প্রায় সারাটা বিকেল বিমান চুরি আর কালো চশমা পরা লোকটার কথা আলোচনা করেই কাটালো ওরা। একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছে না, নিজেকে ভরি বলে চালাতে গেল কেন সে? এতো বড় বোকামি কেন করলো? তার বোঝা উচিত ছিলো, কারো সন্দেহ হলে, আর সামান্য খোঁজ করলেই ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যাবে।
হয়তো ব্যাটা পাগল, মুসা বললো। নিজেকে ডরি ভাবতে ভালোবাসে। এজন্যেই, ডরি নয় বলেই ব্যাটা আমাদের প্রজাপতিটা চিনতে পারেনি।
এক কাজ করলে কেমন হয়? জিনা প্রস্তাব দিলো, আজ রাতে গিয়ে লুকিয়ে থেকে চোখ রাখবো প্রজাপতির খামারের ওপর। নকল ডরি, আসল ডরি, ডাউসন, কে কি করে দেখে আসা যাবে।
আমিও এই কথাই ভাবছি, কিশোর বললো। যাবো, তবে সবাই নয়। আমি আর মুসা। তোমরা ক্যাম্পে থাকবে। সবার একসাথে যাওয়া ঠিক হবে না।
আমিও যাবো, জনি বললো।
না, দল ভারি করে লাভ নেই। ধরা পড়ার ভয় আছে। তাহলে রাফিকে নিয়ে যাও, জিনা বললো। তোমাদের বিপদটিপদ হলে…
ও গিয়ে ঝামেলা আরও বাড়াবে, মুসা বললো। কিছু দেখলেই চিৎকার শুরু করবে। অযথা শব্দ করবে। তারচে আমরা দুজনই যাই। ভয় নেই, আমাদের কিছু হবে না। যদি বুড়িটা সত্যি সত্যি ডাইনী না হয়ে থাকে…
হেসে উঠলো জনি। অন্যেরাও হেসে ফেললো মুসার কথা শুনে।
আমি তাহলে বাড়িতেই যাই, জনি উঠে দাঁড়ালো। অনেক কাজ। শোনো, আবারও বলছি, আমাকে নিয়ে যাও। এই এলাকা তোমাদের অচেনা, আমার চেনা। রাতের বেলা আমি সাথে থাকলে সুবিধে হবে…কি বলো?
চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবলো কিশোর। তারপর মাথা কাত করলো। ঠিক আছে। তবে খুব সাবধানে থাকবে। এধরনের কাজ করে তোমার অভ্যাস নেই তো…
আমি কোনো বিপদে ফেলবো না তোমাদের, কথা দিলাম। তা কখন রওনা হতে চাও?
এই দশটা নাগাদ। নাকি এগারোটা? এগারোটা হলেই বোধহয় ভালো হয়। অন্ধকার থাকবে তখন।
ঠিক আছে। খামারের পেছনের ওক গাছটার কাছে দেখা হবে। দেখেছে তো, বড় গাছটা? ওটার নিচেই থাকবো আমি।
আচ্ছা।
জনিকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে এলো রাফি।
চা-টা চলবে নাকি, মুসা? রবিন জিজ্ঞেস করলো। বানাবো?
বানাও,হাত ওল্টালো মুসা। তবে আর কিছু না। দুপুরের খাওয়াটা দেরিতে হয়ে গেছে। খিদে নেই। এখন আর নাস্তার ঝামেলা না করে রাতে একবারেই খাবো।
ও হা, কিশোর মনে করিয়ে দিল, ছটার খবর শোনা দরকার। চুরি যাওয়া প্লেনের কথা কিছু বলতে পারে।
ছ’টা বাজার মিনিটখানেক আগে রেডিও অন করলো সে। খবরের জন্যে কান পেতে রইলো। অবশেষে শুরু হলো খবর। নানারকম খবর পড়ছে সংবাদ পাঠক। ওরা যখন হতাশ হয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছে প্লেনের কথা কিছু বলবেই না, তখনই বলা হলোঃ কাল রাতে বাটারফ্লাই হিল এয়ারপোর্ট থেকে চুরি যাওয়া বিমান দুটো পাওয়া গেছে। দুটোই সাগরে পড়েছে। ওগুলোকে পানির তলা থেকে টেনে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। দুই পাইলটের একজনকেও পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, পানিতে ডুবে মারা গেছে ওরা।…
অন্য খবরে চলে গেল সংবাদ পাঠক।
রেডিও বন্ধ করে দিয়ে সবার মুখের দিকে তাকালো কিশোর। পড়লো কিভাবে? নিশ্চয় ঝড়ে। তাহলে চোরেরা আর যন্ত্র বিক্রি করতে পারলো না।
কিন্তু জনির ভাই তো মারা পড়লো? ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জিনার চেহারা।
চোরই যদি হয়ে থাকে জ্যাক ম্যানর, রবিন বললো, তার জন্যে দুঃখ করে লাভ নেই।
কিন্তু সে চোর নয়, প্রতিবাদ করলো জিনা। চোরের মতো লাগেনি।
আমার কাছেও লাগেনি, মুসা বললো।
রবিন ঠিকই বলেছে, কিশোর বললো।চোর হলে দুঃখ করে লাভ নেই। আর চোর না হয়ে থাকলে তো প্লেনেও থাকবে না, মরেওনি, দুঃখ করা প্রয়োজনই হবে না আমাদের। তবে মারা গিয়ে থাকলে জনি বেচারা খুব কষ্ট পাবে। জ্যাক তার কাছে আর হিরো থাকবে না।
হ্যাঁ, মাথা দোলালো রবিন। জ্যাক সত্যি সত্যি মারা গিয়ে থাকলে আর আমাদের এখানে থাকা চলবে না। সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকবে জনি, আমাদের মজা নষ্ট হবে। আর কোনো আনন্দ পাবো না এখানে থেকে।
ভুল বললে, কিশোর বললো, মারা গিয়ে থাকলে আরও বেশিদিন এখানে থাকা উচিত আমাদের। জনিকে খুশি রাখার জন্যে। আমরা চলে গেলে সান্ত্বনা দেয়ার কেউ থাকবে না, ও আরও বেশি মনমরা হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো তুমি, একমত হলো মুসা। দুঃখের দিনে পাশেই যদি না থাকলো, বন্ধুবান্ধব কিসের জন্যে?
সে-ও নিশ্চয় খবরটা শুনেছে, জিনা বললো। কি মনে হয়, তোমাদের জন্যে ওক গাছের নিচে অপেক্ষা করবে আর?
জানি না, কিশোর বললো। না থাকলেও অসুবিধে নেই। আমাদের তো দুজনেরই যাবার কথা ছিলো। ও তো জোর করে ঢুকলো। যা খুশি ঘটুক, খামারের রহস্যের কিনারা না করে আমি যাচ্ছি না এখান থেকে।
বসে থাকলে সময় কাটতে চায় না, তাই পাহাড়ের ওদিকে ঘুরতে বেরোলো ওরা। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। আটটায় রাতের খাওয়া শেষ করে আবার রেডিও অন করলো। নটার সংবাদ শুনবে।
কিন্তু নটার সংবাদে আর নতুন কিছু বললো না। ছটায় যা বলেছিলো, তা-ই বললো।
রেডিও বন্ধ করে দিয়ে ফীগ্লাস চোখে লাগিয়ে এয়ারফীল্ডে কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে চললো কিশোর।
লোকজনের চলাফেরা আর খুব একটা দেখা যাচ্ছে না, বললো সে। শান্ত হয়ে আসছে সব। জ্যাক আর রিডের বন্ধুরা বোধহয় খুব শক পেয়েছে খবর শুনে।
আচ্ছা, আমরা শুনলাম, অথচ ওরা কেউ কাল রাতে প্লেন দুটো উড়তে শুনলো? প্রশ্ন তুললো জিনা।
না শোনার তো কথা নয়, রবিন বললো।
তাহলে বাধা দিলো না কেন?
ঝড়ের জন্যে হয়তো প্রথমে বুঝতে পারেনি কিছু। তারপর তো উড়েই চলে গেল। তখন আর কিছু করার ছিল না।
তা-ই হবে, মাথা ঝাঁকালো জিনা।
আমরা সাড়ে দশটায় রওনা হবো, কিশোর বললো। তোমরা শোয়ার ব্যবস্থা করছে না কেন?
সে করা যাবে, যাও না আগে তোমরা, জিনা বললো। রাফিকে নিয়েই যাও, বুঝেছো? ওই ডাইনী বুড়িটা কি করে বসে ঠিক নেই! তার ওপর রয়েছে কালো চশমাওয়ালা লোকটা। পাজি লোক।
তোমরা এই পাহাড়ে একা থাকবে, রাফিকে তোমাদেরই বেশি দরকার। আমাদের কিছু হবে না। বারোটার মধ্যেই ফিরে আসবো।
খোলা আকাশের নিচে বসে কথা বলছে ওরা। আজ আর মেঘ নেই, ফলে ভাবতে ঢোকারও দরকার নেই। ঝকঝকে তারাজলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এখন কল্পনাই করা যায় না, গত রাতে এই সময় কি প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি ছিলো।
ঘড়ি দেখলো কিশোর। যাবার সময় হয়েছে। মুসা, ওঠো।
রবিন আর জিনাকে সাবধানে থাকতে বলে রওনা হলো দুজনে। আকাশ পরিষ্কার বটে, কিন্তু অন্ধকার যথেষ্ট আছে। খোলা অঞ্চলে এমনিতেই অন্ধকার কিছুটা কম লাগে, কিন্তু তারপরেও যা আছে, অনেক।
তবু সাবধানে থাকতে হবে আমাদের, নিচু গলায় বললো কিশোর। কেউ যাতে দেখে না ফেলে।
সোজা চলে এলো ওরা খামারের পেছনের বড় ওক গাছটার কাছে। জনি নেই। তবে মিনিট দুয়েক পরেই খসখস শব্দ শোনা গেল। জনি এলো। হাঁপানো দেখেই অনুমান করা গেল ছুটে এসেছে।
সরি, দেরি হয়ে গেল, ফিসফিস করে বললো সে। ছটার খবর শুনেছো?
শুনেছি, জবাব দিলো কিশোর। খুব খারাপ লেগেছে আমাদের।
আমাদের লাগেনি, জনি বললো। আমি জানি, জ্যাক ভাইয়া আর রিড ওগুলোতে ছিলো না। যদি মরেই থাকে, দুটো চোর মরেছে। চোরের জন্যে দুঃখ করতে যাব কেন?
না, কোনো কারণ নেই, কিশোর বললো। মনে মনে অবশ্য সে জনির মতো নিশ্চিত হতে পারলো না যে বিমান দুটোতে ওই দুইজন ছিলো না।
তা এখন কি করবে, ভেবেছো কিছু? জনি জিজ্ঞেস করলো। কটেজের জানালায় আলো দেখছি, পর্দা টানেনি বোঝাই যায়। গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পারি ভেতরে কি হচ্ছে।
তা-ই করবো। এসো। সাবধান, একটু শব্দও যেন না হয়। আমার পেছনে, একসারিতে এসো।
পা টিপে টিপে কটেজের দিকে এগিয়ে চললো ওরা।
<