উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কিশোর। লাঞ্চের সময় ফেরার কথা, অথচ বিকেল হয়ে গেল, এখনও ফেরেনি। রবিন আর মুসা। কোন অঘটন ঘটেনি তো?
ম্যাগাজিনটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। উপসাগরের পুরো উত্তর প্রান্তটা চোখে পড়ে এখান থেকে। কিন্তু কই, কোন ছোট পালের নৌকা তো চোখে পড়ছে না!
ঘরে এসে ঢুকল মিসেস ওয়েলটন। হাতে দুধের গ্লাস আর কিছু বিস্কুট। টেবিলে নামিয়ে রাখল।
নিশ্চয় খিদে পেয়েছে তোমার, কিশোর, পেছন থেকে বলল বাড়িওয়ালি। নাও, এগুলো খেয়ে নাও। রবিন আর মুসা ফেরেনি এখনও?
না, ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। লাঞ্চের সময়ই ফেরার কথা, এখনও ফিরছে না! কোন বিপদেই পড়েছে মনে হয়।
এত ভাবছ কেন? বলল মিসেস ওয়েলটন। হয়ত বড়শি ফেলে মাছ ধরছে। ভুলেই গেছে ফেরার কথা।
বেরিয়ে গেল বাড়িওয়ালি।
নিশ্চিন্ত হতে পারল না কিশোর। বসে পড়ল টেবিলের সামনে। বিস্কুট চিবোতে চিবোতে ম্যাগাজিনটা টেনে নিলো আবার। কঙ্কাল দ্বীপ নিয়ে লেখা ফিচারের জায়গায় জায়গায় পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছে। আবার দেখতে লাগল ওগুলো। ভাবনা চলছে। মাথায়।
বাইশ বছর আগে বজ্রপাতে মারা গেছে স্যালি ফ্যারিংটন। সুযোগটা নিয়েছে মেলভিলের পর্কের মালিক। গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে স্যালির ভূত দেখা গেছে প্লেজার পর্কে। তারপর? প্রায় বিশ বছর আর ভূতের দেখা নেই। হঠাৎ করেই দেখা দিতে শুরু করেছে। আবার বছর দুই আগে থেকে। দেখেছে অশিক্ষিত, কুসংস্কারে ঘোর বিশ্বাসী জেলেরা। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কঙ্কাল দ্বীপে লোক যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।
এলো সিনেমা কোম্পানি। প্লেজার পার্কে কয়েকটা দৃশ্য শুটিং করবে। তাদেরকে উত্যক্ত করা শুরু হল। কেন? দ্বীপে ক্যাম্প করে তারা কার কি ক্ষতি করছে? মালিক বিরূপ নয়। তাদের ওপর, তাহলে ভাড়াই দিত না। তাহলে কে?
ঝটিকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো কিশোর। ঘরে এসে ঢুকল জোসেফ গ্র্যাহাম। উত্তেজিত।
কিশোর, বলল জোসেফ। পাপালো হারকুসকে দেখেছ?
সকালে দেখেছি, জবাব দিল কিশোর। ওর নৌকায় করে সাঁতার কাটতে গেছে। রবিন আর মুসা। ফেরেনি এখনও।
সারাদিন পাপালোর সঙ্গো প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল। জোসেফ। ওরা দুসেট একোয়ালঙ নিয়ে গেছে। প্র্যাকটিস করবে বলল, দিয়ে দিলামা কালো হয়ে গেছে তার মুখ। ওই হারামি গ্রেসানটার সঙ্গে গুপ্তধন খুঁজছে না-তো ওরা?
জবাব দিল না কিশোর। চেয়ে আছে জোসেফের মুখের দিকে। সতর্ক হয়ে উঠেছে।
ওদেরকে খুঁজতে যাওয়া দরকার। আবার বলল জোসেফ, ওই গ্রেসানের বাচ্চা এমনিতেই যা করেছে, তার ওপর আরও কিছু… থেমে গেল সে। কিশোরের দিকে তাকাল। আমি চললাম খুঁজতে।
আমিও যাব, সর্দি লেগেছে, ভুলে গেল কিশোর। তার এখন ভাবনা, তিন বন্ধুকে খুঁজে বের করা।
এসো, বলেই ঘুরে দাঁড়াল জোসেফ।
জেটিতে বাঁধা আছে ছোট একটা মোটর বোট। উঠে বসিল জোসেফ আর কিশোর। ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ছুটে চলল বোট।
এমনিতেই যা করেছে… কথাটার মানে কি, জানার কৌতূহল হচ্ছে কিশোরের। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারল না। কথা বলার মেজাজে নেই জোসেফ। থমথমে গভীর মুখ। হুইলে চেপে বসেছে আঙুল।
কঙ্কাল দ্বীপের জেটিতে এসে বোট রাখল জোসেফ। একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলল।
পাঁচজনের জায়গা হবে না। এই বোটে, বলল জোসেফ। তাছাড়া সব সরঞ্জাম নিয়ে তৈরি হয়ে যেতে চাই। ডুব দেবার দরকার পড়বে। কিনা কে জানে!
কি ব্যাপার? এত দুশ্চিন্তা কেন জোসেফের?—ভাবল কিশোর। পাপালোর সঙ্গে ডুব দিতে গেছে। রবিন আর মুসা, কি হয়েছে তাতে? কোন অঘটন। আশা করছে জোসেফ?
পাশের বড় বোটটায় উঠে গেল জোসেফ। কিশোরও উঠল।
গর্জে উঠল বোটের শক্তিশালী ইঞ্জিন। নাক ঘুরিয়ে তীব্ৰ গতিতে ছুটল উপসাগরের পানি কেটে।
প্রথমে পুরো কঙ্কাল দ্বীপের চারপাশে একবার চক্কর দিল জোসেফ। পাপালোর বোটের চিহ্নও নেই। দ্য হ্যান্ডের দিকে রওনা দিল সে।
শিগগিরই পৌঁছে গেল দ্য হ্যান্ডে। দ্বীপের চারপাশে দুবার চক্কর দিল।
নেই, ইঞ্জিন নিউট্রাল করে বলল জোসেফ। কঙ্কাল দ্বীপে নেই, দ্য হ্যান্ডে নেই। তারমানে, একটা দিকেই গেছে নৌকাটা। উপসাগরের পুবে। ঠিক, ওদিকেই গেছে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল কিশোর।
আবার গিয়ার দিল জোসেফ। চলতে শুরু করল বোট। নাক ঘুরে গেল পূর্ব দিকে।
তাকে উঠে বসে আছে। রবিন, মুসা আর পাপালো। কোমরের কাছে উঠে এসেছে পানি। আগের চেয়ে দুফুট বেড়েছে। পাথুরে দেয়ালে বাড়ি মারছে ছলাৎ-ছল-ছলা ছলাৎ-ছল-ছলা। ধীরে ধীরে কমে আসছে। গুহার ভেতরে আলো।
মোহরের নেশায় আর কোন দিকেই খেয়াল নেই তিনজনের। গোটা পঞ্চাশেক। মোহর খুঁজে পেয়েছে। কোমরের থলেতে ঢুকিয়ে রেখেছে ওগুলো পাপালো।
জোয়ার এসেছে, প্রথম খেয়াল করল পাপালো। চল, বেরিয়ে পড়ি। আর মোহর নেই এখানে।
ঠিক, সায় দিয়ে বলল মুসা। গত আধা ঘণ্টায় আর একটাও পাইনি। খিদেও লেগেছে। চল, যাই।
আগে আগে চলল মুসা। সুড়ঙ্গমুখে আটকে থাকা নৌকাটা প্রথম দেখতে পেল সে-ই। ওপরের দিকটা এপাশে। সুড়ঙ্গের ছাতের একটা খাঁজে ঢুকে গেছে মাস্তুলের আগা। বাইরে থেকে ধাক্কা দিচ্ছে স্রোত। শক্ত হয়ে আটকে গেছে নৌকা।
টর্চের আলোয় সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মুসা। নৌকার চারপাশে ফাঁক নেই বললেই চলে। আটকে গেছে ওরা, বুঝতে অসুবিধে হল না তার।
মুসার পাশে চলে এসেছে রবিন। সামনের দৃশ্য সে-ও দেখল। এগিয়ে গেল দুজনে। ধাক্কা দিল নৌকার গায়ে। নড়াতে পারল না। পারবেও না, বুঝে গেল।
ঠিক এই সময় ওদের পাশে এসে থামল পাপালো। এক মুহূর্ত চেয়ে রইল নৌকাটার দিকে। বুঝে গেল। যা বোঝার। ডিগবাজি খেয়ে ঘুরল। তীরের মত ছুটে চলে গেল। গুহার দিকে। তার দম ফুরিয়ে গেছে। গুহায় ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
মুসা আর রবিনও খেয়াল করল এতক্ষণে, ট্যাংকে গ্যাস ফুরিয়ে এসেছে। আরেকবার প্রাণপণ চেষ্টা করল নৌকাটা সরানোর। ব্যর্থ হয়ে পাপালোর পথ অনুসরণ করল।
মিনিট দুয়েক পর। তাকে বসে আছে তিন কিশোর। কোমর ছাড়িয়ে উঠে এসেছে পানি।
ভালমতো ফাঁদে আটকেছি। আমরা বলল পাপালো। জোয়ার যতই বাড়বে, নৌকাটা আরও শক্ত হয়ে আটকাবে।
হ্যাঁ, বিষগ্ন কণ্ঠে বলল মুসা। এমন কান্ড ঘটবে, কে জানত?
টানে ধীরে ধীরে সরে আসছে নৌকাটা। গুরুত্ব দিইনি। তখন ব্যাপারটাকে। যা হবার তা-তো হল, এখন কি করব?
দীর্ঘ নীরবতা। কেউ কোন পরামর্শ দিতে পারল না।
জোয়ার নামার সময় হয়ত টানের চোটে নেমে যাবে নৌকাটা, বলল পাপালো।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টা থাকবে জোয়ারা গুঙিয়ে উঠল মুসা। তারপরও যদি নৌকা না নামে?
ততক্ষণ আমরা বাঁচব কিনা তাই বা কে জানে! রবিনের গলায় আতঙ্ক। আরও বড় সমস্যা আসছে।
কি বললে? বট করে রবিনের দিকে ফিরল পাপালো।
দেখ! বলল রবিন। হাতের টর্চের আলো পড়েছে ছাতে। ভেজা ভেজা। শেওলা লেগে আছে।
তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।
জোয়ারের সময় ওখানে উঠে যায় পানি, রবিনের গলা কাঁপছে। খাঁচায় ভরে ইদুরকে পানিতে চুবিয়ে রাখলে যা হয়, আমাদেরও সেই অবস্থা হবে!
কারও মুখে কথা নেই। আর। গুহার দেয়াল ছলাৎ-ছল।াৎ বাড়ি মারছে পানি। ধীরে ধীরে উঠে আসছে ওপরে।
দ্বীপের দিকে চেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, মিস্টার গ্রাহাম! বোট ফেরান। কি যেন দেখা যাচ্ছে!
ভুরু কোঁচকাল জোসেফ। কিন্তু বোট ফেরাল।
এক মিনিট পরেই দ্বীপের এক পাশে খুদে সৈকতের ধারে এসে থামল বোট। লাফ দিয়ে নেমে এল কিশোর। ছুটল। চলে এল অন্য পাশে, যেখানে জিনিসগুলো দেখেছিল।
আছে। পাথরের ওপর বিছিয়ে আছে কাপড়। শুকিয়ে এসেছে। পায়ের আওয়াজ শুনে ফিরে চাইল কিশোর। জোসেফ গ্র্যাহাম আসছে।
ওদের কাপড়, বলল কিশোর। কাছেপিঠেই নিশ্চয় কোথাও আছে ওরা। দেখি, টিলাটায় চড়ে দেখে আসি আমি।
ছেলেদের কাপড়গুলোর দিকে চেয়ে আছে জোসেফ। হতবুদ্ধি হয়ে গেছে যেন! কিশোরের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল, নৌকাটা নেই, আমি শিওরা এখানে কাপড়চোপড় খুলে রেখে কোন কারণে…
জোসেফের কথা শোনার অপেক্ষা করছে না কিশোর। ছুটে যাচ্ছে টিলার দিকে।
চুড়ায় উঠে এল কিশোর। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কোথাও দেখা যাচ্ছে না নৌকাটা। ধাপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল। হতাশ ভঙ্গিতে।
পাশে এসে দাঁড়াল জোসেফ। পুরো দ্বীপটাি দুবার চক্কর দিয়েছি। দেখিনি ওদের। তারমানে এখানে নেই! লাথি মারাল একটা ছোট পাথরে। ক্ষোভ চাপা দিতে পারছে না।
গড়াতে গড়াতে গিয়ে ছোট একটা গর্তে পড়ল পাথরটা। এক মুহূর্ত পরেই পানিতে পড়ার চাপা শব্দ কানে এল। ব্যাপারটা খেয়াল করল। কিনা। ওরা, বোঝা গেল না।
উপকূলেই খুঁজতে হবে। কিন্তু কাপড় এখানে ফেলে গেল কেন ওরা
চল, বলল জোসেফ। আগে কোস্ট গার্ডকে খবর দিতে হবে। সাঁঝের বেশি বাকি নেই। অন্ধকার নামার আগেই খুঁজে বের করতে হবে ওদের।
বোটের দিকে এগিয়ে চলল জোসেফ। অনুসরণ করল কিশোর। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে।
পেয়েছি। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। পাই করে ঘুরেই ছুটল টিলার দিকে। ছোট গর্তটার ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
গর্তের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, মুসা রবি-ই- ন! তোমরা আছ ওখানে? বলেই কান রাখল গর্তের ওপর।
এক মুহূর্তনীরবতা। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে কিশোরের। তবে কি ভুল করেছে সে? অনুমান ঠিক হয়নি?
হঠাৎ শোনা গেল। জবাব। চাপা, কিন্তু পরিষ্কার। মুসার গলা। কিশোরা ফাঁদে আটকে গেছি। তাড়াতাড়ি বের করা আমাদের! জোয়ার এসেছে পানি আরও বেড়ে গেলে ড়ুবে মরব। জলদি, জলদি করা কি-শো-ও-র-র-র…
<