সকালে আগে ঘুম ভাঙলো কিশোরের। চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো নীল আকাশের দিকে, পুরো দুই মিনিট। কি যেন একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে, অনুভূতি বলছে। হঠাৎ মনে পড়লো। গন্ডগোলটা আর কিছু না, আগের দিনের ঝড়। বিপদে রয়েছে ওরা। নড়তে ইচ্ছে হলো না। বাতাস তাজা। গায়ে পরশ বোলাচ্ছে যেন ভোরের কাঁচা রোদ। বেশ আরাম। মাথার নিচে হাত দিয়ে চিত হয়ে থেকে ভাবতে শুরু করলো সে।
কি করেছে ওমর ভাই? তার জায়গায় সে নিজে হলে কি করতো? ওদেরকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি, কারণ ঝড় আসছিলো, বিমানটাকে বাঁচানোর জন্যে শেষে মুসা আর ডজকে নিয়ে উড়ে চলে গেছে। অবশ্যই ফিরে আসবে আবার। ঝড়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে ওরা, ভাবতেই পারলো না কিশোর। এত সহজে মরবে না। যে কোন মুহূর্তে এখন ফিরে আসতে পারে।
চোখ মেললো সাগরের হাসি। উঠে বসে কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসলো। লেগুনের দিকে ফিরলো। সাগরের দিকে চোখ পড়তেই হাসি মিলিয়ে গেল মুখ থেকে। বলে উঠলো, সর্বনাশ! কারনেস!
লাফিয়ে উঠে বসলো কিশোর। লেগুনে ঢোকার প্রণালী দিয়ে ঢুকছে স্কুনারটা। ঝড়ে পড়েছিলো, অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত। একটা পালও আস্ত নেই। কারনেসের হোয়াইট শার্ক, কোন সন্দেহ নেই। দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত জাহাজটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো কিশোর, কি করবে? ঝিনুকের পা ধরে ঝাঁকানি দিলো, এই ঝিনুক, ওঠ।
উঠে বসলো ঝিনুক। জাহাজটা দেখে দূর হয়ে গেল ঘুম। ভয় দেখা দিলো চোখে।
নড়ো না, হুঁশিয়ার করলো কিশোর। হয়ত আমাদেরকে দেখেনি। এসেছে কোন কারণে। আমাদের না দেখলে চলে যাবে শীঘ্রি।
মাথা নাড়লো ঝিনুক। না, যাবে না। ঝড়ে পড়েছিল। অনেক ক্ষতি হয়েছে জাহাজের। এখানে থেমে মেরামত করবে।
ঠিক, সাগরের হাসি বললো। না হলে আসছে কেন?
নিশ্চয় পানি আর খাবারের খোঁজে, কিশোর বললো। দ্রুত একবার চোখ বোলালো দ্বীপটায়। লুকানোর জায়গা খুঁজলো। চল, ওদিকটায় চলে যাই। নারকেল কুঞ্জের অন্য পাশটার কথা বললো সে।
উঠে দাঁড়াতে গেল সাগরের হাসি আর ঝিনুক। বাধা দিলো কিশোর। কারনেসের চোখে পড়ে যেতে পারে। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল ওরা কুঞ্জের দিকে। ভেতরে বালির একটা ঢিবি আছে। তার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকলে জাহাজ থেকে দেখা যাবে না।
গাছপালার ভেতরে ঢুকেই উঠে দাঁড়ালো কিশোর। দৌড় দিলো ঢিবির দিকে। ওটার আড়ালে আসার আগে পেছন ফিরে তাকালো না একবারও। বসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকিয়ে দেখলো লেগুনে ঢুকে পড়েছে জাহাজটা। নোঙর ফেলছে। ডেকে লুটোপুটি খাচ্ছে ছেড়া পাল। ওগুলো মাড়িয়েই হাঁটাচলা করছে নাবিকেরা। কারনেসের গলাকাটা সাগরেদের দল। হুইল ধরে থাকতে দেখা গেল কারনেসকে।
কিছুই করার নেই, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া। তা-ই করলো কিশোর আর দুই পলিনেশিয়ান। কিশোর ভাবছে, কারনেস কি করবে? আশা করলো, একটুক্ষণ থেকেই নারকেল নিয়ে চলে যাবে জাহাজটা। তবে যতই সময় যেতে লাগলো, নিরাশ হতে থাকলো সে। ডেকটা যতটা সম্ভব গোছগাছ করলো নাবিকেরা। তার পর ডিঙি নামানোর আদেশ দিলো কারনেস। পানির ওপর দিয়ে স্পষ্ট ভেসে আসছে তার কণ্ঠ। ডিঙি নামানো হলো। তাতে চড়ে বসলো কারনেস আর দুই সাগরেদ। দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে কিশোর। কপালে মনে হয় দুঃখ আছে আমাদের। কারনেস নিশ্চয়, অনুমান করেছে, এই দ্বীপের কাছাকাছিই কোথাও রয়েছে মুক্তোর খেত। দ্বীপে নেমে ঝিনুকের খোসাগুলো দেখলে শিওর হয়ে যাবে। আরও একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে, যে আমরাও উঠেছি দ্বীপে। খুঁজতে শুরু করবে।
জবাব দিলো না সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক। তাকিয়ে রয়েছে।
তীরে নামলো কারনেস। চোখ বোলালো দ্বীপের লেগুনের দিকের অংশটায়। পরিত্যক্ত ক্যাম্পটা চোখে পড়লো। দাঁতের ফাঁকে সিগার। কি ভেবে এগিয়ে গেল কয়েক পা। থামলো। দেখলো। আবার এগোল। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিলো একটা জিনিস। ঝিনুকের খোলা। এখান থেকেও দেখতে পাচ্ছে কিশোর।
ব্যস, হয়ে গেছে কাজ! অস্বস্তি বেড়ে গেল কিশোরের। ক্যাম্প দেখতে পেয়েছে কারনেস। ঝিনুকের খোলা পেয়েছে। ওটা কিভাবে কিজন্যে খোলা হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হবে না পাকা মুক্তো শিকারীর।
হাত নেড়ে দুই সঙ্গীকে ডাকলো কারনেস। ওরা কাছে এলে খোলাটা দেখালো।
ঘণ্টাখানেক দ্বীপে থাকলো ওরা। তারপর ফিরে গিয়ে উঠল ডিঙিতে। জাহাজের দিকে রওনা হলো। তীর থেকে একশ গজ দূরে নোঙর করা হয়েছে।
আশা হলো আবার কিশোরের। তীরে নেমে ক্যাম্প আর ঝিনুকের খোলা পাওয়ার পরেও যখন কিছু করেনি, আর করবে না। ফিরে যাবে কারনেস।
কিন্তু নড়লো না জাহাজটা। নোঙর তোলার কোন লক্ষণই নেই। জাহাজ আর পাল মেরামতে ব্যস্ত নাবিকেরা। যতই সময় যাচ্ছে উৎকণ্ঠা বাড়ছে কিশোরের। বিমানটা কখন এসে হাজির হয় কে জানে। তাহলে শুরু হবে বড় রকমের গন্ডগোল।
সারাটা দিন গেল। পশ্চিমে ঢলতে শুরু করলো সূর্য। তখনও দেখা নেই বিমানের। আসেনি বলে বরং স্বস্তিই বোধ করছে কিশোর। ভালই হয়েছে। কারনেস চলে যাওয়ার পর আসুক। তাহলে অহেতুক গোলমাল এড়ানো যাবে।
কিন্তু জাহাজটার নড়ার কোন লক্ষণই নেই।
ঝিনুকের দিকে ফিরলো কিশোর। আচ্ছা, ছোট একটা নৌকায় করে এখান থেকে রাটুনায় যেতে কতক্ষণ লাগবে?
এক মুহূর্ত ভাবলো ঝিনুক। একদিন। বড় জোর দুদিন।
জাহাজের পাশে বাধা ডিঙিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ওই নৌকাটা হলে?
ঝিনুক জানালো, রাতের বেলা রওনা হতে পারলে পরদিন গিয়ে তার পরদিন সকালে রাটুনায় পৌঁছতে পারবে।
পথ চিনে যেতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করলো না কিশোর। সে নিশ্চিত, একটুও ভুল না করে চলে যেতে পারবে সাগরের হাসি কিংবা ঝিনুক।
তাহলে, ঘোষণা করলো যেন কিশোর। রাতে কারনেসরা ঘুমিয়ে পড়লে নৌকাটা চুরি করবো আমরা।
কিশোরের কথা শুনে খুব খুশি সাগরের হাসি আর ঝিনুক। উত্তেজনা ফুটলো চেহারায়। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকালো ডিঙিটার দিকে, যেন ওটা মহামূল্যবান একটা বস্তু।
ভাবছে কিশোর, ডিঙি চুরি করাটা কিছুই না। অন্ধকারে নিঃশব্দে সাঁতরে চলে যেতে পারবে ওটার কাছে। তারপর বাঁধন খুলে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেই হল। ভয় একটা আছে অবশ্য, হাঙরটার। ওটা এখনও লেগুনে রয়েছে কিনা কে জানে। সারা দিনে একবারও ওটার পাখনা দেখা যায়নি যদিও। তবু থাকতে পারে। কিছু করার নেই। ডিঙিটা পেতে চাইলে ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
এখানকার গোধূলি খুব সংক্ষিপ্ত। এসেই চলে যায়। সেদিনও গেল। অন্ধকার নামলো। একটামাত্র আলো জ্বলছে জাহাজে। নাবিকদের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় রইলো কিশোর। অন্ধকারে এখনও যেতে পারে, ডেকের ওপর দেখা যাচ্ছে না কাউকে। কিন্তু বলা যায় না। বেরিয়ে আসতে পারে। তাড়াহুড়ো করে অযথা বিপদে পড়ার কোন মানে হয় না।
কোন শব্দ নেই জাহাজে। ডেকে একবারের জন্যেও আর কেউ আসেনি। সারাদিন খেটেছে নাবিকেরা। সন্ধে হতে না হতেই তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠে। দাঁড়াল কিশোর। চাঁদ ওঠেনি এখনও। তবে তারার আলো আছে। আকাশটাকে লাগছে বিশাল এক গম্বুজের মতো। ভেতরের দিকে যেন ঝুলে রয়েছে তারাগুলো।
সাগরের হাসির দিকে ফিরে বললো সে, একসাথে সবার যাওয়ার দরকার নেই আমাদের। তুমি নারকেল কুড়িয়ে নাও, যত বেশি পার। আমি আর ঝিনুক গিয়ে নৌকাটা নিয়ে আসি।
লেগুনের কিনারে চলে এলো ঝিনুক আর কিশোর। পানিতে পা দিলো। কোমর পানিতে নেমে সাঁতরাতে শুরু করলো। অন্ধকারে পানির ওপরে আবছা ভাবে চোখে পড়ছে জাহাজটা। কালো বিশাল একটা ভূতুড়ে অবয়ব। নিঃশব্দে সাঁতরে চললো দুজনে।
আলোটার দিকে কিশোরের চোখ। ওটা কারনেসের কেবিন। সে জেগে থাকতে পারে। হয়ত বসে বসে মদ গিলছে। খোলা বাতাসের জন্যে বেরিয়ে আসতে পারে। বলা যায় না। সতর্ক থাকা দরকার। ওকে দেখলেই ডুব মারতে হবে।
মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে ডিঙিটা। নীরব হয়ে আছে জাহাজ। কোন শব্দ নেই। কেউ বেরোচ্ছে না ডেকে। ডিঙির কাছে পৌঁছে আস্তে হাত দিয়ে খামচে ধরল সে ওটার কিনারা। কান পেতে রইল। না, কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না। আস্তে করে দুহাতের সাহায্যে টেনে তুললো নিজেকে। ডিঙির পাটাতনে নামতে গিয়ে পড়লো নরম কিছুর ওপর। ভয়ানক চমকে গেল সে। নরম জিনিসটা কি বুঝতে পেরেছে। মানুষ!
ডিঙিতে ঘুমিয়েছে লোকটা। অন্ধকারে কোন ফাঁকে নেমেছে ও, ঢিবির আড়ালে বসে দেখতে পায়নি কিশোর। জেগে গেল লোকটা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। জাপটে ধরলো কিশোরকে।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ধস্তাধস্তি শুরু করলো কিশোর। কিন্তু অসুরের শক্তি লোকটার গায়ে। তাকে পেড়ে ফেলে গলা টিপে ধরলো। ছটফট করতে লাগলো কিশোর। বাতাসের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে ফুসফুস। কানে আসছে অনেক লোকের চেঁচামেচি। ডেকে বেরিয়ে এসেছে নাবিকেরা।
আরেকবার ছাড়া পাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলো কিশোর। প্রচন্ড ঘুসি এসে লাগলো চোয়ালে। হাজারটা তারা জ্বলে উঠলো যেন মাথার ভেতরে। জ্ঞান হারালো সে।
বেশিক্ষণ অচেতন থাকলো না। হুঁশ ফিরলে দেখলো ডেকে পড়ে আছে। প্রায় চোখের কাছে জ্বলছে একটা হ্যারিকেন। অনেকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাকে।
চোখ মেলতেই তার দিকে তাকিয়ে কুৎসিত হাসি হাসলো কারনেস। ওঠ ওঠ। নরম গলায় ডাকলো সে। কিশোরের মনে হলো বেড়ালের ঘড়ঘড়ে স্বর বেরোল লোকটার গলা দিয়ে।
উঠে বসলো কিশোর। এরকম একটা কান্ড ঘটবে কল্পনাই করতে পারেনি। যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনও। মাথা ঝাড়া দিয়ে মগজের ঘোলাটে ভাবটা দূর করার চেষ্টা করলো। সে একাই ধরা পড়েছে? নাকি ঝিনুকও? তবে পালিয়ে গেলেও বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। সকাল হলেই ধরা পড়তে হবে।
আবার তাহলে দেখা হলো, আঁ? দাঁত বের করে হাসলো কারনেস।
জবাব দিলো না কিশোর।
তোমার দোস্তরা কোথায়? শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলো কারনেস।
জানি না, তিক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো কিশোর।
মিছে কথা বলবে না বলে দিলাম!
মাথা নাড়লো কিশোর। না, মিথ্যে বলছি না। ঝড়ের সময় হারিয়ে গেছে ওরা। দ্বীপের নিচে একটা গুহার ভেতরে আটকা পড়েছিলাম আমি। হাঙর ঢুকেছিলো গুহায়। ওটার জন্যে বেরোতে পারছিলাম না। সকালে বেরিয়ে দেখি, নেই। জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্যে তখন নারকেল গাছে চড়ে বসে রইলাম।
এমন ভঙ্গিতে বলেছে কিশোর, বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো কারনেস। মসৃণ গলায় জিজ্ঞেস করলো, অনেক মুক্তো পেয়েছে, না?
অল্প কিছু, অস্বীকার করার কোন কারণ দেখতে পেলো না কিশোর। বেশি তুলতে পারিনি। একটা সোর্ডফিশ প্লেনের তলা ফুটো করে দিয়েছিলো। ডুবুরির সাজসরঞ্জাম সব পানিতে ফেলে দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি আমরা।
মুক্তোগুলো কোথায়?
ওদের কাছে।
খেতটা কোথায়, জান?
মোটামুটি।
ঠিক আছে। সকালে আমাকে দেখাবে।
আচ্ছা। কথা দিলো বটে কিশোর, তবে দেখাবে কিনা ভাবতে হবে। আসলে সময় চাইছে সে। এখনই কারনেসের বিরোধিতা শুরু করে মার খেতে চায় না।
কোমরের খাপ থেকে ছুরি বের করলো কারনেস। ইচ্ছে করেই চোখা মাথাটা তুললো কিশোরের দিকে। হুমকি দেয়ার জন্যে। বললো, সাবধান, চালাকির চেষ্টা করবে না। তাহলে কি করবো জানো? দিয়ে দেব তোমাকে। আমার সাগরেদদের হাতে। ওরা নিয়ে গিয়ে জবাই করবে। কেটে মাংস খাবে তোমার। অনেক দিন মানুষের মাংস খায় না। পেলে খুব খুশি হবে।
কিশোরকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলো কারনেস।
প্রায় টেনেহিঁচড়ে কিশোরকে নিচে নামিয়ে আনলো দুজন নাবিক। একটা ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো ওরা। বোটকা গন্ধ। গন্ধেই চিনতে পারলো কিশোর, এই ঘরেই বন্দী করে রাখা হয়েছিলো ঝিনুককে।
<