মোড় নিয়ে বেভারলি হিলের গিরিখাতগুলোর দিকে এগিয়ে চললো হলুদ গাড়িটা।
ধীরগতি, সাবধানী ড্রাইভার সাইনাস। বৃদ্ধ পরিচালকের সন্দেহ না জাগিয়েও তাঁর পিছে লেগে থাকতে অসুবিধে হলো না হোফারের।
এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথ, ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে, তারপর একসময় ঢুকে গেল পাহাড়ের মধ্যে। বাড়িঘর এখন অনেক দূরে দূরে। আকারেও বড় এখন ওগুলো। বিরাট বিরাট এলাকা নিয়ে একেকটা বাড়ি, প্রাসাদের মতো, পাথরের দেয়ালে ঘেরা। ওগুলো সিনেমার লোকদের বাড়িঘর। তবে এখনকার নয়, আগের, যখন সিমেনা কোম্পানিগুলো হঠাৎ করে অনেক টাকা কামাতে শুরু করেছিলো। এই পথে যাতায়াতের জন্যে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা আছে। বাস বোঝাই হয়ে আসে টুরিস্টরা। ওসব বাড়ির সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থামে। আর বলে দেয় ড্রাইভাররা কোনটা কার বাড়ি, কোন পাথরের দেয়ালের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতো সিনেমা-দর্শকদের অতি-পরিচিত কোন প্রিয় মুখটি।
কিশোর জানে, এখন বেশির ভাগ বাড়িই আসল মালিকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন এগুলোর মালিক ব্যাংক, তেল কোম্পানি, আর আরব শেখের। সিনেমার লোকেরা সরে চলে গেছে বেভারলি হিলের ভেতরের চ্যাপ্টা অঞ্চল নামে পরিচিত এলাকায়।
গতি কমালো হোফার। মোড় নিয়ে একটা খোলা গেটের ভেতরে ঢুকছে হলুদ গাড়ি। মোড়ের কাছে এসে থেমে গেল সে।
এখন কি করবো? কিশোরের দিকে ফিরে তাকালো হোফার। ঢুকবো?
না, থ্যাংক ইউ। পেছনের দরজা খুলে রাস্তায় নামলো গোয়েন্দাপ্রধান। নিশ্চয় তাঁর বাড়িতে অনেক লোক। গার্ড, চাকর-বাকর, মালি। আমাদেরকে ঢুকতে দেখলে সর্তক হয়ে যাবে। তুমি এখানেই থাকো, আমরা যাই। নেলিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে জানার চেষ্টা করবো।
ঠিক আছে। ম্যাগাজিন বের করলো হোফার। গুড লাক। সাহায্যের দরকার পড়লে ডেকো।
ওকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে দেয়ালের ধার ঘেঁষে রওনা হলো কিশোর। সাথে চললো রবিন আর মুসা।
গেট খোলাই রয়েছে। বন্ধ করতে এলো না কোনো দারোয়ান। কাউকে চোখেও পড়লো না। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেকারের হলুদ গাড়িটা। কেমন যেন অবাস্তব লাগছে ওটা ওখানে। দক্ষিণাঞ্চলের এই পরিত্যক্ত প্রাসাদটায় আধুনিক সিত্রে বেমানান।
নীরব হয়ে আছে সব কিছু। প্রচুর পয়সা খরচ করে তৈরি হয়েছিলো এই প্রাসাদ, কিন্তু এখন মনে হয় এটাকে সংস্কারে পয়সাও আর নেই। এখানে ওখানে প্রাস্টার খসে পড়েছে, মেরামত করতে পারছে না। রঙ চটে গেছে, নুতন রঙ করা হয়নি। সিঁড়ির পাশে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সাফ করা হয়নি। আশপাশে ঝোপঝাড় বেড়ে উঠেছে বেয়াড়াভাবে।
গেটের ডান পাশ থেকে একসারি গাহ চলে গেছে বাড়িটার দিকে। ইশারায় সহকারীদেরকে কাছের গাছটা দেখালো কিশোর। গাছের গোড়ায় ঘাস এতো লম্বা হয়েছে, হমড়ি খেয়ে ওরা বসে পড়লে স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারবে। আড়ালে আড়ালে এগোতেও পারবে।
খাইছে! বিড়বিড় করলো মুসা। এখনও এখানে লোক থাকে? এ-তো ভূতের বাড়ি!
মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আগে বাড়িটা কেমন ছিলো কল্পনা করার চেষ্টা করছেঃ ছিমছাম লন, রঙিন বাগান, উজ্জ্বল রঙের বীচ-চেয়ার, নতুন সাদা রঙ করা খিলান আর অসংখ্য স্তম্ভ, ঝকঝকে জানালা কাজ।
কিন্তু কতো আর বয়েস হয়েছে বাড়িটার? চোদ্দ-পনেরো বছর হবে। ক্ষতিটা বেশি করেছে প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই কোনোরকম জানার না দিয়ে আচমকা ধেয়ে আসে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বনা, লাভার মতো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামে গলিত কাদার ঢল। তার ওপর রয়েছে প্রচণ্ড কড়া রোদ, আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের গাছপালা, বাগান আর বাড়িঘরের সাংঘাতিক ক্ষতি করে। যত্ন করতে না পারলে দ্রুত নষ্ট করে একেবারে ধ্বংস্তুপে পরিণত করে ফেলে। পাগল সংঘ যখন পরিচালনা করতেন সাইনাস, তখনও নিশ্চয় এটা ছিলো একটা জমকালো প্রাসাদ। এখন প্রায় শেষ অবস্থা।
আরেকটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলো কিশোর, দারোয়ান-বেয়ারা-মালি বহুকাল আগে বিদায় হয়ে গেছে এখান থেকে। সাইনাস নিশ্চয় একেবারে একা থাকেন এখন, আর হয়তো কাল থেকে রয়েছে নেলি।
এসো, সহকারীদের কললো সে। লুকোচুরির আর দরকার নেই। সোজা গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাইনাসকে ডাকবো। কথা বের করে নেবো তার মুখ থেকে।
একমত হলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। বৃদ্ধ সাইনাসের কাছ থেকে ভয়ের কিছু নেই।
ইলেকট্রিক কলিং বেল নিই। দরজার পাশে রাখা একটা পিতলের পুরানো আমলের ঘন্টা আর কাঠের হাতুড়ি রাখা। সেটা তুলে নিয়ে ঘন্টায় বাড়ি মারলো কিশোর। সাথে সাথে খুলে গেল দরজা। তাদের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন সাইনাস।
কিশোর পাশ তিনি বললেন, তোমরা আসবে জানতাম। পুরস্কার নিতে। কাপ-রহস্যের সমাধান করে দিলে দেবো বলেছিলাম যে। এসো, ভেতরে এসো।
ভেতরে ঢুকলো তিন গোয়েন্দা। পেছনে দরজা লাগিয়ে দিলেন সাইনাস। মস্ত একটা হলঘর, আবছা আলো। এতোবড় ঘরটায় আসবাব বলতে কিছু নেই, শুধু দুটো পুরনো ক্যানভাসে চেয়ার আর একটা নড়বড়ে ডেস্ক ছাড়া।
দেয়ালে চোখ পড়লো কিশোরের। ফ্রেমে বাঁধাই অসংখ্য ফটোগ্রাফ, সুদর্শন তরুণ আর সুন্দরী তরুণীদের। সিনেমা আর টেলিভিশনের কয়েকজন অভিনেতাকে চিনতে পারলো সে। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের বড় বড় অভিনেতা তারা।
ছবির দিকে কিশোরকে তাকিয়ে থাকতে দেখলেন সাইনাস। পিঠ সোজা করলেন। মুহূর্তে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন তিনি, একজন সফল মানুষ, ওই ছবিগুলোর মতোই। ওরা আমার পুরানো বন্ধু, বললেন তিনি। স্টুডিও আমাকে অপমান করে পাগল সংঘের মতো ছবি তৈরি করতে দেয়ার আগে, ওসব বড় বড় অভিনেতার ছবি পরিচালনা করেছি আমি। বললে বিশ্বাস করবে, এদের অনেকেই অভিনয় শিখেছে আমার কাছে? গলা চড়লো পরিচালকের, গমগম করে উঠলো হল জুড়ে, শিখিয়েছি কি করে কি করতে হয়। নরম কাদার মতো আঁচে ফেলে ওদের গড়েছি আমি। সৃষ্টি করেছি।
কেঁপে উঠলো রবিন। জানালার কাঁচ ভাঙা, সেগুলো দিয়ে বাতাস আসছে বটে, তবে কেঁপে ওঠার মতো শীত নয় ঘরে। তবু কেমন যেন গা ছমছমে একটা পরিবেশ, অনেকটা পুরনো, ভাঙা কবরখানার মতো, যেন অতীতের মানুষের ভূত হয়ে উঠে এসে ঘোরাফেরা করহে চারপাশে।
হ্যাঁ, আসল কথা বলি, সাইনাস বললেন, পুরস্কার। আমার কাছে নগদ টাকা নেই এখন, তবে বিজ্ঞাপন বিভাগ…।
বাধা দিয়ে কিশোর বললো, পুরস্কারের জন্যে আসিনি আমরা। গোয়েন্দাপ্রধানেরও যে অস্বস্তি লাগছে তারই মতো এটা বুঝতে পারলো রবিন কণ্ঠস্বর
নেই। নেলিকে নিয়ে যেতে এসেছি।
নেলি? মানে বটিসুন্দরী? মলিন জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকালেন সাইনাস। এখানে আছে কে বলে তোমাকে?
কাল রাতে হলিউড বুলভার থেকে তাকে তুলে নিতে দেখেছি আপনাকে, মুসা বললো। মড়ার খুলি আর নেলি আপনার গাড়িতে উঠছে…।
অসম্ভব, হাসার চেষ্টা করলেন পরিচালক। এখন কোনো গাড়িই নেই আমার। রোলস রয়েসটা গ্যারেজে। আর আমার…।
বাইরের গাড়িটা আমার বিশ্বাস, কিশোর বললো, হ্যারিস বেকারের। কিংবা বিজ্ঞাপন বিভাগের। কুইজ শো পরিচালনার সময়টাতে আপনাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে। খানিক আগে আপনাকে চালিয়ে আনতে দেখলাম। কাল রাতে নেলি আর মড়ার খুলিকেও তুলে নিতে দেখেছি।
প্রতিবাদ তো করলেনই না, এবার আর হাসারও চেষ্টা করলেন না সাইনাস। ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে বসে পড়লেন একটা ক্যানভাসের চেয়ারে। বেরিয়ে এলো ক্ষোভ, একটা লিমুজিন পর্যন্ত ওরা ভাড়া করে দেয়নি আমাকে। কুইজ শো পরিচালনার জন্যে যতোটা কম টাকা দেয়া সম্ভব, দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছে ওরা। প্রায় ভিখিরির মতো হাত পেতে বেকারের কাছ থেকে গাড়িটা চেয়ে নিয়েছি কদিন ব্যবহারের জন্যে। কিংবা বলা যায় হুমকি দিয়ে নিয়েছি। যদি গাড়ি না দেয়, তাহলে কুইজ শো পরিচালনা করবো না বলে। পাগল সংঘের পরিচালককে বাদ দিয়ে… থেমে গেলেন আচমকা। হাঁটুর দিকে চোখ। সুতো-ওঠা প্যান্টের একটা সুতো টানছেন আনমনে। নেলিকে আমি কিডন্যাপ করিনি। তুমি ভুল করছে।
প্লীজ, মিস্টার সাইনাস, নরম গলায় অনুরোধ করলো কিশোর, যদি কিছু জানা থাকে আপনার, বলুন। আমরা জানি, নেলি ওই চিঠি বেকারকে লেখেনি। নিজের ইচ্ছেয় কুইজ শোতে অনুপস্থিত থাকেনি। এখন তাকে না পেলে পুলিশের কাছে যেতেই হবে আমাদের। পুলিশ এসে সারা বাড়ি খুঁজবে।
নেলি এখানে অবশ্যই আছে, মাথা তুললেন পরিচালক। আবার সেই আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর ফিরে এসেছে। আমার মেহমান হয়ে এখানে আছে সে। ওকে আমি বড় অভিনেত্রী বানাবো। ধনী, বিখ্যাত বানিয়ে ছাড়বে। উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের হবিগুলোর দিকে হাত তুললেন তিনি। এই মানুষগুলোর মতো, যারা ওদের সবকিছুর জন্যে আমার কাছে ঋণী। সিনেমায় অভিনয় করিয়ে নেলিকে আমি…
চুপ করো বুড়ো ভাম। বেকুব কোথাকার।
দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো কঠিন কষ্ঠ। ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা। সোনালি চুলওয়ালা, চামড়ার জ্যাকেট রা তরুণ ঢুকে পড়েছে ভেতরে।
<