টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বিল্ডিঙের একটা বড় অফিসে জমায়েত হয়েছে অনেকে। নকল মড়ার খুলি, হ্যারিস বেকার, রাফায়েল সাইনাস, তিন গোয়েন্দা, শিকারী কুকুর, ভারিপদ, আর টেলিভিশন কোম্পানির একজন সিকিউরিটি গার্ড।

ডেস্কের ওপাশে বসেছে বেকার। তার সামনে রাখা কিশোরের তোলা ছবিটা। মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছে নকল মড়ার খুলি। আরও কতগুলো চেয়ার নিয়ে তার পেছনে গোল হয়ে ঘিরে বসেছে অন্যান্যরা।

ও-কে, পরাজিত ভঙ্গিতে অবশেষে বললো মড়ার খুলি, স্বীকার করছি, আমি আসল মড়ার খুলি নই। আরও স্বীকার করছি আমি একটা গাধা। গর্দভ না হলে মোটুরামকে আমার ছবি তোলার সুযোগ দিই? কিশোরের দিকে তাকালো সে। তোমাকে আগেই বলেছি, তুমি যে বেশি নও সেটা আমি বুঝেছি, যতোই বোকার অভিনয় করো না কেন। তবে যতোটা চাক মনে করে, তার চেয়ে যে অনেক বেশি, এটা বুঝতে পারিনি। চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিরাশার ভঙ্গি করলো সে। হাত ওল্টালো। চেষ্টা করে দেখলাম, পারিনি। বিশ হাজার ডলার, কম কথা নয়। তবে প্রায় সেরে ফেলেছিলাম।

পকেট থেকে চেকটা বের করে দেখলো মড়ার খুলি। জ্বলে উঠলো একবার চোখের তারা। তারপর দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারলো বেকারের দিকে।

কাপটাও ফেরত দাও, হাত বাড়ালেন সাইনাস। কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে আবার।

পকেট থেকে কাপটা বের করে আহাড় দিয়ে রাখলো টেবিলে।

এখন বলো তুমি কে? মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলো সিকিউরিটি গার্ড। তোমার আসল নাম কি?

সেটা জেনে কি লাভ? আবার কাঁধ ঝাঁকালো মড়ার খুলি। আমার নাম দিয়ে কার কি এসে যায়? এ-শহরে আরও হাজারটা অভিনেতার মতোই আমিও একজন, অভিনয় জেনেও যারা সুযোগ পায় না। যদিও অভিনয় ভালোই জানি আমি।

মনে মনে তার সাথে একমত না হয়ে পারলো না গোয়েন্দাপ্রধান। আসল মড়ার খুলির চেয়ে এ অনেক ভালো অভিনেতা।

দল পাকানো চেকটা চেপেচুপে সোজা করে পকেটে ভরে রাখলো বেকার। জিজ্ঞেস করলো, কে তোমাকে একাজ করতে বলেছে?

কেউ না। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে আবার নকল মড়ার খুলির গলায়। আমাকে কেউ একাজ করতে বলেনি। টেলিভিশনে পাগল সংঘের ছবিগুলো দেখেছি। কাগজে পাগলদের সম্পর্কে পড়েছি। ইস্কুলে কিছুদিন আসল মড়ার খুলির সঙ্গে পড়েছিলাম। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল সে, বোধহয় সহপাঠীদের টিটকারির জ্বালায়ই অনেক বছর হলো তার আর কোন খবর নেই। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, মারা গেছে সে। একেবারে বোকা ছিলো তো। গরুর গাড়ির চাকার নিচে পড়ে মরলেও অবাক হবো না।

ওর চেহারার সঙ্গে কিছু কিছু মিল আছে আমার। কান বাদে। ছবি দেখতে দেখতে একটা মতলব এলো মাথায়। নিজেকে মড়ার খুলি বলে চালিয়ে দর্শকদের কাছ থেকে বাবা আদায় করবো। প্রথমে ভেবেছিলাম পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবো। তৈরিও করে ফেলেছিলাম, এই সময় খবর শুনলাম নেটওয়ার্ক একটা কুইজ শোর বন্দোবস্ত করেছে। লুফে নিলাম সুযোগটা। কেন নেবো না? বিশ হাজার ডলার কম কথা?

সবাই নীরব। বেকার হাসছে, তবে প্রাণ নেই হাসিটায়, কেমন যেন দ্বিধায় ভরা।

এখন আমাকে নিয়ে কি করতে চান? জিজ্ঞেস করলো নকল মড়ার খুলি।

পুলিশের হাতে তুলে দেবো, সিকিউরিটি কললো। জালিয়াতির অভিযোগে…

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো বেকার। ওই কাজও করতে যেও না। নেটওয়ার্ক কিংবা মুভি স্টুডিও, কারোই সুনাম হবে না এতে। কল্পনা করতে পারো, খবরের কাগজওয়ালারা শুনতে পেলে কি তুমুল কাণ্ড শুরু করে দেবে? সিকিউরিটিকে একটা উজ্জ্বল হাসি উপহার দিলো সে। আসলে আমাদের এখনও কোনো ক্ষতি তো হয়নি। বিশ হাজার ডলারের চেকটা স্যান ফ্রান্সিকোয় নেলির কাছে পাঠিয়ে দেবো। খুশি হবে। আর একে…।

নকল মড়ার খুলির দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। পুরো ব্যাপারটাকেই একটা রসিকতা মনে করি না কেন আমরা? সাইনাসের দিকে তাকালো বেকার। রাফায়েল, তুমি কি বলো?

ক্লান্ত চোখ নামিয়ে নিলেন বৃদ্ধ পরিচালক। সাদা, পাতলা চুলে আঙুল চালালেন। তা তো হতেই পারে। আমার আপত্তি নেই।

উঠে দাঁড়ালো কিশোর। তার ইশারায় রবিন আর মুসাও উঠলো।

আমরা কাগজওয়ালাদের কিছু বলবো না, কথা দিলো কিশোর। মীটিং শেষ হয়ে আসছে বঝেই যেন তাড়াতাডি, সবার আগে বেরিয়ে যেতে চায়, বাইরের কার পার্কে যেখানে লিমুজিন নিয়ে অপেক্ষা করছে হোফার। তাহলে, যদি অনুমতি দেন, মিস্টার বেকার, আমরা এখন যাই।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, উঠে দাঁড়ালো বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। তোমাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম, কিশোর পাশা। হাসিটা ঠিকই রয়েছে মুখে, তবে কণ্ঠস্বরে কৃতজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই। বুদ্ধিমান ছেলে তুমি, দারুণ গোয়েন্দা। তোমার সাহায্য না পেলে একটা সাংঘাতিক ভুল হয়ে যেতো। ঠকানো হতো নেলিকে।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দুই সহাকারীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো কিশোর। পেছনে দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার আগে চট করে ফিরে তাকালো একবার। চেয়ারে হেলান দিয়ে স্তস্তির হাসি হাসছে বেকার, হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মড়ার খুলির মুখেও। চোখ নামিয়ে রেখেছেন সাইনাস, কোটে লেগে থাকা ময়লা নখ দিয়ে খুঁটে পরিষ্কারের চেষ্টা করছেন। ভুরু কুঁচকে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সিকিউরিটি ম্যান।

লিফট লোকে বোঝাই। নীরবে নেমে এলো তিন গোয়েন্দা। লবি থেকে বেরোনোর আগে কথা বলার সুযোগ পেলো না রবিন আর মুসা।

ওদেরকে এভাবে ছেড়ে দিলে? রাগ করে বললো মুসা। সে বিশ্বাস করতে পারছে। কোনো কেসে কিশোর কোনো অপরাধীকে ছেড়ে দেয়নি। অথচ আজ তা-ই করে এলো! মুসার ধারণা, হ্যারিস বেকার প্রথম থেকেই জানতো যে মড়ার খুলি নকল। সে জন্যেই লোকটা ধরা পড়ার পরও তাকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে।

হ্যাঁ, মুসার সঙ্গে সুর মেলালো রবিন, সে-ও রেগেছে, কেন ছাড়লে? আর নেলির ব্যাপারটাই বা কি? তুমিই আমাদেরকে কললে, সে স্যান ফ্রান্সিসকোয় যায়নি। কললে, ও বিপদের মধ্যে রয়েছে।

হ্যাঁ,রবিনের কথার পিঠে বললো মুসা। রেগেছে তো বটেই, অবাকও মনে হচ্ছে এখন তাকে। কি ভাবছো তুমি, কিশোর?

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ফিরে তাকালো গোয়েন্দাপ্রধান। আমি ভাবছি নেলির কথা। আজ সকালে আমাকে হুমকি দিয়ে ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই ভাবছি। ফোন পাওয়ার কথা আগেই দুই সহকারীকে বলেছে সে। ওর জন্যেই সমস্ত প্রশ্নের ভুল জবাব দিয়েছি আমি। যাতে নেলি জিততে পারে। এখনও ডাবছি তার কথাই। রবিনের দিকে তাকালো সে। ও বিপদেই রয়েছে। তাকে বাঁচাতে হবে আমাদের। এসো।

আর একটিও কথা না বলে তাড়াতাড়ি চত্বর পেরিয়ে এলো কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে এলো রবিন আর মুসা।

গাড়িতে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলো হোফার। কিশোর পেছনের দরজায় হাত দিতেই ফিরে তাকালো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যেতে হবে?

কোথাও না। গাড়ির পেছনের সীটে উঠে বসলো কিশোর। রবিন আর মুসাও উঠলো। জানালা দিয়ে হ্যারিস বেকারের হলুদ সিত্রো গাড়িটার দিকে তাকালো সে। আরেকটু বোধহয় পিছানো দরকার। তাহলে ওদের চোখে না পড়েও গাড়িটার ওপর চোখ রাখতে পারবো।

নিশ্চয়ই, জবাব দিলো হোফার।

এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে কার পার্কের পেছন দিকে গাড়ি পিছিয়ে আনলো সে। ওরা এখানে আছে একথা জানা না থাকলে সহজে কারো চোখে পড়বে না লিমুজিনটা এখন, অন্তত হলুদ গাড়িটার কাছ থেকে। অথচ ওরা এখান থেকে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে গাড়িটার তিমির মুখের মতো নাক।

হ্যারিস বেকারের পিছু নেবো নাকি? জিজ্ঞেস করলো হোফার।

তাকে নিরাশ করলো না কিশোর, আনমনে মাথা ঝাঁকালো। সীটে হেলান দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। রবিন বুঝতে পারছে, এখন ওভাবেই কিছুক্ষণ নীরব আর রহস্যময় হয়ে থাকতে চায় গোয়েন্দাপ্রধান, চায় না তাকে বিরক্ত করা হোক।

কিন্তু তাকে ওভাবে থাকতে দিলো না রবিন। বললো, এই, চুপ করে আছে কেন? ভেবেছো পার পেয়ে যাবে। তা হতে দিচ্ছি না। অফিসে ওরকম করলে কেন, জলদি বলো।

হ্যাঁ, রবিনের পক্ষ নিলো মুসা, জলদি বলো। কেন করলে?

বেশ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো কিশোর। এক আঙুল তুললো, এক নম্বর, বেশ জোরেই বললো, যাতে হোফারও শুনতে পায়, নেলিকে শেষ কখন দেখেছি আমরা?

কাল রাতে, হলিউড বুলভারে, জবাব দিলো রনি। ওকে তুলে নিয়েছিলো বেকার।

সাথে ছিলো মড়ার খুলি, যোগ করলো কিশোর। তারপর আজ সকালে সে আমাকে ফোন করলো কিশোর। হ্যারিস বেকারের গলা নকল করে আমাকে শাসালো, যদি আমি ফাস্ট হই তাহলে নেলি দুর্ঘটনায় পতিত হবে। এ থেকে কি বোঝা যায়?

সে কোথাও আটকে রেখেছে নেলিকে, বললো রকিন। বন্দি করেছে। তবে সেটা নিশ্চয় তার ম্যাগনোলিয়া আর্মসের বাসায় নয়। এখানে অনেক লোকের বাস। চেঁচামেচি করে বা অন্য কোনোভাবে লোকের দৃষ্টি আর্কষণ করে ফেলবে তাহলে নেলি।

ঠিক, কিশোর বললো।

কিন্তু এখন তো কুইজ শো জিতেছে, মুসা বললো, আর জালিয়াত বলে চিহ্নিত হয়ে গেছে মড়ার খুলি, এখন আর নেলির কি বিপদ? ছেড়ে দেবেনা?।

না। কেন বাড়বে না বুঝিয়ে দিলো গোয়েন্দাপ্রধান, ওই অফিসে যা-ই বলে থাকুক, একা কাজ করছে না মড়ার খুলি। কেউ তাকে ধরে এনেছে ওই রোলে অভিনয় করার জন্যে। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। পাগলদের ব্যাপারে সব মুখস্থ করিয়েছে। যেমন, তাকে বলা হয়েছে, অভিনয়ের সম্মানী হিসেবে শুক্রবারে নগদ টাকা দেয়া হতো আমাদেরকে। বাদামী খামে ভরে, লাল সুতোয় বেঁধে। তাকে বলে না দিলে ওরকম তথ্য হাজার চেষ্টা করেও নকল মড়ার খুলির জানার কথা নয়। তার জানার কথা নয় যে, জনাব গণ্ডগোলের গাড়িটা ছিলো একটা পিয়ার্স-অ্যারে কনভার্টিবল, টোয়েন্টি নাইন মডেলের। এসব কথা নিশ্চয় বলে দেয়া হয়েছে তাকে।

তারমানে তার সহযোগী আছে, বুঝতে পারলো রকিন।

আছে। আর সেই সহযোগীই নেলিকে কিডন্যাপ করতে তাকে সাহায্য করেছে। এখন ওকে কিছুতেই ছাড়বে না ওরা। কারণ নেলি জানে সেই সহযোগী লোকটি কে। জালিয়াতির চেয়ে কিডন্যাপিং অনেক বড় অপরাধ। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যাবে।

হ্যারিস বেকার। মড়ার খুলিকে সে-ই হেড়ে দিয়েছে। শুরু থেকে সব শয়তানী সে-ই করে আসছে।

কিশোর, তাই? মুসা জিজ্ঞেস করলো। বেকারের বাড়িতে আটকে রাখেনি তো নেলিকে?

জবাব দিলো না কিশোর। চোখ তার হলুদ গাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়া লোকটার দিকে। গাড়িতে উঠে বসলো সে। এঞ্জিন স্টার্ট দিলো। তারপর বেরিয়ে যেতে লাগলো পার্ক থেকে।

না, মুসার প্রশ্নের জবাবে বললো কিশোর, হ্যারিস বেকার নয়। সে বিজ্ঞাপনের লোক। কিসে কিসে স্টুডিওর ক্ষতি হবে ভালো করেই জানে। সে স্টুডিও আর নেটওয়ার্ককেই বাঁচাতে চেয়েছে। সে জানতো না যে মড়ার খুলি নকল। এমন এক লোক মড়ার ধূলির ওস্তাদী করেছে, ছব্বি প্রতিটি ইঞ্চি যার জানা। কোথায় কি আছে না আহে মুখস্থ। সেই লোকই নেলিকে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করেছে মড়ার খুলিকে। এবং সেই লোকই এখন ওই হলুদ গাড়িটা চালাচ্ছে।

কে? দেখার জন্যে রবিন আর মুসাও সামনে ঝুঁকে পড়লো।

হোফার পিছু নিয়েছে। হলিউড বুলভারের কাছে মোড় নেয়ার সময় ক্ষণিকের জন্যে হলুদ গাড়ির গতি শ্লথ হলো। সেই সুযোগে ওটার একেবাবে কাছে চলে গেল মিজিন।

ধীরে সুস্থে বোমাটা ফাটালো গোয়েন্দাপ্রধান, রাফায়েল সাইনাস।

<

Super User