কাদায় ভরা কাঁচা রাস্তায় পৌঁছার আগে থামলো না ছেলেরা। হাঁপাতে হাঁপাতে তাকালো ডানে-বাঁয়ে। বুঝতে পারছে না এখন কোনদিকে যাওয়া দরকার।
এটা দিয়ে গেলে, মুসা বললো, কাউন্টি রোডে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলবে।
পাহাড়ে উঠতে গেলেও দেখে ফেলবে, বললো রবিন।
বাঁধের ওপর দিয়েও আর যাওয়া যাবে না এখন, পিনটু বললো। পানির যা তোড়। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছে ওরা। কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।
বেরিয়ে এলো তিন কাউবয়। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে এলো ছেলেদের ধরার জন্যে। সঙ্গীদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিচ্ছে গুড়।
রাস্তার দিকে যাই। মুসা বললো।
জোরে মাথা নাড়লো কিশোর, না না, অ্যারোইও! শেষ মাথায় চলে যাবো, বাঁধের কাছাকাছি। আমরা ওদিকে গেহি এটা ভাববে না ওরা।
একটা মুহূর্ত সময় নষ্ট করলো না হেলেরা, হুড়মুড় করে এসে নামলো অ্যারোইওতে। নিচে নামতে পারলো না, ওখানে পানি, কিনার ধরে চললো। পিচ্ছিল হয়ে আছে ঢালের মাটি, তার ওপর ঝোপঝাড়, দৌড়াতে পারলো না। তবে ঝোপ থাকায় গাহ ধরে ধরে মোটামূটি দ্রুতই এগোতে পারলো।
ওপরে রাস্তার কাদায় ভারি বুটের ছপাৎ হুপাৎ শব্দ হচ্ছে। মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়লো ছেল্লো, পিছলে যাতে পানিতে না গিয়ে পড়ে সেজন্যে গাছ আঁকড়ে ধরে রেখেছে। দুরুদুরু করছে বুক। ঠিক মাথার ওপরেই শোনা গেল কর্কশ কণ্ঠ, গেল কোথায় বদমাশগুলো!
এক্কেবারে ইবলিসের বাচ্চা!
চাবিটা সত্যিই পেয়েছে?
পেয়েছে। নইলে আমাদের দেখলেই পালায় কেন?
বাঁধের দিকে যায়নি তো?
গাধা নাকি? মরতে যাবে?
পাহাড়েও চড়েনি। তারমানে রাস্তা দিয়েই গেছে। এসো।
কাউন্টি রোডের দিকে ছুটলো তিন কাউবয়। চুপ করে পড়ে রইলো ছেলেরা। চ্যাপারালের ঝোপ আড়াল করে রেখেছে তাদের শরীর।
ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। উঠে বসে মাথা ঝাড়া দিলো রবিন। গেছে। বাঁচা গেল।
এখানে লুকিয়ে থাকা যাবে না, পিনটু বললো। ওঠো।
যাবোটা কোথায়? মুসার প্রশ্ন। আপাতত বাঁচলাম। রাস্তায় না পেয়ে আবার ফিরে আসবে ওরা। তখন?
বাঁধের কাছে লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে ব্বে করতে হবে, কিশোর বললো। আর তেমন জায়গা না পেলে ঢিবি পেরিয়ে চলে যাবো। কনডর ক্যাসলের ওধারে
লুকানোর জায়গা পাওয়া যাবেই।
মাথা নিচু করে, রাস্তা থেকে যাতে দেখা না যায় এমনভাবে আবার টিরি দিকে এগোলো ওরা। বাঁধের ওপর থেকে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে বৃষ্টির আওয়াজকে আপিয়ে।
দেখ, কিশোর বললো, ঝোলা পাথর-টাথর আছে কিনা। কিংবা কোনো গর্ত।
ঢালের গায়ে গাছ আঁকড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বোলালো চারজনেই।
মুসা মাথা নাড়লো, নাহ্ একটা ইঁদুরের গর্তও নেই।
রাস্তার ওপারে পাথর আছে, ওগুলোর আড়ালে লুকানো যেতে পারে, বলে মাথা তুলে দেখতে গেল পিনট। পরক্ষণেই ঝট করে নামিয়ে ফেললো। ওরা আসছে!
আবার মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ওরা।
দেখেনি তো তোমাকে? রবিনের কণ্ঠে শঙ্কা।
মনে হয় না।
কোনখানে আছে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
আমরা যেখানে অ্যারোইওতে নেমেছি।
ঝুপড়িতে ফিরে যাচ্ছে বোধহয় আবার, আশা করলো মুসা।
না, অতোটা আশা করতে পারলো না কিশোর, ওরা এদিকেই আসবে। বাঁধ্বে কাছে খুঁজতে। এখানেই থাকতে হবে আমাদের। দেখে ফেললে,ফেলবে, আর কিছু করার নেই।
ঝোপ আর মাটির সঙ্গে যতোটা সম্ভঘ গা মিশিয়ে পড়ে রইলো ওরা। বুটের শব্দ কানে আসছে। অবশেষে শোনা গেল কথা, …বাঁধের কাছে না পেলে এখানে এসে ঝোপের মধ্যে খুঁজবো।
থাকা যাবে না এখানেও। ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। ওরা সরলেই ঢিবি বেয়ে উঠতে শুরু করবো, যতোটা ওপরে ওঠা যায়। যেই ওরা এদিকে সরে আসবে ওদিকে চলে যাবো আমরা।
কিন্তু চূড়ায় উঠলেই তো দেখে ফেলবে আমাদের, মুসা বললো।
ঝুঁকি নিতেই হবে। বেশিক্ষণ থাকছি না আমরা ভোলা জায়গায়, মাত্র কয়েক সেকেণ্ড।
কিশোরে পরামর্শটা পছন্দ হলো না মুসার, কিন্তু এর চেয়ে ভালো কিছু আর রে করতে পারলো না। ভাবনারও সময় নেই। ওদের মাথার ওপর দিয়ে কাউবয়দের চলে যাওয়ার শব্দ হলো। আস্তে করে মাথা তুলে দেখলো কিশোর। ঢিবির আড়ালে চলে যাচ্ছে তিনজন লোক। চলো, বললো সে।
চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে অ্যারোইওর বাকি পথটুকু পেরিয়ে এলো ওরা, টিবির ঢাল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলো। ঝোপের কমতি নেই, সেগুলোর গড়া কিং শেকড় ধরে ধরে বেয়ে উঠছে, খাড়া ঢালে পর্বতারোহীরা যেমন করে ওঠে। দাঁড়ানো তো দূরের কথা, ঠিকমতো মাথা তোলারই সাহস করতে পারছে না। যদি চোখে পড়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে আশা করছে এই বুঝি চেঁচিয়ে উঠলো কেউ। কিন্তু না, শোনা গেল না।
যাক তাহলে উঠলাম! অবশেষে বললো মুসা।
সোজা শিরাটার দিকে! তাগাদা দিলো কিশোর। যত তাড়াতাড়ি পারো?
তাড়াতাড়ি কি আর হয়? সব পিচ্ছিল হয়ে আছে। মাথা নামিয়ে শরীরটাকে যথাসর কজো করে চলতে লাগলো ওরা। দুইবার কিশোর আর রবিন পা পিছলালো। আরেকবার পিনটু। পড়েই যাচ্ছিলো নিচে, অনেক কষ্টে সামলালো গাছের বেরিয়ে থাকা শেকড় চেপে ধরে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে এলো আবার আগের জায়গায়। কেবল মুসা পড়লো না। অন্য তিনজনকে সাহায্য করলো বরং। সারা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে ওদের। তবে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারলো শৈলশিরার প্রায় খাড়া পাথুরে ঢালের কাছে।
থামলো না। উঠতে শুরু করলো কনডর ক্যাসলের চূড়ায়। নাড়া লেগে ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়তে লাগলো আলগা ছোট পাথর।
জলপ্রপাতের গর্জনকে হাপিয়ে হঠাৎ শোনা গেল উত্তেজিত চিৎকার, ওই যে! ওখানে!
চূড়ার ওপরে!
ওরাই! ধরো, ধরো!
ঢালের ওপরে স্থির হয়ে গেল ছেলেরা। ফিরে তাকালো। রাস্তা থেকে সরে বাপ্পে ধরে চলে এসেছে তিন কাউবয়।
দেখেই ফেললো! কান্নার মতো স্বর বেরোলো পিনটুর।
এত্তো তাড়াতাড়ি! কোলাব্যাঙ ঢুকেছে যেন মুসার গলায়।
ঢিবির পাশ ঘুরে তততক্ষণে শৈলশিরার দিকে ছুটতে শুরু করেছে তিন কাউবয়।
কিশোর, এখন কি করা? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো রবিন।
তোতলাতে লাগলো কিশোর, কি-ক্কি..
অঝোর বৃষ্টি আর প্রপাতের শব্দকে ছাপিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ যেন ভরে দিতে লাগলো বাতাসকে। ক্রমেই বাড়ছে, জোরালো হচ্ছে। বারে ওপরে কোনোখান থেকে আসছে। টিরি ওপরে অর্ধেকটা উঠে পড়ছিলো কাউবয়রা, শব্দটা শুনে থমকে গেছে ওরাও। কান পেতে শুনহে।
আরি, দেখো! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
বাঁধের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানির উচ্চতা যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল দশ ফুট। তাতে ভাসছে কাঠ, ওপড়ানো ঝোপঝাড়। এমনকি আস্ত গাছও রয়েছে। প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঁধের নিচে। জলপ্রপাতের গর্জন একলাফে যেন বেড়ে গেল একশো গুণ। ছেলেদের পায়ের নিচে থরথর করে কেঁপে উঠলো পাহাড়টা।
থেমে গিয়েছিলো, আবার টিবি বেয়ে ছেলেদের দিকে উঠে আসতে লাগলো তিন কাউবয়। ছেলেরাও থেমে রইলো না আর, চূড়ায় উঠতে শুরু করলো আবার। কি মনে করে একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েই অস্ফুট শব্দ করে উঠলো পিনটু। অন্য তিনজনেও ফিরে তাকালো। দুভাগ হয়ে গেছে ঢিবিটা। একটা অংশ দাঁড়িয়ে আছে, খসে পড়ছে আরেকটা অংশ। চেঁচামেচি, হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি শুরু করে দিলো তিন কাউবয়। কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। ওদেরকে নিয়েই পানিতে ভেঙে পড়লো মাটির বিশাল চাঙড়। জলপ্রপাতের মধ্যে পড়ে খাবি খেতে লাগলো কাউবয়েরা, সঁতরে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। একজন একটা ভেসে যাওয়া গাছের গুড়ি চেপে ধরলো। পানি ওদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
গেল ব্যাটারা! হঠাৎ বড় বেশি ক্লান্তি লাগলো রবিনের। অবশ হয়ে গেছে যেন হাত-পা।
বেশিক্ষণের জন্যে না, রবিনের মানসিক শান্তি আবার নষ্ট করলো কিশোর। বাঁধের নিচে পড়েনি ওরা, পড়েছে অ্যারোইওর ভেতরে। ভেসে চলে যাবে শেষ মাথায়। স্রোতের জোর কম ওখানে। সাঁতরে পাড়ে উঠে আবার ধরতে আসবে আমাদের।
আগে আগে উঠছে এখন মুসা। কনডর ক্যাসলের চূড়ায় উঠে নিচে তাকালো সবাই। ঢাল থেকে খসে পড়ছে মাটি আর পাথর। বেরিয়ে পড়ছে নতুন নতুন পাথর, শেকড়। মাটি খসে গিয়ে যেন ক্ষত সৃষ্টি করছে পাহাড়ের গায়ে।
যেভাবে মাটি ভাঙছে, পাহাড়টাই না ধসে পড়ে। উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে নামার সময় কললো মুসা। এবারেও আগে আগে চলেছে সে।
বেরিয়ে থাকা কয়েকটা পাথরের ওপাশে চলে গেল মুসা।
অন্য তিনজনও এলো পেছনে পেছনে।
কিন্তু মুসা নেই। গেল কোথায়?
<