হোটেলে ফিরে ম্যাপ নিয়ে বসলো কিশোর। আর গাইডবুক পড়তে লাগলো রবিন। মুসা বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।
মিটলা ধ্বংসস্তুপে যাওয়ার পথেই পড়ে টুলে ট্রী। ম্যাপ থেকে মুখ তুলে কিশোর বললো, দরকার হলে একেবারে মিটলাতেই চলে যাবো। মনে আছে, একটা ছবিতে ছিলো, বিশাল এক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক লোক?
সিনর স্টেফানোকেও ওখানেই পাবে ভাবছো? মুসার প্রশ্ন। টুলেট্রীতে?
পেতেও পারি। কিংবা মিটলাতে। টুলে ট্রী থেকে মিটলা বেশি দূরে নয়।
গাইডবুক থেকে মুখ তুলে রবিন বললো, জানো, গাছটা তিন হাজার বছরের পুরানো! আমেরিকান কন্টিনেন্টের সম্ভবত সব চেয়ে পুরানো গাছ ওটা।
কি গাছ? মুসা জিজ্ঞেস করলো। সাইপ্রেস। সবুজ সাইপ্রেস।
এতো বছর বেঁচে আছে! খাইছে! ইস, আমি যদি এতোদিন বাঁচতাম! কতো কিছু দেখতে পারতাম, খেতে পারতাম!
তার কথায় হেসে ফেললো কিশোর। তোমার খালি খাওয়ার কথা। এক কাজ করলেই পারতে। গাছ হয়ে গেলেই হতো। মাটির ওপর শেকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, আর খালি রস টানতে মাটি থেকে…
নাহ, গাছ হয়ে লাভ নেই। বেঁচে থাকে বটে। নড়তে চড়তে পারে না, পাখিরা বাসা বাঁধে, পায়খানা করে। লোকে মড়াৎ করে ডাল ভেঙে ফেলে, পাতা ছেড়ে। না, বাপু, মানুষ হয়ে বাঁচতে পারলেই খুশি হতাম আমি…
ভূত হলে? হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো রবিন।
ভেবে দেখলো মুসা। তা হতাম। মানুষ হওয়ার চেয়ে অনেক ভালো। কেউ দেখতে পেতো না আমাকে। যা ইচ্ছে করতে পারতাম। যেখানে খুশি যেতে পারতাম। আর খাওয়া! সে তো যখন যা খুশি! যে রেস্টুরেন্টে যা পাওয়া যায়, যা খেতে ইচ্ছে করতো…নারে ভাই, ভূতই হওয়া উচিত ছিলো।
বেরোনোর সময় ম্যানেজার জানতে চাইলো, আবার কোথায় যাচ্ছে ওরা। এতে তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছে দেখে কৌতূহল হয়েছে লোকটার। জানালো কিশোর।
টুলেট্রীর দিকে গাড়ি চালালো মুসা। ম্যাপ দেখে রাস্তা বাতলে দিতে থাকলো কিশোর। শহর ছাড়িয়ে আরও কয়েক মাইল আসার পর মস্ত গাছটার দেখা মিললো। মুসা বললো, এই যে, সাইপ্রেস গাছের দাদার দাদা।
পেছন থেকে রবিন মন্তব্য করলো, শুধু দাদার দাদা না, তারও অনেক বেশি।
গাছটাকে ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে একটা পার্ক। দর্শনীয় জিনিস। টুরিস্টরা আসে। গাড়ি থেকে নেমে হাঁ করে গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো তিন গোয়েন্দা। বিশ্বাসই করতে ইচ্ছে করছে না, তিন হাজার বছর ধরে বেঁচে রয়েছে ওই গাছ। পৃথিবীর কতো পরিবর্তনের নীরব সাক্ষি। ওই গাছের বিশালত্ব আর বয়েসের কাছে নিজেদেরকে বড় ক্ষুদ্র মনে হতে লাগলো ওদের।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করলো রবিন।
গাছের কান্ডে একটা সাইনবোর্ড লেখা রয়েছে, তাতে গাছটা সম্পর্কে তথ্য। কান্ডের বেড় একশো ষাট ফুট। বয়েস, তিন হাজার বছর। জাত, সবুজ সাইপ্রেস।
চারদিকে অনেকখানি ছড়িয়ে রয়েছে ডালপালা। গোড়ার চারপাশ ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করলো তিন গোয়েন্দ।
নীরবে গাছের কাছে এগিয়ে এলো বারো বছরের এক কিশোর। তিন গোয়েন্দাকে গাছের গোড়ায় চক্কর দিতে দেখে অবাক হয়নি। এই দৃশ্য বহুবার দেখেছে সে। বুঝতে পেরেছে, ওরা বিদেশী, টুরিস্ট। তার জানা আছে, টুরিস্টদেরকে তথ্য জানাতে পারলে খুশি হয়ে পয়সা দেয়। সেই লোভেই এসেছে সে।
ঠিক যা ভেবেছিলো ছেলেটা, তা-ই ঘটলো। তাকে দেখেই কাছে ডাকলো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, কি নাম তোমার?
পিকো।
এই গাছটর কথা কি জানো তুমি?
সঅব। কয়েক পেসো পেলে বলতে পারি।
পাবে, বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো কিশোর। কয়েকটা মুদ্রা বের করে ফেলে দিলো ছেলেটার বাড়ানো হাতে। দাঁত বের করে হাসলো পিকো। পয়সাগুলো ময়লা প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়ে বললো, কি জানতে চান?
এই গাছের পুরো ইতিহাস।
সত্যিই জানে ছেলেটা। গড়গড় করে বলে যেতে লাগলো। গাইডবুকের সঙ্গে তার কথার সামান্যতম অমিল হলো না। আরও নতুন তথ্য দিলো সে, হন্ডুরাসে যাওয়ার পথে এই গাছের নিচেই জিরোতে বসেছিলেন বিখ্যাত স্প্যানিশ যোদ্ধা করটেজ।
কথায় কথায় অ্যাজটেক যোদ্ধার কথায় চলে এলো কিশোর।
অনেক যোদ্ধাই আছে। কার কথা জিজ্ঞেস করছেন?
তা তো জানি না। বিশেষ কার নাম জাননা তুমি?
অনেক অনেক আগে একজন নামকরা যোদ্ধা ছিলেন, অ্যাজটেকদের মহান নেতা। ম্যাক্সিল ডা স্টেফানো।
চট করে দৃষ্টি বিনিময় করলো তিন গোয়েন্দা। একটা জরুরী তথ্য জানতে পেরেছে। কিশোর জিজ্ঞেস করলো, একজন ডা স্টেফানোকে খুঁজছি আমরা। আধুনিক স্টেফানো। আরকিওলজিস্ট। এদিকে বেশ খোড়াখুড়ি করেন। চেনোটেনো নাকি?
না, মুখ কালো হয়ে গেল ছেলেটার। প্রশ্নের জবাব জানা না থাকা যেন বিরাট অপরাধ তার কাছে।
পিন্টো আলভারোকে চেনো? চেহারার বর্ণনা দিলো কিশোর।
হাসি ফিরে এলো ছেলেটার মুখে। সবাই চেনে তাকে। এই তো, কাছেই থাকেন সিনর আলভারো, পুবে হাত তুললো সে। ওদিকে যাবেন। বায়ের প্রথম গলিটাতে ঢুকবেন। সোজা এগিয়ে গিয়ে থামবেন শাদা রঙ করা উঁচু দেয়ালওয়ালা বাড়িটার সামনে। ওরকম বাড়ি একটাই আছে। চিনতে অসুবিধে হবে না।
ছেলেটার হাতে আরেকটা পেসো গুজে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, আলভারোর কথা আর কিছু বলতে পারবে?
খুব ভালো খুঁড়তে পারেন তিনি। বড় বড় আরকিওলজিস্টরা এসেই তাঁর খোঁজ করেন। তাদের সঙ্গে অনেক জায়গায় চলে যান সিনর আলভারো।
আর কোনোই সন্দেহ থাকলো না তিন গোয়েন্দার, এই পিন্টো আলভারোকেই খুঁজছে ওরা। তার কাছে হয়তো জানা যাবে অ্যাজটেক যোদ্ধার বংশধরের খবর। রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে তাহলে।
উত্তেজিত হয়ে এসে গাড়িতে উঠলো তিনজনে। গাড়ি ছাড়লো মুসা। পিকো ঠিকই বলেছে, বাড়িটা খুঁজে পেতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না। দরজার কড়া নাড়ল কিশোর। খুলে দিলো মোটাসোটা এক মহিলা পরনে কালো পোশাক। কালো একটা ফিতে দিয়ে চুল বাঁধা। নিশ্চয় আলভারের হাউসকিপার।
কি চাই?
সিনর আলভারো আছেন?
মিটলা ধ্বংসস্তুপে গেছেন।
ও। সেখানে গেলে তার দেখা পাবো?
পেতে পারো। যদি অন্য কোথাও চলে না গিয়ে থাকেন। মিটলা থেকেও খুঁজে বের করা কঠিন। অনেক বড় জায়গা। কোথায় যে কখন থাকবেন, বলা যায় না, হাসলো মহিলা। তবে কাছাকাছি যদি চলে যেতে পারো, তোমাদের আর খুঁজে বের করা লাগবে না। তোমাদেরকেই খুঁজে বের করবে।
মানে? বুঝতে পারলো না রবিন।
সিনরের কুত্তাগুলো বড় সাংঘাতিক। ধারেকাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। কাজ করতে গেলে লোকে বিরক্ত করে। ইদানীং তাদের হাত থেকে বাচার জন্যেই বোধহয় এই পাহারার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
গাড়িতে এসে উঠলো আবার ওরা। মিটলায় চললো। টুলেট্রী ছাড়িয়ে কিছুদূর আসার পর চোখে পড়লো ধ্বংসস্তূপ। দেখ, কতো পিরামিড! বলে উঠলো মুসা।
আরও খানিকদূর এগিয়ে গাড়ি থামালো সে। তিনজনেই নামলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ওরা। এর কাছে মনটি অ্যালবান কিছু না। মহিলা একটু ভুল বলেছে, খুঁজে বের করা কঠিন! আসলে বলা উচিত ছিলো, অসম্ভব! কিশোরের তা-ই মনে হলো। যেদিকেই তাকায়, সবই একরম লাগে দেখতে। আলাদা করা মুশকিল।
তবে, আলভারোকে সহজেই খুঁজে বের করে ফেললো ওরা। কিংবা ওদেরকেই খুঁজে বের করলো কুকুরগুলো।
কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে এগোলো তিন গোয়েন্দা। ধ্বংসস্তুপে ঢুকে ঘোরাঘুরি করছিলো, এই সময় কানে এলো ডাক। একটা সমাধি মন্দিরের কাছে পৌঁছতেই জোরালো হলো চিৎকার। মনে হলো ভেতর থেকে আসছে।
দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়েই ছিটকে সরে এলো মুসা। ঘেউ ঘেউ করে বেরিয়ে এলো বিশাল এক অ্যালসেশিয়ান। ওটার পেছনে বেরোলো আরও দুটো। ঘিরে ফেললো তিন গোয়েন্দাকে। কামড়ালো না, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলো। সেরকমই ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, ওগুলোকে। জোরে জোরে ডাকলো কিশোর, সিনর আলভারো আছেন? সিনর আলভারো! আপনাকে খুঁজছি আমরা। আমেরিকা থেকে এসেছি!
<