বানশি (প্রথম পর্ব)

আয়ারল্যাণ্ডের সব ধরনের ভূত, প্রেত, পেত্নীর মধ্যে সাধারণ লোকেদের কাছ সবচেয়ে পরিচিত বানশি। কখনও কখনও একে বহিস্থা কিংবা বানকিস্থা নামেও ডাকা হয়। বানশি এখানকার লোকদের দেখা দিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। তবে তার ইতিহাস কতটা প্রাচীন এটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন।

বানশির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো সে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে। তবে তার এই মৃত্যুসংকেত দেওয়ার রীতি আগের জমানা থেকে এখন বদলেছে। পুরানো দিনে আইরিশ গল্পে মানুষের মাথাঅঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা রক্তরঞ্জিত পোশাক ধুতে দেখা যেত বানশিকে। যতক্ষণ না পানি পুরোপুরি রক্তে লাল হয়ে যেত ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধোয়াধুয়ি চলত। তবে ইদানিং কালে সাধারণত চিল্কার করতে করতে হাত আঁকিয়ে বা তালি দিয়ে মৃত্যুর বার্তা দেয় বানশি।

এদিকে তার পোশাক-আশাক আর চেহারার নানান ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনও কখনও সে তরুণী, সুন্দরী। কখনও আবার বুড়ো, কদাকার। একজন লেখক যেমন তার বর্ণনা দিয়েছেন, লম্বা, কৃশ এক নারী। যার মাথার খোলা লম্বা চুল নেমে এসেছে কাঁধের চরপাশে। পরনে সাদা আলখেল্লা। সেই সঙ্গে আছে কাপা, টানা চিৎকার। আবার এক কোচোয়ান তাকে এক সন্ধ্যায় একটা বাড়ির আঙিনায় বসে থাকতে দেখেছে। তরে তখন সে নীল চোখের ছোটখাট এক মহিলা। ঘাড় বেয়ে নেমে এসেছে লম্বা পাতলা চুল। আর পরনে লাল আলখেল্লা। তবে এখন যে কাহিনিগুলো আমরা পাঠকদের শোনাব তাতে মিলবে তার আরও নানান ধরনের বর্ণনা।

পুরানো আর বিখ্যাত বানশি কাহিনিগুলোর একটি পাওয়া যায় লেডি ফানশর স্মৃতিকথায়। ১৬৪২ সালে স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে এক ব্যারন বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান তিনি। পরিখা ঘেরা পুরানো ধরনের একটা দুর্গবাড়িতে থাকেন ভদ্রলোক। রাতে কলজে চরা, অতিপ্রাকৃত একটা চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল লেডি ফানশর। বিছানা থেকে তাকাতেই জানালার ওপাশে একটি নারীর মুখ আর শরীরের কিছু অংশ ভাসতে দেখলেন, চাঁদের আলোয়। মাটি থেকে জায়গাটার উচ্চতা আর পরিখার উপস্থিতি বলে দিল, তাঁর দেখা এই চেহারাটা মোটেই এই পৃথিবীর কারও নয়। মুখটা তরুণী, সুন্দর চেহারার এক নারীর। তবে বড় ফ্যাকাসে, লালচে চুলগুলো আলুথালু। আতংকে ফানশ ওটার পরনের পোশাক খুঁটিয়ে খেয়াল করলেন না। তবে পুরানো, আইরিশ পোশাক মনে হলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই ঝুলে থাকল নারীমূর্তিটা। তারপর শুরুতে যেমন চিৎকারে লেডি ফানশর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সেরকম দুটো তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে অদৃশ্য হল।

সকালে আতংকে প্রায় কাঁপতে-কাঁপতে গৃহকর্তাকে কী দেখেছেন তা খুলে বললেন। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক তাঁর কথা পুরোপুরি মেনে নিলেন। শুধু তাই না, এর ব্যাখ্যা হিসাবে নিজের পরিবারের অবিশ্বাস্য এক কাহিনি শোনালেন।

আমার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় গত রাতে এই দুর্গে মারা গেছেন, বললেন তিনি। এমনটা ঘটতে পারে এটা জানা সত্ত্বেও আপনার কাছে এটা গোপন করেছিলাম। কারণ মনে হয়েছে আপনি যে হাসি-আনন্দে মেতে থাকার জন্য এখানে এসেছেন, তাতে এটা কালো ছায়া ফেলতে পারে। আমাদের পরিবারে কিংবা দুর্গে কারও মৃত্যুর আগে সবসময়ই আপনি যাকে দেখেছেন সেই নারী মূর্তিটি দেখা দেয়। ধারণা করা হয় নিম্নগোত্রের একজন মহিলার আত্মা সে। আমার এক পূর্বপুরুষ জাত-পাতের বাইরে গিয়ে তাকে বিয়ে করেন। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। আর পরিবারের প্রতি যে অসম্মান করেছেন তা ঢাকতে স্ত্রীকে পরিখায় ফেলে মারেন। এর পর থেকেই এই মহিলা বানশি হয়ে দেখা দেওয়া শুরু করেন।

বানশির পরের যে কাহিনিটি বলব সেটি পাঠিয়েছেন টি.জে.ওয়েস্ট্রপ। চলুন, তবে সরাসরি গল্পতে চলে যাওয়া যাক।

আমার নানী এটা শোনেন তাঁর মা রস-লিউইনের কাছ থেকে, যিনি নিজেই ছিলেন ঘটনাটির সাক্ষী। তাদের বাবা মি. হ্যারিসন রস-লিউইন আইন ব্যবসার কাজে তখন ডাবলিনের বাইরে গিয়েছেন। তাঁর অবর্তমানে বাড়ির ছেলে-মেয়েরা কয়েক মাইল দূরে বাস করা এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান।

সেটি ছিল চমৎকার একটি রাত। চঁদের আলোও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। তবে কিলক্রিস্টের পুরানো গির্জাটার পশ্চিমে গাছপালা আর ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যখন এগিয়েছে তখন রাস্তাটার বেশ একটা অংশে অন্ধকারের রাজত্ব। গির্জাটা পুরানো দিনের ধবংসপ্রাপ্ত অন্য অট্টালিকাগুলোর মতই আয়তাকার একটা অট্টালিকা। চারপাশে লম্বা পাঁচিল। তবে এই মুহূর্তে পাঁচিল ভেঙে-চুরে যাওয়ায় গির্জা আর এর ধারের সমাধি দুটোই উন্মুক্ত। লম্বা, অন্ধকার পথটা ধরে যাবার সময় দূর থেকে তীক্ষ্ণ কান্না আর হাততালির শব্দ শুনতে পেলেন তারা। সাধারণত মৃত্যুর সময় আয়ারল্যাণ্ডবাসীরা এভাবে শোক করে। দ্রুত এগিয়ে গির্জার কাছে চলে এলেন তাঁরা। এখানে এসেই চমকে উঠলেন। গির্জার পাঁচিলের ওপর ধূসর চুলের ছোট্ট একজন মহিলা, যার পরনে গাঢ় একটা আলখেল্লা, দৌড়াদৌড়ি করছে। আর চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে হাত ছুঁড়ছে। মেয়েরা ভয় পেয়ে গেলেন। তবে ছেলেরা সামনে এগিয়ে গেলেন, তাদের দুজন গির্জার সীমানায় ঢুকে পড়লেন। তবে তখনই নারীমূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেল। চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারও হদিস পেলেন না তাঁরা। ইতোমধ্যে অজানা একটা ভয় চেপে ধরেছে সবাইকে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ির দিকে ছুটলেন। বাড়িতে পৌঁছতেই তাদের মা দরজা খুললেন। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার চেহারা। আতংকিত কণ্ঠে বললেন স্বামীর জন্য ভয় পাচ্ছেন তিনি। কারণ চাঁদের আলোয় জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছেন এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে। আগুনে চোখের বিশাল একটা কাক এসে জানালার চৌকাঠের ওপর বসে পর পর তিনবার কাঁচে ঠকঠক শব্দে টোকা দিয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতাটা মাকে বললে ভদ্রমহিলা আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এসময়ই আবার কাছের জানালাটায় ট্যাপ ট্যাপ শব্দ হলো। তাকাতেই তাঁরা দেখলেন পাখিটা ফিরে এসেছে। কয়েক দিন পরে তাঁরা খবর পেলেন, মি. রস-লিউইন ডাবলিনে মারা গিয়েছেন। এটা ছিল ১৭৭৬ সাল।

 

এবারের অভিজ্ঞতাটি একজন রোমান ক্যাথলিক বিশপের বোনের। তাঁর কিশোরী বয়সের ঘটনা এটি। এক সন্ধ্যায় আরও কিছু ছেলে-মেয়ের সঙ্গে হাঁটতে বের হন তিনি। রাস্তা ধরে হাঁটতে-হাঁটতে একটা বাড়ির গেট অতিক্রম করে গেলেন। রাস্তার ধারেই বিশাল একটা পাথর আছে এই জায়গাটায়। পাথরটার ওপর কিছু একটাকে বসে থাকতে দেখলেন তারা। কাছাকাছি হতেই ছোট্ট, গাঢ় পোশাকের একজন বুড়ো মহিলা বলে চিনতে পারলেন ওটাকে। হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করল সে, আর হাততালি দিচ্ছে। সাহসী দু-একজন মহিলাটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে উল্টো ঘাবড়ে গেলেন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব ওখান থেকে কেটে পড়লেন সবাই। পরদিন জানা গেল যে বাড়ির সামনে নারী মূর্তিটিকে কাঁদতে দেখা গেছে সেই বাড়ির কর্তা মারা গিয়েছেন। শুধু তাই না তিনি মারা গেছেন ওই সময় যখন মহিলাটিকে দেখেছে ছেলে-মেয়েরা।

<

Super User