কোথায় যে গেছে কিশোর, মুসার অন্তত এটা বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু উত্তেজনা আর বিপদের সময় হাত-পা যতটা সহজে খেলে ততটা খেলে না তার মগজ। সে জায়গাটায় মুসা গিয়েছে, কিন্তু সেকথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি ওমর কিংবা ভজকে। তাহলে ওরা হয়ত অনুমান করতে পারতো।
ডজের অনুরোধে গুহার কাছে এসে মাছ ধরতে বসলো সাগরের হাসি আর ঝিনুক। তাদের পাশে কিশোর। দেখতে দেখতে যথেষ্ট মাছ ধরা হয়ে গেল। আগের দিনের মতই প্রস্তাব দিলো সাগরের হাসি, সাঁতরাতে নামবে। বলেই নেমে পড়ল।।
ঝিনুকও কি আর বসে থাকে? নেমে পড়লো সে-ও। কিশোর ভাবলো, গুহাঁটা দেখেই আসা যাক। এত সুন্দর যখন বলেছে মুসা।
সাগরের হাসি আর ঝিনুককে বললো সেকথা। ওরা তো বলতেই রাজি। ঢুকে পড়লো তিনজনে।
গুহাঁটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল কিশোর। মুসার মত এত সহজে আগ্রহ নষ্ট হলো তার, দেখছেই, দেখছেই। কোন দিক দিয়ে যে বেরিয়ে যাচ্ছে সময়, খেয়ালই রাখছে না।
অবশেষে যখন খেয়াল হলো, তাকে বসেই মুখ ফিরিয়ে দুই সঙ্গীকে বললো সে, চল, যাই। আর দেরি করলে রাত হয়ে যাবে। পানির দিকে তাকিয়ে কি ভাবলো। দেখ, পানির রঙ কেমন বদলে যাচ্ছে। না?
তাকের ওপর দাঁড়িয়ে সাগরের হাসি আর ঝিনুকও তাকিয়ে রয়েছে পানির দিকে। তাকের কিনার ধরে দুই হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে উঁচু করলো কিশোর। এক দোলা দিয়ে আলগোছে ছেড়ে দিতে যাবে এই সময় চিৎকার করে উঠলো সাগরের হাসি, ম্যাকো! ম্যাকো?
শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালো কিশোর। কিংবা বলা যায় ভীষণ চমকে গিয়ে শরীরটাকে ছেড়ে দিলো। ধপ করে বসে পড়লো আবার তাকের ওপর। কি বললে?
পানির দিকে হাত তুলে রেখেছে সাগরের হাসি।
মস্ত একটা তিনকোণা পাখনা ভেসে উঠেছে পানিতে। গুহার প্রবেশ মুখের কাছে। এগিয়ে আসতে লাগলো ধীরে ধীরে।
পুরো একটা মিনিট নীরবে তাকিয়ে রইলো কিশোর। লেগুনের পানিতে এখানে এই প্রথম হাঙর দেখলো। বাধা দিতে আর একটা সেকেন্ড দেরি করলে সাগরের হাসি কি ঘটত ভেবে শিউরে উঠলো। কি করবো? প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো সে।
বসে থাকতে হবে, বললো ঝিনুক। আর তো কোনো উপায় দেখি না।
সাত দিনেও যদি না যায় ওটা?
আমাদেরও থাকতে হবে।
তাকে উঠে দাঁড়ালো কিশোর। সে যেখানে রয়েছে তার ফুট দশেক দূরে ভেসে উঠলো বিশাল হাঙরের পিঠ। এত বড় ওটা, গুহাঁটা যেন প্রায় ভরে গেল। ছোট ওই বদ্ধ জায়গায় তিমির চেয়ে বড় লাগলো ওটাকে। যেখানে রয়েছে ওরা, নিরাপদেই থাকবে। কারণ তাকটা পানি থেকে তিন ফুট উঁচুতে, কোন জায়গায় দুই ফুট। ওপরে থাকলে কিছু হবে না, কিন্তু পানিতে পা নামালে মহা বিপদে পড়বে। পা কামড়ে ধরে টেনে নিতে পারে হাঙরটা। আর তার অর্থ ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
আটকা পড়লাম আমরা! বললো সে। বেরোতে পারব না। কিন্তু ব্যাটা এখানে এল কেন মরতে?
অনেক বড় ঝড় আসছে, ঝিনুক বললো। হয়ত হারিকেন। বড় বড় মাছ যখন লেগুনে ঢোকে, গুহায় ঢোকে, বুঝতে হবে বাইরের সাগরের অবস্থা খারাপ।
তাহলে এখন কি করব? এসব অবস্থায় কি করতে হয় তোমরাই ভাল বোঝ।
থাকতে হবে, আরকি।
মারা যায় না? কিংবা তাড়ান? তোমরা তো হাঙরের সঙ্গে লড়াই কর।
সেটা খোলা জায়গায় হলে। এখানে গুহার ভেতরে পারব না। আটকে ফেলবে সহজেই। ওদের ক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। বুদ্ধির জোরেই কেবল কাবু করা যায়।
বিশাল পাখনাটার দিকে তাকালো আবার কিশোর। নৌকার পালের মত খাড়া হয়ে আছে। ওরা খুব চিন্তা করবে। আমাদেরকে না পেয়ে।
বসলো সাগরের হাসি। তাকের কিনারের দেয়াল থেকে আলগা একটুকরো প্রবাল খুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো হাঙরটাকে সই করে। গাল দিলো আঞ্চলিক ভাষায়।
ধীরে সুস্থে শরীর নাড়লো হাঙরটা। দেখিয়ে দিলো ধূসর-শাদা পেট।
তোমাদের দেবতাকে ডাক, কিশোরকে পরামর্শ দিলো ঝিনুক। চিন্তিত লাগছে তাকে।
কিছু বললো না কিশোর। সে-ও ভাবছে। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। কালো হয়ে গেছে নীল পানি। তার মানে সূর্য ডুবে গেছে। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে। ওদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্যেরা। পাবে না ওপরে। তখন মূসার হয়ত, মনে পড়বে গুহাঁটার কথা। মাছ আর জুতো ফেলে এসেছে ওপরে। ওগুলো দেখে সে আন্দাজ করে ফেলবে, ওরা কোথায় রয়েছে। তখন দেখতে আসতে পারে। ওকে হুঁশিয়ার করার কোন উপায়ই নেই। সোজা এসে পড়বে হাঙরের মুখে। নিজেদের চেয়ে মুসার জন্যে এখন বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লো সে।
জীবনে অনেক বিপদে পড়েছে কিশোর। সেগুলো থেকে উদ্ধারও পেয়েছে কোন না কোন ভাবে। কখনও নিজের বুদ্ধির জোরে, কখনও অন্যের সাহায্যে। কিন্তু এই বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথই খুঁজে পাচ্ছে না সে। কোন বুদ্ধি বের করতে পারছে না। কতদিন থাকবে এখানে হাঙরটা, সেটা এখন আর বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, মুসা খুঁজতে আসবে।
শান্ত পানিতে কাঁপন উঠেছে এখন। হাঙরটা চুপ করে রয়েছে, আলোড়নটা তার সৃষ্ট নয়। পানি একবার উঠছে একবার নামছে। সেদিকে তাকিয়ে ঝিনুককে বললো কিশোর, ঠিকই বলেছ। ঝড়ই আসছে।
ঝড় থেমে গেলেই ম্যাকো চলে যাবে, বললো ঝিনুক।
ঝড়টা কতক্ষণ থাকবে?
দুই দিন। তিন দিন। ঠিক নেই।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো কিশোর। প্রবালের টুকরো ভেঙে ভেঙে ছুঁড়ছে সাগরের হাসি। যেন ঝাল মেটাচ্ছে হাঙরের ওপর। গায়েই যেন লাগছে না এই আঘাত, কিংবা অপমান গায়ে মাখছে না হাঙর। চুপ করে রয়েছে সেটা। দ্রুত অন্ধকার হয়ে গেল। আলোর কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। তার মানে একটা রাত এই গুহার ভেতরে অন্ধকারে কাটাতে হবে, যদি মুসা না আসে। আল্লাহ্, না আসুক, প্রার্থনা শুরু করলো কিশোর। না আসুক! অন্ধকারেই থাকব আমরা!
ঘুটঘুটে অন্ধকার। পানির ওঠানামার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দও নেই। হাঁটুতে থুতনি রেখে রাত কাটাতে তৈরি হলো কিশোর। জীবনের দীর্ঘতম রাত।
রাত যেন আর শেষই হতে চায় না। ভোরের আলো আসতে এত দেরি হচ্ছে, একসময় কিশোরের মনে হল দেয়াল ধসে পড়ে গুহার মুখটাই বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে। পানির ওঠানামার শব্দ বাড়ছে। তার মানে বাইরে ঝড়ও বাড়ছে। ঘুমানো তো দূরের কথা, চোখের পাতাও এক করতে পারছে না সে। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, তাকিয়ে রয়েছে তবু।
অবশেষে দেখা গেল আলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। নাহ, গুহার মুখটা খোলাই আছে, দেয়াল ধসে পড়েনি। কিন্তু আলো বাড়লেও পানির রঙ আর নীল হলো না। ধূসর, একঘেয়ে, বিষন্ন। আবার দুশ্চিন্তা হতে লাগলো মুসার জন্যে। রাতের অন্ধকারে পানিতে নামেনি বটে, কিন্তু এখন আলো ফুটেছে। নিশ্চয় দেখতে আসবে।
গুহার দেয়ালে হেলান দিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সাগরের হাসি আর ঝিনুক। যেন ঘরের ভেতরে রয়েছে। ভাবনার কিছুই নেই এখানে। কোন বিপদ নেই, ভয় নেই। আস্তে করে ঝিনুকের কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিল সে। জেগে গেল ঝিনুক। সাগরের হাসিও। পানির রঙ দেখাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল, পাখনাটা দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কি হাঙরটা নেই?
ভালো করে দেখে ঘোষণা করলো সাগরের হাসি, নেই, চলে গেছে। স্বস্তির কাপা নিঃশ্বাস পড়লো কিশোরের। আনন্দে চিৎকার করে উঠতে যাবে, এই সময় গম্ভীর মুখে ঝিনুক বললো, ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে না বটে। হয়ত নিচে ডুবে রয়েছে। নামলেই ধরবে।
ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল যেন কিশোর। এটা ভাবেনি। সত্যি, নিচে ডুব দিয়ে থাকতেই পারে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন হাঙরটা ভাসলো না, উঠে দাঁড়ালো ঝিনুক। বললো, আমি যাচ্ছি।
হাঙরটা যদি থাকে? কিশোরের প্রশ্ন।
লড়াই করবো। হয় ম্যাকো মরবে। নয়তো আমি।
মাথা নাড়লো কিশোর। তবে নিষেধ করতে পারলো না ঝিনুককে। করতে হলে অন্য কোন উপায় বাতলে দিতে হবে এখান থেকে মুক্তির। সেটা যখন পারছে না, কি আর বলবে।
আমি যাই, আবার বললো ঝিনুক। তোমরা থাক। ম্যাকো না থাকলে ফিরে আসব।
এতবড় একটা ঝুঁকি নিতে চলেছে কেন ঝিনুক, বুঝতে পারছে কিশোর। মুসার কথা ভেবে। তাকে যেতে না দেয়াই উচিত। কিন্তু এবারও মানা করতে পারলো না। ভাবলো, সে নিজেও যাবে। সাহায্য করবে ঝিনুককে। পরক্ষণেই বাতিল করে দিলো চিন্তাটা। বদ্ধ জায়গায় উপকার তো করতেই পারবে না, গিয়ে আরও সমস্যা বাড়াবে ঝিনুকের। অসহায় দৃষ্টিতে সাগরের হাসির দিকে তাকালো সে। পানির দিকে চেয়ে রয়েছে মেয়েটা। বোধহয় ম্যাকোকে খুঁজছে।
ওই মুহূর্তে ছুরি কামড়ে ধরে পানিতে ঝাঁপ দিলো ঝিনুক। কোমরের ছুরির বাঁটে হাত ছোঁয়ালো সাগরের হাসি। তৈরি রয়েছে। দরকার হলেই যাতে ঝাঁপ দিতে পারে।
কয়েকটা সেকেন্ড পানির দিকে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। তারপর আচমকা কোমর থেকে ছুরিটা টেনে বের করে দাঁতে কামড়ে নিয়ে দিলো ঝাঁপ। কিশোর কিছু বলার সময়ও পেল না, বাধা দেয়া দূরে থাক। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো পানির দিকে।
বেশ আলোড়ন উঠতে লাগলো। যেন হঠাৎ করেই সাংঘাতিক তোলপাড় শুরু হয়েছে তলায়। গুহামুখের কাছে কালো ছায়া দেখতে পেল বলে মনে হলো তার। মিনিট কাটছে। উত্তেজনায় টান টান হয়ে উঠেছে স্নায়। ভেসে উঠলো ঝিনুকের মাথা। ডেকে বললো, জলদি এস!
ম্যাকো গেছে?
জলদি এস! বড় বড় ঢেউ!
একবার দ্বিধা করলো কিশোর। তার পরই ঝাঁপ দিলো পানিতে নেমে চললো ঝিনুকের পিছু পিছু। ভয়ে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি এসে পা কামড়ে ধরলো হাঙরটা।
ঠেলে নিয়ে গিয়ে চেপে ধরতে চাইছে তাকে স্রোত। ঢোকার সময় এই স্রোত ছিলো না। এখন এলো কোথা থেকে? হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে চললো ঝিনুক। সুড়ঙ্গের মুখের ভেতরে ঢুকতেই যেন অদৃশ্য এক দানবের হাত হ্যাচকা টানে বাইরে বের করে নিয়ে গেল তাকে। তারপর ছুঁড়ে দিলো ওপর দিকে।
কি করে ডাঙায় উঠলো কিশোর, বলতে পারবে না। শুধু মনে আছে, পেছন থেকে তাকে ঠেলছে ঝিনুক, আর চুল ধরে তাকে টেনে তুলছে সাগরের হাসি। হাঁটু পানিতে থাকতেই পেছন থেকে এসে ধাক্কা মারলো মস্ত এক ঢেউ। তিনজনকেই প্রায় ছুঁড়ে ফেললো সৈকতে।
ধপ করে বসে পড়লো কিশোর। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো ঝিনুক। হাত তুলে দেখালো ঢেউয়ের দিকে। মস্ত একটা পাখনা ভেসে উঠেছে। শিউরে উঠলো কিশোর। ওরা যখন বেরিয়ে আসছে তখনও কাছাকাছিই ছিল হাঙরটা।
গুহায় অসুবিধে হচ্ছিলো, ঝিনুক বললো। অনেক বড় তো। হাঁসফাস লাগছিলো হয়ত। তাই বেরিয়ে পড়েছে।
চারপাশে তাকানোর সুযোগ পেলো এতক্ষণে কিশোর। অনুভব করলো ঝড়ের শক্তি। বাতাসের অদৃশ্য থাবা তার দেহ আঁকড়ে ধরে যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কাত হয়ে যাচ্ছে নারকেলের পাতা, ছিড়ে চলে যাচ্ছে ডালের গোড়া থেকে। লেগুনের দেয়ালের নিচে যেন কয়েক কোটি দৈত্যের তান্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে। এমন করে ফুসছে সাগর। শাদা ফেনায় ভরে গেছে লেগুনের পানি। দেখে বিশ্বাসই হয় না, ঝলমলে রোদের সময় ওটা নীল ছিলো। কালচে-ধূসর আকাশের মতই এখন রঙ হয়ে গেছে পানির।
বিমানটাকে খুঁজতে গিয়ে হাঁ হয়ে গেল কিশোর। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে। নেই। সে ভাবলো, প্রচন্ড ঢেউ নোঙর ছিড়ে নিয়ে গেছে ওটাকে, ডুবিয়ে দিয়েছে। মুসারা কোথায়? সাগরের হাসি আর ঝিনুককে বললো সে, দেখতে যাচ্ছে। বাতাসের মধ্যে মাথা নিচু করে দৌড় দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলো কতটা ভয়ংকর ঝড়। প্রচন্ড বাধার বিরুদ্ধে যেন লড়াই করতে করতে এগোতে হলো তাকে। যেখানে ক্যাম্প করেছিলো ওরা সেখানে এসে দেখলো কোন মানুষ নেই। মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে নারকেল পাতা। ইতস্তত পড়ে থাকা কয়েকটা কাঠের বাক্স প্রমাণ করছে এখানে ক্যাম্প ছিলো। হতাশ কণ্ঠে চিৎকার করে যেন নিজেকেই বোঝালো সে, ওরা চলে গেছে!
সৈকতের দিকে তাকালো। যেখানে বিমানটা বাঁধা ছিলো। বিড়বিড় করে বললো, নিশ্চয় ঝড় শুরু হতেই চলে গেছে।
ওসব নিয়ে পরে ভাববে। আপাতত মাথা গোঁজার একটা ঠাই দরকার। দ্বীপের মাঝখানের দিকে চললো সে। ওখানে নারকেল গাছের জটলার ভেতরে ঢুকে বসার ইচ্ছে। কিন্তু এমন ভাবে ছোটাছুটি করছে নারকেলের পাতা, নিরাপদ মনে করতে পারলো না জায়গাটাকে।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের দিকে তাকালো। হাত নেড়ে সেদিকেই যাওয়ার ইঙ্গিত করলো ওরা। ওরাও সেদিকে চলেছে। নিশ্চয় কোন কারণ আছে। এসব ঝড় দেখে অভ্যস্ত পলিনেশিয়ানরা। ঝড়ের সময় আত্মরক্ষা করতে হয় কিভাবে জানে।
নারকেলের জটলার ভেতরে পৌঁছে গেল ওরা। মুখের কাছে দুহাত এনে কিশোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ঝিনুক বললো, বাতাস পড়ে গেলেই আসবে, বড় জোয়ার।
বোধহয় জলোচ্ছ্বাসের কথা বলছে ঝিনুক। পাগল হয়ে যাওয়া বিশাল ঢেউয়ের দাপাদাপির দিকে তাকিয়ে কিশোর বললো, এর চেয়ে বড়?
হ্যাঁ। দ্বীপ ভাসিয়ে দেবে। এস। যেন ঝিনুকের কথার সমর্থনেই বিশাল এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো সৈকতে, পানি উঠে চলে এল অনেকখানি ওপরে।
এস এস!
নারকেল উড়ছে না আর। কারণ ওড়ার মত নেইই। সব পড়ে গেছে, বিছিয়ে রয়েছে গাছের তলায়। মোটা একটা গাছ বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো সাগরের হাসি। গাছের চারপাশ ঘিরে খাঁজ কাটছে। কাটা শেষ করে নিজের শরীর পেঁচিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধলো গাছের সঙ্গে, দড়িটা বসিয়ে দিয়েছে খাঁজের মধ্যে। ক্যাম্পের কাছে দড়ি পড়ে ছিলো, ওখান থেকে তুলে এনেছে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো, গাছে ওঠার জন্যে। তার সঙ্গে একই গাছে।
ঠিক কি করতে চাইছে সাগরের হাসি তখনো বুঝতে পারছে না কিশোর। যা করতে বলা হলো করলো সে। মেয়েটার কাছে উঠে এলো। আরেকটা খাঁজে দড়ি বসিয়ে কিশোরের চারপাশে পেঁচিয়ে বাঁধলো সাগরের হাসি।
ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে ব্যাপারটা কিশোরের কাছে। বাতাসে দুলছে নারকেলের কান্ড, মাঝে মাঝে এত বেশি নুয়ে পড়ছে তার ভয় লাগছে ভেঙেই না যায়। মাটি থেকে অনেক ওপরে রয়েছে। দড়ি ছিড়ে গেলে কি হতে পারে কল্পনা করতে চাইলো না সে।
ক্রমেই এগিয়ে আসছে ঢেউ, পানি উঠছে দ্বীপে। সব চেয়ে উঁচু জায়গাটায় উঠতেও দেরি হবে না, বুঝতে পারছে কিশোর। এখনও গুহার ভেতরে থাকলে কি অবস্থা হতো ভেবে গায়ে কাঁটা দিলো তার। হাঙরে না খেলেও পানিতে ডুবেই মরতে হতো। নিশ্চয় এতোক্ষণে পানিতে ভরে গেছে গুহাঁটা।
মাথা ঘুরিয়ে তাকালো কিশোর। আরেকটা গাছে উঠে একই ভাবে নিজেকে বেঁধেছে ঝিনুক। এই বাতাসের মধ্যে নারকেলের কান্ড আঁকড়ে থাকা যে কতটা কঠিন, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গোয়েন্দাপ্রধান। ওই মুহূর্তে তার মনে হলো এসব অ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে গোয়েন্দাগিরি অনেক ভালো এবং সহজ।
তার দিকে তাকিয়ে হাসলো ঝিনুক। বাপরে, বাপ! সাহস আছে ওদের! ভাবলো কিশোর।
গাছের কান্ড আঁকড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কখন থামবে সেটা ঝড়ের ইচ্ছে।
এক ঘণ্টা পেরোল, দুই ঘণ্টা। তারপর আচমকা নীরব হয়ে গেল সব কিছু। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি মাথার ওপরে নীল আকাশও চোখে পড়লো একটুকরো।
যাক, ঝড়টা তাহলে গেল। হাঁপ ছাড়লো কিশোর।
কিন্তু মাথা নাড়লো সাগরের হাসি। উহু! শেষ হয়নি। এটা ঝড়ের মধ্যিখাটা। আবার আসবে বাতাস।
মেয়েটা কি বলছে বুঝতে পারলো কিশোর। মনে পড়ল অথৈ সাগর অভিযানের কথা। সেবারেও হারিকেনের মাঝে পড়েছিল জাহাজ। ঝড়ের মধ্যিখান বলতে কেন্দ্রবিন্দু বোঝাচ্ছে সাগরের হাসি। ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাস থাকে না, সেটা পেরোলেই আবার আগের মত জোরালো তুফান শুরু হবে।
বেশিক্ষণ থাকলো না ওই নীরবতা। হঠাৎ যেমন থেমে গিয়েছিল, তেমনি হঠাৎই আবার এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো বাতাস। মাথার ওপর থেকে হারিয়ে গেল নীল আকাশ। ধেয়ে এল ঢেউ।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একটানা বয়ে চললো ঝড়। বিকেল চারটের দিকে কমে এলো বাতাসের বেগ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তিতে একবারে কাহিল হয়ে পড়েছে কিশোর। গাছ জড়িয়ে ধরে রাখার শক্তিও যেন নেই।
পানি নেমে যেতে শুরু করলো। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো সূর্য। দিগন্তসীমার কাছাকাছি নেমে গেছে। বিরাট এক আগুনের গোলার মত লাগছে এখন ওটাকে।
নামবে কিনা জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মাথা নাড়লো সাগরের হাসি। এখনও সময় হয়নি।
সূর্য ডুবলো। সাগরের হাসি ঘোষণা করলো, এবার নামা যেতে পারে। নেমেই ভেজা মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়লো কিশোর। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি ব্যথা হয়ে গেছে। লবণে শক্ত হয়ে গেছে চুল এমনকি ভুরু পর্যন্ত।
সাগরের হাসি আর ঝিনুকের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। তবে সকলেই খুশি। ঝড়টা কাটাতে পেরেছে। আর বেঁচে তো রয়েছে এখনও। কোন কিছু নিয়েই একটুও উদ্বিগ্ন হলো না দুই পলিনেশিয়ান।
খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠলো ওরা। এগোল ক্যাম্প এলাকার দিকে। দ্বীপের চেহারা বদলে দিয়ে গেছে ঝড়। প্রবালের অনেক চড়া গায়েব হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় মাটি খুবলে নিয়ে গেছে ঢেউ। পানিতে ভেসে গেছে অনেক পাতা, কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখনও। তবে তার চেয়ে বেশি জমে রয়েছে সামুদ্রিক আগাছা। আর রয়েছে ঝিনুক। অগুনতি। নানা জাতের, নানা আকারের। ওসবের মাঝে কিলবিল করছে কাঁকড়ার দল। আরও নানা রকম জলজ প্রাণী উঠে এসেছিলো ঢেউয়ে, নামার সময় আর যেতে পারেনি, আটকা পড়েছে বালিতে।
ক্যাম্প এলাকাটা সব চেয়ে উঁচু ওই দ্বীপে। ওখানে পানি ওঠেনি। কাছাকাছি ঝাপটা দিয়ে গেছে শুধু ঢেউ। পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে রেখে গেছে। প্রবালের চাঙড়ের খাঁজে একটিন গরুর মাংস আটকে থাকতে দেখলো কিশোর। কয়েক টিন কনডেনসড মিল্ক, আর এক টিন বিস্কুট পাওয়া গেল, বালিতে অর্ধেক গাঁথা অবস্থায়। খিদেয় চো চো করছে পেট। তর সইছে না আর। সাগরের হাসির কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে মাংস আর বিস্কুটের টিন কাটলো সে। মুখে দিয়ে চিবুতে গিয়ে টের পেল জিভই নাড়তে পারছে না। শুকিয়ে যেন আঠা হয়ে লেগে গেছে মুখের ভেতরে। পানি দরকার। ঝর্নাটার দিকে চলল সে। কিন্তু গিয়ে অবাক হয়ে গেল। যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই ওটা। বালিতে ঢাকা পড়ে গেছে।
দুই পলিনেশিয়ানও এসেছে তার পিছু পিছু। তাদের দিকে চেয়ে গুঙিয়ে উঠলো কিশোর, পানি নেই! এবার মরব!
হেসে উঠলো সাগরের হাসি। না, মরব না। পানি অনেক আছে। পড়ে থাকা অনেক ডাব দেখালো সে।
তাই তো! ভুলেই গিয়েছিলো কিশোপ। চিন্তা দূর হলো।
একটা ডাব তুলে নিলো সাগরের হাসি। ছুরি দিয়ে মুখটা কেটে ছিদ্র করে তুলে দিলো কিশোরের হাতে।
মিষ্টি পানিতে ভরে গেল কিশোরের মুখ। জিভ নাড়তে কষ্ট হচ্ছে এখনও। আস্তে আস্তে ভিজিয়ে নরম করে আনলো। পানি খাওয়ার পর ডাবটাকে দুই টুকরো করে ভেতরের নরম মিষ্টি শাস খেলো সে। অনেকটা বল ফিরে পেলো শরীরে।
ভেজা মাটিতে বসে নীরবে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া চালিয়ে গেলো ওরা। ধীরে ধীরে খাচ্ছে। গরুর মাংস, বিস্কুট আর নারকেল।
শেষ হলো খাওয়া। চাঁদ উঠেছে। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। সাগরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কিশোর, ওমররা প্লেন নিয়ে নিরাপদ জায়গায় যেতে পেরেছে তো? নাকি ডুবে মরেছে সাগরে? কালকের মধ্যে যদি ফিরে না আসে, তাহলে বুঝতে হবে বেঁচে নেই ওরা।
বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তা করার সুযোগ পেলো না কিশোর। এতে ক্লান্ত হয়েছে শরীর, বসেও থাকতে পারছে না আর। শুয়ে পড়লো বালিতে। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
<