লাইব্রেরিতে এসে পিনটুকে খুঁজে বের করলো কিশোর। মুখ কালো করে বসে আছে আলভারেজদের শেষ বংশধর। কললো, গিরিখাতে গোলাগুলির অনেক খবর আছে। কিন্তু ডনের কি হয়েছিলো, সে-সম্পর্কে কিছুই নেই।

দরকারও নেই। জিনিস পেয়ে গেছি আমি। রবিন আর মুসাও নিশ্চয় কাজ শেষ কবে ফেলেছে। চলো, যাই।

কোথায়? হেডকোয়ার্টারে। ওখানেই আসবে ওরা।

স্যালভিজ ইয়ার্ডে এসে দুটো সাইকেল পার্ক করে রেখে ট্রেলারে ঢুকলো দুজন। রবিন আর মুসা আসেনি।

এখনও হয়তো কথা বলছে রিগোর সাথে, কিশোর বললো। আসুক। আমরা বসি।

তুমি কি জিনিস পেলে? বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো পিনটু।

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো কিশোর। উত্তেজনায় আবার চকচক করে উঠলো চোখ। আমেরিকান সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার ছিলো ফ্রিমন্টস, যার দলে ছিলো সার্জেন্ট ডগলাস আর দুই করপোরাল। আরও একজন অফিসার ছিলো, সে সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট, জার্নাল রাখতো। আঠারোশো ছেচল্লিশের পনেরো সেপ্টেম্বর লিখেছে এই লেখাটা, বলে পড়তে লাগলো সে। মাথা ঘুরছে আমার! মেজাজও ভীষণ খারাপ। হবেই। যা অত্যাচার যাচ্ছে শরীরের ওপর দিয়ে। তারপরেও স্বস্তি নেই, রেহাই পেলাম

কাজ থেকে। আজ রাতে আমার ডিউটি পড়লো ডন পিউটো আলভারেজের হাসিয়েনডায়, লুকানো জিনিসের খোঁজ করার জন্যে। শোনা গেছে, চোরাই মাল নাকি আছে ওখানে। সন্ধ্যা হয় হয় এই সময় এমন একটা জিনিস চোখে পড়লো, বিশ্বাস করতে পারলাম না। হয়তো আমার চোখের ভুল, প্রচণ্ড ক্লান্তিতে অমন হয়েছে। দেখলাম, সান্তা ইনেজ ক্ৰীকের পাশের একটা শৈলশিরা ধরে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে ডন পিউটো আলভারেজ, হাতে একটা ব্রিট তলোয়ার। পিছু নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার আগেই অন্ধকার নেমে এলো। আর এগোতে সাহস করলাম না, কারণ আমার শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। যদি সত্যিই ডন হয়ে থাকে, তার সাথে একলা লাগতে যাওয়া বোকামি হয়ে যাবে। ক্যাম্পে ফিরে রিপোর্ট করলাম। আমাকে, জানানো হলো, সেইদিন সকালেই পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা পড়েছে ডন, কাজেই আমি যাকে দেখেছি সে ডন হতেই পারে না। তাহলে কাকে দেখলাম? চোখের ভুল? ভূত? বার বার জিজ্ঞেস করছি ক্লান্ত মনকে, কোনো জবাব পাচ্ছি না।

তারমানে গুলি খেয়ে মরেননি ডন প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু। লেফটেন্যান্ট সত্যিই দেখেছে। কিশোর, তার হাতে তলোয়ারটাও ছিলো

ছিলো, হাসলো কিশোর। এখন জোর দিয়ে বলা যায়, পনেরো সেপ্টেম্বর রাতে জীবিত ছিলেন ডন, সাথে ছিলো করটেজ সোর্ড। ভুল দেখেনি লেফটেন্যান্ট। মুসা আর রবিন এলেই দেখতে যাবো।

কিন্তু আরও আধঘণ্টা পরও যখন ওরা ফিরলো না, আশঙ্কা জাগলো পিনটুর মনে। কিছু হয়নি তো ওদের?

গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে হওয়াটা স্বাভাবিক, গভীর হয়ে বললো কিশোর। আমার মনে হয়, রিগোর কাছ থেকে কোনো তথ্য জানতে পেরে খোঁজ নিয়ে দেখতে গেছে সেটা।

কোথায় গেল?

নিশ্চয় হাসিয়েনডায়। আর কোথায় যাবে? চলো, আমরাও যাই।

ট্রেলার থেকে বেরিয়ে আবার সাইকেলে চাপলো দুজনে। বৃষ্টি কমছে। ওরা হাসিয়েনডায় পৌঁছতে পৌঁছতে একেবারে কমে গেল। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ। কাউন্টি রোড ধরে সান্তা ইনেজ কীকের ব্রিজ পেরোনোর সময় দেখলো পানিতে কানায় কানায় ভরে গেছে নালাটা। অ্যারোইওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুখ তুলে করটেজের মূর্তিটার দিকে তাকালো পিনটু। চিৎকার করে উঠলো, কিশোর, দেখো দেখো, নড়ছে!

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো দুজনেই।

না, মূর্তি নড়ছে না, কিশোর কললো। ওটার কাছে কেউ উঠেছে।

মূর্তির পেছনে লুকিয়েছে?

মনে হয়…দুজন…আরে দৌড়াচ্ছে!

আসছে তো এদিকেই!

মুসা আর রবিন!

চলো, চলো!

পথের পাশের ঝোপে ঠেলা দিয়ে সাইকেল দুটো ঢুকিয়ে রেখেই দৌড় দিলো দুজনে। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে, পিছলে পড়ছে রকিন আর মুসা, কিন্তু পরোয়াই করছে না যেন ওসবের। কি করে রাস্তায় নেমে আসবে দ্রুত, কেবল সেই চেষ্টা। শৈলশিরাটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার গোড়ায় একটা খাদ রয়েছে। ওখানে মিলিত হলো চার কিশোর।

কিশোর, প্রমাণ পেয়েছি! হাঁপাতে হাঁপাতে বললো মুসা।

লোক তিনটে দেখে ফেলেছে আমাদের! এতো জোরে দম ফেলছে রবিন, জড়িয়ে যাচ্ছে কথা।

তিনজন? কারা? পিনটু হাঁপাচ্ছে।

চিনি না। তাড়া করলো আমাদের।

জলদি চলো ব্রিজের দিকে, কিশোর বললো। ওটার নিচে লুকানোর জায়গা আছে।

কিন্তু ওখানেও খুঁজবে,রবিন বললো, জানা কথা।

রাস্তার ধারে একখানে একটা বড় ড্রেন-পাইপ আছে, পিনটু জানালো। ওটা দিয়ে একটা খাদে নেমে যাওয়া যায়। খাদের মধ্যে এতো জংলা, ঢুকলে আর দেখতে পাবে না। চলো চলো।

পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা বিশাল ড্রেনটার মুখের কাছে এসে পঁাড়ালো চারজনে। ভেতরে পানি বইছে, তবে খুব কম, সামান্যতম দ্বিধা না করে তাতে ঢুকে পড়লো পিনটু। অন্য তিনজনও ঢুকলো। গিয়ে নামলো খাদের মধ্যে। কাদা থিকথিক করছে ওটাতে, একেবারে তলায় পানিও জমেছে যেখানটায় সবচেয়ে বেশি গভীর। চারপাশে চ্যাপারালের ঘন ঝোপ। তার মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলো ওরা।

কি প্রমাণ পেয়েছো? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

চাবিটার কথা জানালো রবিন আর মুসা। ওটা হাতে নিয়ে ম্লান আলোয় দেখলো পিনটু। আমাদের না।

তাহলে ওই লোকগুলোরই কারো, কিশোর বললো। মনে হচ্ছে গোলাঘরে আগুন লাগার আগে ঢুকেছিলো ওখানে। চাবিটা হারিয়েছে। এবং কাউকে জানতে দিতে চায় না যে ওরা ঢুকেছিলো। হয়তো হ্যাটটা ওরাই চুরি করে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পফায়ারের কাছে রেখে দিয়েছিলো।

কিন্তু ওরা কারা? খসখসে হয়ে গেছে মুসার গলা।

কি করে বলি? তবে ওই আগুন লাগা আর রিগোর অ্যারেস্টের পেছনে ওদের হাত আছে শশশশ!

রাস্তায় হুটন্ত পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আস্তে ঝোপ ফাঁক করে তাকালো ছেলেরা। দুপদাপ করে দৌড়ে ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল তিন কাউবয়।

কখনও দেখিনি, ফিসফিসিয়ে জানালো পিনটু। মিস্টার ডয়েলের লোক হতে পারে। নতুন চাকরি নিয়েছে হয়তো।

এখানে কি করছে? মুসার প্রশ্ন।

সেটাই জানতে হবে, জবাব দিলো কিশোর।

আবার ফিরে না এলেই বাঁচি! রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো রবিন।

বসেই রইলো ছেলেরা। কান পেতে রয়েছে। আরও পনেরো মিনিট পর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোর বললো, গিয়ে দেখা উচিত।

আমি যাচ্ছি, পিনটু উঠে দাঁড়ালো। মুসা আর রবিনের পিছে লেগেছে ওরা, আমার নয়। আমাকে সন্দেহ করবে না।

রাস্তায় উঠে বাঁয়ে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পিনটু। খাদের মধ্যে অপেক্ষা করতে লাগলো তিন গোয়েন্দা। শব্দটা প্রথম শুনতে পেলো রবিন। কে এসেছে দেখার জন্যে উঠতে গেল সে।

রাখো! বাধা দিলো মুসা। পিনটু না-ও হতে পারে।

খাদের কাছে এসে থামলো কেউ। ডেকে বললো, বেরিয়ে এসো।

পিনটু। খাদ থেকে উঠে এলো তিন গোয়েন্দা। ফিরে এলো সান্তা ইনেজ ক্রীকের ব্রিজের কাছে। হাত তুলে দেখালো পিনটু। সবাই দেখলো, উত্তরের কাঁচা রাস্তা ধরে ডয়েল র‍্যাঞ্চের দিকে চলে যাচ্ছে তিন কাউবয়।

গেছে, হেসে বললো পিনটু। এখান থেকেই আমাদের তদন্ত শুরু হবে, তাই না কিশোর?

কিসের তদন্ত? বুঝতে পারলো না মুসা।

লেফটেন্যান্টের জার্নালের কথা মুসা আর রবিনকে জানালো কিশোর। ফটোকপি করে আনা লেখাটাও দেখালো।

খাইছে বলে উঠলো মুসা। ডন পিউটো তাহলে সত্যি সত্যি পালিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলো করটেজ সোর্ড।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তবে লেফটেন্যান্ট যেভাবে লিখেছে, তাতে জায়গা খুঁজে পাওয়ার ভরসা কম। জায়গাটার কোনো বর্ণনা দেয়নি।

কিন্তু কিশোর, বলেছে… প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল পিনটু।

ও তো বিশ্বাসই করেনি, বলবে কি? তবে যতদূর মনে হয় ওদিকটার কথা বলেছে। হাত তুললো কিশোর। বলেছে সান্তা ইনেজ ক্রীকের পাশের একটা শ্লৈাি ধরে গিয়েছেন। নিশ্চয় বেরিয়েছিলেন হাসিয়েনডা থেকে। তার মানে পশ্চিমে গেছে।

সেদিকে তাকালো সবাই।

কিছুই বোঝা গেল না, ওদিক দিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন ডন।

মাথা গরম ছিলো তখন লেফটেন্যান্টের নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর।

কি দেখতে কি দেখেছে। কিছু একটা ভুল করেছে, লিখতে গিয়ে। হয়তো যা দেখেছিলো ঠিকমতো লিখতে পারেনি।

আবার নিরাশা এসে ভর করলো ওদের মনে।

চলো ফিরে যাই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান।

ধীরে ধীরে আবার ফিরে চললো ওরা। বাড়ি যাবে।

<

Super User