সাগর থেকে ফিরে
টম পটারকে সে অর্থে দুষ্ট ছেলে বলতে পারবেন না আপনি। কিন্তু সে দারুণ অস্থির, যেখানেই থাকবে একটা একটা না গোলমাল, ঠিক পাকাবে। কখনও কোনো পড়শির জানালা ভাঙতে চায় না সে। কিন্তু যখনই একটা বলে লাথি মারে কীভাবে না কীভাবে ওটা কাঁচের জানালার দিকেই ছুটে যায়।
ওহ, টম পটার! তোমাকে নিয়ে আমরা কী করব? লোকেরা বলে। টম কেবল দুষ্টুমি মাখা ঝকঝকে একটা হাসি দেয়। আর এটাই মন জয় করে নেয় সবার, মাফ পেতেও সময় লাগে না তার।
১৮৬০ সালের কথা। টমের বাবা নেই। কাজেই মা-ছেলে দুজনের ভরণপোষণের জন্য চাকরি করতে হয় টমের মাকে। এসময়ই হাওয়ার্ড নামের এক ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকরি হলো তাঁর। ইংল্যাণ্ডের গ্রিনউইচে বিশাল এক বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন মি. হাওয়ার্ড।
বাড়ির ওপরের তলার একটা কামরায় আপনি থাকতে পারেন, নতুন মালিক বললেন মিসেস পটারকে। আর টম যদি কাছের কোনো স্কুলে ভর্তি হয়, তবে সম্ভবত সে একটু স্থির হবে।
ধন্যবাদ, স্যর, খুশি হয়ে বললেন মিসেস পটার। টম আসলে চমৎকার একটা ছেলে। আমার মনে হয় স্কুলে সে ভাল করবে, আর আপনার অনুগ্রহের মর্যাদা দেবে।
টমের মাথা ভাল। সে দারুণ চটপটে আর বুদ্ধিমানও। স্কুলে তার দিনগুলো ভালই কাটতে লাগল। কখনও কখনও যে সে দুষ্টুমি করে না তা না, তবে ওই আগের মতই মাফও পেয়ে যায়।
টম যে স্কুলটাতে পড়ে সেটা চালায় একটা রোমান ক্যাথলিক এতিমখানা। এই এতিমখানাটার দায়িত্বে আছেন নরম মনের একজন পাদ্রী, ফাদার টড। শুরুতেই টমের সঙ্গে পাদ্রীর দারুণ ভাব হয়ে গেল। কয়েকটা বছর বেশ শান্তিতেই কাটল। টম পড়ালেখাও করছে মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আবার দুরন্তপনা পেয়ে বসল তাকে। টমকে বাগ মানানো রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়ল তার মার পক্ষে।
টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব? একদিন ফাদার টডের কাছে জানতে চাইলেন মি. হাওয়ার্ড।
টমের বয়স এখন চোদ্দ, পাদ্রী জবাব দিলেন। তাকে ভাল একটা কাজে লাগিয়ে দেওয়ার এটা চমৎকার সময়। দেখি কী করতে পারি।
অতএব কাজ করতে গেল টম। সুতির কাপড় বানায় ম্যনচেস্টারের এমন একটা বড় খামারে পাঠানো হলো তাকে। এখানে কিছু দিন আরামেই থাকল। তারপরই আবার অস্থিরতা পেয়ে বসল তাকে। মা আর ফাদার টডকে লিখে জানাল তার খুব ইচ্ছা সাগরে যাবে। এতটাই আবেগের সঙ্গে আর গুছিয়ে লিখল কথাগুলো, মনে-মনে আশঙ্কা চেপে বসলেও তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন তার মা আর ফাদার টড।
১৮৬৪ সালে উলউইচের একটা প্রশিক্ষণ জাহাজে চাকরি পেল টম। এখান থেকে তাকে পাঠানো হলো রাণীর একটা যুদ্ধ জাহাজে। প্রথম কিছু অভিযান দারুণ উপভোগ করল টম। তারপর আবার সক্রিয় হয়ে উঠল তার সেই অস্থির মন। নৌ বাহিনীর কড়া নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল সে। কয়েকজন বন্ধুসহ জাহাজ ছেড়ে পালাল। কঠিন পরিশ্রম আর নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল ছেলেরা। দুষ্টু বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তাদের। বোকার মত কিছু অঘটন ঘটাল। আর এগুলোই তাদের ঝামেলায় ফেলল।
একদিন টম হাজির হলো গ্রিনউইচে মি. হাওয়ার্ডের বাসায়। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়। প্রচণ্ড অসুস্থ সে। মার সেবায় যখন সুস্থ হয়ে উঠল তখনই জানা গেল জাহাজ থেকে পালানোর অপরাধে তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে।
মন ভেঙে গেল হতভাগী মার। টম, তোমাকে নিয়ে আমরা কী করব? হতাশায় কাঁদতে-কাঁদতে বললেন তিনি।
এদিকে এবার মি, হাওয়ার্ডেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। টমকে আর এখানে জায়গা দিতে নারাজ তিনি। মিসেস পটারকে বললেন, আমার মনে হয় ফাদার টডের পরমর্শ নেওয়া উচিত আপনার।
দয়ালু পাদ্রী কথা দিলেন এই বিপদ থেকে টমকে উদ্ধার করার জন্য তাঁর পক্ষে যতটুকু সম্ভব করবেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন আর নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাদের টমের, পক্ষ নিয়ে বুঝালেন তিনি। টম মন থেকে খারাপ ছেলে নয় মোটেই, বললেন পাদ্রী। আমি তাকে ভালমত চিনি। সে দুষ্ট স্বভাবের আর একটু স্বেচ্ছাচারী। কিন্তু আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ভালই করবে টম।
পাদ্রীর কথায় মন গলল নৌ কর্তাদের। টমকে আবার জাহাজে ফিরিয়ে নিতে আর তার শাস্তি হালকা করে দিতে রাজি হলেন তারা। এবার টমকে পাঠানো হলো পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগামী রণতরী ডরিসে।
তার চাকুরিদাতা আর পাদ্রী দুজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মিসেস পটারের মন। যখন খবর পলেন সব ঠিক আছে আর টম আবার সাগরে বেরিয়ে পড়েছে, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া এক মহিলায় রূপান্তরিত হলেন। এদিকে জন কুপার নামের এক লোক মি. হাওয়ার্ডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। একদিন তিনি টমের মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, ভদ্রমহিলাও রজি হয়ে গেলেন। যেদিন চাকরি ছাড়লেন, মি. হাওয়ার্ড করমর্দন করে বললেন, আপনি চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ায় এক দিক থেকে ভালই হলো। আপনাকে মিসেস কুপার বলে ডাকার অভ্যাস কখনওই করতে পারতাম না আমি। আশা করি সুখী হবেন। ওই দুরন্ত ছেলেও আর কখনও দুশ্চিন্তার কারণ হবে না আপনার।
টমের মার জায়গায় নতুন একটা মেয়ে কাজ নিল মি. হাওয়ার্ডের বাসায়, নাম মেরি স্নেইক।
কয়েক মাস পরের ঘটনা। তারিখটা ১৮৬৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। কেউ একজন মি. হাওয়ার্ডের বাড়ির সদর দরজার বেল বাজাল। মেরি স্লেইক গেল দরজা খুলতে। মিসেস হাওয়ার্ড ছিলেন উপরে তার বেডরুমে। দরজা খোলার শব্দ পেলেন, তারপরই কণ্ঠ শুনতে পেলেন। কথাবার্তা চলল অল্প কিছুক্ষণ, কিন্তু আগন্তুকের কণ্ঠটা কানে আসতেই কেমন যেন পরিচিত ঠেকল মিসেস হওয়ার্ডের।
আমি এটা চিনি, নিজেকে বললেন তিনি, হঁা, সন্দেহ নেই এটা টম পটারের কণ্ঠ।
দরজা বন্ধ হয়ে যেতে নীচে হলে দাঁড়ানো মেয়েটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছিল, মেরি?
ওপরে তার বেডরুমে উঠে এল মেরি। জাহাজে কাজ করা একটা ছেলে, ম্যাম। তার মাকে খুঁজছিল। আমি বলেছি তাঁকে আমি চিনি না, তারপর ছেলেটাকে চলে যেতে বলি।
সে দেখতে কেমন ছিল? চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হাওয়ার্ড।
পোশাক-আশাকে খুব ফিটফাট। তবে খালি পায়ে ছিল। আমি তাকে দেখলে আবার চিনতে পারব। তার মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল, চোখে-মুখে হতাশার একটা ছাপ ফুটে উঠেছিল।
সে কি কিছু বলেছে?
তেমন কিছু না, ম্যাম। যখন আমি তাকে বললাম তার মা এখানে নেই তখন কেবল মাথায় হাত রেখে বলল, এখন আমি কী করব?
ধন্যবাদ, মেরি। আবার ও আসলে আমাকে ডাক দিতে ভুল করবে না।
মি. হাওয়ার্ড বাড়ি ফিরলে দেরি না করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললেন তাঁর স্ত্রী। তারপর যোগ করলেন, আমার মনে হয় আবার জাহাজ থেকে পালিয়েছে সে।
মাথা ঝাঁকিয়ে মি.হাওয়ার্ড বললেন, টম পটারকে নিয়ে আমরা কী করব! কখনওই ঝামেলা ছাড়া থাকতে পারল না ছেলেটা।
ছেলেটা এভাবে বাড়ির দুয়ার থেকে ফিরে যাওয়াতে অপরাধবোধে ভুগছিলেন হাওয়ার্ডরা। তারা তাই টমের মার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ভদ্রমহিলার সঙ্গে টমের দেখা হয়েছে কিনা জানতে। যখন তিনি জানালেন টমের সঙ্গে অনেকদিন কোনো যোগাযোগ নেই, আরও হতাশ হয়ে পড়লেন তারা। সম্ভবত ছেলেটার কোনো ধারণাই নেই তার মা কোথায় আছে। আর এখন নিশ্চয় লণ্ডনের পথে-পথে ঘুরছে।
মি. হাওয়ার্ড ফাদার টডের সঙ্গে দেখা করলেন। ঘটনাটা শুনে অবাক হলেন তিনিও। টম আবার জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছে এটা বিশ্বাস হয় না আমার, ঘোষণা দিলেন তিনি। মাত্র মাস দুয়েক আগে ওর একটা চিঠি পেয়েছি। তখনও সেখানে চমৎকার ছিল সে। আমার মনে হয় আপনাদের বাড়িতে কাজ করা সেই মেয়েটা, মেরির সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার আমার। তাহলে নিশ্চিত হওয়া যেত আসলেই ছেলেটা টম পটারই ছিল কিনা।
আমি এখনই ওকে নিয়ে আসছি। বলে বেরিয়ে গেলেন মি. হাওয়ার্ড।
মেরি এসে পৌঁছতেই পাদ্রী তাকে ডজন খানেক ছেলের ছবি দেখালেন, যাদের মধ্যে টমও ছিল। তারপর বললেন, আমি দেখতে চাই সেদিন যে ছেলেটা এসেছিল তাকে তুমি এদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে পার কিনা।
একটু সময় তাকিয়েই একটা ছবি তুলে নিয়ে মেয়েটা বলল, এটাই সেই ছেলেটা। দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমি।
আর ছবিটা টম পটারেরই। অর্থাৎ এখন আর কোনো সন্দেহ রইল না সেদিনের সেই রহস্যময় আগন্তুক আর কেউ না টম পটার। তাহলে কোথায় গেল সে? কেন আর ফিরে এল না? আর যদি কেউ তাকে তার মায়ের ঠিকানা দিয়ে থাকে, তবে সে কেন সেখানে গেল না? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আর এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।
বেশ কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। তারপর অক্টোবরের এক দিনে নৌ সদরদপ্তর থেকে একটা চিঠি এল ফাদার টডের কাছে। খাম ছেড়ার সময় পাদ্রী মনে-মনে বললেন, সন্দেহ নেই টম পটারের খবর আছে। ছেলেটা এখন কোথায় আছে?
চিঠিটা পড়তে-পড়তে হাঁফাতে লাগলেন পাদ্রী, চেহারাটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে তাঁর। তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।
ভাগ্য ভাল তিনি যখন পৌঁছলেন তখনও বেরিয়ে পড়েননি মি. হাওয়ার্ড। মিসেস হাওয়ার্ড আর মেরিকে ডেকে আনা হলো। তারপর চারজন জড় হলেন বাড়ির স্টাডিতে।
আপনারা কি প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করেন? হঠাৎই জানতে চাইলেন পাদ্রী।
চমকে উঠলেন তাঁরা। তারপরই মি. হাওয়ার্ড বলে উঠলেন, না, প্রশ্নই ওঠে না। আপনি কেন এটা জিজ্ঞেস করছেন?
তাঁর কথায় কান না দিয়ে পাদ্রী জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস হাওয়ার্ড, আপনি?
স্বামীর দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিলেন ভদ্রমহিলা, আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি। তবে তবে ওরা থাকতেই পারে।
সবশেষে মেরির দিকে তাকালেন পাদ্রী, আর তুমি, মেরি? হ্যাঁ। সোজাসাপ্টা জবাব দিল মেয়েটা।
তাহলে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হবে না, যদি আমি বলি একটা প্রেতাত্মার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে।
স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল মেয়েটা। মি. হাওয়ার্ড এবার পাদ্রীর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?
টম পটার কবে এসেছিল এখানে? জিজ্ঞেস করলেন পাদ্রী।
ওটা ছিল সেপ্টেম্বরের আট তারিখ। জবাব দিলেন মিসেস হওয়ার্ড।
এর দু-দিন আগেই জ্যামাইকায় মারা গেছে টম।
মি. হাওয়ার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর স্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, আর মেরি কাঁদতে শুরু করল।
পাদ্রী নৌ দপ্তরের চিঠিটা নাড়িয়ে বললেন, চিঠিতে বলা হয়েছে, রণতরী ডরিসে বড় রকমের একটা দুর্ঘটনায় পড়ে টম। সেটা ছিল ১৮৬৬ সালের ২৪ জুলাই। এতে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয় ছেলেটা। কয়েকটা সপ্তাহ যমে-মানুষে টানাটানি হয় তাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ মারা যায়। মারা যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেও মাকে দেখতে চাচ্ছিল সে। তারপর সবাইকে এটা হজম করার একটু সময় দিয়ে ফাদার টম আবার বলতে শুরু করলেন, এই বাড়িতেই টম তার মাকে শেষ দেখেছে। আর এই কারণেই টমের প্রেতাত্মা এখানে আসার আকর্ষণ অনুভব করেছে। একটা আত্মা কেবল সেসব ঘটনা জানে যা সে জীবদ্দশায় জানত। বেঁচে থাকা অবস্থায় সে কখনওই জানত না তার মা বাসা বদল করেছে। আর তাই এখানে ফিরে এসেছে, প্রিয় মাকে শেষবারের মত দেখবার জন্য…
ফাদার টম কথা বলা বন্ধ করতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল গোটা কামরাটা। তারপর শোনা গেল মেরির কান্নার শব্দ। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। কাঁদতে-কাঁদতেই সে বলল, আমিই নাবিক ছেলেটার হতভাগ্য আত্মাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে কেবল তার মাকে খুঁজছিল। ইস, আমি যদি জানতাম…
<