বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নকার আর তার সঙ্গীর অজান্তেই নদীর ধারে নডির সাথে মিলিত হলো জুলিয়াস। শহরে পৌঁছে নডিকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে লোলার খোঁজে রেস্টুরেন্টে ঢুকল সে।
রাত হয়েছে। রেস্টুরেন্টের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার জন্যে তৈরি হচ্ছিল লেলা এত রাতে জুলিয়াসকে দেখে অবাক হয়ে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল সে। ভিতরে বসে পেপির সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে ক্রেস্টলাইনে পৌঁছা’ অবধি আদ্যপান্ত সব কথাই জুলিয়াসের মুখে শুনল। বিবরণ শেষ করে সে বলল, আরও বলতে গেলে তুমিই আমার ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি জেনে ফেলবে!
আমি তো তা-ই চাই, হেসে জবাব দিল লোলা। এবারে পেপির কথা কিছু শোনাও।
তাই করল জুলিয়াস। দুজনে মিলে পেপিকে নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা করল। জুলিয়াসের ধারণা সব কিছুর মূল চাবিকাঠিই পেপির হাতে। লোলারও একই মত, কিন্তু এখন যে কি করা দরকার তার কোন ভাল বুদ্ধি সে যোগাতে পারল না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পেপির কতদিন লাগবে?
জানি না। তবে ওরা তাড়াহুড়ো করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। বিয়েটা হয়ে গেলেই মেডকের সবচেয়ে বড় বাধাটা সরে যাবে। তখন বাবার মরার অপেক্ষায়। থাকবে ওরা এরপরে আসবে জারভিসের পালা।
আমার মনে হয় তুমি বাবার সাথে দেখা করতে পারলে ভাল হত।
সুযোগ পাইনি-তবে হয়তো এটাই ভাল হয়েছে। পেপি বলছিল বাবার শরীর খুব দুর্বল। তবে সে এটাও বলেছে যে বাবা আশা ছাড়েননি। একদিন তিনি আবার ভাল হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠবেন বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস।
ডাক্তার কি বলে? তার কি ভাল হবার কোন আশা নেই?
সম্ভাবনা কম। তবে বাবা একটু ওইরকমই-চিরদিনই উনি একটু একগুয়ে। মৃত্যুর ব্যাপারেও তিনি শেষ পর্যন্ত যুঝবেন, সন্দেহ নেই।
হাসল লোলা। ওঁর মত মানুষেরা এইরকমই। একদিন না একদিন মৃত্যু হবেই, কিন্তু মরেও তারা অন্যের মনের সাহস হয়ে বেঁচে থাকেন তবু এসবের মাঝে তোমার স্থান কোথায়, জুলিয়াস? তুমি কিসের জন্যে লড়ছ?
জুলিয়াস তার মনের অনুভূতি কথায় প্রকাশ করার চেষ্টা করল সম্পত্তির অংশের লোভে লড়ছি না আমি। বাবা যদি আমাকে বঞ্চিত করতে চান প্রতিবাদ আমি করব না। কিন্তু তাই বলে অতীতকেও ভুলতে পারব না। বাবা, পেপি, জারভিস ওদের সবাইকে নিয়েই আমাদের পরিবার, ওরাই আমার আপনজন। ওদের বিপদ মানেই আমার বিপদ। মেডক লোকটা সবকিছু গ্রাস করার মতলবে আছে-কিন্তু এত সহজে আমি তা হতে দেব না।
কিন্ত পেপি যদি এডকে বিয়ে করে?
ওর মাথা ঠাণ্ডা থাকলে তা করবে না।
এত নিশ্চিত হয়ো না, জুলিয়াস, প্রেম বড় সাংঘাতিক। কেউ নিজের ইচ্ছা মত চালাতে পারে না মন। অনেক সময়েই যুক্তি বা বুদ্ধি মেনে চলে না প্রেম। এর জন্যে অনেক দুঃখ-কষ্টই হাসি মুখে সহ্য করে মানুষ। না, হেসো না তুমি। আমি জানি বলেই বলছি।
গুরুগম্ভীর আলোচনা অনেকক্ষণ চলেছে। এবারে হাসতে হাসতেই আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে জুলিয়াস বলল, দেখো, মোটেও হাসছি, না আমি।
হেসে ফেলল লোলাও। ঠিক আছে, মুখ যখন আছে যতখুশি হাসো। কিন্তু আজ রাতে কোথায় থাকবে ঠিক করেছ কিছু?
না।
কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে চাও?
পারলে সেটাই সবচেয়ে ভাল হত। পেপি কয়েকদিন একটু ভেবে দেখার সুযোগ পেত। ওর সাথে আবার দেখা করব। সপ্তাহখানেক লুকিয়ে থাকতে পারলে আমার হাত দুটোও সেরে যেত।
আমাদের ওখানে থাকলে কেমন হয়? বাবা মারা যাওয়ার আগে আমরা যে খামারে ছিলাম ওটা তো খালিই পড়ে আছে। যে লোকটা ওটা ভাড়া নিয়েছিল, চালাতে পারেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে।
জায়গাটা রকিং এইচ থেকে অনেক দূরে পাহাড়ের মধ্যে। এক সপ্তাহের মধ্যে জুলিয়াসকে ওখানে খুঁজতে যাবে না কেউ। জুলিয়াসের জন্যে সবদিক দিয়েই জায়গাটা চমৎকার।
খাওয়ার কি ব্যবস্থা হবে?
আগামীকাল রাতে আমি খাবার পৌঁছে দিতে পারি।
আমার জন্যে রাধাৰাড়া করবে কে? দুষ্টুমির হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস। আমার দেখাশোনা?
লোলার চোখ-মুখ, হেসে উঠল। ভেবেছ পারব না? তবে সে-সময় এখনও আসেনি। হেভি ইঞ্জিন আমি, একবার চালু হলে সহজে থামতে পারি না।
চিন্তার বিষয়।
অবশ্যই! সে যাক, আমাদের খামার বাড়িতে থাকতে চাইলে এখনই রওনা হয়ে যাও। তোমার সাথে নেয়ার জন্যে কিছু খাবার বেঁধে দিচ্ছি।
এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে জুলিয়াসের হাতে একটা পোঁটলা ধরিয়ে দিল লোলা। কাল রাতে তোমার জন্যে এক সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসব।
ঠিক আছে-কাল আবার দেখা হবে। বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল জুলিয়াস।
পার্কের একেবারে পুব সীমানায় লোলাদের র্যাঞ্চ। ঘরগুলো এখনও ভালই আছে। কিছু আসবাবপত্রও রয়েছে ভিতরে। বিছানাগুলো বেশ নরম। ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে ঘরে এসে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ল জুলিয়াস। পরদিন বিকেল পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটল ওর। ঘোড়ার যত্ন সেরে ঘরদোর হাঁড়ি পাতিল ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলল সে। এত কাজ করে খিদে পেয়ে গেছে তার, কিন্তু উপায় নেই, খাবার যা সাথে দিয়েছিল লোলা তা এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এখন লোলার পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে।
একা একা চিন্তা করার প্রচুর অবকাশ আর সুযোগ আজ পেয়েছে জুলিয়াস। বিভিন্ন ধরনের চিন্তা আসছে ওর মাথায়। কিন্তু কেন যেন ঘুরেফিরে বারবার লোলার কথাই মনে আসছে। ওর সঙ্গ পাবার জন্যে জুলিয়াসের মনটা উদ্গ্রীব হয়ে আছে। সে কি নিজের অজান্তেই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছে? অবশ্য ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক সবসময়ই ছিল। যখনই শহরে গেছে, লোলার সাথে অবশ্যই দেখা করেছে। এতদিন লোলাকে নিছক বন্ধু বলেই ভাবত সে। কিন্তু এখন নিঃসন্দেহে বুঝেছে মেয়েটা ভালবাসে তাকে।
সন্ধ্যার দিকে দূর থেকে লোলাকে আসতে দেখে বাইরে এসে দাঁড়াল জুলিয়াস। ঘোড়া থেকে নামতে নামতে হাসি মুখে জুলিয়াসের দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কি, খিদে পেয়েছে?
মনে হচ্ছে একটা আস্ত খাসি খেয়ে ফেলতে পারব আমি!
ঠিক আছে, আমি ভিতরে গিয়ে তোমার খাবার তৈরি করছি, তুমি আমার ঘোড়া সামলাও। জিন নামিয়ো না, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আমি।
কেন, এত তাড়া কিসের?
পারলে সারারাতই তোমার সাথে কাটাতাম কিন্তু এখন তোমার খুব সাবধান থাকা উচিত। হয়তো সে সুযোগ একদিন আসবে-নাও, ঘোড়াটা ধরো।
জুলিয়াস এগিয়ে গেল ওর দিকে। লোলা…
হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল লোলা। না, জুলিয়াস। আগে খাওয়া তারপরে অন্য চিন্তা।
থলে ভরে বাজার করে এনেছে লোলা। সেগুলো ঘরে পৌঁছে দিয়ে ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে গেল জুলিয়াস। ফিরে এসে দেখল খাবার তৈরি করতে লেগে গেছে মেয়েটা।
তোমার কোন সাহায্যের দরকার আছে? দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
না, এখন আর কিছু করতে হবে না। তুমি বরং ততক্ষণে শেভ সেরে নাও। ক্ষুরটা দেখো টেবিলের ওপরই রেখেছি।
টেবিলের ওপর ওটা দেখতে পেল জুলিয়াস। কোন কোন মেয়ে কিন্তু ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ পছন্দ করে।
আমি অন্য দলে।
ঠিক আছে, তাহলে শেভটা করতেই হয়
প্রদীপের আলোয় বসে ওরা রাতের খাবার খেলো। রান্নাটা বড় সুস্বাদু হয়েছে। টুকিটাকি হালকা কথাবার্তার মাঝেই খাওয়া শেষ হলো। বাতি নিভিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। সুন্দর ঝিরঝির হাওয়া বইছে।
এসো, বাইরে কিছুক্ষণ বসা যাক, বলল জুলিয়াস।
বেশিক্ষণ দেরি করতে পারব না আমি। মাকে একা ফেলে এসেছি, তাছাড়া কাল সকালেই আছে রেস্টুরেন্টের কাজ। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।
এখনই যেয়ো না, কিছুক্ষণ থাকো।
তা হয় না, জুলিয়াস। সহজ সরল মানুষ আমি-যা ভাবি তাই বলি। তুমি বলেছিলে আমার মনের মানুষকে পেতে হলে আমাকে চেষ্টা করতে হবে-চেষ্টা আমি করেছি। এখন থাকলে নিজেকে সামলাতে পারব না বলেই থাকার সাহস পাচ্ছি না। তবে যাওয়ার আগে একটু স্মৃতি রেখে যাচ্ছি। জুলিয়াসের আলিঙ্গনে ধরা দিল লোলা। সেদিন রেস্টুরেন্টে চমকে উঠেছিল সে, কিন্তু আজ সে মনে মনে প্রস্তুত। ওর নরম ভিজে ঠোঁট জোড়ায় চুমু খেলো জুলিয়াস। ওকে যেতে দিতে আর মন সরছে না।
লোলা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই ফিসফিস করে জুলিয়াস বলে উঠল, প্লীজ, থাকো।
যেতেই হবে, জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিল লোলা।
আস্তাবল থেকে ঘোড়া বের করে আনল জুলিয়াস। নীরবেই ঘোড়ায় উঠে বসল লোলা।
তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে মন চাইছে, কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। আবার আসবে তো তুমি?
না, জুলিয়াস।
কেন?
তুমিও আমাকে চাও কিনা সেটা তোমার নিজের ভাল করে বুঝে দেখার জন্যে কিছু সময় দরকার।
জুলিয়াস হাত বাড়াল, লোলা… কিন্তু আর অপেক্ষা করল না লোলা, ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হলো। মিনিটখানেক পরে ঘোড়ার খুরের শব্দও মিলিয়ে গেল।
<