীনাকে অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করল, হঙকঙে ব্যবসাবাণিজ্য এখন কি রকম?

চীনের অধীনে? খুবই ভাল! গর্বের সঙ্গে বলল লীনা।

অতিথিদের পিছু নিয়ে বিল্ডিঙটার টপ লেভেলে উঠে এল ওরা। ফাউলার ভবিষ্যতের সেতু বলছে বিশাল এক প্ল্যাটফর্মকে, সবাই জড়ো হলো তাতে। মাঝে মধ্যেই লীনা আর রানা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনের মনেই সন্দেহ। লোকজনের সঙ্গে এফএমজিএন নিউজরুমে চলে এল ওরা। ওয়েটাররা এখানে শ্যাম্পেন ভরা গ্লাস সাধছে অতিথিদের। বড় আকৃতির একটা স্যাটেলাইট মডেলকে পাশ কাটিয়ে ওদেরকে পথ দেখাল একজন পাবলিক রিলেশন্স অফিসার। নিউজরুমে চলে এল সবাই। প্রকাণ্ড কামরাটা লাল ফিতে দিয়ে দুভাগ করা। কাল রাতে এখানে বসেই কবির আর ফাউলার নটিংহামের নাবিকদের হত্যাকাণ্ড চাক্ষুষ করেছে। এই মুহুর্তে কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ফাউলার, তার চারপাশে টেলিভিশন ক্যামেরা বসানো হয়েছে। একজন মেকআপ গার্ল খুব ব্যস্ততার সঙ্গে তার চেহারার যত্ব নিচ্ছে, একটু পরই গোটা দুনিয়া জুড়ে তার জ্যান্ত ছবি প্রদর্শিত হবে। কামরার এক ধারে ঘুরঘুর করছে পামেলা। রানা আর লীনাকে ভেতরে ঢুকতে দেখছে ফাউলার, লক্ষ করল সে। হাতছানি দিয়ে ডিক মেনাচিমকে ডাকল ফাউলার। পামেলা মেনাচিমকে পছন্দ করে না। লোকটাকে দেখলেই ভয়ে তার গা শিরশির করে।

মেনাচিমের কানে কানে কি যেন বলছে ফাউলার, শোনার সময় রানার দিকে তাকাল জার্মান স্যাডিস্ট। ছোট্ট করে মাথা ঝাকিয়ে ফাউলারের কাছ থেকে সরে গেল সে।

সবই লক্ষ্য করল অদৃশ্য সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে এল, লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, প্লীজ চুপ করুন। ব্রডকাস্ট শুরু হতে আর মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড বাকি।

মেনাচিমের ওপর নজর রাখছে পামেলা। মেনাচিম ওয়াকি টকিতে কথা বলছে। পামেলার পাশে দাঁড়ানো একজন সিকিউরিটি গার্ড হঠাৎ হাত তুলল নিজের কানে। তাকে পামেলা বলতে শুনল, হ্যাঁ, মি. মেনাচিম, ওকে আমি দেখতে পাচ্ছি। বাদামী রঙের স্যুট পরে আছে। রানা?..ঠিক আছে, স্যার, ব্যবস্থা করছি।

ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে পামেলা, রানার দিকে যাচ্ছে। চারদিক থেকে গুঞ্জন উঠল, কারণ সব কটা মনিটরে ম্যাডক ফাউলারের জ্যান্ত ছবি ফুটে উঠেছে।

দশ সেকেন্ড, বুদের ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সবাই চুপ করুন, প্লীজ। ফাইভ, ফোর, খ্রী, ট, ওয়ান…

কথা বলার জন্যে লীনার দিকে ফিরল রানা, কিন্তু ওর পাশে নেই সে। চারদিকে দ্রুত চোখ বুলাল ও, দেখল একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।

গুড ইভিনিং, মিডিয়া সম্রাট ক্যামেরার দিকে ফিরে বলল। আমি ম্যাডক ফাউলার। আজ রাতে আমরা পশ্চিম গোলার্ধের নতুন ব্রডকাস্ট ফ্যাসিলিটি উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। এখানে, হামবুর্গে, আমাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছেন সম্মানীয় অতিথি বৃন্দ…

একটা স্ক্রীনে অতিথিদের একাংশকে দেখানো হলো।

…এবং একই সঙ্গে জাকার্তায়, এদের পশ্চিম গোলার্ধের হেডকোয়াটারে, এবং আমাদের আঞ্চলিক কেন্দ্ৰসমূহ যথা : লস অ্যাঞ্জেলেস, নাইরোবি, তেলআবির, মঙ্কো, নতুন দিল্লী…

ফাউলার যে-সব শহরের নাম বলছেন, বিভিন্ন মনিটরে সে সব দেশের ফ্যাসিটিটি থেকে আসা প্রতিনিধিদের ছবি আসছে।

রানার পাশে এসে দাঁড়াল পামেলা। ফিসফিস করে বলল, এমন কিছু বলেছ যা শুনে আমার স্বামী আপসেট হয়ে পড়েছে। আমি চাই এখুনি তুমি এখান থেকে চলে যাও।

কিন্তু পার্টিটা যে আমার ভাল লাগছে, বলল রানা।

আমি সিরিয়াস, রানা ওকে তুমি চেনে না। কিছু একটা করতে যাচ্ছে ও। হয়তো ঠাং ভেঙে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে। বিপদজনক সব লোক সারাক্ষণ ঘিরে রাখে ওকে। সুদৰ্শন জার্মান লোকটাকে দেখেছ? আমার ধারণ ও একট  খুনী।

অনুষ্ঠানে আসার খানিক এই মেনাচিমকে লক্ষ করেছে রানা। ওরও মনে হয়েছে, লোকটা সুস্থ নয়। ফিসফিস করে পামেলকে বলল, সন্দেহ করা হচ্ছে তোমার স্বামী ভয়ানক কোন ক্ৰাইমে জড়িয়ে পড়েছে। আমার ঠ্যাং ভাঙ্গার চেষ্টা করা হলে বুঝতে হবে সন্দেহটা মিথ্যে নয়।

কি ধরনের ক্ৰাইমের কথা…সেরেছে! বললাম কি চলে যাও …এখন কি হবে?

ওদের দিকে এগিয়ে অাসছে একজন গার্ড।

বক্তৃতা বন্ধ করেনি ফাউলার, তবে স্ত্রী ও রানার দিকে তাকিয়ে অাছে। …পরিস্থিতি খুবই জটিল। ব্রিটিশরা মনে করছে একজোড়া চীনা মিগ দক্ষিণ চীন সাগরে এইচএমএস নটিংহামকে ডুবিয়ে দিয়েছে। সত্যি ডুবিয়ে দিয়েছে কিনা জানার জন্যে  ব্রিটেন তাদের জাহাজ বহরকে পাঠাচ্ছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত আমরা প্ৰশংসা না

করে পারি না। অাত্মমৰ্যাদা আছে এমন একটা জাতি মার খেয়ে তা হজম করবে কেন? অপরদিকে চিন মনে করছে তাদের মিগ দুটোকে গুলি করে নামিয়েছে নটিংহাম। কাজেই তারা যদি নিজেদের উপকূলে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজকে ঢুকতে না দেয়, আমরা বিস্মিত  হব না…

গার্ড বলল, মাফ করবেন, মি. রানা। অাপনার টেলিফোন।

প্রথমে কথা বলক পামেলা, মি. রানাকে এই মুহুর্তে বিরত করা উচিত হবে না।

দুঃখিত, ম্যাডাম। ওরা বলল কলটা খুব আর্জেন্ট।

রানার বাহু আঁকড়ে ধরল পামেলা। যেয়ো না নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ।

আমারও তাই ধারণা, বলল রানা কিন্তু না গেলে কি হবে, দুঃসংবাদ ঠিকই আমার নাগাল পেয়ে যায়। আশ্বস্ত করার জন্যে পামেলার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে গার্ডের সঙ্গে এগোল ও।

ফাউলার বলে চলেছে, ঘটনাটা  দুঃখজনক, কোন সন্দেহ নেই, তবে উত্তেজক একটা খবরও বটে  এবং আমি গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছি যে এই সংকট সম্পর্কিত প্রতিটি নতুন খবর অামরাই বিশ্ববাসীকে সবার আগে জানাব।

অাবার তুমুল করতালি শুরু হলো, ফাউলার তৃপ্তির হাসি হাসছে, বিশেষ করে তার গার্ড রানাকে নিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে। সে তার ভাষণ এখনও শেষ করেনি।

নিউজরুম থেকে বেরিয়ে এসে গার্ডকে অনুসরণ করছে রানা। প্লাটফর্ম হয়ে প্রেস ক্লাবে এল ওরা , রানা জিজ্ঞেস করল, ওদিকে কোন ফোন নেই?

গার্ডের হতে একটা ব্রাউনিং নাইন এমএম সেমি-অটোমেটিক বেরিয়ে এল। আমরা ভবলাম এখানে, এই অফিসে বেশি আরাম পাবেন আপনি।

<

Super User