সান জুয়ানের আত্মারা

ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির জন্য নাম আছে ফিলিপাইনের শহর সান জুয়ানের। শহরটির ইতিহাস বেশ পুরানো। গির্জাসহ বেশ কিছু পুরানো ইমারতের ধ্বংসস্তূপ পাবেন এখনও। এসব পুরানো ইমরাতগুলোর ধ্বংসস্তুপগুলোর মধ্যে প্রায়ই দেখা মেলে ভৌতিক আর রহস্যময় সব চরিত্রদের। অন্তত লোকে তাই বলে। এদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত হলো মাথাহীন এক পাদ্রীর ভূত। রাতের বেলা শহরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় সে। কখনও কাটা মাথাটা হাতে নিয়ে ইতস্তত ঘোরাফেরা করে, কখনও আবার তার মুণ্ডুহীন ধড়টাকে মাথা খুঁজতে দেখা যায়। আবার এই এলাকা দিয়ে রাতে যাওয়া কোনো কোনো লোক দাবী করেছেন পাদ্রীর মাথাটাকে চিৎকার করে ধড়ের খোঁজ করতে শুনেছেন তারা।

আবার এখানে আরেক ধরনের ভূতদের দেখা যায়, যারা পরিচিত পাস্তাসাত নামে। পাস্তাসাতের মানে করলে দাঁড়ায় যাকে ছুরি মারতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিপাইনে যেসব মানুষ মারা গিয়েছে তাদের ভূতেরা পরিচিত পাস্তাসাত নামে। এসময় কফিন ছিল খুব দুর্মূল্য। কাজেই মৃতদেহ খড়ের মাদুর দিয়ে মুড়িয়ে কবর দিতে বাধ্য হত লোকেরা। সাধারণত গোরস্থানের বদলে অন্য কোনো জায়গায় সমাহিত করা হত মৃতদের। কারণ ওই সময় প্রচণ্ড দারিদ্র্যের কারণে কবর চুরির হিড়িক পড়ে যায়। নির্জন রাস্তা কিংবা গলিতে চলার সময় নিঃসঙ্গ পথচারীদের সামনে হাজির হয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার উপক্রম করে এরা। বলা হয় এই ভূতেদের কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ছুরি দিয়ে মাদুরটা কেটে একে মুক্ত করতে হবে। তবে মাদুর কাটার পর কোনো মৃতদেহের খোঁজ করলে হতাশ হতে হবে। মাদুর থেকে কেবল ভয়ঙ্কর একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসবে, যার সঙ্গে মিল আছে পচা মাংসের গন্ধের।

১৮৯৮ সালে, ফিলিপিনিয় বিপ্লবের শেষের দিকে, ভয়ঙ্কর এক অগ্নিকাণ্ডে গোটা সান জুয়ানের বেশিরভাগ ইমারত বিধ্বস্ত হয়। এরপর থেকেই এখানকার রাস্তা আর অলিগলিতে নানান ধরনের অশরীরী আর আত্মাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। অনেকে অস্বাভাবিক কোনো ছায়ামূর্তি কিংবা ভুতুড়ে কাঠামোর দেখা পাওয়ার দাবি করেন। কেউ আবার বলেন অদ্ভুতুড়ে সব শব্দ শোনার কথা। সন্দেহ নেই মানুষের অভিজ্ঞতা রং চড়ে আর এর সঙ্গে কিংবদন্তী মিশে দস্তুরমত এক ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয় সান জুয়ান।

সান জুয়ানের প্রেতাত্মাদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত হলো ডেভিল সিগার ম্যান। ঘটনার শুরু যুদ্ধের ঠিক আগে। এসময় শহরের তরুণেরা পরিত্যক্ত একটা ম্যানহোলের চারপাশে ভীড় করে ধূমপান করতে-করতে আড্ডায় মেতে উঠত। তারপরই এক মধ্যরাতে ঘটল ভয়ঙ্কর এক ঘটনা। এক আগন্তুক হাজির হলো তাদের সামনে। পরনে কালো আলখেল্লা, লম্বা চুল বিনুনি করে বাঁধা। খড়ের লম্বা কিনারাওলা একটা খড়ের টুপিতে ঢাকা মুখটা। তাদের কাছে সিগারেট ধরানোর আলো চাইল আগন্তুক। তরুণদের একজন যখন তার জ্বলন্ত সিগারেটটা দিল তাকে, নিজেরটা জ্বালবার জন্য মুখ উঁচু করল লোকটা। আর তখনই

আতংকে শিউরে উঠল উপস্থিত সবাই। লোকটার যেখানে মুখ। থাকার কথা সেখানে কেবলই একটা গর্ত। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই দেখা যেত তাকে। এমনকী এখনও রাতের বেলা সান জুয়ানের রাস্তায় একা-একা হাঁটতে বের হওয়া লোকেদের নাকি চমকে দেওয়ার অভ্যাস আছে ডেভিলম্যানের। তবে পুরানো দিনের স্থানীয় সিগারেটই তার পছন্দ। যদি তাকে আলো না দেন তবেই সর্বনাশ। বিপদ ঘনিয়ে আসবে আপনার ওপর। আবার লোকেরা গল্প করে ডেভিলম্যানের লম্বা কিনারাওলা টুপি নিয়েও। বলা হয় এ ধরনের কোনো টুপি পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখলে কোনোভাবেই স্পর্শ করা যাবে না। আর এটা করলেই ডেভিলম্যানের দোসর বানিয়ে ফেলবেন নিজেকে। সেক্ষেত্রে নরকবাস নিশ্চিত।

সান জুয়ানের ভুতুড়ে সন্ন্যাসিনীও হাজির হয় মাঝে মাঝে। যতদূর জানা যায় জাপানিরা তার মঠ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে ধর্মভীরু এই কুমারী মহিলার মাথা কেটে নেয়। তারপর থেকেই দেখা দিতে শুরু করে সন্ন্যাসিনীর অতৃপ্ত আত্মা।

মঠের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। দিনের বেলা এর পাশ দিয়ে যান কিংবা ঘুরে ফিরে দেখেন ইমারতগুলো, কোনো সমস্যা নেই। তবে রাত হলেই বিপদ, বিশেষ করে পূর্ণিমার রাত হলেই সেরেছে। মধ্যরাতে ভরা পূর্ণিমার সময় মন্দভাগ্য কোনো লোক মঠের ধ্বংসাবশেষকে পাশ কাটানোর সময় হঠাৎই হয়তো শুনবেন ভুতুড়ে একটা ঘণ্টার আওয়াজ। শব্দটা কোন্‌খান থেকে আসছে কেউ জানে না। তবে বুদ্ধিমান হলে এটা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে ঝেড়ে দৌড় দেবেন। যদিও তাতেও শেষ রক্ষা হবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না কেউ। কারণ ঘণ্টা বাজা মানে ধরে নিতে হবে সন্ন্যাসিনীর আত্মা কাছে-ধারেই কোথাও আছে। হয়তো লোকটার পিছনেই, চুপিসারে এগিয়ে আসছে আরও কাছে। মানুষের ধারণা তাকে যে মেরেছে তার কিংবা তার খুনির বংশধরের খোঁজ করে এখনও সে হন্যে হয়ে। সাধারণত পিছন থেকে এসে আচমকা বাম কাঁধে হাত রাখে ভুতুড়ে সন্ন্যাসিনী। পিছন থেকে তাকে এভাবে গায়ে হাত রাখতে দেখে ভয়ে হার্টফেল করে নাকি মারা গেছেন বেশ কয়েকজন মানুষ। বাকিরা হয়ে যায় বদ্ধ উন্মাদ।

হিসপানিয়দেরও আগের আমলের পুরানো একটা টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ আছে সান জুয়ানে। এই টাওয়ারে মাঝে-মাঝেই দেখা দেয় রহস্যময় এক সাদা পোশাকের নারী মূর্তি। সাধারণএকা হেঁটে-চলা পথচারীদেরই ভয় দেখায় নারীটি। স্তম্ভ ছাড়াও সান জুয়ানের আরও অনেক পুরনো স্থাপনাতেই ঘুরে-ফিরে হানা দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অনেক সময় গায়ে কাঁপন ধরানো শব্দে হেসে ওঠে সে। বলা হয় তার চোখের জায়গায় কিছুই নেই। কেউ-কেউ ভয়ঙ্কর হাসির শব্দ শুনেই আর মহিলাকে দেখার সাহস না দেখিয়ে জান বাজি রেখে পালিয়ে এসেছেন।

এদিকে গাড়িতে লিফট চাওয়া এক তরুণীর কাহিনিও বেশ প্রচলিত সান জুয়ানে। যতদূর জানা যায় তিন যুবক এক গোরস্থানের কাছ থেকে অপরূপা এক মেয়েকে গাড়িতে তুলে নেয়। তারপর তাকে একটা পার্টিতে নিয়ে যায় তারা। ফেরার পথে মেয়েটি জানায় তার খুব শীত করছে। তখন যুবকদের একজন তার জ্যাকেট ধার দেয় মেয়েটিকে। তারপরই গোরস্থানের কাছে অদৃশ্য হয় মেয়েটি। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই জ্যাকেটটা পায় ছেলেরা। একটা সমাধিফলকের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে পরিপাটিভাবে। তারপরই তারা আবিষ্কার করে সমাধিটি মেয়েটি যে নাম বলেছে ওই নামের এক তরুণীর। কেউকেউ আবার দাবি করেছেন ওই সময় যুবকেরা একটা সদ্য খোঁড়া কবর খুঁজে পায়-যেখান একটা মৃতদেহ মাটি থেকে বের করে আংশিক খেয়ে গেছে কেউ। ধারণা করা হয় রাস্তা-ঘাটে গাড়িতে উঠতে চাওয়া এই নারীটি পিশাচীর মত কোনো প্রাণী, যার সত্যিকারের অস্তিত্ব আছে। এমনিতে পিশাচ হলো ফিলিপাইনের লোককাহিনির এক দানব, যে কিনা কবর খুঁড়ে মড়ার মাংস খায়।

অবশ্য কখনও আবার নারীর বদলে এক পুরুষকে দেখা যায় লিফট চাইতে। গন্তব্যে পৌঁছার পর লোকটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন তার দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে দেখা যায় একসময় এখানে ঠিকই থাকত সে, আর আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। সাধারণত যখন হাজির হয় দেখে মনে হয় কোনো দুর্ঘটনা থেকে কোনো মতে বেঁচে ফিরেছে সে, কাপড়-চোপড়ে লেগে থাকে রক্তের দাগ।

<

Super User