রুশ ভূত

এবার যে কাহিনিটি বলব এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন মি. ডব্লিউ. ডি. এডিসন। আর এটা তিনি পাঠান মি. ডব্লিউ. টি. স্টিডকে, যিনি এটা প্রকাশ করেন বর্ডারল্যাণ্ডে।

১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়াতে মি. এডিসনের বাসায় ঘটনাটি ঘটে। মাত্র সপ্তাহ পাঁচেক আগে তাঁদের প্রথম সন্তানটি পৃথিবীতে এসেছে। তাই ড্রইং রুমে পাতা একটা বিছানায় আপাতত ঠাই হয়েছে এডিসনের। খুব একটা বড় না হলেও বাসাটা বেশ খোলামেলা আর আলো-বাতাস ঢোকার বেশ ভাল সুযোগ আছে।

ঘটনার রাতে দশটার একটু পর পরই বিছানায় চলে গেলেন এডিসন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তলিয়ে গলেন গভীর ঘুমে। সাধারণত সকাল পর্যন্ত টানা ঘুম হয় তাঁর। তবে এই রাতে স্বপ্নহীন ছোট্ট একটা ঘুমের পরেই জেগে উঠলেন। কেন যেন মনে হয়েছে কেউ মাম ধরে ডেকেছে তাঁকে। উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ভেবে চিন্তাটা ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবেন এমন সময় আবার শুনলেন শব্দটা। ফিসফিস করে সত্যি কেউ তার ডাক নাম ধরে ডাকছে, উইলি। এখন যে নার্সটি বাচ্চাটার দেখাশুনা করে আর শোবার ঘর লাগোয়া ডাইনিংয়ে থাকে, কয়েক দিন হলো সে অসুস্থ। গত সন্ধ্যায়ও তার স্ত্রী এডিসনকে ডেকে নিয়ে গেছেন সাহায্য করার জন্য। কাজেই যখন ফিসফিস শব্দটা শুনলেন প্রথমেই তার মনে হল, ওহ! বাবুটা যন্ত্রণা করছে আবার।

কামরাটায় জানালা আছে তিনটা। আকাশে চাদনেই তবে তারারা ঝলমল করছে। এদিকে তুষার পড়ার কারণে এতে প্রতিফলিত আলোও আছে। কাজেই ঘরের ভিতরটা অন্ধকার বলা যাবে না।

মাথা ঘুরিয়ে বিছানার কিনারায় একটা নারী মূর্তি আবিষ্কার করলেন এডিসন। কোনো ধরনের চিন্তা ছাড়াই ধরে নিলেন ওটা তার স্ত্রী।

কী ঘটনা? জানতে চাইলেন।

কিন্তু ছায়ামূর্তিটা নীরব আর স্থিরই রইল। ইতোমধ্যে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে এডিসনের। লক্ষ করলেন, নারীদেহটার কাঁধ আর মাথা ধূসর একটা শালে ঢাকা। তারচেয়ে বড় কথা কাঠামোটা তাঁর স্ত্রীর তুলনায় আরও বেঁটে। একদৃষ্টিতে ছায়ামূর্তিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভাবছেন কে হতে পারে এটা?

এবার এখানকার ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী চাও?

কিন্তু উত্তর মিলল না। এসময়ই মনে হলো এটা মনে হলো তাঁদের কাজের মেয়েটা। ওর ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়াবার বদভ্যাস আছে। এডিসনের শয্যার কাছেই একটা টেবিল আছে। ছায়ামূর্তিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ম্যাচবাক্সটা নেওয়ার জন্য টেবিলের কাছে পৌঁছলেন। ম্যাচবাক্সটা হাতে নিলেন। কিন্তু কাঠিটা জ্বালার আগেই তাকে চমকে দিয়ে কাঠামোটা যেন মেঝে থেকে শূন্যে উঠে গেল। তারপর পিছু হটতে হটতে কামরার শেষ প্রান্তের জানালাটার দিকে সরে পড়ল। ধীরে ধীরে মলিন হতে হতে জানালায় যখন পৌঁছল, ঝাপসা একটা ধূসর অবয়বে পরিণত হয়েছে। ম্যাচের কাঠি ধরাতে ধরাতে পুরোপুরি অদৃশ্য হলো। মোমবাতি জ্বেলে লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন এডিসন। ওটা লাগানো। ড্রইং রুমের পাশেই একটা সাজঘর আছে। কামরা দুটোকে আলাদা করেছে কেবল একটা পর্দা। এই কামরাটাও খালি, আর দরজাটার দোর আটকানো।

রীতিমত বিস্মিত হয়ে গেছেন এখন এডিসন। চোখ ডললেন কয়েকবার। এসময়ই প্রথমবারের মত একটা কথা খেয়াল হলো তাঁর, কাঠামোটা একটু অস্পষ্ট ছিল। এদিকে একমাত্র তার স্ত্রীই তাকে উইলি নামে ডাকেন, আর কেবল তিনিই নামটা ইংরেজ উচ্চারণে বলেন। আরেকবার ভালমত ড্রইং রুম আর সাজঘরটা পরীক্ষা করলেন। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। এবার স্ত্রীর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতলেন। বাচ্চাটা কাঁদছে আর তাঁর স্ত্রী সজাগই আছেন। আস্তে আস্তে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন। তাঁর স্ত্রী, বেশ সাহসী মহিলা-এটা জানা থাকায় পুরো ঘটনাটি খুলে বললেন তাকে। শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর জানতে চাইলেন তিনি কি কামরাটায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন কিনা? এডিসনও বেশ সাহসী মানুষ। কাজেই এখনই ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখলেন না। কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের কামরায় ফিরে এলেন। খুব শান্তভাবে পুরো বিষয়ুটা নিয়ে ভাবলেন। কিন্তু এটার কোনো ব্যাখ্যা বের করতে পারলেন না। এদিকে দু-চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। মোমবাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

আবারও স্বপ্নহীন ছোট্ট একটা ঘুমের পর জেগে উঠলেন। এবার তার মুখটা মাঝখানের জানালার দিকে। ওটার কাছেই আবার দেখলেন ছায়ামূর্তিটাকে। বাইরে থেকে আসা আলোর পটভূমিতে বেশ কালো মনে হলো কাঠামোটাকে।

তড়িঘড়ি ম্যাচের জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে টেবিলটাকেই উল্টে দিলেন। মোমবাতি, চাবি, ঘড়িসহ আরও নানান জিনিসপত্র নিয়ে বিকট শব্দে মাটিতে পড়ল ওটা। তবে তাঁর চোখ সেই গাঢ় কাঠামোটার দিকেই। তারপরই লক্ষ করলেন, জিনিসটা যাই হোক, এই মুহূর্তে সরাসরি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। এক মুহূর্ত পরে দরজার দিকে যাবার পথও আটকে দেবে। আঁধারে অজানা একটা জিনিসের মুখোমুখি হওয়া মোটেই আনন্দের বিষয় নয়। মুহূর্তের মধ্যে বিছানার চাদরটা তুলে দুই কোনা দুই হাত দিয়ে ধরলেন শক্ত করে। তারপর সরাসরি ছায়ামূর্তিটার দিকে লাফ দিলেন। ভাবছেন চাদরটা দিয়ে ওটার মাথা, চোখ-মুখ ঢেকে ফেলে আক্রমণের প্রথম ঝাপটাটা সামলাবেন। পর মুহূর্তেই জানালার সামনের একটা সোফার ওপর গিয়ে পড়লেন। হাতদুটো গিয়ে ঠেকল জানালার গরাদে। তারপরই আঁতকে উঠলেন। ওটাকে অতিক্রম করে গেছেন। ছায়ামূর্তি এখন তার পিছনে। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়ালেন। পরমুহূর্তেই গাঢ় অন্ধকারের একটা জালে যেন আটকা পড়লেন। ওটাকে স্পর্শ করা যায় না। আবার একই সঙ্গে এতটাই ঘন যে মনে হলো যেন তার ওপর ভারি একটা কিছু চড়ে বসেছে। চারপাশ থেকে প্রচণ্ড একটা চাপ অনুভব করলেন। নড়তে-চড়তে পারছেন না একটুও। বিছানার চাদরটা তার বাম বাহুতে ঝুলছে, আর ডান হাত মুক্ত। কিন্তু ওজনদার কিছু একটা যেন ওটাকে চেপে ধরেছে। সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে চাইলেন। মনে হলো যেন তার জিভটা শুকিয়ে গেছে, আর কয়েক ইঞ্চি পুরু হয়ে তালুতে আটকে গেছে। একটা শব্দও বের হলো না মুখ থেকে। তারপরই প্রচণ্ড চেষ্টার পর কিছু একটা বের হলো মুখ দিয়ে। আধা প্রার্থনা, আধা ভয়মিশ্রিত অসংলগ্ন কিছু শব্দ ওগুলো। সমস্ত মানসিক আর শারীরিক শক্তি এক করে শেষ চেষ্টা চালালেন। এতেই ভয়াল ওই জিনিসটার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন। পরের কয়েক সেকেণ্ডে দরজার নাগাল পেলেন, ওটা খুলে বের হয়ে আসতে পারলেন বারান্দায়। নিজের হৃৎপিণ্ড বাড়ি খাওয়ার ধপ ধপ শব্দ শুনতে পাচ্ছেন পরিষ্কার। ভয়টা দূর হয়ে গেল মন থেকে। তবে মনে হলো যেন জীবন বাঁচাতে মাইলের পর মাইল দৌড়েছেন। আর একটু সুযোগ পেলেই ওটা তাঁকে শেষ করে দিত।

আবার স্ত্রীর কামরার সামনে চলে এলেন। আওয়াজ শুনে বুঝলেন জেগে আছেন তিনি আর বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। দরজা ধাক্কাতেই তিনি খুলে দিলেন। এডিসনের চেহারার হালই তার কাছে পরিষ্কার করে দিল কিছু একটা ঘটেছে। মুখ দিয়ে ফোটায় ফোঁটায় ঘাম গড়িয়ে পড়ছে, চুল ভেজা। আর কয়েক গজ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে তাঁর হৃৎপিণ্ডের দ্রিম দ্রিম।

সেই রাতে কী ঘটেছে তার কোনো ব্যাখ্যা এডিসন বের করতে পারেন নি কখনই। তবে ঘটনাটা যখন তাদের আগে এই বাড়িতে যারা ছিলেন তাঁরা শুনলেন তখন একটা ঘটনা বললেন। এক রাতে বাড়িতে আসা এক অতিথির এই কামরায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ওই ভদ্রলোক কামরাটায় থাকতে অস্বীকার করে বলেছিলেন ওটা ভুতুড়ে।

<

Super User