যাদেরকে সন্দেহ করি, কিশোর কললো। এক নম্বর, একটা আঙুল তুললো সে, ভারিপদ।
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। টেলিভিশন স্টেশন থেকে ফিরে সোজা এসে ঢুকেছে এখানে।
ভারিপদ,আবার বললো কিশোর, তার সম্পর্কে কি কি জানি আমরা?
জবাব পেলো না সে। আশাও করেনি পাবে। আসলে মনে মনে না ভেবে জোরে জোরে ভাবছে। ধরে নিতে পারি কাপগুলো সে চুরি করেছিলো। চুরি অবশ্য অন্যেরাও করে থাকতে পারে। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। কিচেন সেটের কাছে অনেক লোক ছিলো, ওয়েইটার, ইলেকট্রিশিয়ান, ক্যামেরাম্যান। যে কেউই রান্নাঘরের পেছন দিয়ে ঘুরে গিয়ে কাপগুলো সরিয়ে থাকতে পারে। দুই-তিন মিনিটের জন্যে আমাদের কেউ ওখান থেকে সরে থাকলেও কারো নজরে পড়ার কথা ছিলো না।
মড়ার খুলি, সামনে ঝুঁকলো রকিং চেয়ারে বসা মুসা। ওই ব্যাটাকেই আমার সন্দেহ।
হাত তুললো কিশোর, বুঝিয়ে দিলো, রাখো, আগে আমার কথা শেষ করি। ভারিপদকে নিয়ে আলোচনা শেষ করি, তারপর অন্যদের কথা। রাফায়েল সাহ সন্দেহ আরিপদকে। রাতের বেলা ওকে নয় নম্বর স্টেজের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখেছেন তিনি। তার ধারণা, চোরাই কাপগুলো বের করে নিতে এসেছিল ভারিপদ। তাঁর দেখে সরে পড়েছে। তাঁর অনুমান ছিলো, আবার গিয়ে ওখানে হানা দেবে সে। হয়তো ঠিকই আন্দাজ করেছেন। আজ সকালে, এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে মোটর সাইকেলে করে স্টুডিওর দিকে রওনা হয়েছিলো সে। আমি তার পিছু নিয়ে তার আগেই ওখানে পৌঁছুলাম। আমাকে স্টেজের ভেতরে ঢুকতে দেখে বোধহয় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো ভারিপদ, বাইরে থেকে তালা আটকে দিয়েছিলো…
পরিষ্কার হচ্ছে, মাথা দোলালো রবিন।
হয়তো। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। হেঁড়া সূত্রের অনেকগুলো মাথা জোড়া দেয়া বাকি এখনও। কারণ, তার মনে হচ্ছে, যে-ই তাকে স্টেজের ভেতরে আটকেছে, মোটেই আতঙ্কিত হয়ে নয়, অন্য কোনো জোরালো কারণ ছিলো। তাকে কুইজ শো থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে হতে পারে। আর কুইজ শোতে জেতার ব্যাপারে ভারিপদর কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। জিততে পারবে একথা নিশ্চয় ভাবেওনি সে।
কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে, এটাও বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর। মোটর সাইকেলে চড়ে ভারিপদর স্টুডিওতে যাবার ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে না।
দুই নম্বর সন্দেহ, দুটো আঙুল তুললো কিশোর।
মড়ার খুলি, বলে দিলো মুসা।
হ্যাঁ, মড়ার খুলি। ওই ব্যাটা যথেষ্ট সেয়ানা। লোভী। টাকার জন্যেই এই কুইজ শোর ধারণাটা হারিস বেকারের মাথায় ঢুকিয়েছে কিনা কে জানে? শুধু আলোচনার জন্যেই একশো ডলারের জন্যে কি-রকম চাপাচাপি করছিলো। বাজি জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠছে। আমার অভিনয় বুঝে ফেলেছে সে, আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে।
কি করে জানলে? রকিন জিজ্ঞেস করলো।
শো-এর শেষে আমাকে ধরেছিলো ব্যাটা, অন্যমনস্ক হয়ে গেল কিশোর। কোথায় যেন ছিলাম? ও, হ্যাঁ। সুতরাং মড়ার খুলি যদি আমাকে দেখেই থাকে নয় নম্বর স্টেজের দিকে যেতে, তাহলে কেন একজন বিপজ্জনক প্রতিযোগীকে সরিয়ে রাখার সুযোগটা গ্রহণ করবে না? এবং শেষ মুহূর্তে যখন শো-এর স্টেজে হাজির হয়ে গেলাম, আমাকে দেখে তার চমকে যাওয়াটাও স্বাভাবিক। তাকে দেখে যে অস্বস্তি বোধ করছিলো মড়ার খুলি, সেকথা ভাবলো কিশোর। কিন্তু তখন মুভি স্টুডিওতে কি করছিলো সে ভারিপদর সঙ্গে একই সময়ে?
কোনোভাবে চলে গিয়েছিলো আরকি, রবিন বললো, তাই না?
না, জোরে মাথা নাড়লো কিশোর। কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না আমার।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভালো সে। তারপর তিনটে আঙুল তুললো, সন্দেহ নম্বর তিন, আলউড হোফার।
উঁইঁ, এবার মাথা নাড়লো রবিন, আমার তা মনে হয় না। ওই লোকটার চোরের মতো স্বভাব নয়।
হয়তো। মনে মনে রবিনের সঙ্গে একমত হলেও মুখে বললো, তবে দেখে চোরের মতো না লাগলেও চোর হবে না এমন কোনো কথা নেই। আলোচনা প্রশ্ন আগে তাকে দেখেছি আমি। কাপ আর অব্যবহৃত আর্ক লাইটগুলো যেদিকে ছিলো সেদিকে গিয়েছিলো সে। পাগল সংঘের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে সে। কুইজ শো দেখার জন্যে টিকেট চেয়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে। হাতে ক্লিপবোর্ড নিয়ে এসে বসেছে শো দেখতে, প্রশ্নের জবাব লিখেছে প্রতিযোগীরা জবাব দেয়ার আগেই। মনে থাকার কথা নয় এরকম একজন অভিনেতার নাম মনে রেখেছে। পাগল সংঘের ব্যাপারে এতো আগ্রহ, অথচ এটা আবার বুঝতে দিতে চায় না কাউকে। নয় নম্বর স্টেজ যে চেনে, সেটা জানতে দিতে চায়নি, থেমে গেল কিশোর। তাকালো দুই সহকারীর দিকে। আমার বিশ্বাস অনেক কিছুই জানে সে, যা হয়তো আমরা জানি না।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে লাফিয়ে উঠলো মুসা, ওরেব্বাবা, চারটে বেজে গেছে!
টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি ফুটলো কিশোরের চোখে। এখন পাগল সংঘ সিরিজের আরেকটা ছবি দেখানোর কথা। মোটুরামের দিকে তাকিয়ে আবার কষ্ট পাওয়ার পালা কিছুক্ষণ। তবে আগামী দিনের কুইজ শোর ব্যাপারে কিছু সাহায্যও করতে পারে ছবিটা। প্রতিযোগী হিসেবে হব্বি প্রতিটি দৃশ্য খুঁটিয়ে দেখা এখন তার হোমওয়ার্ক বলা চলে।
ও-কে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো কিশোর, রবিন, টিভিটা ছেড়ে দাও।
বিজ্ঞাপন দেখা গেল পর্দায়। সেটা শেষ হতেই মোটুরাম উদয় হলো, অনুরোধ করলো সে, নিয়ে তলো, প্রীত, নিয়ে তলো আমাকে!
অন্য পাগলরা সবাই মাথা নাড়লো। আইসক্রীম কিনতে শহরে যাচ্ছে ওরা। একটা বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ওদের নেই।
কিন্তু ওকে এখানে একা ফেলে যাই কি করে, নেলি বললো। বেচারা।
বেশ, তাহলে থাকো তুমি ওর সাথে,মড়ার খুলি বললো।
কিন্তু নেলি থাকতে চায় না। অবশেষে ঠিক হলো ওদের জন্যে অনেক আইসক্রীম নিয়ে আসা হবে।
আত্থা,মোটুরাম বললো, এনো তাহলে। অনেক, অনেক বেতি আইতক্রীম।
মড়ার খুলি আর শজারুকাঁটা রওনা হলো। পথে শজারুকে ফাঁকি দিয়ে আরেক দিকে চলে গেল মড়ার খুলি। কি আর করে বেচারা শজারু, মনের দুঃখে ফিরে এলো আবার।
এই ছবিটাতেই রয়েছে জনাব গণ্ডগোল আর তার গাড়িভর্তি চোরাই রেডিও। গাড়ি পাহারা দিতে রেখে গিয়েছিলো কয়েক পাগলকে। আর বিনিময়ে দিয়েছিলো একটা ডলার। সেই টাকা দিয়েই আইসক্রীম কিনে খাওয়ার কথা। পুরনো পিয়ার্সঅ্যারো কনভার্টিবল গাড়িটা ঘিরে দুষ্টুমি কহে পাহারাদাররা, একে অন্যের পিছে লাগছে, আর জনাব গণ্ডগোল গেছে ফোন করতে, এই সময় এলো পুলিশ। পাহারাদার পাগলদেরকেও থানায় ধরে নিয়ে গেল।
যাই হোক, ফিরে এসে রান্নাঘরে নিজেই আসক্রীম বানাতে কালো শজারুফাটা। তাকে সাহায্য করলো মোটুরাম। তাকে চিনি আনতে বললে আনে নুন, ময়দার কথা বললে আনে সুজি। ভালোই জমিয়েছে।
ওদিকে পুলিশের কাছ থেকে আবার গাড়িটা চুরি করে নিয়ে পালালো জনাব গণ্ডগোল। তাড়া কালো পুলিশ। ওদের গাড়িতে বসে আনন্দে চেঁচাতে লাগলো পাগলেরা।
উঠে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলো কিশোর।
এতৃহে, এটা কি করলে? প্রতিবাদ জানালো মুসা। জনাব গণ্ডগোলকে ধরতে পারবো কিনা সেটাই দেখতে দিলে না।
ধরতে পারবে না, কিশোর কলো। একই অভিনেতাকে আরেকবার ব্যবহার করতে চেয়েছে পরিচালক। আরেকটা সিরিজে শজারুকাঁটাকে ভাড়া করে জনাব গণ্ডগোল, একটা কুকুর চুরি করার জন্যে। কাজেই কামনা করে তাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতেই হয়েছে পরিচালককে।
রিসিভার তুলে একটা নম্বরে ডায়াল করলো সে। হালো, মিস্টার হোফার?…কিশোর পাশা-কাছি। এবার আসতে পারবেনইয়ার্ডে?…হ্যাঁ হ্যাঁ, যতো জলদি পারে।
আবার কোথায় যাচ্ছি? কিশোর রিসিভার রাখলে জিজ্ঞেস করলো রবিন।
কোথাও না, আনমনে বললো কিশোর। কাপওলো কে চুরি করেছে এটা জানতে হলে একজন বন্ধু দরকার আমাদের, যাতে কেউ সন্দেহ করবে না।
আর কোনো প্রশ্ন ব দিলো না সে। হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা।
গেটের কাছে এসে থামলো লিমুজিন। নিলামে পুরনো মাল কিনতে গেছেন মেচিাচী আর রাশেদ চাচা। হোফারকে ঘরে ডেকে নিয়ে এলো কিশোর।
খোলামেলা সুর রান্নাঘরটায় কালো ওর। চুলায় কফির পানি চাপলো কিশোর। হোফারের জনে। তিন গোয়েন্দর জন্যে বের করলো সোডার বোতল।
কুইজ শো দিয়ে আলোচনা শুরু করলো কিশোর। গাড়িটা কান্ত্র তৈরি সেটা আমাকে বলেনি ওরা, বেঁচেছি। আমি জানি না এর জবাব।
জানেন না? অবাকই মনে হলো যেন হেফারকে। সব প্রশ্নের উত্তরই তো দেখলাম জানা আপনার।
যা, কিশোর কালো। তবে গাড়ির দৃশ্যটায় আমি ছিলাম না। মড়ার খুলি, শিকারী কুকুর আর অন্যেরা ছিলো। আমার মনে হয় গাড়িটা কার তৈরি সেটা মিস্টার সাইনাসকে জিজ্ঞেস করেছিলো মড়ার খুলি, সেজন্যেই বলতে পেরেছে ওটা পিয়ার্সঅ্যারো। কিন্তু ওই গাড়িটা তখন আমি দেখিইনি।
হ্যাঁ, তা ঠিক, শোফার বললো। আপনি ডাকার আগে এই ছবিটাই দেখছিলাম। হাসলো সে। আপনি আর শজারুকাঁটা ঘরে বসে আসক্রীম বানাচ্ছিলেন।
পানি ফুটেছে। কাপে ঢেলে তাতে কফি আর চিনি মিশিয়ে হোফারের দিকে ঠেলে দিলো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, পুরনো এই সিরিজটা বুঝি খুব পছন্দ আপনার?
শ্রাগ করলে হোফর। ঠিক পছন্দ করি বলা যাবে না। বেশি ভাড়ামি। তবে মাঝে মাঝে বেশ হাসায়।
ঠিকই বলেছেন, ভাড়ামি বেশি। তবে পরিচালওে উদ্দেশ্য ছিলো সেটাই, তাই না? আমাদেরকে বেশি বেশি পাগলামি করতে বলেছেন, ছবির নামের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে। মড়ার খুলিকে দিয়ে কান নাড়িয়েছে। কুকুরের মতো জিভ বের করে রাখতে বলেছেন শিকারী কুকুরকে। আমাকে বলেছেন জিভে জড়িয়ে কথা ঝলতে। ভারিপদর পায়ের পাতা এমনিতেই বড়, তার ওপর বড়দের জুতো পরিয়েছেন। শজারুকাঁটার চুল খাড়াই, স্পেশাল কিছু করতে হয়নি তার জন্যে। তবে তাকে সুর করে কথা বলতে বলা হয়েছে মামি বোঝানোর জন্যে।
এক মুহূর্ত থামলো কিশোর। তারপর শজারুকাঁটার স্বর অবিকল নকল করে একটা সংলাপ বললো।
হেসে উঠলো হোফর। দারুণ করতে পারেন তো!
টেবিলে দুই রেখে সামনে ঝুঁকলো কিশোর। এখন এসব শুনলে রাগ লাগে, এত্তে ন্যাকামি। তাই না? অন্তত আমার লাগে।
তা কিছু কিছু যে লাগেনা তা নয়,কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাটা নামিয়ে রাখলো থোফর। চলুন, যওয়া যাক। কোথায় কেন?
আপাতত কোথাও নয়। হাত ঝড়িয়ে দিলে কিশোর। নি, হাত মেলান।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলো মুসা আর রবিন। কি কলহে কিশোর? কি সুতে চাইছে?
হাতটা বাড়িয়েই রাখলে কিশোর, যতক্ষণ না হোফার তার সঙ্গে হাত মেলালো। তারপর হাসি হাসি গলায় কালো গোয়েন্দাপ্রধান, তোমর সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় খুব খুশি হলাম, শজারু। তুমি করে বললাম, আশা করি কিন্তু মনে করোনি। আগেও তো তুমি করেই লতাম।
<