পকেট থেকে নকলটা বের করল গোয়েন্দাপ্রধান। আপনমনেই বলল, টেনথ বল অভ টোয়াইন আমাদেরকে নিয়ে এসেছে শপিং সেন্টারে। তারপরে? ইউ অ্যাণ্ড মি; সী আওয়ার হ্যান্ডসাম মাগ অ্যাহেড।
রবিন বলল, ইউ অ্যাণ্ড মি হল আ কাপ অভ টী।
মরেছে, সেন্টারে গিজগিজ করছে লোক, সেদিকে তাকিয়ে বলল মুসা। এক কাপ চা নিয়ে ওখানে কেউ বসে আছে নাকি আমাদের জন্যে।
বসে হয়ত নেই, কিশোর বলল। তবে চা কোথায় পাওয়া যাবে, তা জানি। ওই দেব।
একটা পনিরের দোকান আর একটা কার্পেটের দোকানের মাঝের দোকানটা চায়ের নাম লেখা রয়েছে দ্য স্ট্যাটফোর্ড টী শপ্পে। নামটার মতই অক্ষরও ইংরেজি পুরানো ধাচে লেখা। জানালার ওপাশে দেখা যাচ্ছে কেকের সারি।
ছোট রেস্টুরেন্ট, রবিন বলল।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। আর আমরা কারমলের বাড়ি থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে রয়েছি। নিশ্চয় এখানে চা খেতে আসত সে।
ভেতরে ঢুকল ছেলেরা। ছোট ছোট একসারি ঘর রয়েছে, নিচু ছাত। একেবারে খাঁটি ইংলিশ টী শপ। স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো রয়েছে স্টাফ করা মাছ, দেয়ালে শোভা পাচ্ছে জজানোয়ারের মাথা, রকি বীচের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। ছোট ছোট টেবিলগুলোকে ঘিড়ে ভিড় করে বসেছে লোকে, চা কেক খাচ্ছে। এ
ছেলেদের দিকে এগিয়ে এল এক সুন্দরী ওয়েইট্রেস। হেসে জিজ্ঞেস করল কিছু লাগবে কিনা।
কটা কথা জানতে এসেছিলাম, সৌজন্য দেখিয়ে খুব ভদ্রভাবে বলল কিশোর। মিস্টার কারমল কি প্রায়ই আসতেন এখান?
আসতেন। হপ্তায় অন্তত তিন-চার দিন।
যা, আমারও তাই ধারণা ছিল। নিশ্চয় নির্দিষ্ট একটা মগে চা খেতেন। ওটা দেখতে পারি?
মগ? অবাক হল ওয়েইট্রেস। কোন মগ তো ছিল না। তাছাড়া মগ ব্যবহার করি না আমরা, কাপে চা দিই…
ছিল না? তাহলে…তাহলে…
রবিন বলল, এখানে কখন আসতেন তিনি, কি কি করতেন, কি খেতেন বলতে পারবেন?
নিশ্চয় পারব। বিকেলের দিকেই আসতেন, ঠিক এই সময়। দুতিন কাপ ওললাং আর একটা নরম রোল খেয়ে চলে যেতেন।
ওলোংটা কি জিনিস? মুসা জানতে চাইল।
চীনা চা। ভাল তৈরি হয় আমাদের এখানে, লোকে খায়ও প্রচুর।
মিস্টার কারমল কোন নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতেন? রবিন জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, এসেই ছয় নাম্বার টেবিলটার খোঁজ করতেন। ওটা খালি না থাকলে অন্য টেবিলে বসতেন।
টেবিলটা দেখতে পারি? কিশোর বলল।
তা পার। খালিই আছে এখন।
ওয়েইট্রেসের পিছু পিছু কোণের একটা টেবিলের কাছে চলে এল ছেলেরা। টেবিলের পাশে দেয়ালে বসানো একটা দানবীয় তলোয়ার মাহ৷ চেয়ারে বসল মুসা। খাইছে! এখানে বসে উল্টোদিকের দেয়াল ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যায় না।
রবিন বসল আরেকটা চেয়ারে। শুধু সামনের দেয়াল দেখা যায়, কিশোর। একটা হরিণের মাথা, বড় একটা আয়না আর গোটা দুই ছবি, ব্যস। মগটগ নেই।
কিশোর, প্রায় চিৎকার করে উঠল মুসা। হরিণটার নাক আছে! পরের ধাঁধায় নাকের কথা বলা হয়েছে না?
নকল বের করে পড়ল কিশোর, ওয়ান ম্যানস ভিকটিম ইজ অ্যানাদারস ডারলিন, ফলো দ্য নোজ টু দ্য প্রেস। মানে হল, একজনের শিকার আরেকজনের প্রিয়, নাক অনুসরণ করে জায়গামত যাও। বেশ। হরিণটা অবশ্যই একজনের শিকার। হরিণ ইংরেজি ডিয়ার, প্রিয় ইংরেজিও ডিয়ার, দুটো শব্দের বানান আলাদা হলেও উচ্চারণ এক। প্রিয়, অর্থাৎ ডিয়ারের প্রতিশব্দ ডারলিং। আবার ডারলিংকে অনেকে উচ্চারণ করে ডারলিন।
করে, রবিন বলল। কিন্তু হরিণের নাক তো এই টেবিল ছাড়া আর কোনদিকে নির্দেশ করছে না।
আশা ছাড়তে পারল না কিশোর। ওই ছবিগুলোতে কিছু নেই তো?
এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো কাছে থেকে দেখল তিনজনে। একটাতে রয়েছে রকি বীচের একটা হোটেল, যেটা বহু বছর আগেই ভেঙে ফেলা হয়েছে। আরেকটাতে আগের বছরের ফিয়েস্টা ডেপরেডের দৃশ্য।
টেবিলে কিছু লুকানো নেই তো? রবিন বলল।
টেবিলের ওপরে নিচে তন্ন তন্ন করে দেখা হল। কিছু পাওয়া গেল না। ঘড়ি দেখল ওয়েইট্রেস। দেখ, এখন আমরা খুব ব্যস্ত।
বেরিয়ে যেতে বলা হচ্ছে, বুঝল ছেলেরা। খুবই নিরাশ হয়ে বেরিয়ে এল চা দোকান থেকে। দেরি হয়ে গেছে অনেক, ডিনারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।
ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি, ঘোষণা করল মুসা। অযথা এসব খেখুজি বাদ দিয়ে চ বাড়ি চলে যাই। সাইকেলগুলোও নিতে হবে।…
হ্যাঁ, তাই চলে, এভাবে বিফল হয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। তবে চলো আগে এলসার সঙ্গে দেখা করে যাই। চা দোকানের ব্যাপারে হয়ত কোন তথ্য দিতে পারবে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছেলেদের কথা শুনল এলসা। কি জানি। ওই দোকানের কথা আমি কিছু জানি না।
ওলোঙের কোন বিশেষ মানে হয়? রবিন জানতে চাইল।
কি? অন্যমনস্ক মনে হল এলসাকে। আঁ…আসলে কোন কথায়ই মন দিতে পারছি না। সেই দুপুরের পর থেকে আর নরির খবর নেই।…কি যেন বলছিলে, ওললাং? এক জাতের চা, কারমলের খুব প্রিয় ছিল…ওফ, বাঁচা গেল! ওই যে নরি আসছে, সঙ্গে রস!
তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল এলসা। ঘরে ঢুকল নরি আর উড। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।
এদিকেই আসছিলাম, উড জানাল। শপিং সেন্টারে ঘুরঘুর করতে দেখলাম ওকে।
ভুরু কেঁচকাল মুসা। নিশ্চয় আবার আমাদের পিছু নিয়েছিল। রাস্তার ইটকেও বিশ্বাস কোরো না তোমরা চেঁচিয়ে উঠল নরি। আমি…
কর, নরি! ধমক দিল এলসা। সকালেই তোমাকে মানা করেছি, একা। একা বাড়ি থেকে না বেরোতে।
থাক, হয়েছে, হাত তুলল উড। ছেলেরা, এবার বল তো কতখানি এগোলে।
ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে করতে ছেলেদের কথা শুনল সে। বলল, চা। দোকানে মগ নেই, তোমরা শিওর?।
শিওর, কিশোর বলল। তার ঘরে নেই তো?
থমকে দাঁড়াল উড। তারপর কি মনে করে ছুটল কারমলের ঘরের দিকে। পিছু নিল অন্যেরা। ধুলোয় ঢাকা ঘরটায় গরুখোঁজা করা হল। মগ একটা পাওয়া গেল বটে, ধূসর রঙের সাধারণ মগ, কোন চিহ্নটিহ্ন নেই।
নাহ, এটা না, মাথা নাড়ল কিশোর।
মগটা রাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল উড। ইস, এগোনোই যাচ্ছে না, মুঠো করে ফেলল হাত। অথচ তাড়াতাড়ি করা দরকার। এজটাররা আর ডয়েলদের ওই ছেলেটা যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, আমাদের আগেই না পেয়ে যায়!
মা, নরি বলল, দাদা…।
তাকে থামিয়ে দিল তার মা। তোমার গোসলের সময় হয়েছে। যাও।
তার কথা শুনল না দেখে রাগ করে দুপদাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল নরি।
ধুলোয় ঢাকা ঘরটাতেই পায়চারি শুরু করল আবার উকিল। মাগ-এর সঙ্গে ছন্দ মেলে এরকম আর কি কি শব্দ আছে?
চা দোকানে ওরকম তো কিছু চোখে পড়ল না, কিশোর বলল। মাগের সঙ্গে মেলে বাগ, হাগ, লাগ, রাগ…
কি হয়, সেটা তুমি মিলিয়ে নিয়ো, আচমকা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল উডের কণ্ঠ। জলদি সমাধানের চেষ্টা কর। নইলে অন্য গোয়েন্দা ভাড়া করতে হবে আমাকে।
মনমরা হয়ে কারমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। বাস ধরে ডিপোতে ফিরে যেতে হবে। স্টপেজের দিকে এগোতে এগোতে চমকে উঠল রবিন। এই, দেখ, সেই গাড়িটা!
পরিচিত নীল গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। পেছনে গাছের ছায়ায় নড়ছে দানবীয় ছায়া।
এই নিয়ে তিনবার দেখা হল, ফিসফিস করে বলল কিশোর। আর কাকতালীয় বলা যাবে না। নিশ্চয় আমাদের ওপর নজর রাখছে, কিংবা…
কিশোর,মুসা বলল, আরেকজন!
হোট আরেকটা ছায়ামূর্তি যোগ দিল বড়টার সঙ্গে।
চলো, শুনি, ওরা কি বলে, কিশোর বলল। এমন ভাব দেখাবে, কিছু দেখিনি আমরা। খানিক দূর গিয়ে ঘুরে আবার ফিরে আসব।
খানিক দূর এগিয়ে, রাস্তা থেকে নেমে গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। ঘুরে ফিরে এল গাড়িটার কাছাকাছি। আস্তে মাথা তুলল মুসা। ফিসফিসিয়ে বলল, দৈত্যটা আবার একা হয়ে গেছে।
পেছনে মট করে একটা কুটো ভাঙল। ঝট করে মাথা ঘোরাল ছেলেরা। জ্বলন্ত চোখে তাদের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে হালকা-পাতলা একজন মানুষ। টুপির কানা সামনের দিকে নামানো। কালো জ্যাকেটের বুক খোলা। ভেতরে হোলস্টারে পিস্তল দেখা যাচ্ছে। কঠিন গলায় ধমক দিল, এখানে কি?
আরেক ধার থেকে উদয় হল দৈত্যটা। ছয় ফুট নয় ইঞ্চির কম হবে না লম্বায়, ভোতা নাক, ছড়ানো বড় বড় কান, অস্বাভাবিক লম্বা হাত।
আমাদের ওপর চোখ রাখছিলেন কেন? বেপরোয়া হয়ে গেল মুসা। কে বলল চোখ রাখছি? কর্কশ কন্ঠে বলল পাতলা লোকটা।
তাহলে কি করছেন? পাল্টা প্রশ্ন করল রবিন।
নিজের চরকায় তেল দাও গিয়ে, থোকা। যাও, ভাগ।
এত সহজে ছাড়া পাবে ভাবেনি ছেলেরা, দৌড় দিল গাছপালার ভেতর দিয়ে। বাস আসার শব্দ শুনল। স্টপেজে এসে বাসটা ধরল ওরা। শহরমুখো অর্ধেক রাস্তা যাবার আগে কথা বেরোল না কারও মুখ দিয়ে।
রবিন বলল, লোকগুলো কে?
কি জানি, হাত নাড়ল কিশোর। ছোটটার কাছে তো পিস্তল দেখলাম। গোয়েন্দা হতে পারে। চোর-ডাকাতও হতে পারে।
গোয়েন্দা? এজটাররা ভাড়া করেনি তো?
করতে পারে! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন সী আওয়ার হ্যাণ্ডসাম মাগের মানে বের করতে হবে আমাদের।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। মাগের সঙ্গে থাগ, অর্থাৎ ঠগেরও ছন্দ মেলে। ওই দৈত্যের মত ঠগের কাছাকাছি মগ খুঁজতে গিয়ে আর বিপদে পড়তে চাই না।
<