চুম্বকের টানে যেন রেস্তোরার জানালায় সেঁটে গেলাম আমি। মিস লি তখনও আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছেন।
কী ব্যাপার! আপনি আমার কাছে কী চান? চেঁচিয়ে উঠলাম।
ঘণ্টাধ্বনি সহসা থেমে গেল। পিনপতন নিস্তব্ধতা। দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেউ নেই।
তুমি কেন এখানে এসেছ তুমি জাননা, কিশোর, বললেন মিস লি। অন্তত আমার তাই মনে হলো। আমি ওঁর কণ্ঠ শুনেছি, যদিও ঠোট নড়তে দেখিনি এবং তার হাসি বন্ধ হয়নি এবং কাচের জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি।
কিশোর? আপনি আমাকে কিশোর বললেন? প্রশ্ন করলাম।
সময় হয়েছে, কিশোর, বললেন তিনি। আবারও গলা শুনলাম তার, কিন্তু ঠোট নড়েনি। মৃদু হাসি ধরে রেখেছেন মুখে।
কীসের সময় হয়েছে? প্রশ্ন করলাম। এই খেলা শেষ হওয়ার সময়? নাকি কী ঘটছে তা জানার সময় হয়েছে?
তোমার ভাগ্য জানার সময় হয়েছে, কিশোর।
সাদা এক ন্যাপকিন খুললেন তিনি। ভিতরে এক ফরচুন কুকি। ন্যাপকিনটা ফেলে দিয়ে কুকিটা তুলে ধরলেন মিস লি।।
ওটার দিকে চাইলাম। দুনিয়ার সবখানে চাইনিজ রেস্তোরায় এরকম ফরচুন কুকি দেখা যায়।
এসব কিছুর পিছনে একটা ফালতু ফল কুকি? জিজ্ঞেস করলাম।
দেখো, কিশোর, জবাব এল। মিস লিক কণ্ঠ আমার মাথার ভিতরটা ভরিয়ে তুলল। ফরচুন কুকিটা ভাঙলেন তিনি। গোটা ঘটনাটা যেন স্লো মোশনে ঘটছে।
কুকিটা খসে পড়ল মেঝেতে। মিস লি ছোট, সাদা কাগজের টুকরোটা তুলে ধরলেন। ওটার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন। এবার আবার আমার দিকে চাইলেন।
এখানে তোমার ভাগ্য লেখা আছে, কিশোর। পড়ো। পড়ে দেখো।
কাগজের টুকরোটা কাঁচের জানালায় তুলে ধরলেন তিনি। ছোট ছোট অক্ষরে লেখা পড়া কঠিন। প্রথমটায় পড়তে পারলাম না।
চোখ পিটপিট করে পড়ার চেষ্টা করছি, দূরে একটা ঘণ্টা বাজার শব্দ হলো। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।
ফরচুনটা অস্পষ্ট। আমি মর্মোদ্ধার করতে পারলাম না। এবার হঠাই চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল।
ওতে লেখা: আজ তুমি সম্পূর্ণ নতুন একজন মানুষ হিসেবে দিন শুরু করবে। নতুন মানুষ! উনি তো আগেও এটা আমাকে বলেছিলেন। কী মানে এর?
ওঁর দিকে চাইলাম।
কী বলছেন আপনি? এর মানে কি আমি সম্পূর্ণ নতুন মানুষ? কীভাবে…সেটা কীভাবে সম্ভব?
আমরা আমাদের নিয়তিকে এড়াতে পারি না, কিশোর, আমার মাথার মধ্যে মৃদু কণ্ঠে বলল মিস লির কণ্ঠ। চেষ্টা করলে শয়তান আমাদের পথ আগলে দাঁড়াবে।
এবার আলোর ঝিলিকের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেলেন তিনি। জানালাটা আবারও অন্ধকার, এবং ফাঁকা হয়ে গেল।
রাস্তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। এটাই কি জবাব? এটাই কি আমার নিয়তি যে আমি একদম নতুন মানুষে পরিণত হব? কিন্তু আমি তো তা চাইনি! আমি পুরানো কিশোর পাশাই থাকতে চেয়েছি।
অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিশোর।
ঘুরে দাঁড়ালাম।
মিস্টার হালবার্ট! চেঁচিয়ে উঠলাম। কোথায় ছিলেন আপনি?
তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি, কিশোর। তোমার এখন সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হওয়ার সময় এসেছে। পুরানো কিশোর পাশা এখন…হারিয়ে যাবে। এবং তিনি কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠলেন।
কী? কী বলতে চান? জবাব চাইলাম। এবার মেইন স্ট্রীটের দিকে চাইলাম।
এখনও নীরব, তবে হঠাই রাস্তাটা ভরে উঠল মানুষ-জনে। সবাইকে আমি চিনি। হাঁটছে। রাস্তা ধরে। আমার দিকে। নিঃশব্দে।
একটা বৃত্ত তৈরি করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে তারা। আমার চাচা। আমার চাচী। ডন। আমার বন্ধু মুসা, রবিন, টিমমেটরা। হাসপাতালের লোকেরা, মি. জেসাপ, সার্জেন্ট কলিন্স, মিসেস ওয়েসলি (মিসেস ওয়েসলি?), মিসেস বার্টন, মি. লাউয়ি, মিসেস পোর্টার, আমার হিরু চাচা, এবং আরও অনেকে।
বৃত্তটা ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে আমাকে। বন্দি হয়ে পড়ছি আমি।
সবাই হাসছে, দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে, আমাকে ছুঁতে চাইছে, আরেকটু হলেই ছুয়ে দেবে, এবং আমার কাঁধ প্রচণ্ড ব্যথায় দপ-দপ করছে। হঠাৎই সবার মুখ হয়ে গেল মিস লি-র মত! আর্তচিৎকার ছাড়লাম আমি!
<