ঘোড়ার কাছে পৌঁছতেই যেন অনন্তকাল লেগে গেল ওর। সেখান থেকে যে কোথায় কোথায় ঘুরেছে আবছা ভাবে কিছু কিছু মনে পড়ছে তার। ভোরের বেলা জুলিয়াস দেখল ইডেন নদীর ধারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলছে সে। রকিং এইচ থেকে জায়গাটা মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার। ক্রেস্টলাইনের দিকে রওনা হতে পারে সে, কিন্তু এতটা পথ পেরিয়ে ওখানে পৌঁছতে পারবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া এতক্ষণে হয়তো মেডকের লোকজন তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। পশ্চিমে গিয়ে, পাহাড়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাতেও ঝুঁকি অনেক। শেষ পর্যন্ত কলিন গেইলের খামারেই যাবে বলে ঠিক করল জুলিয়াস।

নদী পার হয়ে কোনাকুনি ভাবে কলিনের র‍্যাঞ্চের দিকেই রওনা হলো সে। এবারে জিনার কথা মনে পড়ল ওর। জুলিয়াসকে কি চোখে দেখবে জিনা? ওর সাথে দেখা হওয়া দরকার, কয়েকদিন ভেবেছে সে। কিন্তু সুযোগ আসেনি। হয়তো ওর সাথে কথা বলেও লাভ হবে না আর। ওর বিশ্বাসই হতে চায় না-এই কিছুদিন আগেও জিনার সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখন দু’জনার মাঝে গড়ে উঠেছে একটা দুর্ভেদ্য দেয়াল।

জুলিয়াস যখন কলিনদের উঠানে পৌঁছল তখন সূর্য সবেমাত্র উঠেছে। ঘোড়া থেকে নামার আগেই কলিন বেরিয়ে এল। ওকে চিনতে পেরে সাদর সম্ভাষণ জানাল সে। আর একবার ভাল করে জুলিয়াসের দিকে চেয়েই উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কলিন, কি হয়েছে, জুলিয়াস? তোমার একি…

কথা শেষ না করেই ছুটে এগিয়ে এসে জুলিয়াসকে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল সে।

রাতটা দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে কেটেছে, শুকনো মুখে মন্তব্য করল জুলিয়াস।

তোমার এই অবস্থা কে করল?

মাডি লরিমার।

ঝাল লাগার ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে শব্দ করে বাতাস টানল কলিন। মাডি, না? ওতো একাই ছয়জনের সমান ভিতরে চলো, দেখি কি করা যায়।

ওরা আমার পিছনে ধাওয়া করে আসতে পারে।

মেডক?

সাথে আরও লোকজন থাকবে ওর।

মুখ তুলে রকিং এইচে যাবার পথের দিকে চাইল কলিম। ওর ঠোঁট দুটো একটা দৃঢ় সঙ্কল্পে পরস্পরের ওপর চেপে বসেছে। এটা আমার বাড়ি। আর কারও মাতব্বরি চলবে না এখানে ঢুকতে হলে আগে আমার সাথে বোঝাপড়া করতে হবে। মনে হয় না ওরা সে চেষ্টা করবে। চলো, ভিতরে যাই।

হিলডা বারান্দায় বেরিয়ে এল। ওদের একনজর দেখে নিয়েই ভিতরে জিনার উদ্দেশে কি যেন বলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল। পরমুহূর্তেই জিনাকে দেখা গেল দরজায়। ভীত-সন্ত্রস্ত ভাব ওর চোখে-মুখে।

ওকে জনের কামরায় নিয়ে যাই, চলো, বলল হিলডা।

কি যেন বলার জন্যে মুখ খুলল জিনা, কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে বলল না সে। সবার আগে আগে গিয়ে জনের কামরার দরজা খুলে বিছানা ঢাকা চাদরটা উঠিয়ে নিল জিনা। জুলিয়াসকে ধরে বিছানার ওপর বসিয়ে দিল কলিন।

আমি পানি গরম করতে যাচ্ছি, বলল হিলডা। কলিন, তুমি ওর মোজা আর কাপড়-জামা খুলে দাও-ধুতে হবে। ড্রয়ারে জনের ধোয়া কাপড় আছে, সেগুলোই আপাতত পরাও ওকে। তোমার জামা ওর গায়ে ছোট হবে।

ড্রয়ার থেকে কাপড় বের করে বিছানার ওপর রাখল জিনা। হাত কাঁপছে ওর। দুর্বল গলায় সে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছিল, জুলিয়াস?

পেপির সাথে দেখা করতে খামারে গেছিলাম-ফেরার পথে ওদের হাতে ধরা পড়ে যাই।

বাবার সাথে দেখা করতে চাওনি তুমি?

না।

জারভিস বলছিল তুমি বাবার সাথে দেখা করে সম্পত্তির ভাগ আদায় করার চেষ্টা করবে।

না, জিনা।

তাহলে পেপির সাথে দেখা করার কি দরকার ছিল তোমার?

এতক্ষণ জুলিয়াসের বুট খোলায় ব্যস্ত ছিল কলিন। সে এবার সোজা হয়ে দাড়াল, আর বকবক কোরো না, জিনা, এবার যাও। জুলিয়াসের কাপড় বদলাব আমি এখন।

ঠোঁট কামড়ে ধরে দরজার দিকে এগোল জিনা। বেরুবার মুখে হঠাৎ ঘুরে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা, রকিং এইচের লোক যদি জুলিয়াসের পিছনে ধাওয়া করে এসে এখানে হাজির হয়, তখন?

ওরা এলে ওদের আবার খালি হাতেই ফিরে যেতে হবে, রুক্ষ গলায় জবাব দিল কলিন। আর কোন কথা নয়, এবার যাও।

শরীরের সবখানেই কমবেশি কেটে-ছিলে গেছে জুলিয়াসের এ নিয়ে দুর্ভাবনা নেই তার, সে জানে সময়ে সবই সেরে যাবে-শুধু পাঁজরের ব্যথাটা নিয়েই চিন্তা। হয়তো পাজরের কোন হাড় ভেঙে থাকতে পারে। তাছাড়া হাতের গাটগুলো কেটে রক্ত জমে আড়ষ্ট হয়ে গেছে, কয়েক সপ্তাহেও তার হাত দুটো ঠিক হবে কিনা সন্দেহ। পশ্চিমের লোকেরা হাত ছাড়া নিতান্তই তাহার

যথাসাধ্য চেষ্টা করছে হিলডা। ক্ষত পরিষ্কার করে মলম লাগানো, পা গরম করে বাইক্লোরাইড ট্যাবলেট মিশিয়ে জুলিয়ানের হাত দুটো ভিজিয়ে রাখা-সবই করছে সে। জিনাও নীরবে সাহায্য করে যাচ্ছে। সব সময় ওর মুখ থাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আর শুকনো। এই জিনা আর জনের মৃত্যুর আগের জিনা যেন ভিন্ন মানুষ। জিনাকে ইদানীং প্রাণখুলে হাসতে দেখেনি জুলিয়াস।

পানিতে হাত দুটো ডুবিয়ে বসে আছে জুলিয়াস। বাইরে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেল। জিনা উঠে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে, ওরা এসে গেছে, বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

তুমি নিশ্চিন্ত মনে হাতের যত্ন নাও, বলল হিলডা। চিন্তার কিছু নেই, কলিনই ওদের সামলাবে।

ওরা কয়জন এসেছে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।

উঠে, জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল হিলডা। মেডক আর জারভিস। সাথে এডমন্ড ফিনলে, নকার, হোয়েল কিড আর হিউ হাপার। জানালাটা খুলেই দিচ্ছি। আমি।

খোলা জানালা দিয়ে ওদের কথাবার্তা, শোনা যাচ্ছে। মেডক বলছে, ‘…এই হলো অবস্থা, গেইল। জুলিয়াস রকিং এইচে এসে গোলমাল করুক এটা আমরা চাই না। বিশেষ করে সেবাস্টিন দত্তের যা শারীরিক অবস্থা তাতে এসব ঝামেলা না হওয়াই ভাল। তাই আমরা এসেছি জুলিয়াসকে ধরে নিয়ে জেলে আটকে রাখব।

সেটা আজ হবে না, জবাব দিল কলিন।

কেন হবে না?

জুলিয়াসের কোথাও যাবার মত অবস্থা এখন নেই। তোমার লোকই তো ওর এই দশা করেছে। তোমার আর ওর বিরুদ্ধে কোন নালিশ থাকা উচিত নয়। অনেক চোট পেয়েছে বেচারা।

মিথ্যে কথা! লোক দেখানো ভণিতা করছে ও। ওকে বের করে দাও, গেইল।

না।

নকার, হোয়েল-যাও ওকে ভিতর থেকে বের করে নিয়ে এসো।

হঠাৎ কলিনের স্বর রুক্ষ হয়ে উঠল। খবরদার, মেডক। এখানে মাতব্বরি করতে যেয়ো না। তোমাদের সবাইকে সাবধান করে দিচ্ছি-কেউ আমার বাসায় ঢোকার চেষ্টা করলেই গুলি করব আমি।

এক মুহূর্ত নীরবে কাটল। জুলিয়াস ওখান থেকে ওদের দেখতে পাচ্ছে না বটে, কিন্তু ঘটনা পরিষ্কার আন্দাজ করতে পারছে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কলিন। কোন রকম উত্তেজনার প্রকাশ নেই ওর চেহারায়। উত্তেজিত হওয়া ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। শান্ত পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল কলিন। এটা জানা কথা, মেডকের লোকজনের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না, কিন্তু কেউ তাকে গুলি করলে পার্কের সবাই ক্ষেপে উঠবে। এই সাহসেই সে রুখে দাঁড়িয়েছে। ভেবেছিল এতেই কাজ হবে, কিন্তু তা হলো না।

তাহলৈ আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ তুমি? রাগত স্বরে প্রশ্ন করল মেডক।

নিশ্চয়ই না, জবাব দিল কলিন। তুমি আবার কবে থেকে আইনের প্রতিনিধি হলে?

যে কোন লোকেরই গ্রেপ্তার করার অধিকার আছে।

আমার এলাকায় নয়। এখানে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তোমরা অনধিকার প্রবেশ করেছ এখানে।

আবার সবাই চুপ হয়ে গেল। মেডকের কয়েকটা অসহ্য মুহূর্ত কাটল। রাগে নিল ভাবে দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, খোদার কসম, গেইল, তোমার, এই আচরণের কথা আমার মনে থাকবে।

একটু পরেই ঘোড়ায় চড়ে ওদের চলে যাবার শব্দ শুনল জুলিয়াস। জানালার ধার থেকে স্বামীর গরবে গর্বিতা একটা ভাব নিয়ে সরে এল হিলডা।

নিজের হাতের যত্ন নাও তুমি, আমি তোমার খাবার যোগাড় করছি।

কলিন দম্পতি সারাদিন বাসাতেই রইল। কি একটা কাজে কলিন কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেছিল। ফিরে এসে জানাল মেডকের দু’জন লোক এই বাড়ির আশপাশেই ঘুরঘুর করছে। ওদের লক্ষ্য করে গুলি করা উচিত ছিল আমার, রাগের সাথে বলল কলিন।

গুলি না করে ভালই করেছেন, মন্তব্য করল জুলিয়াস। এসবের মধ্যে আপনার জড়ানো ঠিক হবে না।

দুপুরের দিকে জিনা ঘোড়ায় চেপে বাইরে কোথাও গেল। দু’ঘণ্টা সে যে কোথায় ছিল জুলিয়াস তা জানে না। হয়তো ফিরে এসে সে তার বাপ-মাকে। বলেছে-কিন্তু জুলিয়াস তখন গভীর ঘুমে অচেতন। জিনার সাথে কথা বলার সুযোগই পাচ্ছে না জুলিয়াস। ইচ্ছা করেই যেন ওকে এড়িয়ে চলছে সে।

রাতে খাবার সময়ে বিছানা ছেড়ে উঠল জুলিয়াস। এতক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার। পর বেশ চাঙ্গা বোধ করছে সে। পাঁজরের ব্যথার জন্যে একটু খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে তাকে, শরীরটাও একটু আড়ষ্ট। মুখটা এখনও ফুলে রয়েছে, তবু নিজেকে আর আগের মত দুর্বল ঠেকছে না। একটু অসুবিধা হলেও হাত দুটো এখন কিছুটা ব্যবহার করতে পারছে সে।

খেতে বসে প্রকাশ পেল জিনা দুপুরে কোথায় গেছিল। বিকেলের দিকে জারভিসের সাথে দেখা হয়েছে আমার, বলল সে।

কেউ কথা বলল না। অস্বস্তি ভরে নিজের প্লেটের দিকে চেয়ে বসে রইল জুলিয়াস। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে এবারে অপ্রিয় কোন প্রসঙ্গ তুলবে জিনা।

জারভিসের কাছে গতরাতের ঘটনা শুনলাম। বাবার কামরায় যাবার পথে ধরা পড়েছিল জুলিয়াস। ওর এই অবস্থার জন্যে সে নিজেই দায়ী, বাবার সাথে দেখা করার জিদ ধরে মারপিট না করলে মার খেতে না ও।

না, আসল ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, প্রতিবাদ করল জুলিয়াস। পেপির সাথে দেখা করতে গেছিলাম আমি। ওর ঘর থেকে বেরিয়ে ফিরে আসার পথে আমাকে ধরে গোলাঘরে নিয়ে যায়, সেখানেই মাড়ির সাথে মারপিট করতে বাধ্য করেছিল ওরা।

তাহলে হয় জারভিস মিথ্যে কথা বলেছে, নয় তুমি।

হ্যাঁ, বোঝাই যাচ্ছে আমাদের দু’জনের একজন মিথ্যাবাদী। পেপির সাথে শহরে দেখা হলে ওর কাছেই জেনে নিয়ে আসল ঘটনা।

তাই করব।

একটু সামনে ঝুঁকে কলিন জিজ্ঞেস করল, আমার খামারে ওদের দুজন লোক কি করছে তা কিছু বলেছে জারভিস?

হ্যাঁ, সে বলল ওদের একজন হচ্ছে নকার, জুলিয়াসের সাথে তার পুরোনো বিবাদ আছে। ঝামেলা এড়াবার জন্য মেডক তাকে বরখাস্ত করেছে। এখন সে কি করছে না করছে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার।

আর অন্যজন?

সেটা জারভিসও জানে না।

বিষণ্ন মুখে মাথা নাড়ল কলিন। দুঃখ হয় ভাবতে যে বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে না আমরা একই পরিবারের মানুষ। বিপর্যয়ের মাঝে পরিবারের সদস্যরা একজোট হয়ে একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে-কিন্তু এই বাড়িতে তা হবার নয়। হিলডা আর আমি একজন বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু জিনার সমর্থন আমরা পাইনি।

জিনার মুখটা লাল হয়ে উঠল। আমার অনুভূতিকে কি করে অস্বীকার করব আমি? প্রশ্ন করল সে।

চেষ্টাই করোনি তুমি!

করেছি। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে আমি যা জানি তা তোমরা জানো না। জারভিস আমাকে বলেছে বিপজ্জনক জেনেও জুলিয়াস ইচ্ছে করেই উস্কে জনকে উত্তেজিত করে ওই ঘোড়ায় চড়তে বাধ্য করেছিল।

কথাটা ঠিক নয়, জিনা। সবাই জানে ঘোড়া বশ করায় জন আমার চেয়েও বেশি দক্ষ ছিল। আমি দু’বার চেষ্টা করেও পারলাম না দেখে সে নিজেই এগিয়ে এসেছি। বন্য ঘোড়া বশ করার আছে একটা নেশা, উত্তেজনা, আনন্দ আর সব শেষে আছে তৃপ্তি। একটা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে জয়ী হবার আনন্দ পেতে চেয়েছিল জন। কিন্তু তাতে যে, এমন মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা আমরা কেউই আশা করিনি।

ঘটনা, অন্য রকম ঘটেছিল বলে শুনেছি আমি। জন চায়নি, তুমিই ওকে উস্কে দিয়ে ওই ঘোড়ায় চড়তে রাজি করিয়েছিলে।

হতাশ ভাবে মাথা নাড়ল জুলিয়াস। ওকে চেনো না তুমি? ধরতে গেলে ঘোড়া চরিয়েই বড় হয়েছে জন। ঘোড়া বশে আনতে পার্কের সেরা লোকদের একজন ছিল সে।

আমি জানি আমার ছেলে দুর্ঘটনার শিকার হয়েই মারা গেছে, বলে উঠল কলিন। বুনো ঘোড়া বশ করে সে যে কত আনন্দ পেত তা অজানা নয় আমার। ঠ্যাটা ঘোড়াটাই ওর জিদ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

ঘাড় কাত করে বাঁকা চোখে বাবার দিকে চাইল জিনা। জারভিস বলেছে-আচ্ছা ঘাড় বিকৃত করায় ওর কি স্বার্থ?

নিজের ভাই সম্বন্ধে এমন কথা কি ধরনের মানুষ মুখে আনতে পারে বোঝো না? শাসনের সুরে প্রশ্ন করল কলিন।

এ কথার কোন জবাব দিতে পারল না জিনা হঠাৎ একেবারে চুপসে গিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপতে লাগল মেয়েটা। অস্বস্তিকর নীরবতা ভঙ্গ করার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে ন জুলিয়াস। হাত বাড়িয়ে জিনাকে ছুঁয়ে সান্ত্বনা দিতে বড় ইচ্ছে করছে, কিন্তু আবার ভয় হচ্ছে হয়তো ঘৃণায় কুঁকড়ে সারে যাবে ও। হিলড়ার দিকে চাইল জুলিয়াস।

গরম পানিতে আবার হাত ভিজানোর সময় হয়েছে, বলে উঠে দাঁড়াল হিলডা। জিনা, তুমি গামলাটা বার করো, আমি টেবিল পরিষ্কার করছি।

রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। বাইরের লোক দুটো এখনও আছে। রাতের বেলা আস্তাবলের কাছেই একটা আস্তানা করে কাটিয়েছে ওরা। সম্ভবত ঘোড়ার ওপর নজর রাখার জন্যেই। সকাল হতেই আবার সরে গেছে। দূর থেকেই নজর রেখেছে এই বাড়ির ওপর। সারাটা দিন বাড়ির আশপাশেই কাজ করে কাটাল কলিন। জিনাও সাথে থেকে সাহায্য করল তাকে। গত রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে, আর আজ সকালেও জুলিয়াসকে কথা বলার কোন সুযোগ দেয়নি মেয়েটা।

দুপুরে নডি এল। কলিনের অনুরোধে ওদের সাথে খাওয়া দাওয়া করল সে। মেডকের লোক ‘দু’জন ওকে আসতে দেখেছে, বাধা দেয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, জুলিয়াসের জন্যেই অপেক্ষা করছে ওরা।

খেতে বসে ঠাট্টা করে নডি বলল, আমি দেখতে এসেছি কেউ যেন আমার কাজের মানুষটাকে ভাগিয়ে না নেয়। জুলিয়াসের সাথে মারামারির খবরটা ক্রেস্টলাইনের সবাইকে শোনানো হয়েছে।

কি রকম রং চড়ানো হয়েছে শুনি?

শোনা যাচ্ছে মাডিকে নাকি সেবাস্টিন দত্তের দেখাশোনা করার ভার দেয়া হয়েছিল। তুমি ওঁর সাথে দেখা করার জন্যে জিদ ধরায় তোমাকে মেরে পিস্তল কেড়ে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঘোড়াটা হাটতে হাটতে এখানে এসে হাজির হয়।

শেরিফ তো ঘটনা শুনে তোমাকে হাজতে ভরার জন্যে তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু মেডকই ওকে ঠেকাল। বলল তোমার নাকি যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।

খাওয়ার টেবিলে বসেই জুলিয়াসের কাছ থেকে রকিং এইচের আর কলিনের কাছ থেকে তার পরের সব ঘটনার বিবরণ শুনল নডি। দু’জন লোক এখনও এই খামার বাড়ির বাইরে পাহারায় আছে সেকথাও জানাল কলিন। এখন অবশ্য চিন্তা নেই, কিন্তু জুলিয়াস এখান থেকে যাবার পথে কি ঘটবে বলা মুশকিল।

কিছু একটা উপায় বের করে ফেলব, বলল নডি।

এর মধ্যে জড়াবার কোন দরকার নেই তোমার আপত্তি জানাল জুলিয়াস। মারিয়া আর ছেলেমেয়েদের কাছেই তোমার এখন থাকা উচিত।

ফেরার তাড়া নেই আমার। জিনার দিকে ইচ্ছে করেই চাইছে না জুলিয়াস। গতকাল সে জারভিসের সাথে দেখা করতে গেছিল, হয়তো আজও যাবে। মন চাইলেও ওকে বিশ্বাস করতে পারছে না জুলিয়াস।

তোমার হাত দুটো এক সপ্তাহের আগে ঠিক হবে বলে মনে হয় না। মন্তব্য করল নডি।

বেশিও লাগতে পারে বলে উঠল কলিন। কিন্তু কোন অসুবিধা নেই, জুলিয়াস যতদিন খুশি থাকতে পারে এখানে।

কৃতজ্ঞতা ভরে মাথা আঁকাল জুলিয়াস। এক সপ্তাহের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি।

বিশেষ করে জিনাকে শোনানোর জন্যেই কথাটা বলল সে। কিন্তু খাওয়া শেষ হতেই নডির সাথে গোপনে কিছুক্ষণ আলাপ করল জুলিয়াস। এক সপ্তাহ কিছুতেই বসে, থাকবে না, আজ রাতেই সে বেরিয়ে পড়বে। কতদিন আর কলিন বাড়ি বসে থাকবে ওর জন্যে? খামারের লোকদের বাড়ি বসে থাকলে কাজ চলে না, এটা বোঝে জুলিয়াস।

বিকেলের দিকে নডি বিদায় নিল। অল্প পরেই জিনাও বেরুল। সে যে কোথায় যাচ্ছে তা আন্দাজ করে নিল জুলিয়াস। মনটা ওর বিষাদে ছেয়ে গেল। কেন এমন হয়? নিষ্ফল আক্রোশে ওর দেয়ালে ঘুসি মারতে ইচ্ছে করছে। জিনার কথা আর ভাববে না জুলিয়াস।

রাতে খেতে বসার আগেই এক ফাঁকে কলিনকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে রাখল জুলিয়াস। বাকি দুজন এ ব্যাপারে কিছুই জানল না। জিনা ফিরেছে, কিন্তু আজ কোথায় গেছিল এ সম্বন্ধে সে আর কাউকে কিছু বলল না। খাওয়া সেরে বেশ জলদিই ঘুমাতে গেল সবাই।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাড়িটা নিঝুম হয়ে গেল। অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে প্রহর গুনছে জুলিয়াস। নডির সাথে যুক্তি করে একটা সহজ পন্থা বেছে নিয়েছে সে। শহরে গিয়ে অন্ধকার হবার সাথে সাথে একটা বাড়তি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসবে নড়ি। ঘোড়া নিয়ে কলিনের খামার থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে নদীর ধারে অপেক্ষা করবে। দূরত্ব নিয়ে ভাবছে না জুলিয়াস, তার আসল কঠিন কাজটা হবে পাহারায় যে দু’জন আছে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানো। তবে জুলিয়াস আশা করছে কাজটা তার পক্ষে খুব শক্ত হবে না, কারণ ওরা কলিনের আস্তাবলের ওপরই চোখ রাখবে। জুলিয়াস যে পায়ে হেঁটে পালাতে পারে এটা ওদের মাথায় চট করে খেলবে না।

কলিন একটা পিস্তল দিয়েছে-অন্ধকারে বসেই সেটা একবার পরীক্ষা করে দেখে নিল জুলিয়াস হাতের বর্তমান অবস্থায় সে পিস্তলটা ঠিকমত ব্যবহার করতে পারবে কিনা সন্দেহ, তবু ওটা সাথে থাকলে সাহস অনেকটা বাড়ে। নিঃশব্দে উঠে দরজার কাছে গেল জুলিয়াস। খোলার সময়ে সামান্য শব্দ হলো দরজায়। একটু অপেক্ষা করে আবার এগিয়ে গেল সে। কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা খসখস শব্দ শুনে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে দাড়িয়ে পড়ল। কে যেন অন্ধকার থেকে ফিসফিস করে ডাকল, ‘জুলিয়াস?’

জিনার গলা চিনতে পেরে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, কি?

ওর দিকে এগিয়ে এল জিনা। অন্ধকারে আবছা ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে ওকে। তুমি চলে যাচ্ছ? কোথায়? বাইরে ওই দুজন রয়েছে না? একসাথে একগাদা প্রশ্ন করে বসল সে।

ওরা আস্তাবলের দিকে নজর রেখেছে, জবাব দিল জুলিয়াস। আমি হেঁটেই যাচ্ছি, নডি ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।

মুখ দেখা না গেলেও বিরক্তিতে বিকৃত ওর চেহারাটা আঁচ করতে পারছে জুলিয়াস।

আমাকে বলতে পারতে তুমি? বুঝেছি, রিশ্বাস কোরো না। তোমার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম-পাইনি। যাক, এখন কোথায় যাচ্ছ? নাকি তাও বলা যাবে না?

নিজেই জানি না কোথায় যাব!

পার্কেই থাকছ?

হ্যাঁ।

কি দরকার?

দরকার আছে, জিনা।

হঠাৎ রাগ প্রকাশ পেল ওর গলায়। এখানে থেকে ওদের সাথে বোঝাপড়া করতে চাও। তোমার অংশ আদায়ের চেষ্টা করবে তুমি! জারভিস ঠিকই বলেছিল।

না, জিনা। আমাকে ভুল বুঝছ তুমি।

এছাড়া এখানে থাকার আর কি কারণ থাকতে পারে? নাহ্, অনেক বদলে গেছ তুমি।

তুমিও আর সেই আগের মত নেই।

নীরবে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। জুলিয়াসের মনে হচ্ছে যেন এই মাত্র ওদের শেষ কথা বলা হয়ে গেল। কিছুই বাকি রইল না। মুখের ভিতরটা বিস্বাদ ঠেকছে। পেপি বলেছিল ছেলেবেলাটাই ভাল ছিল। কথাটা এখন সমর্থন করতে ইচ্ছে করছে ওর। এখন বুঝতে পারছে পেপি ঠিক কি রোঝাতে চেয়েছিল।

নড়ে উঠে দরজার দিকে ফিরল জুলিয়াস। এবার যাবার সময় হলো, জিনা।

বেশ, যাও।

আবেগহীন একটা উক্তি। সামান্য মমতার আভাস থাকলেও মনে মনে আশা করতে পারত জুলিয়াস। ওর শেষ কথা যেন জানিয়ে দিল জিনা।

বাইরে বেরিয়ে এল জুলিয়াস।

<

Super User