প্রচন্ড মাথা ধরেছে কিশোরের। দপদপ করছে চোয়ালের যেখানটায় ঘুসি খেয়েছে। তার পরেও ঘুম এলো।
ওপরে ডেকে চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। আঞ্চলিক ভাষায় অনর্গল কথা বলছে নাবিকেরা। মুখ খারাপ করে গালাগাল করছে কারনেস। কাকে, কেন, কিছুই বোঝা গেল না। গোল একটা ফুটো দিয়ে আলো আসছে। ভোর হয়ে গেল? অবাকই লাগলো কিশোরের। ঘুম কত দ্রুত সময় পার করে দেয়।
বাইরের করিডরে পায়ের আওয়াজ হলো। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দুজন নাবিক ঘরে ঢুকলো। আগের রাতে যারা কিশোরকে এখানে রেখে গেছে তারা দুদিক থেকে এসে চেপে ধরলো তাকে। আবার টেনে নিয়ে চললো ওপরে।
ডেকে পায়চারি করছে কারনেস। কিশোরকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ। পিচিক করে থুথু ফেললো ডেকের ওপরেই। ধীরে ধীরে এগোল শিকারি বেড়ালের মত। হাতের আঙুল একবার খুলছে, একবার মুঠো করছে। তোমার সাথে দ্বীপে আর কে ছিল? লোহা, ঘষলো যেন শিরিষ দিয়ে এমনই কণ্ঠস্বর।
চুপ করে রইলো কিশোর।
ফেটে পড়লো কারনেস। কে নৌকা চুরি করেছে?
লম্বা দম নিলো কিশোর। তাহলে এই ব্যাপার। ডিঙিটা নেই। নিশ্চয় তাকে ধরে আনার পর ফিরে এসেছিলো ঝিনুক। নৌকাটা নিয়ে চলে গেছে। আশা হলো মনে। তবে সেটা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিলো না। কিন্তু তার পরেও কি করে যেন বুঝে ফেললো কারনেস। ঠাস করে চড় মারলো।
মাথা সরানোরও সুযোগ পায়নি কিশোর। আরেকটু হলেই উল্টে পড়তো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছলো সে।
আর কে ছিলো তোমার সাথে? আবার গর্জে উঠলো কারনেস।
আর চুপ করে থাকার কোন মানে হয় না। লাভ হবে না। নৌকা যখন চুরি হয়েছে, কেউ না কেউ ছিলোই দ্বীপে এটা বুঝে ফেলেছে কারনেস। অস্বীকার করে অযথা মার খেতে হবে। বললো, ঝিনুক। মনে মনে আশা করলো, এতক্ষণে নিশ্চয় সাগরের হাসিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে ঝিনুক।
তীব্র ঘৃণা দেখা দিলো কারনেসের চোখে। শুঁয়োপোকার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় মানুষ সেভাবে তাকালো কিশোরের দিকে। জুতো দিয়ে মাড়িয়ে পিষে ফেলতে চায় যেন। ওই নোংরা কানাকাটা! জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে করসিকান। কোথায় গেছে? এত জোরে চিৎকার করে উঠলো সে, চমকে গেল কিশোর। পিছিয়ে গেল এক পা।
গেলে রাটুনাতেই গেছে, আর কোথায়।
আকাশের দিকে নজর চলে গেল কারনেসের। তার মনে কি ভাবনা চলেছে অনুমান করতে পারলো কিশোর। রাটুনায় পৌঁছার আগেই নৌকা-টাকে ধরতে পারবে কিনা ভাবছে সেকথা। পারবে না। এক বিন্দু বাতাস নেই। সাগরের পানিও লেগুনের মত শান্ত, এক বিরাট আয়নার মত লাগছে। এক রত্তি মেঘ নেই আকাশে। বাতাস যে আসবে তার কোন সম্ভাবনাই নেই।
সেটা বুঝে আরও রেগে গেল কারনেস। মাথায় আগুন ধরছে তার, বুঝতে পারছে কিশোর। ভয় পেয়ে গেল। এখন বেফাস কিছু করে বসলে মরতে হবে।
কিশোরের গলা চেপে ঠেলতে ঠেলতে মাস্তুলের কাছে নিয়ে গেল কারনেস। ছুরি বের করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, আমার সঙ্গে চালাকির মজা দেখাচ্ছি!
মাথা গরম করলো না কিশোর। গলায় চাপ রয়েছে। ফ্যাসফ্যাস করে কোনমতে বললো, আমাকে মেরে ফেললে মুক্তোর খেতটা আর খুঁজে পাবেন না।
দ্বিধা করলো কারনেস। গলার চাপ বাড়িয়েই আবার ঢিল করে ফেললো। কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলো এক পা। হ্যাঁ, মুক্তো। আরও কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। ফিরে তাকিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় আদেশ দিলো। নাবিকদেরকে।
লোকটাকে যে কি ভীষণ ভয় পায় সেটা নাবিকদের আচরণেই বোঝা গেল। লংবোট নামাতে দৌড়ে গেল ওরা। দেখতে দেখতে নামিয়ে ফেললো জাহাজের পাশে পানিতে। তাতে চড়ে বসলো ছজন লোক, দাঁড় তুলে নিলো।
এসো আমার সঙ্গে, কিশোরকে বললো কারনেস। ওরা উঠলে দাঁড় বাইতে শুরু করলো লোকগুলো। তীরে পৌঁছলো।
অবাক হয়ে কিশোর ভাবছে, কি করবে লোকগুলো? একটু পরেই বুঝতে পারলো। ঢেউয়ের সঙ্গে যে ঝিনুকগুলো তীরে এসে পড়েছে, সেগুলো কুড়াতে এসেছে ওরা। অনেক ঝিনুক পড়ে থাকতে দেখলো কিশোর। শুকনোয় তো আছেই, পানিতেও আছে। অল্প পানিতে ছেয়ে রয়েছে লেগুনের নিচে। তবে ওগুলোর প্রতি কোন আগ্রহ বোধ করলো না সে। চারজন লোক ঝিনুক কুড়িয়ে এক জায়গায় করছে, একজন বয়ে নিয়ে গিয়ে তুলছে নৌকায়। ছয় নম্বর লোকটা নারকেল কুড়াচ্ছে।
কিশোরকে নিয়ে ক্যাম্পের কাছে চলে এলো কারনেস। যেখানে যা পেলো, কাজে লাগার মত, তুলে নিতে আরম্ভ করলো। অভিযাত্রীদের ফেলে যাওয়া জিনিস। মাঝে মাঝে কথা বলছে কিশোরের সঙ্গে, প্রশ্ন করছে। পারলে জবাব দিচ্ছে কিশোর।
তাড়াহুড়া করছে কারনেস। কেন, সেটা বুঝতে পারলো কিশোর। কারনেসের ভয়, ঝিনুক পালিয়েছে। গিয়ে দলবল নিয়ে ফিরে আসতে পারে। তাই পালাতে চাইছে কারনেস, লেগুন থেকে বেরিয়ে দূরে চলে যেতে চাইছে।
পাথরের নিচে, শ্যাওলার ভেতরে খোঁজাখুঁজি করছে কারনেস। নীল আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেছে সূর্য। বেলা যতই বাড়ছে, গরমও বাড়ছে। নিরাসক্ত চোখে তার কাজকর্ম দেখছে কিশোর। সে একটা কথাই ভাবছে, কি করে পালাবে। কিন্তু কোন উপায়ই বের করতে পারছে না। এক কাজ করতে পারে। দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। চলে যেতে পারে দ্বীপের নিচের সেই গুহায়। তবে তাতে হাঙরের ভয় আছে। আর কারনেসের লোকেরাও যে গুহাঁটা খুঁজে বের করতে পারবে না তা নয়। তার ওপর রয়েছে গুলি খাওয়ার ভয়। সে দৌড় দিলেই কোমর থেকে রিভলভার নিয়ে গুলি চালাবে কারনেস। গুহায় ঢোকার ভাবনাটা বাতিল করে দিলো সে।
একটা পাথরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কারনেস। ওটার নিচেই মুক্তোর টিনটা লুকিয়ে রেখেছিল ডজ। এইবার কিছুটা আগ্রহী হলো কিশোর। পাথরের চারপাশে শ্যাওলার স্তূপ জমে রয়েছে। টেনে টেনে কিছু সরালো কারনেস। কিছু সরালো পা দিয়ে। ঘুরে দাঁড়াতে যাবে এই সময় একটা জিনিস চোখে পড়লো তার।
ধক করে উঠলো কিশোরের বুক। মনে হলো হৃৎপিন্ডের গতিই বুঝি থেমে যাবে। এত গরমেও ঠান্ডা শিহরণ জাগলো শরীরে। চিকণ ঘাম দেখা দিলো কপালে। জিনিসটা সে-ও দেখতে পেয়েছে। বালির ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে টিনের একটা অংশ। সেই বিস্কুটের টিনটাই, চিনতে অসুবিধে হলো না তার। ওপরের বালি অনেকখানি ধুয়ে নিয়ে গেছে পানি, ফলে বেরিয়ে পড়েছে টিনটা।
কিশোর আশা করলো, দেখতে পেলেও টিনটা ছোঁবে না কারনেস। কারণ পুরনো একটা জিনিস বালিতে দেবে রয়েছে, কোন মূল্য নেই ওটার। কিন্তু কারনেসের কাছে আছে। এখানে কিশোরদের আনা জিনিস যা-ই পাচ্ছে তুলে নিচ্ছে লোকটা। কি করবে আল্লাহই জানে। লাথি দিয়ে টিনের ওপরের বালি আরও সরালো কারনেস। তারপর টেনেটুনে বের করে আনলো ওটা বালির নিচ থেকে। ওই সময় একবার কিশোরের মুখের দিকে তাকালেই তার কাছে ফাঁস হয়ে যেত ব্যাপারটা। কারণ একেবারে শাদা হয়ে গেছে তার মুখ।
টিনের অবস্থা দেখে পছন্দ হলো না কারনেসের। ছুঁড়ে ফেলে দিলো। হাঁপ ছাড়তে যাচ্ছিলো কিশোর, ছাড়া আর হলো না। টিনের মুখটা হয় ঠিকমত লাগেনি, নয়তো জোর ঝাকুনিতে গেল খুলে। ছড়িয়ে পড়লো ওটার ভেতরের জিনিস।
পাথরের মূর্তি হয়ে গেল যেন কারনেস। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো জিনিসগুলোর দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপরই জোরে এক চিৎকার দিয়ে দৌড় দিলো। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মুক্তোগুলোর কাছে। কাঁপা হাতে তুলে রাখতে শুরু করলো আবার টিনের মধ্যে। একবার তাকালো কিশোরের দিকে। উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। ঘামছে দরদর করে। দৌড়ে এলো তার সাগরেদরা। উত্তেজিত হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় কিচির মিচির করে কি বলতে লাগলো ওরা বুঝতে পারছে না কিশোর।
অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। টিনটা যে কেন ফেলে গেছে ডজ, মাথায় ঢুকছে না কিশোরের। এত কষ্ট করলো ওরা ওগুলোর জন্য, সব শেষ, কোনই লাভ হলো না। এসব জিনিসের লোভ নেই তার, নির্দ্বিধায় ওই একটিন মুক্তো দান করে দিতে পারে, কিন্তু এখন তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কারণটা আর কিছু না, অভিযানের ব্যর্থতা। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। রাগ হতে থাকলো ডজের ওপর, আর কারনেসের প্রতি তীব্র ঘৃণা। ওই মুহূর্তে বুঝতে পারলো কেন এসব মূল্যবান রত্নের জন্যে মানুষ মানুষকে খুন করে।
কারনেস মুক্তোগুলো পাওয়ার খানিক আগে ঝিনুকের প্রথম চালানটা নিয়ে রওনা হয়েছিলো লংবোট। জাহাজের কাছে পৌঁছে গেছে। দুজন লোক গেছে সঙ্গে। চিৎকার করে জানতে চাইলো, কি হয়েছে। তীর থেকে জানালো ওদের সঙ্গীরা। দ্রুত ঝিনুকগুলো ডেকে ছুঁড়ে ফেলে নৌকা নিয়ে ফিরে এলো ওরা।
অনেক ঝিনুক পড়ে রয়েছে এখনও। সেগুলো তোলার নির্দেশ দিল কারনেস। লোকটার লোভ দেখে আরও তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। এতগুলো মুক্তো পেয়েছে, তার পরেও আরও পাওয়ার লোভে ঝিনুক তুলে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাজ বোঝাই করে মুক্তো দিয়ে দিলেও হবে না, আরও চাইবে, আরও।
নিজে দাঁড়িয়ে ঝিনুক তোলা দেখতে লাগল কারনেস। তদারক করছে। কোনটা বাকি রয়ে গেল কিনা দেখছে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে কিশোরের দিকে। কিশোরের গম্ভীর হয়ে যাওয়া মখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, খুব মজা পাচ্ছে যেন। ক্ষোভ, রাগ সব দূর হয়ে গেছে তার। খোশমেজাজে আছে। একবার জিজ্ঞেস করলো, এগুলো যে আছে বলনি কেন?
জানতাম না।
কণ্ঠের তিক্ততা চাপতে পারলো না কিশোর। তাতে আরও মজা পেল লোকটা। হেসে উঠলো। অনেক কষ্ট থেকে আমাকে বাচিয়ে দিলো তোমার বন্ধুরা। এতগুলো মুক্তো রেখে গেল। কিশোরের দিকে একটা ডাব ছুঁড়ে দিলো সে। ছুরি দিয়ে আরেকটা ডাবের মুখ কাটলো নিজে খাওয়ার জন্যে।
ডাবটা দেখে পিপাসার কথা মনে পড়লো কিশোরের। কারনেসের কাছ থেকে ছুরিটা নিয়ে মুখ কাটতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেছে।
শেষ ঝিনুকটা যখন নৌকায় তোলা হলো, পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই ছুঁই করছে তখন সূর্য। নৌকায় উঠলো দাঁড়ীরা। যার যার জায়গায় বসলো। কিশোর ভাবলো, তাকে ফেলেই চলে যাবে কারনেস। তাতে বরং খুশিই হবে কিশোর। কারণ ওমররা ফিরে আসবেই। কিন্তু তাকে নিরাশ করলো কারনেস। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এক ধরনের অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটেছে চোখে। নৌকায় ওঠার ইশারা করলো।
উঠলো গিয়ে কিশোর। তার পেছনেই বসলো কারনেস। নৌকা ছাড়তে বলার আগে শেষবারের মত সৈকতে চোখ বোলালো সে, কিছু ফেলে যাচ্ছে কিনা দেখলো। আরেকবার ফেরার কোন ইচ্ছেই নেই তার। নৌকা ছাড়তে বললো সে।
জাহাজের দিকে এগিয়ে চললো নৌকা। একেবারে নিরাশ হয়ে পড়েছে কিশোর। সারাটা দিন বিমানের অপেক্ষা করেছে। ভেবেছে এই বুঝি এলো, এই বুঝি এলো। শব্দ শোনা গেল। কিন্তু এলো না ওটা। এখন রাত হয়ে আসছে। আজ আর আসবে না বিমানটা। এলেও আগামী দিন।
জাহাজের গায়ে এসে ভিড়লো নৌকা। ডেকে উঠতে বলা হলো কিশোরকে। উঠলো সে। সাগরের দিক থেকে ধেয়ে এলো এক ঝলক বাতাস। আলোড়ন তুললো লেগুনের পানিতে। মৃদু দুলতে লাগলো জাহাজ। আনন্দে চিৎকার করে উঠলো কারনেস। তার খুশির কারণ বুঝতে পারলো কিশোর। প্রকৃতিও যেন কারনেসের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। প্রথমে পাঠিয়েছে ঝড়, মুক্তোগুলো দ্বীপে ফেলে রেখে বিমানটাকে চলে যেতে বাধ্য করেছে। সেগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে কারনেসকে। এখন পাঠিয়েছে বাতাস। স্কুনারটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। পরদিন ওমররা আসতে আসতে অনেক দূরে চলে যাবে ওটা। ধরার আর কোন উপায়ই থাকবে না হয়তো।
মুক্তোর টিনটা বগলে চেপে নিচে চলে গেল কারনেস। ফিরে এলো একটু বাদে। ওটা ছাড়া অন্য কোন পরিকল্পনা ছিলো হয়ত তার, বাতাস আসায় সেটা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিচু গলায় নির্দেশ দিতে আরম্ভ করল তার নাবিকদের। ওরা ফিরে তাকালো কিশোরের দিকে। ওদের দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল সে। নিশ্চয় তার ব্যাপারেই কিছু আলোচনা হয়েছে।
আমার জাহাজটা তোমার পছন্দ হয়নি, কিশোরকে বললো কারনেস। ভাল কথা। এখানেই থেকে যাও! রেখে যাওয়া হবে তোমাকে।
এতে বরং খুশিই হলো কিশোর। এটাই চাইছিলো। বললো না কিছু।
তবে, কারনেস বললো, অনেক কিছু জেনে ফেলেছ তুমি। বলে দিলে বিপদে পড়বো আমি। তাই যাতে বলতে না পার সেই ব্যবস্থা করে যাব। আবার নাবিকদের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকালো। রওনা হয়ে গেল হুইলের দিকে।
ক্যাপস্টানের দিকে দৌড়ে গেল চারজন নাবিক। নোঙর তোলার সময় ঝনঝন করে উঠলো শেকল। দ্রুত কালো হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে দুলে উঠলো একটা শাদা পাল।
দুজন নাবিক রয়ে গেল কিশোরের পাশে। ফুলে উঠলো পাল। লেগুনের মুখের দিকে রওনা হয়ে গেল জাহাজ। কি করতে বলা হয়েছে লোকগুলোকে?
সতর্ক নজর রাখলো কিশোর। রেখেও কিছু করতে পারলো না। জোর করে তাকে ধরে শুইয়ে ফেললো লোকগুলো। কারাত আর জুডোর সাহায্যে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলো সে। কিছুই করতে পারলো না। অসম্ভব শক্তি লোকগুলোর গায়ে। চেপে ধরে রেখে সাহায্যের জন্যে ডাকলো অন্যদেরকে। একজন একটা দড়ি পেঁচিয়ে বাঁধলো তার কোমর। আরেক মাথা বাঁধলো একটা লোহার পাইপের সঙ্গে। আতঙ্কিত হয়ে পড়লো কিশোর। ওদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। পানিতে ফেলে দেয়া হবে তাকে, হাত-পা বেঁধে। লোহার পাইপের ভার তাকে টেনে নিয়ে যাবে। লেগুনের তলায়। কিছুতেই ভেসে উঠতে পারবেনা।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করলো সে। দুএকজনের নাকে ঘুসিও মারলো। লাভ হলো না কিছু। এতগুলো শক্তিশালী হাত থেকে মুক্তি পেলো না। উপুর করে ফেলে মুচড়ে তার হাত নিয়ে আসা হলো পিঠের ওপর। দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। আরেকজন পা বেধে দিলো। শিকারীর হাতে অসহায় খরগোশ যেন সে, কিংবা কসাইয়ের কাছে ছাগল। বয়ে নিয়ে আসা হলো রেলিঙের কাছে। খিকখিক করে তার কানের কাছে হেসে উঠল একটা লোক। দুজনে দুদিক থেকে ধরে তুলে দোলা দিয়ে তাকে রেলিঙের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিলো। ঝপাং করে পানিতে পড়লো সে।
পড়েও সারতে পারলো না। টেনে নিয়ে চললো তাকে লোহার পাইপ। মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে লাগলো ছাড়া পাওয়ার জন্যে। সব দিক থেকে চেপে ধরতে শুরু করেছে যেন কালো পানি।
অবশেষে শেষ হলো নিচের দিকে টানা। তার মানে তলায় পৌঁছে গেছে। লোহার পাইপ, বালিতে ঠেকেছে। চারপাশে শুধুই ঘন অন্ধকার।
<