কঠিন হয়ে উঠেছে ডাংম্যানের চেহারা। শক্ত করে ধরে রেখেছে পিস্তল। বুনো পথ ধরে কিশোরের পিছু পিছু প্রায় ছুটে চলেছে শিকারীর বাংলোটার দিকে।
তোমার ধারণা, বলল ডাংম্যান, যারা পুতুল ছিনিয়ে নিয়েছে, তারাই আমাকে আক্রমণ করেছিল? তোমাদেরও তাড়া করেছিল?
কোন সন্দেহ নেই।
তাহলে ওরাই চারজনকে বন্দী করে রেখেছে। হুঁশিয়ার। বোঝা যাচ্ছে, লোক মোটেই সুবিধের না ওরা।
এতক্ষণ ওখানে আছে কিনা কে জানে। বিশেষ করে, ছায়াটা।
গেলেই দেখা যাবে। আমার মনে হয় না দুটো ছেলের ভয়ে পালাবে। কি করছে ওরা আসলে?
জানি না, স্বীকার করল কিশোর। যাদেরকে ধরে এনেছে, তারা হয়তো জানে গুপ্তধন কোথায় আছে। চাপ দিয়ে ওদের মুখ খোলাতে চাইছে হয়তো ভূতুড়ে ছায়ার মালিক।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে। দেখি, হাতে-নাতে ধরতে পারি কিনা।
ঘন বনের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে ওরা। বাটি-আকৃতির উপত্যকার কাছে চলে এল। বাংলোর সামনে ট্রাকটা নেই। রাতের মতই দিনেও রহস্যময় দেখাচ্ছে বাড়িটা।
গাছের আড়ালে কিশোরকে চুপ করে বসে থাকার নির্দেশ দিল ডাংম্যান। গাছপালা আড়ালে আড়ালে নেমে যেতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।
বাংলোটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। নির্জন, কোন সাড়া-শব্দ নেই। জানালাগুলোর খড়খড়ি খোলা, সামনের দরজাটাও। দেখে তার দৃঢ় ধারণা হলো, ভেতরে কেউ নেই।
কোন রকম ঝুঁকি নিল না ডাংম্যান। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে পৌঁছে গেল উপত্যকার খোলা জায়গাটার ধরে। এক মুহূর্ত থেমে বাড়িটা দেখল। ডেকে বলতে চাইল কিশোর, গিয়ে লাভ হবে না। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই মাথা নিচু করে দৌড় দিল ডাংম্যান। হাতে উদ্যত পিস্তল।
জানালায় গিয়ে উঁকি দিল ডাংম্যান। ঘুরে চলে গেল খোলা দরজার কাছে। ভেতরে ঢুকল।
বসে আছে কিশোর। বাংলোর ভেতর থেকে খুটখাট আর নানা রকম শব্দ কানে আসছে। তারপর দরজায় বেরোল ডাংম্যান। হাতের ইশারায় কিশোরকে ডাকল।
উঠে দৌড় দিল কিশোর।
খালি, বলল নিরামিষভোজী। কেউ নেই। তবে ছিল, দেখো।
ছোট একটা পামাজা দেখাল সে, সাদা কাপড়। এ-রকম কাপড়ই পরে ছিল ওই বাদামী-চামড়ার লোক দুটো, যারা পুতুল ছিনিয়ে নিয়েছে, কিশোর আর রবিনকে পাহাড়ে তাড়া করেছে।
ইনডিয়ান পোশাকের মত লাগছে, বলল ডাংম্যান। তোমার বাদামীরা এখানে এসেছিল মনে হচ্ছে। ট্রাকটাও ঠিকই দেখেছ। পথে তেলের দাগ দেখেছি। শুকিয়ে গেছে। তারমানে ট্রাকটা গেছে যে, অনেকক্ষণ।
কোথায় গেছে আন্দাজ করতে পারেন?
কি করে বলি? চলো, আরেকবার দেখি। কিছু বোঝো কিনা দেখো।
বাংলোয় ঢুকল দুজনে।
খুঁটিয়ে দেখছে কিশোর। তাড়াহুড়ো করে পালিয়েছে লোকগুলো। মদের খালি বোতল পড়ে আছে টেবিলে। প্লেটের অবশিষ্ট খাবার শুকিয়ে মড়মড়ে হয়ে গেছে। সব কিছু নোংরা। কিন্তু ওসব দেখে লোকগুলো কোথায় গেছে অনুমান করার উপায় নেই।
নাহ, এখানে কিছু নেই, বলল সে। এস্টেটের অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়েছে হয়তো।
তাহলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনেক বড় এলাকা এটা, পাহাড়-পর্বতের মধ্যে লুকালে কে খুঁজে বের করবে? তবে ওদের প্ল্যান বরবাদ করে দিয়েছ তুমি। ভয় পেয়ে পালিয়েছে।
আমার মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর। এত সহজে ভয় পাওয়ার লোক ওরা নয়। আজও আমাকে আর রবিনকে তাড়া করেছিল, আপনার অফিস থেকে বেরোনোর পর।
তাড়া করেছিল? আমার বাড়ির কাছে? বিশ্বাস করতে পারছে না যেন ডাংম্যান। আর কি চায় তোমাদের কাছে?
আমাদের কাছে চায় না, চায় আপনার কাছে।
আমার কাছে? আমার কাছে কি চায়?
হয়তো কিছু আছে। আমাদের কাছ থেকে পুতুলটা ছিনিয়ে নেয়ার পর আপনাকে আক্রমণ করেছিল। তারপর আমরা আপনার বাড়ি থেকে বেরোলে তাড়া করল আমাদেরকে। হয়তো ভেবেছে, জিনিসটা আমাদেরকে দিয়েছেন আপনি।
আ-আমি…কি জিনিস! ও হ্যাঁ হ্যাঁ, চেঁচিয়ে উঠল ডাংম্যান। আছে আরেকটা পুতুল। অফিসে নিয়ে রেখেছি। একটা পুতুল চুরি হওয়ার পর ঘাবড়ে গেলেন মিস পেদ্রো, আরেকটাও চুরি হতে পারে। আমিই পরামর্শ দিয়েছি, আমার কাছে নিয়ে রাখার জন্যে, নিরাপদে থাকবে। কি ভুলো মন আমার, ভুলেই গিয়েছিলাম। ওই পুতুলটাও চায় হয়তো ব্যাটারা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দুটো পুতুল এক করলে হয়তো গুপ্তধনের খোঁজ মিলবে, সে-জন্যে চায়।
হ্যাঁ, হতে পারে। কিন্তু জানল কি করে, আরেকটা পুতুল আমার কাছে?
আপনাকে নিতে দেখেছে হয়তো।
অসম্ভব। বাক্সে ভরে পকেটে ঢুকিয়ে তারপর বেরিয়েছি। অফিসে লুকিয়ে রাখার আগেও আশেপাশে ভালমত দেখে নিয়েছি, কেউ ছিল না।
আপনার সহকারীরাও না?
না। আর ওরা দেখলেও কিছু হত না, খুব বিশ্বাসী অনেকদিন ধরে আছে। আমার সঙ্গে, আমাকে গুরু মানে।
নিচের ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। মিস পেদ্রো জানেন…।
তাতে কি? বাধা দিল ডাংম্যান। উনি চোরের সঙ্গে হাত মেলাননি। আর গুপ্তধন চাইলে আগেও তো অনেক সুযোগ ছিল, দুটো পুতুলই অনেক বছর ছিল তাঁর কাছে। শুধু মিস পেদ্রো আর টনি…
টনি! ডাংম্যানের কথায়ও বাধা দিল কিশোর। সে-ও তো জানে।
হাঁ হয়ে গেল ডাংম্যানের মুখ, চোয়াল ঝুলে পড়ল, ধীরে ধীরে আবার বন্ধ হলো ফাঁক। কিশোর-মিস পেদ্রো:টনি কোন কিছুতে জড়ালে বেচারী খুবই দুঃখ পাবেন, শেষ হয়ে যাবেন!
রবিন আর মুসা যখন পুতুলটা পায়, টনি তখন গেটের কাছে ছিল। গতরাতেও অন্ধকারে এস্টেটের মধ্যে ঘুরঘুর করছিল। কতদিন থেকে চেনেন ওকে, মিস্টার ডাংম্যান?
খুব বেশি দিন না। ইংল্যাণ্ডে পরিচয় হয়েছে, এখানে আসার জন্যে রওনা হয়েছে তখন সে। আমিও লস অ্যাঞ্জেলেসে আসছিলাম। টনিই বলেছে, তার দাদী নিরামিষভোজী, অনেক আগে থেকেই। তাই প্রথমেই এসে তার সঙ্গে দেখা করলাম, থামল ডাংম্যান। গভীর। চলো, টনির সঙ্গে কথা বলা দরকার। তার দাদীকে পরে জানাব।
বুনো পথ ধরে ফিরে চলল আবার দুজনে। খুব জোরে ছুটতে পারে লোকটা, তাল রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে কিশোর।
ট্রাকে মাল বোঝাই শেষ হয়নি। গলদঘর্ম হয়ে উঠেছেন রাশেদ পাশা আর বোরিস। কোথায় গিয়েছিলি? জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ পাশা।
এই, একটু ঘুরে দেখতে, বলে কিশোরও এসে হাত লাগাল। তবে কাজে বিশেষ মন নেই, বার বার তাকাচ্ছে বাড়ির সদর দরজার দিকে। ডাংম্যান গেছে টনির সঙ্গে কথা বলতে, কেউই বেরোচ্ছে না।
অবশেষে বেরোল ডাংম্যান। কাছে এসে বলল, টনি গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন গেছে। আমি অফিসে যাচ্ছি।
টনি আপনার অফিসে গেলে চোখে পড়বে, জানাল কিশোর। রবিন আর মুসা আছে ওখানে।
বরফ হয়ে গেল যেন ডাংম্যান। কী?
লোকদুটোর ওপর চোখ রাখতে পাঠিয়েছি ওদের।
কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল নিরামিষভোজী, চেহারা ফ্যাকাসে, আমার সেফে আরেকটা পুতুল রয়েছে। ভীষণ বিপদে পড়বে ওরা। এখুনি যাচ্ছি আমি। তোমার চাচার বোধহয় হয়ে গেল। রকি বীচে ফিরেই পুলিশের কাছে যাবে।
গাড়ির দিকে ছুটল ডাংম্যান।
<