পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো কিশোর। রান্নাঘরে এসে নিজেই ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে নিয়ে নাস্তা সেরে চলে এলো তার ওয়ার্কশপে।
দিনটা মেঘলা। জোরে জোরে বাতাস বইছে। কাজ করার আগে একটা তারপুলিন দিয়ে ঘিরে নিতে হলো ওয়ার্কবেঞ্চের চারপাশ। নতুন জিনিসটা দিয়ে আপাতত কোনো কাজ হবে কিনা জানে না, তবু শুরু যখন করেছে শেষ করে ফেলা দরকার, এই ইচ্ছেতেই বসেছে। ক্যামেরাটার নাম দেবে সে গোয়েন্দা ক্যামেরা। সংক্ষেপে গা্যো। কাজ প্রাতে বসলো আরও একটা কারণে, এরকম কাজের সময় তার মাথা খোলে ভালো, চিন্তাশক্তি বাড়ে।
হাত জোড়া দিচ্ছে একের পর এক খুদে যন্ত্রপাতি, আর মগজ জোড়া দিচ্ছে রূপালি-কাপ-চুরি রহস্যের ছেঁড়া সূত্রগুলো।
বেশ কিছু সূত্র জোড়া দেয়া যাচ্ছে না। ভারিপদর কথাই ধরা যাক। টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বিল্ডিঙে ঢুকেই কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো? নির্দিষ্ট সময়ের দুই ঘন্টা আগে এলো। লিফট করে উঠে গেল, কিন্তু সতেরো তলায় নয়। পাঁচ মিনিট পর নেমে এলে আবার লবিতে।
ওই পাঁচ মিনিট কিকরেছে সে? কারও অফিসে দেখা করেছে?
কার সঙ্গে?
আর হ্যারিস বেকারের ব্যাপারটাই বা কি? রাতের বেলা হলিউড বুলভারের মোড় থেকে নেলি আর মড়ার খুলিকে তুলে নেয়ার তার কি দরকার পড়লো?
দুজনকে হোটেলে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে গেল? মনে হয় না। মড়ার খুলির সঙ্গে হ্যারিসের যা সম্পর্ক দেখা গেছে, তাতে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। আর নিলোই যদি, সরাসরি ম্যাগনোলিয়া আর্মস থেকে ওদেরকে তুলে নিলো না কেন ব্যারিস?
হলিউড বুলভারের ঘটনাটা একটা স্পাই হরি কথা মনে করিয়ে দিলো কিশোরের। ঠিক এরকম ঘটনাই ঘটেছিলো ছবিটাতে। দুজন সন্দেহভাজনকে অনুসরণ করে চলেছিলো দুজন শাই, তারপর হঠাৎ করে একটা গাড়ি এসে সামনের দুজনকে তুলে নিয়ে গেল, যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই ক্যামেরাটা বানিয়ে ফেললো কিশোর। পকেট চিরুনির চেয়ে বেশি মোটা হবে না জিনিসটা। জ্যাকেটের ভাঁজের মধ্যেই জায়গা হয়ে গেল। লোকের চোখে পড়ার মতো ফুলেও থাকলো না। সামান্য একটু ঠেলে চোখটা বোতামের ফুটোর কাছে নিয়ে এলো সে। ঠিক এই সময় জ্বলে উঠলো মাথার ওপরের লাল আলো।
তিরিশ সেকেন্দ্রে মধ্যেই ট্রেলারে ঢুকে রিসিভার তুলে নিলো সে। কিশোর পাশা বলছি।
হালো! যাক, বাড়িতেই আছো, টেলিফোনেও গলার খুশি খুশি ভাবটা বোঝা যায়।
মিস্টার বেকার?
ধরে নাও আমি একজন বন্ধু, কললো হাসি হাসি কণ্ঠ। নেলির বন্ধু। সে কোনো দুর্ঘটনায় পড়ুক, এটা চাই না। তুমি চাও?
নিশ্চয়ই না। কিন্তু নেলি দুর্ঘটনায় পড়বে কেন? কোথায় আছে?
সেটা জানার দরকার নেই তোমার, মোটুরাম, হাসি বাড়লো কণ্ঠটার। আপাতত নিরাপদেই আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না, সেকথাই বলতে চাইছি তোমাকে। এক মুহূর্ত নীরবতা। যদি তুমি আজ ফাস্ট হও, মোটুরাম, নেলি মারা যাবে। মরবে হাসপাতালে গিয়ে, অনেক কষ্ট পেয়ে।
শুনুন…, কথা শেষ করতে পারলো না কিশোর। লাইন কেটে গেল ওপাশ থেকে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে ডেস্কের পাশে এসে বসলো কিশোর। গতদিন পাগলদের বাসার যে লিস্টটা তাকে দিয়েছিলো হোফার, সেটা এখনও পকেটেই রয়েছে। বের করলো। রিসিভার তুলে নিয়ে সাম্ভা মনিকায় নেলির হোটেলের নম্বরে ফোন করলে।
সাড়া দিয়ে নেলির ঘরে লাইন দিলো ক্লার্ক। মিনিটখানেক পরে জানালো, ঘরে নেই।
হোটেল ছেড়ে চলে যায়নি তো?
না, খাতায়-কলমে চলে যায়নি। কিশোর বলার পর সম্রাটা ঢুকলো ক্লার্কের মাথায়। সারা সকাল ধরে নেলিকে দেখেনি। বাক্সেই রয়েছে তার ঘরের চাবি।
লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিভার রেখে দিলো কিশোর। কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে বসে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো সে। তারপর আনমনে মাথা নাড়লো কয়েকবার। মৃদুস্বরে নিজেকেই বোঝালো, হারিস বেকার ফোন করেনি।
একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত, বেকার তাকে মোটুরাম বলে ডাকবে না। ওই লোকটা এ-পর্যন্ত এনামে তাকে একবারও ডাকেনি। শুধু কিশোর বলে। তাহলে বেকার যদি না-ই হয়ে থাকে, তাহলে এমন কেউ, যে খুব ভালো অভিনেতা, কণ্ঠস্বর নকলে ওস্তাদ।
কে? মড়ার খুলি? কিন্তু মড়ার খুলি তো পাগলদের মধ্যে সব চেয়ে বাজে অভিনেতা ছিলো। কান নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই পারতো না। অনেক সময় সংলাপ ভূলে বসে থাকতো। কথার সঙ্গে মুখ-হাত নাড়ানোরও মিল থাকতো না।
জঞ্জালের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে ঝড়ো হাওয়া, তীক্ষ্ণ শিস কাটতে কাটতে যেন মাথা কুটে মরছে ট্রেলারের ভেতরে ঢোকার জন্যে।
মড়ার খুলির একটা স্পোর্টসকার আছে, কথাটা মনে পড়তেই একটা বুদ্ধি এলো কিশোরের মাথায়। আবার রিসিভার তুলে হোফারকে ফোন করলো। মুসা আর রবিনকে
ওদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যতো তাড়াতাড়ি পারে ইয়ার্ডে চলে আসতে বললো।
রিসিভার রেখে দিয়ে আরও কয়েক মিনিট ডেস্কের কাছে বসে রইলো সে। প্ল্যান করছে মনে মনে। গোয়েন্দা ক্যামেরাটা এতো তাড়াতাড়িই কাজে লেগে যাবে ভাবেনি।
ট্রেলারের ভেতরেই একটা ছোট ডার্করুম আছে। সেখানে এসে ঢুকলো কিশোর। সাধারণ ক্যামেরার গোল ফিল্ম ভরা যাবে না তার ক্যামেরাটাতে। কারণ জিনিসটা চ্যাপ্টা। কাজেই ফিল্ম থেকে কেটে মাত্র একটা ছবি তোলা যায় এরকম একটা টুকরো ভরা যাবে। একবার তোলার পর আবার তুলতে হলে আবার ফি কেটে অতে হবে।
তবে তার অনুমান যদি ঠিক হয়, আর টাইমিং ঠিক থাকে, তাহলে একবারই যথেষ্ট।
ফিল্ম ভরে ক্যামেরাটা আবার জ্যাকেটের ভঁজে ভরলো কিশোর। বোতামের ফুটো দিয়ে বের করে দিলো ক্যারোর চোখ। ভালো করে না তাকালে চোখে পড়ে না। আর তাকালেও ছোট গোল লেসটাকে দেখে আরেকটা বোতাম বলেই ভুল হবে। শুধু জ্যাকেটের অন্যান্য বোতামের সঙ্গে এটার রঙ মেলে না, এই যা।
গেটে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তাকে। পৌঁছে গেছে রবিন আর মুসা।
ব্যাপার কি? সে লিমুজিনের পেছনের সীটে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো রবিন। কিন্তু পেলে?
হ্যাঁ। আর কিছু বললো না, শুধু হোফারকে লা পামা স্ট্রীটে যেতে বললো।
ম্যাগনোলিয়া আর্মরে কাছে এনে গাড়ি রাখলো হোফার।
তুমি যাও, মুসা, কিশোর কললো।
আবার। তা কোথায় যেতে হবে?
হাসলো কিশোর। মরতে নয় অবশ্যই। চট করে কার পার্কে গিয়ে শুধু দেখে এসো মড়ার খুরি স্পোর্টসকারটা আছে কিনা।
তিন মিনিটেই ফিরে এলো মুসা। জানালো, হ্যাঁ, আছে, লাল রঙের। ছোট।
সীটে বসেই একপাশে কাত হলো কিশোর। হাত তোলা, না নামানো?
নামানো। ক্যানভাসের হাত।
শুড, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। দোয়া করি যেন নামানোই থাকে।
ঘড়ি দেখলো সে। সাড়ে বারোটা বাজেনি এখনও। কতোক্ষণ বসে থাকতে হয় কে জানে। কখন বেরোবে মড়ার খুলি, টেলিভিশন স্টেশনের দিকে রওনা হবে, ঠিক নেই। একেবারে অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার পথের কাছে প্রায় গেট আগলে রয়েছে লিমুজিন। বেরোতে গেলে কালো গাড়িটা মড়ার খুলির চোখে পড়বেই।
দশ মিটার দুরে একটা গলি এসে পড়েছে লা পাম স্ট্রীটে।
ওই মোড়টায় নিয়ে রাখতে পারবে? হোফারকে অনুরোধ করলো কিশোর। পামার দিকে মুখ করে? তাহলে বেরিয়ে যেদিকেই যাক সে, তার পিছু নিতে পারবো আমরা সহজে।
আঁ, ঠিকই বলেছে।
গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল হোফার, তারপর পিছিয়ে এনে মোড়ের কাছে ঘাপটি মেরে মেরে বসে রইল লা পামার দিকে মুখ করে।
ক্যামেরাটা ঠিকঠাক আছে কিনা, দেখলো আরেকবার কিশোর।
একটা বাজলে পরে দেখা গেল মড়ার খুলি বেরোচ্ছে। বেরিয়ে কার পার্কের দিকে এগোলো। স্টার্ট দিলে হোফার। মড়ার খুলি লাল গাড়িটা লা পামায় বেরিয়ে ডানে মোড় নিয়ে হলিউড বুলভারের দিকে এগোনোর আগেই চলতে কালো লিমুজিন।
বুলভারে পড়ে আবার ডানে ঘুরলো স্পোর্টসকার। তারমানে টিভি স্টেশনেই চলেছে মর খুলি।
পেছনে চলে যাও, কিশোর বললো হোফারকে। তারপর যেই আমি বলবো যাও, অমনি জোরে ছুটে চলে আসবে তার পাশে। ওর যতো কাছাকাছি সম্ভব নিয়ে যাবে আমাকে।
পেছনের সীটে ডানপাশে বসেছে কিশোর। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে জানালার ভেতর দিয়ে, স্পোর্টসকার চালাচ্ছে মড়ার খুলি। লম্বা সোনালি চুল উড়ছে বাতাসে। সামনে ঝুঁকলো কিশোর। মাত্র একবার সুযোগ পাবে ক্যামেরা ব্যবহারের, আর একবারেই ছবিতে তুলে নিতে হবে। মিস করা চলবে না।
এবার আর লাল আলো বাধা দিলো না লিমুজিনকে। সবুজ আলো দেখে বেরিয়ে এলো দুটো গাড়িই। গতি বাড়াচ্ছে মড়ার খুলি। বাতাসে পেছনে প্রায় কাড়া হয়ে গেছে এফ তার চুল, ঝুলে ঝুলে গিয়ে বাড়ি মারছে কাধে। গাল, গলা, মাথার পেছনটা দেখা যায় এখন।
দেখতে দেখতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো কিশোর। কললো, যাও!
লাফ দিয়ে গতি বেড়ে গেল লিমুজিনের। চোখের পলকে চলে এলো স্পোর্টসকারের পাশাপাশি। সীটের পাশে হেলে পড়ে ফিরে তাকালো কিশোর। জানালার কাঁচে চেপে ধরলো জ্যাকেটের ভাঁজে লুকানো ক্যামেরার চোখ।
এখন ফিরে গাড়িটার দিকে মড়ার খুলি তাকালেই কিশোরের আশা শেষ। নষ্ট হয়ে যাবে ওর পরিকল্পনা।
এখনও সামনে তাকিয়ে রয়েছে মড়ার খুলি। ক্যামেরার বোতাম টিপে দিলো কিশোর। এই সময় লিমুজিনের দিকে ফিরলো মড়ার খুলি। ফিরুক। আর অসুবিধে নেই। কাজ যা করার করে ফেলেছে গোক্যা। মড়ার খুলি বুঝতে পারেনি যে তার ছবি তোলা হয়েছে।
হয়েছে, এবার পিছাতে পারো, হোফারকে কললো কিশোর।
লিমুজিনটা যখন পিছাচ্ছে, জ্যাকেটের ভাজ থেকে ক্যামেরাটা বের করে রবিনের হাতে দিলো সে। আমাকে টিভি স্টেশনে নামিয়ে দিয়েই হেডকোয়ার্টারে চলে যাবে তোমরা। ছবিটা ডেভলপ করে বড় করবে। কুইজ শো দেখতে পারবে না তোমরা। কিন্তু রেকর্ডিং শেষ হতে হতে বড় একটা ছবি চাই আমার। ছবিটা নিয়ে স্টেজে চলে আসবে, শো শেষ হওয়ার পর পরই যেন ঢুকতে পারো।
আচ্ছা, ক্যামেরাটা পকেটে ভরে রাখলো রবিন। কিন্তু ব্যাপারটা কি, কিশোর? মড়ায় খুলির ছবি নিলে কেন?
হেসে বললো কিশোর, ঝড়ো দিনে খোলা গাড়িতে তার একটা প্রোফাইল নিলাম। নিশ্চয় কারণটা বুঝতে পেরেছে?
না, স্বীকার করলো রনি, পারিনি।
আমি কিছুই বুঝিনি, মুসা ফললো।
একপাশ থেকে ছবি তুললাম, তার কারণ তার লম্বা সোনালি চুলগুলো দেখতে চাই, বুঝিয়ে দিলো কিশোর। একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ্য করেছে, সব সময় আঁচড়ে ওগুলো সমান করে নামিয়ে রাখে সে। তবে আজকের ঝড়ো বাতাসকে ধন্যবাদ, ওর লুকিয়ে রাখা একটা অঙ্গের ছবি তুলতে পারলাম। এবার নিশ্চয় বুঝেছো?
না, জবাব দিলো রবিন।
কোন্ অঙ্গের কথা বলছো তুমি? মুসা জিজ্ঞেস করলো।
ওর কান, বলে দিলে কিশোর। ওর বিখ্যাত কান, যে দুটো নড়াতে পারে।
<