ওই লোক দুজনকে কীভাবে বোকা বানালাম তা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করলাম আমরা। ওরা কুড়ি ডলারের যে-দুটো গিনি দিয়ে গেছে, তা নিয়েও আলাপ করলাম।

স্টিমারের টিকিট কাটার পরও বেশকিছু পয়সা আমাদের হাতে থাকবে, জিম বলল। ওই টাকা দিয়ে যেখানে নিগ্রোদের স্বাধীনতা আছে, স্বচ্ছন্দে সেখানে যেতে পারব আমরা।

ভোর হতেই নদীর পাড়ে একটা ঝোপের ভেতর ভেলাটাকে লুকিয়ে রাখলাম আমরা। জিম জিনিসপত্র গোছগাছে তৎপর হয়ে উঠল, যাতে কায়রোতে পৌঁছামাত্র সটকে পড়া যায়।

সেই রাতে, প্রায় দশটার দিকে, দূরে একটা বড় শহরের বাতি চোখে পড়ল। ওটাই কায়রো কি-না জানার জন্যে ডিঙি নিয়ে রওনা হলাম আমি। অল্প দূরে যেতেই একজন লোকের সাথে দেখা হল। নদীতে মাছ ধরছে লোকটা।

ভাই, ওই শহরটাই কি কায়রো?

কায়রো? না। তুমি একটা আস্ত গবেট।

তবে ওটা কোন্ শহর?

ইচ্ছে হয় জেনে আস গিয়ে। এখানে ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না।

ভেলায় ফিরে এলাম আমি। জিম হতাশায় মুষড়ে পড়ল। ওকে উৎসাহ দেবার জন্যে বললাম, কুছপরোয়া নেই, জিম। দেখ, ঠিক এর পরের শহরটাই হবে কায়রো।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে আরও একটা শহর পেরিয়ে এলাম আমরা। আমি ডিঙি নিয়ে দেখে আসতে চাইছিলাম, কিন্তু জিম মানা করল। বলল, শহরটা কায়রো নয়, কারণ ওটা পাহাড়ি এলাকা। কায়রোয় পাহাড় নেই। আমরা তীর ঘেঁষে একটা বাঁকের মুখে সারাদিন শুয়ে কাটালাম। একটা সন্দেহ কাঁটার মত খচখচ করছে আমার মনে।

সেই রাতে আমরা বোধহয় কায়রো ছেড়ে এসেছি, বললাম আমি। কুয়াশার মাঝে ঠাহর করতে পারিনি।

 

এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ো না, হাক, কান্না জড়ান গলায় বলল জিম। হতভাগ্য নিগ্রোদের কপাল কখনও ভাল হয় না। এসব ওই সাপের চামড়া ধরার ফল। আরও দুঃখ আমাদের কপালে আছে।

জিমের কথাই ঠিক। সকাল হতেই দেখলাম আমরা সত্যি সত্যি কায়রো ফেলে এসেছি। ওহাইয়ো নদীর স্বচ্ছ পানিতে আমাদের ভেলা ভাসছে। এখন উপায়? তীরে যাবার উপায় নেই, জিমের বিপদ হবে। আবার ভেলা নিয়ে যে উজান ঠেলে পেছনে যাব, তেমন সাধ্যও আমাদের নেই। সবচেয়ে ভাল উপায় হল রাতের আঁধারে ডিঙিতে চেপে কায়রো যাবার চেষ্টা করা। তাই, সন্ধে অবধি তুলোঝোপের ভেতর ঘুমিয়ে রইলাম আমরা। রাত ঘনাতেই ভেলায় ফিরে গেলাম। কিন্তু একি! ডিঙিটা নেই, কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।

কোন কথা সরল না আমাদের মুখে। এ নির্ঘাত সেই সাপের চামড়ার কারসাজি। আমরা ঠিক করলাম ভেলা নিয়ে আরও কিছুটা আগে বেড়ে একটা ডিঙি কেনার চেষ্টা করব। মালিকবিহীন নৌকো ধার নেয়ার যে-কায়দা বাবার কাছে শিখেছি, সেটা এক্ষেত্রে নিরাপদ মনে হল না। কারণ তাতে পেছনে লোক লেলিয়ে দেবে ওরা।

অন্ধকার নামার পর রওনা হলাম। যতটা সম্ভব তীর ঘেঁষে চলেছি, কারণ নৌকো বিনিকিনি ওখানেই হয়। কিন্তু ঘণ্টা তিনেক চলার পরও কোথাও কোন ডিঙি চোখে পড়ল না। এদিকে ঘন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে, এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। চারিপাশে কেমন যেন গা ছমছমে ধূসর অন্ধকার। থমথমে পরিবেশ।

হঠাৎ আমাদের কাছেই একটা স্টিমারের শব্দ পেলাম। তাড়াতাড়ি একটা লণ্ঠন জ্বাললাম, যাতে স্টিমার-চালক দেখতে পায় আমরা কোথায় আছি। যেসব বড় নৌকো বা জাহাজ উজানে যায়, তারা সাধারণত ছোটখাট নৌকো বা ভেলার কাছাকাছি আসে না-বালির চড়া ধরে মরা স্রোত দিয়ে এগিয়ে যায়। তবে এরকম রাতে অনেক সময় ভুল করে সোজাসুজি চলে আসে বড় নৌকো বা জাহাজগুলো।

প্রচণ্ড বেগে পানি ভাঙার শব্দ এগিয়ে আসছে। এই স্টিমারগুলো প্রায়ই এরকম করে; দেখতে চায়, ধাক্কা না দিয়ে কতটা কাছ ঘেঁষে যাওয়া যায়। অনেকসময় ভেলার গায়ে প্রায় দাঁত বসিয়ে চলে যায় প্রপেলার। আর সারেং বেটা মাথা বার করে হাসতে থাকে যেন খুব বাহাদুরির কাজ করেছে একখানা।

দেখতে দেখতে স্টিমারটা আমাদের ঘাড়ের ওপর উঠে এল। যেন অসংখ্য জোনাকি-ঘেরা একখানা মেঘ আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল হঠাৎ—ভাটার মত জ্বলছে ফার্নেস। জিম আর আমি ঝাঁপ দিলাম পানিতে। ভেলা চুরমার করে এগিয়ে গেল স্টিমার।

প্রপেলারের ধাক্কা এড়াতে গভীর পানিতে ডুব দিলাম আমি। প্রায় দেড় মিনিট পর যখন দম নিতে ভেসে উঠলাম, স্টিমারটা বহু দূরে চলে গেছে। সামান্য ভেলাওয়ালাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না ওরা। চেঁচিয়ে জিমকে ডাকলাম বারকয়েক, সাড়া পেলাম না। আমার পাশ দিয়েই একটা ভাঙা তক্তা ভেসে যাচ্ছিল। তক্তাটাতে ভর দিয়ে প্রায় দুমাইল সাঁতরে পাড়ে এসে উঠলাম। পাথুরে এবড়োথেবড়ো জমির ওপর দিয়ে সিকি মাইল যাবার পর একটা পুরোনো ঢঙের কাঠের দোতলা খামারবাড়ির সামনে এসে পড়লাম। দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ার তাল করলাম, কিন্তু আচমকা কয়েকটা কুকুর ভেতর থেকে ধেয়ে এল। আর এক পাও এগোনর সাহস পেলাম না আমি।

জানলা দিয়ে হেঁড়ে গলায় একজন লোক জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে?

আমি, স্যার, জবাব দিলাম।

বলি আমিটা কে?

জর্জ জ্যাকসন, স্যার।

এত রাতে কী চাই?

কিছু না, স্যার। আমি চলে যাব, কিন্তু কুকুরগুলো যেতে দিচ্ছে না।

এখানে ঘুরঘুর করছ কেন?

কই? না, স্যার। স্টিমার থেকে নদীতে পড়ে গিয়েছিলাম আমি।

অ! পড়ে গিয়েছিলে? আচ্ছা। অ্যাই, কে আছিস, আলোটা জ্বালা তো দেখি। তোমার নামটা যেন কী বললে?

জর্জ জ্যাকসন, স্যার। বাচ্চা ছেলে।

সত্যি বলে থাকলে কোন ভয় নেই তোমার। কেউ তোমাকে মারবে না। নড়ো না তুমি, যেখানে আছ, সেখানেই থাক। অ্যাই, বব আর টমকে জাগিয়ে দে। আমার বন্দুকটা নিয়ে আয়। তা, জর্জ জ্যাকসন, আর কেউ আছে নাকি তোমার সাথে?

না, স্যার, নেই।

বাড়িটা সরগরম হয়ে উঠেছে, যেন ডাকাত পড়েছে। একটা বাতি জ্বলে উঠল। জানলায় দাঁড়ান লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, বাতিটা সরাও, বেটসি। এখনও তুমি সেই বোকার হদ্দই রয়ে গেলে দেখছি। দরজার পেছনে মেঝের ওপর রাখ। বব, তুমি টমকে নিয়ে পজিশন নাও।

নিয়েছি।

আচ্ছা, জর্জ জ্যাকসন, বলল জানলায় দাঁড়ান লোকটা, শেফার্ডসন পরিবারের কাউকে চেন তুমি?

নামই শুনিনি কস্মিনকালে।

বেশ। এবার তুমি ভেতরে এস। তাড়াহুঁড়ো করবে না, ধীরেসুস্থে এস। সাথে কেউ থাকলে বাইরেই রেখে আস। ভেতরে আসার চেষ্টা করলে গুলি খাবে সে।

লাগামটানা ঘোড়ার মত এগিয়ে গেলাম। বুকের ধুকপুক ছাড়া কোন শব্দ কানে যাচ্ছে না আমার। কুকুরগুলো ছায়ার মত অনুসরণ করছে। দোরগোড়ায় পৌঁছুতেই ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেলাম। ধীরে ধীরে দরজাটা ফাঁক করলাম একটু।

ঢের হয়েছে, ভেতর থেকে বলল একজন, এবার মাথা গলিয়ে দাও।

তা-ই করলাম আমি। কাঁপছি, প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছে এই বুঝি আমার খুলি উড়ে গেল। চৌকাঠের সামনেই একটা মোমবাতি জ্বলছে। দশাসই চেহারার তিনজন লোক বন্দুক তাক করে আছে আমার দিকে। ওদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বড়, তার বয়েস প্রায় ষাট। পাকা চুল। বাকি দুজনের তিরিশ কিংবা তার কিছু বেশি হবে। প্রত্যেকেই দেখতে বেশ সুন্দর, ছিমছাম। ওদের ঠিক পেছনেই একজন বয়স্কা মহিলা দাড়িয়ে। মিষ্টি চেহারা। তার দুপাশে দুজন সুন্দরী যুবতী।

এস, ভেতরে এস, বললেন বুড়ো ভদ্রলোক।

আমি ঢোকামাত্র দরজা বন্ধ করে দিল ওরা। তারপর আমাকে নিয়ে বিশাল ড্রইংরুমে গিয়ে বসল। মেঝেতে ছেঁড়া শতরঞ্চি পাতা। লক্ষ্য করলাম, জানলা থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসেছে সবাই। মোমের আলোয় আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ওরা।

না, এ শেফার্ডসনদের কেউ নয়, একবাক্যে রায় দিল সবাই। পরক্ষণেই সহজ হয়ে এল ওদের ব্যবহার।

এটাকে নিজের বাড়ি মনে কর, বললেন বৃদ্ধ। সব খুলে বল আমাদের।

এত তাড়াহুঁড়োর কী আছে, স্যল, বললেন বৃদ্ধা। দেখছ না, ভিজে ঝোড়ো কাকের মত হাল হয়েছে বেচারার। খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়ই।

তাই তো, র্যাচেল। ভুলেই গিয়েছিলাম আমি।

এই সময়ে আমার সমবয়সী একটা ছেলে এসে ঢুকল ঘরে। ঘুম তাড়াবার জন্যে এক হাত দিয়ে চোখ কচলাচ্ছে, আরেক হাতে পিস্তল।

বাক, বললেন বৃদ্ধা, এই ছেলেকে নিয়ে যা। তোর কোন শুকনো কাপড় পরতে দে ওকে।

ঘাড় কাত করল বাক। ঘুম জড়ান চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, শেফার্ডসনদের কেউ আসেনি আজকে?

না, ওকে বললেন বৃদ্ধ।

আমাকে দোতলায় ওর ঘরে নিয়ে গেল বাক। ওর কাপড় বার করে পরতে দিল।

কদ্দিন থাকবে এখানে? প্রশ্ন করল ও। এবার খুব মজা করা যাবে। পরীক্ষা শেষ, স্কুলে লম্বা ছুটি।

কাপড় বদলান সারা হলে আমাকে নিচে নিয়ে গেল ও। সেখানে আমার জন্যে খাবার নিয়ে বসে ছিল ওরা। ভুট্টার রুটি, মাংস, মাখন আর ঘোল খেলাম। এত মজাদার জিনিসের স্বাদ এর আগে পাইনি কখনও। খিদেয় নাড়িভুড়ি চোঁ চোঁ করছিল, নেকড়ের মত সব চেটেপুটে খেলাম।

খাওয়ার পর শুরু হল জেরা। বললাম, আরকান-সয়ের দক্ষিণে থাকত আমাদের পরিবারের সবাই। সেখানে একটা গোলাবাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা। আমার বোন, মেরি অ্যান, পালিয়ে বিয়ে করেছে। বহুদিন বোনের কোন খবর না পেয়ে বিল বেরিয়েছে তার খোঁজে। সেই থেকে সে-ও লাপাত্তা। দিনকয়েক আগে বাবা এবং আমার আর দুভাই টম আর মেট মারা গেছে। অগত্যা সামান্য যা সম্বল ছিল, তা-ই নিয়ে জাহাজে চেপে কাজের খোঁজে বেরিয়েছিলাম। পথে নদীতে পড়ে যাওয়ায় এখানে এসেছি।

আমার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে দয়া হল ওদের মনে। বাছা, স্নেহার্দ্র গলায় বললেন বৃদ্ধা, তোমার যদ্দিন খুশি থাক এখানে।

ইতিমধ্যে প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, আমরা সবাই শুতে গেলাম। বাকের ঘরে একটা বাড়তি বিছানায় জায়গা হল আমার। শোয়র সঙ্গে সঙ্গে কাটা গাছের গুঁড়ির মত ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙতে খেয়াল হল, আমার নাম মনে করতে পারছি না। পাশ ফিরে বাককে জিজ্ঞেস করলাম, বাক, বানান করতে পার তুমি?

হ্যাঁ, বলল ও। আমি বাজি ধরে বলতে পারি আমার নামের বানান পারবে না তুমি।

পারব। বাজি?

বেশ।

জি-ই-ও-আর-জি-ই, জর্জ। জে-এ-এক্স-ও-এন, জ্যাকসন।

ঠিক, বললাম আমি। মনে মনে শপথ করলাম আর কিছুতেই নামটা ভুলব না। গোপনে লিখে রাখলাম বানানটা। বলা যায় না, কেউ হয়ত আমাকেই বানান করতে বলে বসবে।

<

Mark Twain ।। মার্ক টোয়েন