পুরস্কারের টাকা পেয়ে এতো খুশি হয়েছে নেলি, কিশোর বললো, মিস্টার সাইনাস
বা মড়ার খুলি, কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেনি।
এখন সে কলেজে যেতে পারবে, রবিন বললো। যা সে চাইছিল। টাকার জন্যে পারছিলো না এতদিন।
সেপ্টেম্বরেই বার্কেলিতে ভর্তি হবে, মুসা জানালো।
প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে মুখ করে থাকা জানালার সারিওয়ালা, ভিকটর সাইমনের মস্ত লিভিং রুমে বসেছে তিন গোয়েন্দা। মিস্টার সাইমনের অনুরোধেই কপিচুরির কেসের গল্প বলতে ওরা এসেছে এখানে। তিনিই ফোন করেছিলেন হেডকোয়ার্টারে, সাইনাসের মুখে কাপ চুরি যাওয়ার খবর শুনে বেশ আগ্রহী হয়েছিলেন সব কথা জানার জন্যে।
টেবিলের পাশে রাখা একটা লম্বা বীচ-চেয়ারে আরাম করে বসেছেন বিখ্যাত রহস্য-কাহিনী লেখক। তাহলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেহে নকল মড়ার খুলি? থিয়েটারে অভিনয় করতে?
গেছে, হাত নাড়লো কিশোর, তবে আমার মনে হয় না এবারেও সুবিধে করতে পারবে। বেঁচে থাকার জন্যে এখনও তাকে মোটর মেকানিকের কাজই করতে হবে।
এক মুহূর্ত থেমে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, মজার ব্যাপার হলো, মড়ার খুলিকে দেখতে পারতাম না বলে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যেই ওই কুইজ শোতে অংশ নিয়েছিলাম। তাকে এতো বেশি ঘৃণা করতাম, চেয়েছিলাম যেভাইে হোক পরাজিত করবোই। কিন্তু পরে গিয়ে যে মড়ার খুলিকে দেখলাম, তাকে পছন্দই করে ফেললাম। নেলির কোনো ক্ষতি করতে চায়নি সে এ্যাপারে আমি নিশ্চিত। ও শুধু রাফায়েল সাইনাসের কথামতো নেচেছে টাকার লোভে সততটা, তার চেয়ে বেশি বড় অভিনেতা হওয়ার লোভে।
হুঁ, অভিনেতা হওয়ার লোভে কতো লোকে যে কতো কিছু করে বসে, ধীরে মাথা দোলালেন সাইমন। তা রাফায়েল সাইনাস কি করছেন এখন? সেই পুরানো ভাঙা প্রাসাদেই কি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে অতীতের স্বপ্ন দেখছেন?
না, মুসা বললো। নেলিকে যখন আমরা নামিয়ে নিয়ে আসছিলাম, শুনলাম পাগলের মতো চিৎকার করছেনঃ চুপ, কোনো গোলমাল নয়! লাইট ক্যামেরা। অ্যাকশন! অনেক কষ্টে তাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছে অ্যালউড হোফার।
সমবেদনা দেখিয়ে মাথা ঝাঁকালেন লেখক। একসময় অনেক বড় পরিচালক ছিলেন তিনি। তাঁর তৈরি অনেক ছবি দেখেছি আমি, ভালো ভালো ছবি। এখনও কি হাসপাতালেই আছেন?
না, কিশোর জানালো, মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের লোকেরা এসে গেছে। অকসর পাওয়া, অক্ষম সিনেমার লোকদের জন্যে একটা কলোনি বানিয়েছে ওরা, সেখানেই জায়গা দিয়েছে তাকে। আর কিছু না পান, পুরনো বন্ধুদের দেখা সাক্ষাৎ ওখানে পানে সাইনাস, কথা বলে মনের ভার কিছুটা হলেও হালকা করতে পরকে।
যা, তা পব্রকেন। তা হ্যারিস বেকার নিশ্চয় একেবারেই নিরপরাধ? সাইনাস আর মড়ার খুলির পরিকল্পনার কিছুই জানতো না?
না। ওই কুইজ শো-র ব্যবস্থা করে প্রমোশনের আশায় ছিলো বেকার। শো শেষ হলে সব জানার পর সেটা ফাঁস করে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায়নি। তাই মড়ার খুলিকে ছেড়ে দিয়ে গোপন অতে চেয়েছে।
ভারিপদ আর শিকারী কুকুরের কি খবর?
অনেক দিন বেকার থাকার পর ভারিপদ একটা কাজ পেয়ে গেছে। একটা জুতোর কোম্পানি ওই কুইজ শো দেখে তাকে ডেকে নিয়ে গেছে, বিজ্ঞাপনের কাজ করার জন্যে। কাজটা পেয়ে খুব খুশি ডারিপদ। আর শিকারী কুকুর কলেজ শেষ করে আইন পড়বে। অসুবিধেয় পড়া, বেকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হয়ে আদালতে লড়াই করবে মুভি স্টুডিও আর টেলিভিশ্ন নেটওয়াকের বিরুদ্ধে। হুট করে যেন আর কাউকে বিদায় করে দিতে না পারে ওরা।
ভালো, খুব ভালো, মন্তব্য করলেন লেখক। রান্নাঘরের দিকে তাকালেন একবার। যেখানে হাড়ি-পাতিল নিয়ে খুটুর-খাটুর করছে তাঁর ভিয়েতনামি বাবুর্চি নিসান জাং কিম। তারপর আবার তিনগোয়েন্দার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আর অলউড হোফার? তার পরিচয় গোপন আছে তো?
নিশ্চয়ই, মুসা বললো। ওর কথা কাউকে বলিনি আমরা। ছুটি শেষ হলে সেপ্টেম্বরে নিরাপদেই ইস্কুলে ফিরে যেতে পারবে।
ইস্কুলের কথায় আবার রান্নাঘরের দিকে তাকালেন সাইমন। কিমও ইস্কুলে যাবে।
ইস্কুলে যাবে? রবিন বললো। কি পড়বে?
রান্না। আপাতত ফরাসী রান্না। কোন্ কোন্ জিনিস খেলে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে, সে-ভূত নেমেছে মাথা থেকে। নানারকম জটিল রান্নার দিকে ঝুঁকেছে আজকাল। এই যেমন, সাগরের শ্যাওলা দিয়ে মুখরোচক খাবার কি করে তৈরি করা যায়। অবশ্য হজম করতে কিছুটা কষ্টই হচ্ছে আমার। সামনে ঝুঁকলেন তিনি।
তোমরা কিন্তু দুপুরে না খেয়ে যেতে পারবে না। বিশেষ করে তুমি, মুসা।
ঝট করে পরস্পরের দিকে তাকালো রবিন আর কিশোর। এর আগের বার যখন এসেছিলো, ওদেরকে গিনিপিগ আর শামুক খাওয়ানোর জন্যে অনেক জোর-জবরদস্তি করেছিলো কিম। কাজেই এখানে দাওয়াত খাওয়ার কথা শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে দুজনে।
কেন, বিশেষ করে আমাকে কেন? মুসাও অস্বস্তি বোধ করছে।
কারণ, তোমাকে খুব পছন্দ করে কিম, মুচকি হাসলেন লেখক। যা দেয় তা-ই মুখ বুজে খেয়ে ফেলো তো। বলে, রান্না করে যদি কাউকে মন মতো খাওয়াতেই না পারলাম তাহলে শান্তি কোথায়?
কেশে উঠলো মুসা। স্যার, একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না। কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেটা আপনি বলে দেন না কেন? আপনি পছন্দ করে দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়।
আমি জানতাম এক সময় না একসময় তোমরা একথা কলবে আমাকে। চেয়ারের পাশে রাখা লাঠিটা তুলে নিয়ে তাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন লেখক, পা এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ঝাল মাংসের পুর দেয়া হ্যামবার্গার খাওয়ার জন্যে আমার প্রাণটা কি কম আঁইঢাই করে? পারি না, বুঝলে, একদম পারি না। জোর করে কিছু বলতে গেলেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় কিম।
ও-কি, কোথায় যাচ্ছেন? ভয় পেয়ে গেছে মুসা।
বলে আসি, অন্তত প্লেন হ্যামবার্গার যাতে দেয়, তবে বিনিময়ে তার কথা তোমাকে শুনতে হবে, মুসা।
রান্নাঘর থেকে হাসিমুখে ফিরে এলেন সাইমন। হ্যামবার্গার দেবে। আবার বসলেন চেয়ারে। নীরবে ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বললেন, তোমাদের কেসের গল্প সবটাই শুনলাম। একটা ব্যাপার পরিষ্কার হচ্ছেনা এখনও।
কী? সামনে ঝুঁকলো কিশোর।
সাইনাসকে সন্দেহ করলে কেন?
সন্দেহটা জাগিয়েছে ভারিপদ। প্রথমে করিনি, কিন্তু যতোই ভাবলাম, ততোই ধারণাটা দৃঢ় হতে লাগলো যে কেউ না কেউ তাকে মুভি স্টুডিওতে পাঠিয়েছে। কোনো কাজে। সেটা দুজন লোক হতে পারে। হ্যারিস বেকার, কিংবা রাফায়েল সাইনাস। হ্যারিস বেকারের, পাঠানোর কোনো কারণ নেই, সে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, চিঠি বা অন্য জিনিস আনা-নেয়ার জন্যে অফিসের লোকই আছে তার। বাকি থাকলেন সাইনাস। ভাবলাম, তিনিই বা কি আনতে পাঠাবেন? যতোই ভাবলাম, সন্দেহ ততোই বাড়তে লাগলো। তাছাড়া কিছুকিছু সূত্রও মিলে যেতে লাগলো তার আচরণের সঙ্গে।
হু্ বুঝেছি, মাথা ঝাঁকালেন প্রাক্তন গোয়েন্দা। তোমাকে যেমন আগে ডেকে এনেছে টিভি স্টেশনে, তেমনি ভারিপদকেও এনেছেন। তাকে একটা চিঠি দিয়ে অযথা পাঠিয়েছেন স্টুডিওর অফিসে, আর তোমাকে বলেছেন তাকে সন্দেহ করেন। লিফটে করে উঠে সাইনাসের অফিসেই ঢুকেছিলো ভারিপদ, খাম নিয়ে বেরিয়ে এসে স্টুডিওতে রওনা হলো। তুমি পিছু নিলে।
টেলিফোনের তার-টার ছিঁড়ে আগেই সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রেখে এসেছিলেন সাইনাস। তুমি গিয়ে নয় নম্বর স্টেজে ঢুকতেই তালা লাগিয়ে দিলো মড়ার খুলি। তাকে ওকাজ করতে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন পরিচালক। তোমাকে আটকাতে চেয়েছিলেন, যাতে কুইজ শো-তে অংশ নিয়ে তুমি মড়ার খুলির পুরস্কার জেতায় বাধা হয়ে না দাঁড়াও।
হুঁ, সব বুঝলাম। বড় বেশি খুঁতখুঁতে মন তোমার, কিশোর পাশা, এটা ভাবতেও পারেননি বেচারা পরিচালক। রান্নাঘরের দিক থেকে আসা পায়ের শব্দ শুনে ঝট করে সোজা হলেন সাইমন। ফিসফিসিয়ে বললেন, ওই যে, আসছে।
টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে, খর দিলো কিম।
ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসলো সবাই। তবে গন্ধ ভালোই আসছে। একটা প্লেটের ঢাকনা তুলে দেখালো কিম। ইয়া বড় বড় চারটে হ্যামবার্গার। ডেতরে গরুর মাংসের কিমা। আর পেঁয়াজের কুঁচি। লোভনীয় গন্ধ বেরোচ্ছে ওগুলো থেকে।
একটা নিয়ে কামড় বসালো মুসা।
ভালো না? জিজ্ঞেস করলো কিম।
চমৎকার। ফার্স্ট ক্লাস।
গুড। খুব খুশি হলো বাবুর্চি। বললো, এবার আমার একটা উপকার করতে হবে।
নিশ্চয়ই ক… বলেই মাঝপথে কামড় থামিয়ে কিমের দিকে তাকালো গোয়েন্দা-সহকারী। কি-ক্কি উপকার।
কিছু না, আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়লো কিম। এই একটু চেখে দেখতে হবে আরকি। একটা প্রাচীন খাবারের উল্লেখ দেখলাম একটা চীনা খাবারের বইয়ে। লোভ সামলাতে না পেরে বেঁধেই ফেললো। আর কেউ তো খেতে জানে না, খেতে বললেও রাজি হয় না। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি। দয়া করে যদি…।
তা জিনিসটা কি?
না, তেমন কিছু না। খুব ভালো খাবার বলেই মনে হয় আমার। তুমি যদি খেয়ে ভালো বলো, আমিও খাবোর হাজার হোক, প্রোটিন যখন বেশি…
অতো ভণিতা করছো কেন? দেখি, ঢাকনা তোলো।
ঢাকনা তুললো কিম। মাংস ভাজি। গন্ধটা বেশ চমৎকার।
হাসি ফুটলো মুসার মুখে। তা এর জন্যে এতে অনুরোধ? দাও দেখি, খাই। মাংসই তো, কি আর হবে খেলে?, শুয়োরটুয়োর না হলেই হলো। ওটা ভাই খেতে পারবো না, ধর্মে মানা।
না না শুয়োর না, শুয়োর না। এই নাও, প্লেটটা ঠেলে দিলো কিম।
একটুকরো মুখে দিয়ে দেখলো মুসা। চিবাতে চিবাতে মাথা নাড়লো, হুঁ, মন্দ। আরও কয়েক টকুরো খেয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তা কিসের মাংস এটা?
হাসলে কিম। প্লেটটা সরিয়ে নিলো মুসার সামনে থেকে। বললো, থাক, আর খেতে হবে না। বুঝেছি, রান্না ভালো হয়েছে।
কিসের মাংস? আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
তুমি খাবে?
না, আর দরকার নেই, হাত নাড়লো কিশোর। শুধু জিজ্ঞেস করছি, কিসের মাংস?
ইঁদুরের। একেবারে খাঁটি চীনা ইঁদুর। অনেক দেখেশুনে বেছে এনেছি, শান্তকণ্ঠে জানালো কিম।
সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল রবিনের। ওয়াক ওয়াক করতে করতে উঠে দৌড় দিলো বেসিনের দিকে।
বিকৃত হয়ে গেছে কিশোরে মুখ। রবিনের মতো বমি করতে না ছুটলেও মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না, পেট থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা খাবার চাপতে কষ্ট হচ্ছে।
পাথরের মতো মুখ করে বসে রইলেন লেখক। কিমের এসব অত্যাচার গা-সওয়া হয়ে গেছে তার।
কয়েকটা সেকেণ্ড নিথর হয়ে রইলো মুসা। তারপর হাসি ফুটলো মুখে। যাকগে, যা খাওয়ার তো খেয়েই ফেলেছি। এখন আর বলে কি হবে? এর চেয়ে কতো খারাপ জিনিস খেয়েছি। আমাজানের জঙ্গলে সাপ, প্রশান্ত মহাসাগরের মরুদ্বীপে শুঁয়াপোকা…মরুকগে। তা ভাই, কিম, দয়া করে দুই বোতল কোকাকোলা এনে দাও তো দেখি। বলে আবার অর্ধেক খাওয়া হ্যামবার্গারটা তুলে নিলো সে। আর গোটা চারেক হ্যামবার্গার। একটা খেয়ে কি হয়?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ইঁদুরের মাংসের প্লেট হাতে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো নিসান জাং কিম।
-: শেষ :-
<