মড়া যখন জ্যান্ত হলো

এই ঘটনাটা বেশ আগের। শ দেড়েক বছর তো হবেই। নায়ক চার্লস ডি. ব্র্যাডলাফ নামের এক তরুণ। ভূত, প্রেতাত্মা এসবের প্রতি মোটেই বিশ্বাস নেই। শুধু তাই না এ সম্পর্কে যে কোনো কাহিনি ভাঁওতাবাজি, হ্যালুসিনেশন এসব প্রমাণ করার জন্য এক পায়ে খাড়া। সে কোনো কিছুকেই ভয় পায় না, এমন কথাও বলে বেড়ায় ব্র্যাডলাফ। একদিন তার এই আচরণে খেপে গিয়ে একজন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বসল, তুমি যদি এতই সাহসী হও তবে তার প্রমাণ দিতে হবে। রাতে দুয়ার আটকানো একটা গির্জার মধ্যে থাকতে হবে, সঙ্গে থাকরে কফিনে ভরা একটা লাশ।

সঙ্গে-সঙ্গে ব্র্যাডলাফ জানাল তার কোনো আপত্তি নেই এতে। কিছুদিনের মধ্যে সুযোগও মিলে গেল। গির্জায় নিয়মিত আসা ধার্মিক এক লোক মারা গেলেন। গির্জার পাতাল ঘরে রাখা হলো কফিনে ভরা মৃতদেহটা। তবে কফিনের ডালাটা খুলে দেওয়া হলো। নিভিয়ে দেওয়া হলো গির্জার সমস্ত বাতি। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে চলে গেল সবাই। গির্জায় জীবিত মানুষ বলতে থাকল কেবল ব্র্যাডলাফ।

বাইরে থেকে যখন দরজাটা লাগানো হলো গির্জার, তখনই অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল তরুণটির মনে। এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করল। মনের ভিতর জমতে শুরু করা ভয়, কুসংস্কার এগুলোকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে গির্জাটা ঘুরেফিরে দেখতে অগ্রসর হলো।

জানালা গলে উজ্জ্বল চাঁদের আলো ঢুকছে ভিতরে। তবে এতে করে নানান দিকে, বিশেষ করে গির্জার শেষ প্রান্তের সারবাঁধা বেদি আর বসার আসনগুলোর পাশে অদ্ভুত ছায়া তৈরি হয়েছে। হেঁটে-হেঁটে, কৌতূহলী দৃষ্টিতে সব কিছু দেখছে ব্র্যাডলাফ। কারণ অনেক দিন পর আবার একটা গির্জায় ঢুকেছে সে। তারপর পাতাল ঘরের দিকে এগোল সিঁড়ি ভেঙে। নীচে নেমে সাহস করে চলে এল একেবারে কফিনের ধারে। একদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে রইল। আশা করছে ওটার সঙ্গে পরচিত হয়ে গেল মনের অস্বস্তিটা দূর হয়ে যাবে। তারপর আবার গির্জার মূল অংশে চলে এল। এখানে একটা সুবিধা মত জায়গা খুঁজে পেয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই কেমন ঘুম-ঘুম আসতে লাগল। সন্দেহ নেই অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়েও যেত। কিন্তু এমন সময় পাতাল ঘর থেকে মৃদু একটা শব্দ কানে এল। কারও জোরে শ্বাস নেওয়ার আওয়াজের মত লাগল। তারপর আরও কিছু শব্দ হলো যার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তার শুধু মনে হলো চাপা নিস্তব্ধতার মধ্যে এই মৃদু শব্দগুলোই ভয়ের শির শির অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে শরীরে। ওগুলোর অস্পষ্টতা আরও বেশি আতংকিত করে তুলল তাকে। এমন ভুতুড়ে আওয়াজ কে করছে ভেবে কূল-কিনারা পেল না। অন্ধকারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, আবছাভাবে যদি কিছু ধরা দেয় চোখে। তারপরই প্রথমবারের মত পাতাল ঘরের সিঁড়িতে ক্ষীণ একটা পদশব্দের মত শুনল। শুরুতে ওটা মৃদুই থাকল, তবে ধীরে-ধীরে চড়ল। এখন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। আর কোনো সন্দেহ নেই এটা পায়ের শব্দ। যেন কোনো মানুষ পাতাল ঘর থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। কিন্ত পাতাল ঘরে আছে কেবল মড়াটা।

উঠে দাঁড়াল ব্র্যাডলাফ। মাথার পিছনের চুল খাড়া হয়ে গেছে। কাঁপুনি ধরে গেছে শরীরে। দরজার দিকে দু-কদম এগোল, কী আশা করছে নিজেও জানে না। তারপর যখন তাকাল চাঁদের আলোয় ওটাকে দেখল এগিয়ে আসতে। মড়াটা। যেটাকে পাতালে কফিনের মধ্যে দেখে এসেছে। আতংকে তখন উন্মাদ অবস্থা একদা সাহসী তরুণের। দৌড়ে গেল মড়াটার দিকে। ওটার গায়ে এখনও জড়ানো শবের সাদা কাপড়, তবে ছেড়াআলুথালু। একটা হাত তুললব্র্যাডলাফ। মড়াটাকে আবার মারতে নাকি ভয়াবহ জিনিসটাকে ঠেলা দিয়ে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে, কে জানে? কিন্তু এ সময়েই মড়ার হাত সচল হলো। চোয়ালে প্রচণ্ড এক আঘাতে ধরাশায়ী হলো ব্র্যাডলাফ।

এদিকে ভোরে যখন ব্র্যাডলাফের বন্ধুরা গির্জায় এল চমকে উঠল তারা। ব্র্যাডলাফ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আর মড়াটা ঝুঁকে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিচ্ছে তার মুখে। তবে এখন সে শবের সাদা পোশাক থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছে। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্য ভাঙল। সংক্ষেপে তাই, বলছি পাঠকদের।

মড়া ভেবে যাকে কফিনে পুরে গির্জার পাতালে এনে রাখা হয় সে আসলে মরেনি। বরং কোনো একটা ধাক্কায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সম্ভবত শ্বাস-প্রশ্বাসও পাওয়া যায়নি। তাই সবাই ধরে নেয় লোকটা মারা গেছে। রাতে জ্ঞান ফিরে আসে তার। তারপর হেঁটে-হেঁটে গির্জার ওপরে ওঠা শুরু করে। ঠিক তখনই দোরগোড়ায় আতংকিত ব্র্যাডলাফের সঙ্গে দেখা হয়। রাতের বেলা গির্জায় একটা লোককে দেখে স্বভাবতই। দুস্কৃতিকারী ধরে নেয়। তাই দেরি না করে আঘাত হানে। শক্তিশালী একজন মানুষ সে, তারপর আবার মুষ্টিযোদ্ধা। আর তাই চোয়ালে ঘুষি খেয়ে ধরাশায়ী হয় ব্র্যাডলাফ। অবশ্য প্রাক্তন মড়া আর অন্যদের চেষ্টায় দ্রুতই জ্ঞান ফিরে আসে ব্র্যাডলাফের। তবে আর কখনও সাহসের বড়াই করেনি সে।

<

Super User