শনিবারে একটু সকাল সকালই ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে তুলে শহরে যাবার জন্যে তৈরি করতে ব্যস্ত হলো মারিয়া। তার ভিতরকার দুশ্চিন্তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু রওনা হবার পরে বারবার অকারণেই নডির হাতে হাত রাখছে সে। ফিলিক্সের থেকে ধার করা ঘোড়াটার পিঠে চেপে গাড়িটার অল্প পিছনে থেকে ওদের অনুসরণ করছে জুলিয়াস। মারিয়া প্রতিবার নডির হাত ছোয়ার সাথে সাথেই সে হাসি মুখে মারিয়ার দিকে চেয়ে তাকে স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করছে, খেয়াল করল জুলিয়াস। ছেলে দুটো পিছনের সীটে বসেছে, ছোট মেয়েটা মারিয়ার কোলে। ঘণ্টাখানেক পরে বাচ্চাকে কোলে নিল নডি, মারিয়া লাগাম ধরল।
মাঝপথে একবার একটা গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ থেমে ছেলে দুটোকে চলে ফিরে হাত-পাগুলো একটু সোজা করে নেয়ার সুযোগ দিয়ে আবার যাত্রা শুরু করল তারা।
এগারোটা নাগাদ ওরা ক্রেস্টলাইনে পৌঁছল। আরও কয়েকটা ওয়্যাগন দেখা যাচ্ছে ব্যাঙ্কের, পাশে ফাঁকা জায়গায়। গাড়ি থেকে ঘোড়াগুলো খুলতে সাহায্য করল জুলিয়াস। ছেলে দুটো আগেই নেমে দাঁড়িয়েছে। নড়ি ঘোড়াগুলো নিয়ে কাঠের রেইলের সাথে বেঁধে রাখল। বৈশ কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে আশপাশে। ওদের কয়েকজনের সাথে কথাও বলল জুলিয়াস–কিন্তু ওদের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি জুলিয়াসের নজর এড়াল না অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। এতদিনে তাকে ত্যাজ্য করার খবরটা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে পড়েছে।
সেলুনের সামনে রকিং এইচের বেশ কয়েকটা ঘোড়া বাঁধা রয়েছে। দিন শেষ হওয়ার আগেই কিছু একটা গোলমাল ওরা বাধাবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা যে কোনদিক থেকে আসবে কিছুই আঁচ করতে পারছে না জুলিয়াস।
খাবার জিনিস কি কি লাগবে সব অর্ডার দিতে হবে আমার, বলল নডি। চলো, একসাথেই যাই, অর্ডার দিয়ে একবারেই ওই পথে ফিলিক্সের ঘোড়া ফেরত দিয়ে তোমার ঘোড়াটা নিয়ে আসব। কি বলো?
কাঁধ ঝাঁকাল জুলিয়াস। জনিও জুটে গেল ওদের সাথে। বলল, চলো, একসাথেই যাই-আমিও ওদিকেই যাচ্ছি।
এভাবে যেচে ওদের সাথে যেতে চাওয়া দেখে জুলিয়াসের সন্দেহ হলো হয়তো নডি ওকে কিছু জানিয়েছে। ওর দেহরক্ষীর সংখ্যা এখন দুই-এ দাঁড়াল।
ফিলিক্সের ঘোড়া ফেরত দিয়ে ফেরার পথে শেরিফের সাথে দেখা হলো অফিসের দরজায়। জুলিয়াসকে দেখেই সে বলে উঠল, ভিতরে শুনে যাও, জুলিয়াস, তোমার সাথে কথা আছে।
নডি একবার জনির দিকে চেয়ে বলল, ঠিক আছে, আমরা বাইরেই দাঁড়াই।
দু’জনে অফিস ঘরে ঢুকল। শেরিফই প্রথম কথা বলল। তাহলে চাকরি একটা জুটিয়ে নিয়েছ?
হ্যাঁ, চাকরি পেয়েছি।
টিকবে তো?
হয়তো। কিন্তু তোমার ডেনভার থেকে টেলিগ্রামের জবাবের কি হলো?
মাথা নাড়ল শেরিফ। আমার প্রশ্নের জবাব হলো না ওটা। যাহোক, সে কথা না হয় আপাতত ছেড়েই দিলাম। টেলিগ্রামের জবাব পেয়েছি আমি, তোমার হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণার কথাও শুনেছি-তোমার টাকাটা বেচেই যাবে। কিন্তু তাই বলে মনে কোরো না তুমিও বেঁচে গেলে। ইন্ডিয়ান ব্লাফে নকারের সাথে কি হয়েছিল তোমার?
ওই নামের কাউকে চেনে না জুলিয়াস। ইন্ডিয়ান ব্লাফেও মনে রাখার মত কোন ঘটনা ঘটেনি। তাহলে ব্যাপারটা কি? কৌতূহলী হলো সে।
নকার কে? প্রশ্ন করল জুলিয়াস।
ন্যাকামি কোরো না। তুমি ফেরার একদিন পরেই এখানে এসেছে লোকটা, মেডকের ওখানে কাজ নিয়েছে সে।
ওকে চিনি না আমি।
ইন্ডিয়ান ব্লাফে ঝগড়া করে এসেছ আর এখন বেগতিক দেখে সব ভুলে যেতে চাইছ, না? কি নিয়ে ঝগড়া বেধেছিল?
ওকেই জিজ্ঞেস করো।
লাল হয়ে উঠল ডিগবি। উত্তেজিত গলায় সে বলল, কসম বলছি, এখানে কোন গোলমাল চাই না আমি। তোমার পিস্তল আমার কাছে জমা দাও।
ওর পিস্তল জমা নিয়েছ তুমি?
ওর সাথে দেখা হলেই নিয়ে নেব।
তাহলে তাই করো। ওর সাথে দেখা করে ওর পিস্তল জমা নিয়ে তারপর আমাকে খবর দিয়ো!
ভাল চাও তো যা বলছি তাই শোনো-পিস্তল জমা দাও।
না।
দুজন দুজনের দিকে চেয়ে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পার্কের নিয়ম হচ্ছে এখানকার লোকজন সবাই পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করে, শেরিফ তা কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে, তবে একমাত্র অ্যারেস্ট করলেই সে সেই ক্ষমতা খাটাতে পারে। ভাওতা দিয়ে কাজ সারতে চেয়েছিল ডিগবি, কিন্তু কাজ হলো না। আত্মসম্মান বাঁচিয়ে নিজের কথা ফিরিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সে বলল, ঠিক আছে, পিস্তল রাখতে চাও রাখো, তবে কোনরকম গোলাগুলি বা ঝামেলা হলেই তোমাকে জেলে ভরব আমি-মনে থাকে যেন।
বাইরে বেরিয়ে এল জুলিয়াস। ভিতরে কি কথা হলো শুনলে?
বেশির ভাগই কানে এসেছে, জবাব দিল নডি।
নকার লোকটা কে?
দু’একবার দেখেছি আমি ওকে, বলল জনি। মাঝারি গড়নের লোক, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। সৌখিন বাবু-কায়দার গেঞ্জিটেঞ্জি পরে। বন্দুকবাজ বলেই মনে হয়।
মেডক যখন কাজ দিয়েছে তখন বন্দুকবাজই হবে ও, মন্তব্য করল নডি।
রাস্তার এদিক ওদিক চেয়ে দেখল জুলিয়াস। মেডকের লোকজন কাউকে এখন দেখা না গেলেও আগামীতে কি ঘটতে যাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে সে। একটা তৈরি ঝগড়া তৈরি করে নিয়েছে ওরা–আর তা-ও ইন্ডিয়ান ব্লাফের ঘটনা বলে প্রচার করায় মেডক বা রকিং এইচের সাথে এটাকে কেউ জড়াবে না।
তাড়াহুড়ো করে গান ফাইটে না যাওয়াই ভাল, বলল নডি।
ঠিক বলেছ, সায় দিল জনি। কিন্তু একটা কিছু করা দরকার।
দেখা যাক ওরা কি করে।
শহরে টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে নিয়ে দুপুরে লাঞ্চ খেতে রেস্টুরেন্টে ঢুকল ওরা। জুলিয়াস বসল নডি আর, তার দুই ছেলের সাথে একই টেবিলে। জনি পাশের টেবিলে মারিয়ার সাথে বসল।
রেস্টুরেন্টে বেশ ভিড়। ব্যস্তভাবে ছুটাছুটি করে কাজ করছে লোলা। শঙ্কিত দেখাচ্ছে ওকে। জুলিয়াসের সামনে খাবার প্লেট নামিয়ে রাখতে রাখতে সে বলল, আজ সকালে মেডক কফি খেতে এসেছিল, ওর সাথে আরও দুজন। ছিল। ওরা বলছিল
দরজার দিকে চেয়ে লোলার কথা হঠাৎ করে থেমে গেল। ওদিকে চাইল জুলিয়াস। পাঁচজন লোক রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। ওদের মধ্যে তিনজনকে চেনে জুলিয়াস-মেডক, এড আর তার ভাই জারভিস। বাকি দু’জন অপরিচিত। একজনের পরনে ফ্যাশানের গেঞ্জি-সাদা সিল্কের ওপর কালো সুতোর কাজ করা। শহরের আরও দুই একজন গেঞ্জি পরেছে আজ, কিন্তু ওটার সাথে তুলনা কোনটারই হয় না।
একটা খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল ওরা। যাবার পথে মোক কয়েকজনের সাথে বিনীতিভাবে কথা বলল। জারভিসকে আড়ষ্ট আর বিচলিত দেখাচ্ছে। কিন্তু এডের চলাফেরা একেবারে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। চতুর্থ লোকটাকে খেয়ালই করেনি জুলিয়াস, কারণ তার দৃষ্টি পঞ্চম লোক নকারের ওপরই আবদ্ধ। হঠাৎ সে থেমে দাড়িয়ে জুলিয়াসের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ওর মুখটা বেশ লালচে দেখাচ্ছে-হয়তো ড্রিঙ্ক করেছে-কিন্তু তবু চোখ দুটো স্থির আর কঠিন। মেডকের ডাকে এগিয়ে গিয়ে টেবিলে বসল সে।
আর একজন লোক ঢুকল রেস্টুরেন্টে-শেরিফ। কিন্তু টেবিলে না বসে দরজার কাছেই একটা সুবিধা মত জায়গায় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
এক মিনিট আগেও ঘরটা কথাবার্তা আর হাসিতে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু এখন সে সব থেমে গিয়ে একটা বিশ্রী নীরবতা নেমে এসেছে। যারা উপস্থিত আছে তাদের কেউ কেউ এর কারণটা জানে, আর বাকি লোক আন্দাজ করে নিয়েছে। মারিয়ার দিকে চাইল জুলিয়াস। ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে-স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে আছে সে।
আমাদের খাবার আমরা শেষ করি, বলল মারিয়া।
নিশ্চয়ই, মাথা ঝাঁকাল নডি। সেজন্যেই তো রেস্টুরেন্টে আসা।
পরবর্তী আধ ঘণ্টা খুব অস্বস্তির মধ্যে দিয়ে কাটল। কয়েকটা টেবিল থেকে লোকজন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠে পড়ল।
মেডকদের টেবিলে মৃদু কথাবার্তা চলছে। জারভিস মেডকের সাথে আর এড চতুর্থজনের সাথে কথা বলছে-নকার নীরব বসে আছে। জুলিয়াসের দিকে পিঠ দিয়ে বসেছে সে, তবে মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে একবার করে তাকে দেখে। নিচেছ। দরজার পাশে তার জায়গা থেকে একটুও নড়েনি শেরিফ। সে যে কেন ওখানে দাঁড়িয়েছে তা জলের মতই পরিষ্কার-রেস্টুরেন্টের মধ্যে কোন গোলমাল হলে নির্দোষ মানুষজন চোট পেতে পারে, ডিগবি তা চায় না।
খাওয়া শেষ করে প্লেটটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল জুলিয়াস। বলল, নডি, আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তোমরা এসো।
না, থামো, বলে উঠল নডি, আমরা সবাই একসাথেই বেরুব, মারিয়া বাচ্চাদের নিয়ে এখানেই থাকুক।
আমারও খাওয়া শেষ, নডির বড় ছেলে বলল।
ভালই হয়েছে, তাহলে তুমিই তোমার মায়ের দেখাশোনা করতে পারবে।
পানির গ্লাস তুলতে গিয়ে মারিয়ার হাত থরথর করে কাঁপছে, তবু তার গলার স্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেল। তোমার কর্তব্য তুমি করো, নডি, আমরা ঠিকই আছি।
রকিং এইচের টেবিলটার দিকে চাইল জুলিয়াস। নকারও ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর দিকে ফিরে চেয়েছে। মনে হলো এখনই উঠে দাঁড়াবে সে। লোলা একটা ট্রেতে করে এঁটো থালা-বাসন নিয়ে ওদের টেবিলের পাশ দিয়েই ছুটতে ছুটতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ পা পিছলে গেল ওর। ট্রের ওপরকার সব থালা বাসন পড়ল নকারের কোলে। হয়তো প্লেটে গরম কোন কিছু ছিল। এক লাফে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে গেঞ্জি আর প্যান্ট ঝাড়তে লাগল সে। টেবিলের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। মেডক আর জারভিস হতবুদ্ধি হয়ে গেছে-হি হি করে হাসছে এড।
দেখে চলতে পারো না? চিৎকার করে বলল নকার। আমার জামা কাপড়ের কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছ?
তার সাধের গেঞ্জিটার কিম্ভুতকিমাকার চেহারা হয়েছে উচ্ছিষ্ট খাবার, কফি আর ঝোলে। প্যান্টের সামনের দিকটা একেবারে ভিজে গেছে।
আমি সত্যি খুব দুঃখিত, বলে উঠল লোলা।
কটমট করে ওর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ঘুসি ওঠাল নকার। চট করে ওর হাত ধরে ফেলে হাসতে হাসতেই এড বলল, মাথা ঠাণ্ডা করো, নকার, ও তো আর ইচ্ছে করে এটা করেনি! তাছাড়া কোন চোটও পাওনি তুমি।
রকিং এইচ টেবিল ঘিরে বিশৃঙ্খলা চলার মাঝেই জুলিয়াস বেরিয়ে পড়েছে রেস্টুরেন্ট থেকে। ওর সাথে নডি আর জনিও আছে। কেউ পিছু নেয়নি ওদের। নকার পিছু নিতে চাইলেও লোলার জন্যে পারেনি। ডিশ মোছার কাপড় দিয়ে তার কাপড় মুছে দেয়ার ছলে ওকে দেরি করিয়েছে সে।
রাস্তায় চলতে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে নডির। কি ঘটেছে সবটাই দেখেছি আমি। ইচ্ছে করেই মেয়েটা অপেক্ষা করছিল ওখানে-ঠিক সময় মতই এগিয়ে গিয়ে ট্রে-সদ্ধ সব ফেলেছে নকারের কোলে। ট্রেতে একটা পটে কিছুটা গরম কফিও ছিল!
সত্যি চমৎকার ভেল্কি দেখিয়েছে লোলা। গরম কফি পড়ে নকারের কোল নিশ্চয়ই এখনও জ্বলছে, হাসি মুখে বলল জনি। যেভাবে কফির দাগ লেগেছে তাতে ওই বাহারের গেঞ্জিটা আর পরা হবে না ওর।
হাসছে জুলিয়াসও। সত্যি, একটা মেয়ে বটে লোলা! কেমন সুন্দর নিজেই একটা বুদ্ধি বের করে কঠিন একটা পরিস্থিতি সামলে নিল। স্থায়ী সমাধান হয়নি বটে, তবু এখনকার মত রক্ষা হলো।
রাস্তার অন্য মাথায় রকিং এইচের লোকজনের সাথে শেরিফকেও রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে দেখা গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। ডিগবিকেই বেশি বলতে দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মেডকের সাথে সেলুনের দিকে এগোল ওরা। সেলুনের সামনে আর একদফা কথাবার্তা চলল। তারপর ঘোড়ায় চেপে নকারকে একাই রকিং এইচের দিকে ফিরে যেতে দেখা গেল।
মনে হয়, বাড়তি পরিষ্কার গেঞ্জি সাথে আনেনি ও, ফোড়ন কাটল নডি। এক বন্দুকবাজের কথা জানি আমি, একটা বিশেষ টুপি ছিল ওর। তোবড়ানো, ময়লা একটা পুরোনো টুপি। অন্য ভাল টুপিও ছিল তার, কিন্তু মারপিটের সম্ভাবনা থাকলেই সে পুরোনো টুপিটাই মাথায় দিত! একদিন অন্য টুপি পরা অবস্থায় গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়েছিল সে। মরার সময়ে তার মৃত্যুর জন্যে সে তার শত্রুকে দায়ী না করে দোষ দিয়েছিল নিজের ভাগ্যকে। তার ধারণা ছিল পুরোনো টুপিটা পরা থাকলে তাকে কেউ মারতে পারত না। হয়তো কারেরও গেঞ্জির ব্যাপারে ওই রকম কিছু কুসংস্কার আছে।
অন্তত এখনকার মত বিদায় হয়েছে লোকটা, বলল জনি।
সে-বিষয়ে সত্যিই কোন সন্দেহ নেই। নকার অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ডিগবি নোবল এগিয়ে এল ওদের কাছে।
চলে গেল নকার, বিরক্তি নিয়ে জুলিয়াসের দিকে চেয়ে বলল শেরিফ। তোমার জন্যেই যত ঝামেলা।
আমি তো বলেছি লোকটাকে চিনি না আমি, জবাব দিল জুলিয়াস। ঝামেলা হলেও সেটা আমার তরফ থেকে আসত না।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডিগবি বলল, এবারের জন্যে বেঁচে গেলে বটে, কিন্তু পরেরবার আমি মুখ ফিরিয়ে থাকব। আগামীবার ঠিকই মরবে তুমি।
কিংবা নকার।
দু’জনেই মরবে তোমরা-আমাকেও জ্বালাবে। আচ্ছা তোমার আর এখন পার্কে ঘুরঘুর করার কি দরকার বলো তো? বাবা যখন ত্যাজ্য করেছেন, বিদায় হও না কেন তুমি?
এই এলাকাটাই আমার পছন্দ।
নিরাশ ভাবে এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে প্রথমে জনি, পরে নডির দিকে চাইল ডিগবি। তার বিরক্তি ভরা ভেঙচি কাটা মুখের অন্তরালে রাজ্যের অনিশ্চয়তা।
জনি বলে উঠল, তোমার জায়গায় আমি থাকলে জুলিয়াসকে নিয়ে মাথা ঘামাতাম না মোটেও, বরং মেডকের লোকজন নিয়েই, দুশ্চিন্তা হত। জেরিকে হত্যার ব্যাপারটা তো কারোই অজানা নয়। এই ধরনের ঘটনা…
মেডককে সাবধান করে দিয়েছি, বাধা দিয়ে বলে উঠল ডিগবি। এরপর থেকে নিজের লোকজনকে সে সামলে রাখবে বলেছে।
কই, নকারকে ঠেকাবার তো কোন চেষ্টাই করেনি সে? প্রতিবাদ করল জনি।
কেন, তোমাদের সামনেই তো সে নকারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল, দেয়নি? বলেই দর্পের সাথে হেঁটে গিয়ে তার অফিসে ঢুকল ডিগবি। ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জনি বলল, ডিগবি সুবিচারই করতে চায়, তবে ওর ব্যক্তিগত মনোভাব বাধ সাধে-লোকটা বোধহয় তোমাকে অপছন্দ করে, তাই না, জুলিয়াস?
ঠিকই ধরেছ, জনি।
ওদিকে মেডকের সাথে তো ওর বেশ বন্ধই আছে বলে মনে হয়। বন্ধুর ত্রুটি চোখে পড়লেও মানুষ তা এড়িয়ে যেতে চায়।
মারিয়ার এটা ওটা টুকিটাকি শপিং সেরে রওনা হতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে শুনে জুলিয়াস বলল, ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের কাজ সেরে নাও, আমি ততক্ষণে লোলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।
এখন আর ওখানে বিপদের সম্ভাবনা নেই, বলল নডি। তারপর আবার বলল, জিনাও শহরে এসেছে আজ, জানো?
ওর সাথে আজ দেখা হয়নি জিনার। রেস্টুরেন্টে যাবার পথ চারদিকে নজর রাখল জুলিয়াস, কিন্তু জিনাকে কোথাও দেখল না। রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া চুকেছে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মিসেস আইডা বেইলি তলোলা, দু’জনেই কাপ প্লেট ধোয়ায় ব্যস্ত। জুলিয়াসকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে চেয়ে মিসেস বেইলি বলল, ওরা বলে গেল আমার মেয়ের নাকি কোন কাজের ছিরি নেই।
বিন্দুমাত্র নেই, হাসতে হাসতেই বলল জুলিয়াস।
হোঁচট খেয়েছিলাম, বলল লোলা, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল আমার। মুখে ওকথা বললেও ওর চেহারায় লজ্জার রেশমাত্র দেখা গেল না। চোখ দুটো চকচক করছে। মুখ গম্ভীর রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ও।–
লোলার মা তোয়ালেতে হাত মুছে ওকে বলল, তুমি এখানকার কাজগুলো শেষ করো, আমি ততক্ষণে সামনের ঘরটা পরিষ্কার করছি। দেখো, আগুনটা যেন নিভে না যায়।
আমাকেও কিছু একটা কাজ দাও, আমিও সাহায্য করি? প্রস্তাব দিল জুলিয়াস।
ওর হাতে একটা শুকনো তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে লোলা বলল, প্লেটগুলো মোছো তুমি। এখন থেকেই অভ্যাস করো, বিয়ের পরে তো কাজটা শিখতেই হবে।
কপট রাগে গজর গজর করতে করতে কাজ শুরু করে দিল জুলিয়াস। তার দূরবস্থাটা বেশ উপভোগ করছে লোলা। চুলোয় কিছু কাঠ চাপিয়ে আভেনের, ডালা খুলে পাইগুলো চেক করে দেখে, একটা পাত্রে রাখা জিনিস একটু নাড়াচাড়া করে আরও পিছন দিকে ঠেলে দিল সে।
তোমার কি সব সবসময়ই এরকম কাজ করতে হয়? জিজ্ঞেস করল জুলিয়াস।
হ্যাঁ, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এখানকার কাজ সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর বিকেলে লোকজন আসা আরম্ভ করবে কফির জন্যে, সেটা শেষ হতে না হতেই আবার রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে-মানে, মোটামুটি ব্যস্তই থাকতে হয় আমাদের।
প্রত্যেক দিন?
আমার বিয়ে পর্যন্ত। বিয়ের পরে মাকে আমার বদলে আর কাউকে রাখতে বলে দেব।
আমি হলে ঝটপট একটা বিয়ে করে ফেলতাম।
সত্যি? আমার তাই করা উচিত?
নিশ্চয়ই, কাউকে পেলেই ঝুলে পড়ো।
সে যে-ই হোক, মনে ধরলেই হলো?
মন চাইলে আর দোমনা কোরো না। ফাঁসিয়ে ফেলো।
চুলোর ধার থেকে ফিরে তাকাল লোলা। হয়তো আগুনের আঁচেই গাল দুটো ঈষৎ লাল হয়ে উঠেছে তার। তাই করব, বলল লোলা, তার মন জয় করার চেষ্টাই করব।
প্লেট মোছা শেষ হয়েছে। তোয়ালেটা ঝুলিয়ে রেখে জুলিয়াস বলল, তুমি আজ যা করেছ সেজন্যে যে কি ভাষায় ধন্যবাদ জানাব জানি না, জানলে…’
তুমি বেঁচে থাকো, ভাল থাকো, এইটুকুই চাই, বাধা দিয়ে বলে উঠল লোলা। আরও হামলা আসবে তোমার ওপর। তুমি কি নডির ওখানেই থাকবে বলে ঠিক করেছ?
আমি জানি মেডকের কিছু একটা প্ল্যান আছে। বাবা মারা গেলে রকিং এইচ খামার জারভিস আর পেপি পাবে। হয়তো জুয়া খেলে জারভিসের শেয়ারটা জিতে নিতে পারবে সে, কিন্তু পেপির ব্যাপারে কি করবে? পেপি যে সোজা মেয়ে নয় একথা সবাই জানে। তাহলে মেডকের মতলবটা কি?
পেপি বিয়ে করলে তখন কি হবে?
পেপি? মেডককে সে কোনদিনও বিয়ে করবে না।
তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আজকে নতুন যে লোকটাকে দেখলাম, তাকে যদি ওর পছন্দ হয়?
এডমন্ড ফিনলে!
আশ্চর্য কি? সুদর্শন যুবক, ওর চলাফেরার মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র আছে, আকর্ষণ আছে। তোমার বোনকে কতটা চেনো তুমি?
ছেলেদের দিকে চোখ তুলে তাকায়ও না সে।
অবিশ্বাস ভরা চোখে জুলিয়াসের দিকে চাইল লোলা। মেয়েদের সম্পর্কে কিছুই বোঝো না তুমি। হয়তো পেপি এতদিন ছেলেদের দিকে চায়নি কারণ চোখে পড়ার মত কাউকে এর আগে সে দেখেনি। এডমন্ড নিঃসন্দেহে সাধারণের অনেক ওপরে।
একটু চুপ করে রইল জুলিয়াস। এই লাইনে চিন্তা করে দেখেনি সে। অসম্ভব কি? মেডকের চিঠি পেয়ে এসেছে এড। বন্দুকবাজ যথেষ্ট আছে ওর। হয়তো মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় চরিত্র বলেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছে মেডক? হয়তো এটাই ওর কাজ?
তোমার কি মত, জুলিয়াস?
নতুন চিন্তার খোরাক জোগালে তুমি। কথাটা ভেবে দেখার মত।
যাক, তবু কিছুটা কাজে লাগলাম।
মন্তব্যটা জুলিয়াসের কানেই গেল না। সে এখনও পেপি আর এডমন্ডের কথাই ভাবছে। জারভিসের যদি কিছু হয়, আর পেপি এডকে বিয়ে করে, কে চালাবে রকিং এইচ? পেপির স্বামী এড-বা মেডক-কিংবা দু’জনেই যৌথভাবে চালাবে!
জুলিয়াস? ডাকল লোলা।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে চমকে মুখ তুলে চাইল সে। কিছু বলছ?
নকার শহর ছেড়ে চলে গেছে বলেই মনে কোরো না সব বিপদ কেটে গেছে।
আমি সতর্ক থাকব, হেসে বলল জুলিয়াস। তোমারও সৌভাগ্য কামনা করছি।
কিসের জন্যে?
যেন মনের মানুষের নাগাল পাও।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোলা জানাল, তার মন পাওয়া খুবই শক্ত।
চেষ্টা চালিয়ে যাও, পাবে।
এগিয়ে গিয়ে লোলার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দিল জুলিয়াস। তারপর ঝুঁকে ওর ঠোঁটে চুমু খেলো। শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু হিসেবেই চুমু খেয়েছিল জুলিয়াস, কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াল। দু’পাশ থেকে লোহার হাত দুটো শক্ত করে জুলিয়াসের গলা জড়িয়ে ধরল। লোলার ভেজা উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া লাগল জুলিয়াসের ঠোঁটে। নরম বুকের চাপে রোমাঞ্চিত হলো তার দেহ। জুলিয়াসের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল লোলা। থরথর করে কাঁপছে ওর দেহ। হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়েছে তারও। জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল জুলিয়াস। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে, চিন্তাশক্তি হারিয়ে গেছে, মুখ লাল হয়ে উঠেছে-গরম লাগছে ওর।
সে বলল, লোলা…লোলা আর বলার কিছু ভেবে পেল না জুলিয়াস।
মনে করার কিছু নেই, বলল লোলা। কিন্তু এখন যাও তুমি, মা হঠাৎ এসে পড়তে পারেন।
চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াল জুলিয়াস। পালিয়েই যাচ্ছে সে। মাথার ভিতর সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে তার।
জুলিয়াস? সে দরজার কাছে পৌঁছতেই ডাকল লোলা।
ফিরে তাকাল জুলিয়াস। লোলাকে সম্পূর্ণ শান্ত সংযত দেখাচ্ছে। একটু হাসির আভাসও যেন দেখা যাচ্ছে ওর মুখে।
ঘটনাটা একটু তলিয়ে ভেবে দেখো, বলল লোলা।
কোন জবাব দিল না জুলিয়াস। হঠাৎ এমন ঘটে যাবার জন্যে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে তার। ভাবার কি আছে এতে? এটা ভুলে যাওয়াই তার উচিত। হ্যাঁ, তাই সে করবে।
<